ঢাবিতে পর্দা নামল নন-ফিকশন বইমেলার

আগের সংবাদ

কালো মানিকের জন্য শোকার্ত বিশ্ব

পরের সংবাদ

আগামীর প্রতিশ্রুতি ও স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৩০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

খ্রিস্টাব্দের নতুন বছর শুরু হচ্ছে। নানা প্রত্যাশা আর স্বপ্ন পূরণের আকাক্সক্ষা প্রতি নতুন বছরের আগমনে আমরা করে থাকি। এবারের নতুন বছরেও আমরা তেমন প্রত্যাশা করছি বৈকি। তবে দেশের সার্বিক অবস্থা আমাদের শঙ্কিত করে তুলেছে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় দুই প্রধান দল এখন পরস্পরের মুখোমুখি। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে- না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন? এ নিয়ে দ্ব›দ্ব ক্রমেই সংঘাতের পথে এগোচ্ছে। রাজনৈতিক সহিংসতার আভাসও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক সন্ত্রাস সামনে আরো ব্যাপক আকারে ঘটবে এমন আশঙ্কা অমূলক বিবেচনা করা যাচ্ছে না।
প্রতি পাঁচ বছরান্তে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পর্যায়ক্রমে একবার এই দল- আরেকবার ওই দল ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করলেও জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। দুই প্রধান দল যে একে অপরের বিকল্প নয় এই সত্যটি বারবার প্রমাণিত। প্রকৃত বিকল্পের অভাবে জনগণ এই দুই দলের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলাদেশে এ যাবৎকালের একটি নির্বাচনও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। বোঝা যাচ্ছে বিদ্যমান ব্যবস্থায় জনগণের মুক্তি অসম্ভব। এ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া জনগণের ভাগ্য বদল হবে না। বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে প্রধান দুই দলের মধ্যে ন্যূনতম বিরোধ নেই, নেই মতপার্থক্য, বরং উভয়েই ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে একমত।
দেশে জ্বালানি তেল নিয়ে চলছে তুঘলকি অনাচার। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য নিম্নগামী অথচ সরকার আইএমএফের চাপে বারবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ের সব স্তরে পড়েছে। খাদ্য-পণ্যসহ দ্রব্য-সামগ্রীর দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। ডলার সংকটে বিদেশি পণ্য আমদানিতে অচল অবস্থা বিরাজ করছে। যার কারণে আমদানি পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে।
বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের অঙ্গীকারে সরকার ক্ষমতায় এসে বিদ্যুৎব্যবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা পালন করলেও, তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের সুযোগ নিয়ে কুইক রেন্টাল পদ্ধতির বাতাবরণে ব্যক্তিমালিকানাধীন কতিপয় প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি করার ফলে চড়া মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের আর্থিক বোঝা চাপানো হয়েছে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ওপর। বহু দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে সরকার ইতিহাস গড়েছে। আবারো বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা চলছে। কুইক রেন্টালের নেতিবাচক প্রভাবে বিদ্যুৎ গ্রাহক মাত্রই চড়া মাশুল গুনছেন।
দেশে ধর্ষণ আগেও ছিল, কিন্তু এখন তা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পাঁচ-সাত বছরের শিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। গণধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। পুলিশ ও আইনের প্রতি আস্থাহীনতার কারণে এবং সামাজিক বিড়ম্বনার ভয়ে আক্রান্তরা বেশিরভাগই বিষয়টি চেপে যায়, প্রকাশ করে না। যে কয়টি প্রকাশ পায় সেগুলোর নগণ্য সংখ্যকই বিচার হয়। ধর্ষকরা প্রধানত বেকার, অর্ধবেকার, বোধ-বিবেচনা বিবর্জিত এবং সংস্কৃতিহীন। বিদ্যমান ব্যবস্থা সুস্থ মানসিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করছে, যার নেতিবাচক প্রভাবে আশাহীন ও আত্মসুখপরায়ণ তরুণ-যুবকরা, অসুস্থ, অমানবিক পন্থায় নিজেদের বিকার জাহির করছে।
সমাজের সর্বত্র চলছে হীন প্রতিযোগিতা। কে কাকে ডিঙিয়ে এগিয়ে যাবে, কাকে ধাক্কা দিলে নিজের অর্জন নিশ্চিত হবে সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান ঘটনা। ব্যক্তির উন্নতির এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সমষ্টি ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, যা নির্বাচনের মাধ্যমে আসবে না, আসবে সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের পথে। আমরা এমন ব্যবস্থা চাই, যা মানুষকে আশাহীন এবং ভবিষ্যৎহীন করবে না, সবার জন্য অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করবে। সে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ছাড়া আমাদের পরিত্রাণ নেই। এটা বললে অন্যায় হবে না যে যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলি আসলে তা ছিল সমাজবিপ্লবেরই চেতনা।
দুটি চেতনার কথা বিশেষভাবেই আসে। আসা দরকারও। একটি একুশের, অপরটি মুক্তিযুদ্ধের। এরা পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়, প্রথমটির সঙ্গে দ্বিতীয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বস্তুত একুশের চেতনাই প্রসারিত হয়ে রূপ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে আন্দোলনটির সম্মুখযাত্রার সূচনা, সেটিতে ওই জাতীয়তাবাদের প্রত্যাখ্যান ছিল কেন্দ্রীয় ঘটনা। পুরনো জাতীয়তাবাদের প্রত্যাখ্যান কেবল নয়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পথ ধরে সমষ্টিগত অগ্রযাত্রার শুরুও ওখান থেকেই। প্রবল বিরোধিতা ও নির্মম দমনপীড়নের মুখে নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনটি এগিয়েছে এবং সে-আন্দোলনই পরিণতিতে কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে ভেঙে ফেলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত এটি অসাম্প্রদায়িক। ভাষা ধর্মীয় বিভাজন মানে না, সাম্প্রদায়িকতার অবরোধ ভেঙে ফেলে এগিয়ে যায়। ধর্মব্যবসায়ীরা বাংলা ভাষার ওপর নানা প্রকার সাম্প্রদায়িক উৎপাত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভাষা সেসব তৎপরতাকে মোটেই গ্রাহ্য করেনি, সে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। ভাষা শুধু যে অসাম্প্রদায়িক তা নয়, ধর্মনিরপেক্ষও বটে। ধর্মনিরপেক্ষতা অসাম্প্রদায়িকতাকেও অতিক্রম করে; কেননা তার ভেতরে থাকে পরিপূর্ণ ইহজাগতিকতা। ভাষা আত্মপ্রকাশের, সৃষ্টিশীলতার, সামাজিক যোগাযোগসহ অনেক কিছুরই মাধ্যম। ভাষার সাহায্যেই আমরা চিন্তা করি, অন্যের চিন্তাকে গ্রহণ করি, অপরের সঙ্গে দ্ব›েদ্বও লিপ্ত হই। ভাষা সমষ্টিগত স্মৃতির সৃষ্টিশীল সংরক্ষক। ভাষা ছাড়া তো মানুষ মূক ও বধির। অপরদিকে আবার ভাষা কোনো একটি শ্রেণির নিজস্ব সম্পত্তি নয়। ভাষার সৃষ্টি সমবেতভাবে, সমষ্টিগত উদ্যোগে। বিশেষ শ্রেণি, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোক, ভাষাকে যে আটকে রাখবে সেটা সম্ভব নয়। অতীতে সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।
এই যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে ও শ্রেণি বিভেদ না মানা- এর ভেতর রয়েছে গণতান্ত্রিকতা। গণতন্ত্র তো কেবল ভোটের ব্যাপার নয়, যদিও ভোট গণতন্ত্রকে কার্যকর করার একটি পদ্ধতি। ভোটের ভেতর দিয়ে মানুষ নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, ক্ষমতা কার হাতে থাকবে সেটা ঠিক করে দেয়ার অবকাশ পায়। কিন্তু ভোটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ঘটবে এমন নিশ্চয়তা যে সর্বদা থাকে তা নয়। বাংলাদেশে সত্তর সালের নির্বাচনে মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য যে রায় দিয়েছিল তখনকার ক্ষমতাধররা সেটা মানেনি, উল্টো পাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয় এই আতঙ্কে রায়দানকারীদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে অতি ভয়াবহ এক গণহত্যা ঘটায়। পরিণামে তারা অবশ্য ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ইতিহাসের আঁস্তাকুড় জিনিসটা অলীক কল্পনা নয়, সেটি আছে, স্বৈরশাসকদের সেটি চূড়ান্ত সমাধিভূমি।
সার কথাটা এই দাঁড়ায় যে, একুশের চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উভয়েরই লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনার দায়িত্ব যারা গ্রহণ করেছিলেন তারা যে নতুন রাষ্ট্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে সমাজতন্ত্রকে চিহ্নিত করেছিলেন সে ঘটনাটি এমনি এমনি ঘটেনি। এর পেছনে কারো করুণা বা কোনো দুর্ঘটনা কাজ করেনি। ওটি ঘটেছে যুদ্ধের ভেতরে বিকশিত ও প্রকাশিত মুক্তির আকাক্সক্ষা থেকেই। সমাজতন্ত্র ছাড়া মুক্তি সম্ভব যুদ্ধসময়ে এমনটা ভাববার কোনো সুযোগই ছিল না।
কিন্তু রাষ্ট্র তার অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। সরে এসেছে। রাষ্ট্র বাইরে যতই বদলাক ভেতরে মোটেই বদলায়নি। স্বভাবে ও চরিত্রে সে আগের মতোই পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক রয়ে গেছে। পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের স্বপ্ন আর জনগণের মুক্তির স্বপ্ন মোটেই এক ছিল না, ছিল বিপরীতমুখী, আসলে পরস্পরবিরোধী। পেটি বুর্জোয়ারা চাইছিল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে বুর্জোয়া হয়ে যেতে, জনগণ চাইছিল শোষণমূলক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্পর্ক চূর্ণবিচূর্ণ করে মুক্ত হতে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা পেটি বুর্জোয়াদের জন্য উন্নতির পথ খুলে দিয়েছে, জনগণ মুক্তি পায়নি। এক পক্ষের উন্নতি, অপরপক্ষের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সন্দেহ নেই যে, একুশের এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছেই আমাদের যেতে হবে। সে চেতনা পুঁজিবাদবিরোধী এবং অনিবার্যভাবেই সমাজবিপ্লবী। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অগ্রাভিযান ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে আমরা এগোচ্ছি; মুক্তিযুদ্ধ বলছিল যে আমরা পারব, আশা জেগে উঠেছিল যে পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক শাসকদের বিতাড়িত করে রাষ্ট্রের ওপর জনগণের অধিকার আমরা প্রতিষ্ঠা করব, সমাজে আর অত্যাচারী থাকবে না। চেতনা দুটি যে হারিয়ে গেছে তা নয় এবং তা বাস্তবায়িত করার ভেতরেই রয়েছে আমাদের জন্য আগামীকালের প্রতিশ্রæতি। অন্য সবকিছুই হয় আড়ম্বর, নয় প্রতারণা। আড়ম্বর আসলে প্রতারণাকে ঢেকে রাখার কৌশল। তবে এও যেন না ভুলি যে সমাজবিপ্লব আপনাআপনি ঘটে না, তার জন্য আন্দোলন প্রয়োজন হয়- সমাজবিপ্লবী আন্দোলন। যেটা গড়ে ওঠার অপেক্ষা।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়