ঢাবিতে পর্দা নামল নন-ফিকশন বইমেলার

আগের সংবাদ

কালো মানিকের জন্য শোকার্ত বিশ্ব

পরের সংবাদ

নতুন বছরের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভালোই শুরু করেছিল ২০২২ সাল। কোভিডের ধকল কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছিল বিশ্ব অর্থনীতি। বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকের চেয়ে ভালো করছিল। এমনিতেই কোভিডকালেও আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি বসে ছিল না। ক্ষেতে-খামারে পুরোদমেই কাজ হচ্ছিল। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মোট জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশের মতো প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়নের এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর আওতায় সংকট সত্ত্বেও রপ্তানিমুখী বস্ত্র ও চামড়া শিল্প কারখানাগুলো খোলা রাখা সম্ভব হয়েছিল। প্রায় ৫০ লাখ শিল্প শ্রমিকের কয়েক মাসের বেতন মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর শিল্প উদ্যোক্তারা যাতে খেলাপি না হয়ে যায় সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার সাধ্যের বাইরে গিয়ে হলেও নানা ধরনের নীতি ছাড় দিয়েছিল। ফলে শিল্প উৎপাদন একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। পাশাপাশি কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর জন্য প্রণোদনামূলক কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বাস্তবে ব্যাংকগুলো এসব কর্মসূচি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করতে পারলেও উদ্যোক্তারা ধীরে ধীরে নিজের চেষ্টাতেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তাছাড়া অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রায় অর্ধকোটি পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাড়তি নগদ সহায়তা দেয় সরকার। চালু সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোও যথারীতি সচল রাখা হয়। ফলে মানুষ ততটা হতাশ ছিল না। সবাই ধীরে ধীরে নিজেদের পেশায় ফিরে আসতে থাকে। সরকারের টিকা কর্মসূচি ছিল আরেক বাড়তি প্রণোদনা। বিনা পয়সায়, সব মানুষকে দুটো করে টিকা দেয়া মোটেও চাট্টিখানি কথা ছিল না। অনেক দেশ এ সাহস দেখাতে পারেনি। টিকা তৈরি হওয়ার আগেই অর্থ দিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। এর অর্ধেকটার মতো সংগৃহীত হলেও বাংলাদেশ সরকারের মানুষ বাঁচানোর সদিচ্ছাকে বিশ্ববাসী সম্মানের চোখেই দেখেছে। তাই উন্নত অনেক দেশ থেকে আমরা উপহার হিসেবেও অনেক টিকা পেয়েছিলাম। আর আমাদের টিকা দেয়ার সংস্কৃতি যে বলিষ্ঠ সে তো জানা কথা। যদিও বাজেট ভর্তুকির বোঝা অনেকটাই বেড়েছে তবুও এ কথা দেশবাসীকে প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে পেরেছিলেন যে, যে কোনো মূল্যে তিনি মানুষ বাঁচাতে দ্বিধা করবেন না। নেতৃত্বের এই দৃঢ়তা পুরো সমাজে এক ধরনের ভরসার পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের নানা অংশও তখন মানুষ বাঁচানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এর সুফল আমরা পেয়েছি। আমরা ভুলে যাইনি লকডাউনের সময় কী করে হাওরের ধান কাটতে সমাজের নানা দিক থেকে মানুষ ছুটে গিয়েছিলেন মৌলভীবাজারে। সামাজিক এই পুঁজির বিস্ফোরণ বাংলাদেশের বড় সম্পদ। এমনিতেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের অভ্যেস ভালো। জিডিপির শতকরা ৩১ শতাংশের বেশি আমরা সঞ্চয় করি। তাই এই সঞ্চয় ভেঙে হলেও আমরা কোভিড আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের সবার। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই আচমকা রুশ ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এই যুদ্ধ বন্ধ না করে উন্নত দেশ আরো পালে বাতাস দিল। ইউরোপ বাধ্য হয়েই পরাশক্তির লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ল। তারা রুশ তেল-গ্যাস নির্ভরশীল। হঠাৎ পশ্চিমের স্যাংশন এবং রাশিয়ার পাল্টা অর্থনৈতিক অবরোধে সারা বিশ্বেই ভঙ্গুর সরবরাহ চেইন আরো ভেঙে পড়ল। বাড়তে থাকল গম, সার ও তেলের দাম। বাংলাদেশ এসব পণ্য ইউক্রেন, বেলারুশ ও রাশিয়া থেকে আমদানি করত। হঠাৎ বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়ে গেল। জাহাজ ভাড়াও বেড়ে গেল। আমাদের বাজেটে তাই ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হলো। টিকার দাম তো ছিলই। এর ওপর এসব আমদানি করা পণ্যের দামে লাগল আগুন। তাই তেলের দাম সমন্বয় করতে গিয়ে প্রায় ৫২ শতাংশ তা বাড়ানো হলো। এর প্রভাব পরিবহন, বিদ্যুৎসহ সর্বত্র পড়ল। তখন বিদ্যুৎ সরবরাহ কমাতে হলো। লোডশেডিং করতে হলো। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প উৎপাদন বেশ খানিকটা ব্যাহত হলো। এর চাপে আমাদের মোট আমদানি মূল্য এতটাই বাড়ল যে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে তার আর সামাল দেয়া যাচ্ছিল না। তাই বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি কমানোর জন্য বাধ্য হয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক কড়াকড়ি করল। এলসি খোলা কমে গেল। তবুও প্রয়োজনীয় পণ্য (যেমন তেল, গ্যাস, সার, খাদ্য) আমদানির জন্য সরকারকে সমর্থন দিতে হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। ফলে তার রিজার্ভে টান পড়ল। রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকানোর জন্য মুদ্রা বিনিময় হার বেশ খানিকটা বাজারনির্র্ভর করার উদ্যোগ নেয়া হলো। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় তাতে অনুপ্রাণিত হলেও শেষমেশ মুদ্রার বিনিময় হার একাধিক হওয়ায় অস্বস্তি রয়েই গেল। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আমদানিমূল্য এবং প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের ভারসাম্য ফিরে আসছে। হয়তো এক-দুই মাসের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্যে আরো উন্নতি হবে। কিন্তু কর্মসংস্থানের সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবসাতেও তো মানুষ খাটে। তাদের কর্মসংস্থান তো সংকুচিত হচ্ছে। তাই ধীরে ধীরে আমাদের পুরো অর্থনীতিকেই খুলে দিতেই হবে। আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করে যেতে হবে।
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি নীতি সুদের হার বিনিময় হারের মতো আরেকটু নমনীয় করত তাহলে বাজারনির্ভর ঋণনীতি নিশ্চয় কাজ করতে শুরু করত। তাহলে অর্থনীতির এই ভারসাম্য আরো আগেই হয়তো ফিরে আসত। তবে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি নিশ্চয় হবে। তবুও আগামী বছরের অর্থনীতির জন্য কিছু প্রত্যাশার কথা বলি।
এক. বাণিজ্যিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে পণ্যের সরবরাহ ও চাহিদা উভয়ের মাঝে সমন্বয়ের চেষ্টা করে যেতে হবে। আমাদের রপ্তানি আরো বাড়াতে যা যা করা দরকার করে যেতে হবে। আশার কথা ইউরোপে আমরা গড়ে ৪৩ শতাংশেরও বেশি রপ্তানি করেছি গত পাঁচ-ছয় মাসে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, কানাডাসহ অন্যান্য বাজারেও আমাদের বস্ত্র ও অন্যান্য রপ্তানি পণ্য বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের বিনিময় হার একই পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করে যেতে হবে। তাহলে বাণিজ্য গতি বাড়বে।

দুই.
আমাদের দেশে যাতে ডলার বিনিয়োগ আরো বাড়ে সে জন্য একক বিনিময় হার ছাড়াও অন্যান্য নিয়ম-নীতিগুলো আরো ব্যবসা-বান্ধব করার বাস্তব উদ্যোগ নিতে হবে।
তিন.
কোনো অবস্থাতেই কৃষির প্রতি যে নীতি মনোযোগ এখন দেয়া হচ্ছে তা থেকে সরে আসা যাবে না। এই খাতের জন্য ভর্তুকি অব্যাহত রাখতেই হবে। পাশাপাশি কৃষকদের সার্টিফিকেট মামলা ও অন্যান্য হয়রানি বন্ধ করতে হবে। তাদের সমর্থন দেয়ার নয়া উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অন্যান্য ব্যাংক এবং আধুনিক কৃষকদের সম্মিলিত আলাপের কোনো বিকল্প নেই।

চার.
ফ্রি-লান্সিংয়ের জন্য বাইরে থেকে ডলার আনতে মোবাইল আর্থিক সেবা, ইন্টারনেট ও এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা আরো সহজ ও প্রণোদনামূলক করা যেতে পারে।

পাঁচ.
সামনের বছরও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি শ্লথ থাকতে পারে। নির্বাচনী বছর বলে অর্থ খরচে ‘খোলামকুচি নীতি’ কোনো অবস্থাতেই নেয়া উচিত হবে না। মনে রাখতে হবে প্রতিটি টাকা খরচের পেছনে খানিকটা হলেও বিদেশি মুদ্রা খরচ হয়। তাই সরকারি খরচে লাগাম টেনে রাখতে হবে।

ছয়.
আর্থিক অন্তর্ভুক্তির (মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং) যে বেগবান ধারা গড়ে উঠেছে তা যেন কোনো স্বার্থান্বেষী মহলে ব্যাহত না করতে পারে সেদিকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে খেয়াল রাখতে হবে। এই খাতটি দ্রুত বেড়ে উঠছে। অনেক লোভী চোখ এ খাতের দিকে থাকতে পারে। রেফারি হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ খাতের দিকে কড়া নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে।

সাত.
বিশ্ব অর্থনীতির এই সংকটকালে ডিলারদের কারণে আমাদের কৃষকরা যেন সার পেতে অসুবিধার মধ্যে না পড়ে, তাদের ফসল বিক্রি করতে পথে পথে চাঁদাবাজদের হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে সরকার ও সমাজকে সজাগ থাকতে হবে।

আট.
জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা যে এখনো রয়ে গেছে তা মানতেই হবে। শুধু রাজস্ব নীতি দিয়ে বাড়ন্ত মূল্যস্ফীতি কশাঘাত থেকে ভুক্তভোগী মানুষকে রেহাই দেয়া যাবে না। তাই মুদ্রানীতির প্রচলিত কৌশল প্রয়োগে দ্বিধা করলে চলবে না। নীতি সুদ বাড়িয়ে বাজারকে উপযুক্ত সিগনাল দেয়ার পাশাপাশি পণ্য সরবরাহ বাড়ানোর যেসব উদ্ভাবনীমূলক উদ্যোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়েছে সেগুলো অব্যাহত থাকুক। নতুন বছরের শুরুতেই সেই প্রত্যাশা করছি।
মনে হয় সহসাই ইউরোপ যুদ্ধ থামবে না। তেলের দামও কমবে না। বরং বাড়তে পারে। তাই আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির দিকেই বেশি করে নজর দিতে হবে। সর্বত্র কৃচ্ছ্র নীতি হয়তো অব্যাহতই রাখতে হবে। তবে বিশ্বব্যাপী এই অর্থনৈতিক সংকটের দায় শুধু সরকারকেই কেন একা নিতে হবে? সমাজের কি কোনো দায় নেই? ব্যক্তি খাতসহ সবাইকে এই সংকটকালে জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে সুবিবেচনার পরিচয় দিতে হবে। কেননা আমরা চাই বা না চাই বাজারনির্ভর অর্থনীতির বাইরে যেতে পারছি না। আর বাজার চলে সব অংশীজনের সম্মিলিত অংশগ্রহণে। বাজার পরিচালনার নীতির সঙ্গে উদ্যোক্তা, আমলাতন্ত্র, রাজনীতি, ভোক্তাশ্রেণি- সবাই যুক্ত। তাই সবার অংশগ্রহণে প্রকৃত অর্থনীতির আসল মূল্য বা ভ্যালুর সন্ধানই সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত। নৈতিক এই মূল্য খুঁজে পেতে সমাজের অকিঞ্চিৎকরতা কাটিয়ে উঠে বৃহত্তর আশার পরিবেশের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করার কোনো বিকল্প নেই। সমাজ ও রাজনীতিতেও শান্তির পরিবেশ বজায় থাকলেই অর্থনীতির অস্থিরতা কমানো সম্ভব। আর সেভাবেই এই আশার ক্ষেত্র প্রসারিত হতে পারে। সেজন্য চাই সুস্থির সমাজ। বিচক্ষণ সমন্বিত নীতি-উদ্যোগ। সেখানে সব অংশীজনের ঔদার্য ও অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
আগামী বছর সবার জন্য সুস্থিতি ও শান্তি নিয়ে আসুক সেই কামনাই করছি। শুভ নববর্ষ।

ড. আতিউর রহমান : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়