সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল : শান্তিপূর্ণ গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৫ শতাংশ

আগের সংবাদ

জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী : নির্বাচনের আগে দেশে ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে > উদ্ভট ধারণা প্রশ্রয় দেবেন না

পরের সংবাদ

কুয়াশা ভেঙে হলো কোরাস সাহিত্য উৎসব

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কুয়াশা ভেঙে হলো কোরাস সাহিত্য উৎসব
এমরান হাসান

মূলধারার সাহিত্য আয়োজনের সার্থকতা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সময় সাহিত্য সম্মেলন আয়োজিত হয়ে আসছে। এ ধরনের সাহিত্য সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য মূলত সমসাময়িক শিল্পসাহিত্য নিয়ে কথা বলা, একে অপরের সঙ্গে ভাব-বিনিময় এবং সমকালীন সাহিত্যের নানা দিগ¦দিক নিয়ে বিশদ আলোচনা। এই লক্ষ্যেই ২৩ এবং ২৪ ডিসেম্বর সাহিত্যের ছোট কাগজ কোরাসের আয়োজনে মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘কোরাস সাহিত্য উৎসব-২০২২’। সাহিত্যের এই ছোট কাগজটির স¤পাদক কবি মুজাহিদ আহমদ। দুই দিনব্যাপী এই আয়োজনে মিলিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং দিল্লি থেকে বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য কবিবৃন্দ।
সুন্দর সকালের শীতের আমেজ কুয়াশা ভেদ করে সূর্য তখন উঁকি দিচ্ছিল মৌলভীবাজারের আকাশে। শীতের সকালে প্রাতঃরাশ শেষ করে শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। আবৃত্তিশিল্পী তওফিকা মুজাহিদ এবং সাইবার জামান সাবাহ্-এর যৌথ সঞ্চালনায় সত্তর দশকের অন্যতম কবি আসাদ মান্নানের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে শুভ উদ্বোধন হলো দুদিনব্যাপী এই আয়োজনের। তখন দি ফ্লাওয়ার্র কেজি অ্যান্ড হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের মূর্ছনায় জড়িয়েছিল চারপাশের প্রকৃতি। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লাঠিনৃত্য উদ্বোধনী শোভাযাত্রাকে সৌকর্যমণ্ডিত করেছে। মেয়র মুক্তমঞ্চ থেকে শুরু হওয়া শোভাযাত্রার প্রথম অংশে নজরকাড়া এই লাঠিনৃত্যের পরিবেশনা সবাইকে অভিভূত করেছিল। বিশেষত যারা মৌলভীবাজার কিংবা সিলেট অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত বা কিয়ৎ পরিচিত তাদের কাছে লাঠিনৃত্য একটি বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল। আয়োজনের শুরুতে স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন কোরাস সম্পাদক কবি মুজাহিদ আহমদ। তিনি আমন্ত্রিত অতিথিদের শুভেচ্ছা জানিয়ে মূল অনুষ্ঠান শুরু করেন। শোভাযাত্রার পরপরই শুরু হয় অনুষ্ঠানের প্রথমদিনের প্রথমপর্ব। এ পর্বে অতিথি ছিলেন কবি আসাদ মান্নান, কবি মিনার মনসুর, সুদূর দিল্লি থেকে আগত কবি প্রাণজি বসাক, কবি শিহাব শাহরিয়ার, কবি আকমল হোসেন নিপু, কবি ও সম্পাদক, ইসলাম রফিক। তাদের মনোমুগ্ধকর আলোচনা অনুষ্ঠানের সূচনাকে নন্দিত করেছিল। বাংলা সাহিত্যের নানামুখী তৎপরতা এবং বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সাহিত্য অবস্থা নিয়ে তাদের এইপর্বের আলোচ্য বক্তব্য মুগ্ধ করেছিল সবাইকে। এরপর মধ্যাহ্নের বিরতি। এই বিরতিতে সবার সঙ্গে ভালোবাসাটা আরো বেশি গাঢ় হয়ে উঠেছিল। একসঙ্গে সবাই মিলে দুপুরের খাবার গ্রহণ করার পরে কিছুটা বিশ্রাম দিয়ে পরবর্তী পর্ব শুরু হয়। এ পর্বেও রয়েছিল আলোচনা। বিষয় ছিল লিটল ম্যাগাজিন : কুয়াশায় ভবিষ্যৎ। প্রথম দিনের যাবতীয় আয়োজনের মধ্যে এই পর্বটি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় এবং মনোগ্রাহী হয়ে উঠেছিল সবার কাছেই- কেননা যারা সামনে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত এবং তারা বিভিন্ন পর্যায়ের বহুমুখী আলোচনার সঙ্গে পরিচিত। এই পর্বের মঞ্চে অতিথি হিসেবে ছিলেন শাহানা আক্তার মহুয়া, খালেদ উদ-দীন, ইসলাম রফিক, পুলিন রায়, সুমন বণিক। এ পর্বের আলোচনায় উঠে এসেছিল সাহিত্যের ছোট কাগজগুলোর নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিষ্ঠাজনিত কথোপকথন। উঠে এসেছিল সমসাময়িক যুগের সঙ্গে গত শতাব্দীতে সম্পাদিত বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার তুলনা এবং সাহিত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ছোট কাগজের ভূমিকাসহ একটি ছোট কাগজ বাঁচিয়ে রাখতে কী কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে সেই বিষয়গুলো। দুদিনের কোরাস সাহিত্য উৎসবের প্রথম দিনে এই সেশনটি বেশ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। কবি ও ছোট কাগজ সম্পাদক ইসলাম রফিকের বক্তব্য, কবি ও ছোট কাগজ বুনন সম্পাদক খালেদ উদ-দীনের বক্তব্য এবং শেষ পর্যায়ে কবি শিহাব শাহরিয়ারের বক্তব্য বেশ যুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছিল। আলোচনা যখন সমাপ্তির দিকে তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়তে শুরু করেছে। সন্ধ্যার কিছুটা আগে শুরু হয় কবিদের কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ। এ পর্বে অংশ নিয়েছিলেন আমন্ত্রিত কবিদের পাশাপাশি মৌলভীবাজার এবং সিলেট অঞ্চলের কবিবৃন্দ। কবিতার অক্ষরে অক্ষরে পুরো সন্ধ্যা মনোমুগ্ধকর আয়োজনে জমজমাট হয়ে উঠেছিল সেদিন। মৌলভীবাজারে সেদিন সন্ধ্যা নেমে এসেছিল কবিদের শব্দ প্রার্থনায় ভর করে। ধীরে ধীরে কুয়াশা ঘন থেকে ঘনতর হতে শুরু করে আর বাড়তে থাকে কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ। কবিতা পাঠ পর্ব সমাপ্ত হলে শুরু হয় সপ্তস্বর সংগীত বিদ্যাপীঠ, মৌলভীবাজারের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছোট শিশুদের এই ব্যতিক্রমী পরিবেশনা ছিল মুগ্ধ করার মতো। সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিয়ে প্রাণের উচ্ছ¡াসে মুখরিত হয়ে উঠেছিল এই ক্ষণ। অদ্ভুত এক আবেশ ছড়িয়ে পড়েছিল গানের সুরের পাশাপাশি। নয়নাভিরাম এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল মৌলভীবাজার মেয়র মুক্তমঞ্চের চারপাশে। মঞ্চের পাশের বিশাল পুকুরটি অনুষ্ঠানের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণ। গান এবং আবৃত্তির পাশাপাশি চলছিল আড্ডা পরস্পরের ভাবনা শেয়ার করা এবং সমসাময়িক বাংলা কবিতা নিয়ে নানা ধরনের কথোপকথন। যেন শীতের আমেজ ভেদ করে বহুগুণে চিন্তার আগুন বাড়িয়ে দিচ্ছিল কোরাস সাহিত্য উৎসবের প্রথম দিনের আয়োজন। ইতোমধ্যেই রাতের খাবারের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। রাতের খাবার গ্রহণের পরপরই সবাই যার যার নির্ধারিত আবাসনস্থলে ফিরে যান এবং সেখানে রাতভর চলে তুমুল আড্ডা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। মৌলভীবাজারে কুয়াশা গাঢ় হয়ে আসে ধীরে ধীরে। নেমে আসতে থাকে মধ্যরাত। এভাবেই শেষ হয় প্রথম দিনের আয়োজন।
কোরাস সাহিত্য উৎসবের দ্বিতীয় দিনের আয়োজনের প্রথম সেশন ছিল কবিতাপাঠ পর্ব। এ পর্বে আমন্ত্রিত কবিদের মধ্য থেকে কবিতা পড়ার জন্য মঞ্চে উঠে আসেন শাহানা আক্তার মহুয়া, ইসলাম রফিক, এমরান হাসান, সালেমুন শাহিন, হেমন্ত হাসান। কবি মানিক বৈরাগীর সঞ্চালনায় এই পর্বে সভাপতিত্ব করেন কবি, কথাসাহিত্যিক ও জলধি সম্পাদক নাহিদা আশরাফী। দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয় সেশন ছিল কবিতার রূপান্তর বিষয়ক। কবি প্রাণজি বসাকের সভাপতিত্বে এই পর্বে আলোচনা করেন কবি শিহাব শাহরিয়ার, কবি ও জলধি সম্পাদক নাহিদা আশরাফী, কবি কামরুল বাহার আরিফ। এ পর্বের সঞ্চালনায় ছিলেন কবি শিবলী মোক্তাদির। দ্বিতীয় দিনের তৃতীয় সেশন শুরু হয় মধ্যাহ্ন বিরতির পর। এ পর্বের বিষয় ছিল নাগরী ভাষা ও লোকসাহিত্যে নানা সম্পদ। এই সেশনে আলোচনা করেন আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, শেখ লুৎফর, দীপংকর মোহান্ত ও চন্দনকৃষ্ণ পাল। এ পর্বের সঞ্চালনায় ছিলেন কবি নাহিদা আশরাফী। এই পর্বে বক্তারা নাগরী ভাষা ও লোকসাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে বিশদ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন। এরপরই অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ পর্ব কোরাস সম্মাননা প্রদান পর্ব। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য কোরাস পরিবার প্রতিবারের মতোই এ বছরও তিনজনকে সম্মাননা প্রদান করে। লোক গবেষণায় আহমদ সিরাজ, ছড়ায় বিশেষ অবদানের জন্য আবদুল হামিদ মাহবুব, সাহিত্যের ছোট কাগজ সম্পাদনায় বুনন সম্পাদক খালেদ উদ-দীন কোরাস সাহিত্য সম্মাননা ২০২২-এ ভূষিত হন। কবি আকমল হোসেন নিপুর সঞ্চালনায় এই মহার্ঘতম অংশের ভেতর দিয়ে কোরাস সাহিত্য উৎসব ২০২২ এর মূল আয়োজন সমাপ্ত হয়। আলোচনা অনুষ্ঠানের পরপর শুরু হয় শিশুদের বৃন্দআবৃত্তি পরিবেশনা অর্থাৎ দ্বিতীয় দিনের সর্বশেষ সেশন। আবৃত্তি পরিবেশন করে উচ্চারণ, আবৃত্তির পাঠশালার আবৃত্তিশিল্পীবৃন্দ। ব্যতিক্রমী এই আবৃত্তি পরিবেশনা ছিল বাস্তবিক অর্থেই সুন্দর। দ্বিতীয় দিনের শেষ পরিবেশনাও অর্থাৎ সন্ধ্যায় ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই পর্বে গান পরিবেশন করেন কবি জাকির জাফরান, সাবরিনা রহমান বাঁধন, বাউল রিপন উদাসী।

‘কোরাস সাহিত্য উৎসব-২০২২’ এর দুদিনের মনোমুগ্ধকর আয়োজন সত্যিই মনে রাখার মতো। নগর-নাগরিক জীবন থেকে কিছু মুহূর্তের বিরতি, সেই সঙ্গে সাহিত্য-শিল্প নিয়ে এক জমজমাট আড্ডার আয়োজন করেছিল সাহিত্যের ছোট কাগজ কোরাস পরিবার। নিঃসন্দেহে এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কোরাস সম্পাদক কবি মুজাহিদ আহমদ এবং সহ-সম্পাদক জয়নাল আবেদীন শিবুসহ পুরো কোরাস পরিবারের এই অসামান্য আয়োজন বর্তমান বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল। এই সার্থকতাটুকু চিরজীবী হোক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়