এইচএসসির বিতর্কিত প্রশ্ন, প্রণেতারা শাস্তি পেলেন : আর কোনো পাবলিক পরীক্ষার দায়িত্ব নয়

আগের সংবাদ

স্বাচিপের পঞ্চম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী : চাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

পরের সংবাদ

তুমি কি তোমার মতো

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘তোমার পেছনে যা লেখা আছে তুমি কি তাই?’
অধ্যাপক কফিল উদ্দিনের এ প্রশ্ন শোনার পর পিকুর মধ্যে আত্ম-পরিচয়ের সংকট হানা দিল। সেই সংকট থেকে তার পরিত্রাণ মিলছে না। নিজের চোখে ছায়া-শ্যামল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটা আজ না শ্যামল না বিবর্ণ। ব্যাপারটা তার কাছে অবিশ্বাস্য। ঘনিষ্ঠ দুই সহপাঠী বন্ধু সোহেল ও দুলালকে ছাড়া এতটা সময় ক্যাম্পাসের কোনো নির্জন জায়গায় কখনো সে একাকী বসে থাকেনি। কিন্তু আজ সে একাই বসে আছে। উঠতে ইচ্ছে করছে না। কফিল উদ্দিন তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেননি। এমনকি অপমানও করেননি। শুধু তার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে প্রশ্নটি করেছিলেন। তখন সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রথম ক্লাসে তার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা। স্যারের কোনো ভৎর্সনাতেই পিকু কখনো এমন লজ্জা অনুভব কিংবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেনি। এত দিন ক্লাসে কিংবা পরীক্ষায় ছোটখাটো প্রতারণার করে পার পেয়ে যাওয়া, ক্যাম্পাসে গোঁয়ারতুমি করা বা মিথ্যে বলে বাড়ি থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা এনে খরচ করাটাকেই নিজের কৃতিত্বই মনে করেছে। পড়াশোনার প্রতি প্রায় বীতস্পৃহ পিকু উদগ্রীব ছিল কোনো রকমে অনার্সটা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলবে- ‘প্রিয় ক্যাম্পাস, আমি তোমায় অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি। তুমি ভালো থেক। খোদা হাফেজ।’
অনার্সের প্রথম সেমিস্টারে কফিল উদ্দিন স্যার পিকুদের একটা কোর্স পড়াতেন। সেই কোর্সের ফাইনালে মৌখিক পরীক্ষায় পিকু বলতে গেলে কিছুই পারেনি। তারপরও সে খুব স্বাভাবিকভাবেই এক্সামিনারগণের সামনে বসে ছিল। বিভাগীয় প্রধানসহ সবাই পিকুর মুখের দিকে তাকিয়ে যেন মজাই পাচ্ছিলেন।
‘কোর্স সম্পর্কে আপনার স্টুডেন্টের দেখছি কোনো ধারণাই নেই।’ বিভাগীয় প্রধান কোর্স টিচার কফিল উদ্দিনকে বললেন।
‘ও মোটামুটি নিয়মিতই আমার ক্লাসে উপস্থিত ছিল। আমার ধারণা ও খুব নার্ভাস ফিল করছে।’ কফিল উদ্দিন বললেন।
এ কথা সত্য যে কফিল উদ্দিন পিকুর মধুর অত্যাচারে বিরক্ত ছিলেন। তারপরও ছেলেটাকে ভাইভা পরীক্ষায় কোনো রকমে পার করিয়ে দেয়ার মানসিকতায় সাপোর্টটা দিলেন।
তখন বিভাগীয় প্রধান পিকুকে বললেন,
‘তোমাকে একটা শেষ প্রশ্ন করব। যদি তুমি এর উত্তর দিতে পার তবে তুমি এই কোর্সের ভাইভায় পাস। উত্তর পুরোপুরি সঠিক না হলেও আমরা যদি মোটামুটি কনভিন্সড হই তবুও তুমি পাস। তুমি কি রাজি?’
ছাত্র চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাওয়ায় কফিল উদ্দিন দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। কিন্তু পিকু মাথা চুলকিয়ে কিছু একটা ভাবছিল। এক্সামিনারগণ পিকুর দিকে তাকিয়ে আছেন। পিকু কফিল উদ্দিনকে অধিক দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়ে চ্যালেঞ্জটা নিয়েই নিল। সে বিভাগীয় প্রধানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘স্যার, আমি রাজি।’
পড়াশোনায় মহাফাঁকিবাজ ছেলেটার এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে কফিল উদ্দিন ধরেই নিলেন যে তার আর ভাইভা পাস করা হচ্ছে না। বিভাগীয় প্রধান কফিল উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ছাত্রকে নিয়ে কোর্স টিচার মনে হয় একটু টেনশনেই আছেন।’
কফিল উদ্দিন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেন। তারপর বিভাগীয় প্রধান পিকুকে শেষ প্রশ্নটা করলেন।
‘বাবা, তুমি বলত যে কোর্সের ভাইভা পরীক্ষা দিচ্ছ সেই কোর্সের বইয়ের কাভারের কী রং? লাল, কাল, হলুদ, নীল, বাদামি, নাকি অন্য কিছু?’
পড়াশোনায় মোটামুটি মনোযোগী ছাত্রছাত্রীর জন্যও এ প্রশ্নটা কতটা লজ্জা আর অপমানের সেটা পিকুর বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। সে কারণে প্রশ্নটা শোনার পর তার চেহারায় লজ্জার সামান্য বহিঃপ্রকাশ ঘটল না। সে গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবছিল প্রশ্নটার কী উত্তর দেয়া যায়। আর এক্সামিনারগণও মনোযোগ সহকারে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
‘স্যার, টাকার অভাবে আমি নতুন বই কিনতে পারিনি। নীলক্ষেত থেকে এই কোর্সের পুরনো বই কিনেছিলাম। সেই বইটার কাভার ছিল না। তাই বলতে পারছি না এই কোর্সের বইয়ের কাভারের কী রং।’
এমন উত্তর শোনে বিভাগীয় প্রধানসহ অন্য এক্সামিনারগণ এমনভাবে পিকুর দিকে হাঁ করে তাকালেন যে সামনে মাছি থাকলে সমস্যাই হতো। ছেলেটির কূটবুদ্ধিতে সবাই কিছুটা দিশাহারা। তারপর বিভাগীয় প্রধান হো হো করে হেসে দিলেন। সেই হাসি অন্যদের মাঝেও সংক্রমিত হলো।
‘স্যার, এই পরীক্ষায় আমি তাহলে পাস?’ পিকু সাহস করে কথাটা বলেই ফেলল।
‘বাবা, তুমি এবার যাও। আমরা তোমার বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটা নেব।’
এ কথা শোনে পিকু বিনম্রভাবে সবাইকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে আসে। তার মনে হয়েছিল উদার এক্সামিনারগণ তাকে প্রাণে মারবেন না। কোনো রকমে পার করিয়ে দেবেন। বস্তুত তাই হয়েছিল। তার ক্লাস পার্সেন্টেজ বিচেনায় নিয়ে সেই কোর্সের ভাইভায় তাকে পার করিয়ে দেয়া হয়েছিল।
প্রতিটি কোর্সে শতভাগ ক্লাস পার্সেন্টেজের জন্য ছাত্রছাত্রীরা ১০ নম্বর পায়। সেই নম্বরটা সেমিস্টার ফাইনালে যোগ হয়। ডিপার্টমেন্টে একমাত্র অধ্যাপক কফিল উদ্দিন তার ক্লাসে কখনো রোল কল করেন না। তিনি ক্লাসে ঢুকেই পার্সেন্টেজের খাতাটা ছাত্রছাত্রীদের হাতে দিয়ে দেন। ক্লাসে যারা উপস্থিত থাকে তারা একে একে খাতায় নিজ নামের পাশে তারিখ অনুযায়ী টিক চিহ্ন দেয়। অথচ ডিপার্টমেন্টের অন্য শিক্ষকরা পার্সেন্টেজের খাতায় উপস্থিত শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষর নেন। কফিল উদ্দিনের সরলতার সুযোগ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ ক্লাসে উপস্থিত না থেকেও তার ক্লাস পার্সেন্টেজটা অন্য কেউ দিয়ে নেয়। সহজ পদ্ধতিতে ১০ নম্বর। তার সরল বিশ্বাসের সাথে কোনো কোনো শিক্ষার্থীর প্রতারণার বিষয়টি কফিল উদ্দিন একদিন টের পান। ভেতরে ভেতরে তিনি বেশ মর্মাহত হন। ঘটনাটি কফিল উদ্দিনের মধ্যে উদ্বেগেরও জন্ম দেয়। শেখার সময়ে তার ছাত্রছাত্রীরা এসব ছোটখাটো ফাঁকিবাজি আর প্রতারণায় অভ্যস্ত হলে কর্মজীবনেও এমনটা করতে পারে।
কফিল উদ্দিনের নেয়া সততার পরীক্ষায় একবার পিকুও ফেল করল। সে একদিন ক্লাসে উপস্থিত ছিল না। সে দিন খাতায় তার পার্সেন্টেজটা দুলাল দিয়েছিল।
‘তুমি গতকাল আমার ক্লাসে উপস্থিত ছিলে না। তারপরও খাতায় তোমার পার্সেন্টেজ কে দিল?’
পরদিন ক্লাসে কফিল উদ্দিন পার্সেন্টেজের খাতার দিকে তাকিয়ে পিকুকে এ কথা বললেন।
‘স্যার আমি গতকাল আপনার ক্লাসে উপস্থিত ছিলাম। আপনি বোধ হয় আমাকে দেখতে পাননি।’
পিকুর নির্জলা মিথ্যে জবাবে কফিল উদ্দিন তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পিকু দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতায় সোহেল ও দুলালের প্রায় সমান। ক্যাম্পাসে কেউ কেউ তাকে ম্যান মাউন্টেন বলেও ডাকে। সে রকম একটি ছেলে ক্লাসে উপস্থিত ছিল আর কফিল উদ্দিন তাকে দেখতে পাননি! এটা কী করে সম্ভব তা তিনি ভেবে না পেয়ে পিকুকে দরজার বাইরে যেতে বললেন। পিকু দরজার বাইরে দাঁড়ালে তিনি দুলালকে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। তারপর দুজনকে এক সাথে পাশপাশি দরজা দিয়ে ঢুকতে বললেন। পিকু দরজা দিয়ে ঢুকার সময় খুব অল্পই ফাঁকা থাকে। তাই পিকুর সাথে ঢুকতে গিয়ে দুলাল আটকে গেল।
‘স্যার, ওর সাথে একটা মাছিও এক দরজা দিয়ে ঢুকতে পারে না। আমি কী করে ঢুকব?’
দুলালের কথা শোনে ক্লাসের কেউই হাসি দমন করতে পারল না।
‘এই সাইজের দেহ নিয়ে একটা ছেলে গতকাল আমার ক্লাসে উপস্থিত ছিল আর আমি দেখতে পাইনি। এটা কি সম্ভব?’
কফিল উদ্দিন এ কথা বলার পর ক্লাসে আরো হাসির বন্যা বয়ে গেল। তখন পাশের রুমে যে শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছিলেন তিনি বেরিয়ে এসে জানতে চাইলেন কফিল উদ্দিনের ক্লাসে কী ঘটেছে। ঘটনার পর পিকু কফিল উদ্দিনের এমন আচরণের প্রতিশোধ নেয়ার ফন্দি এঁটেছিল। একদিন সোহেল ও দুলাল পিকুকে নিয়ে গেল স্যারের রুমে। পিকু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
‘স্যার, আমাদের সেমিস্টার ফাইনালের ফর্ম ফিলাপের আজ শেষ দিন। কিন্তু পিকুর বাড়ি থেকে ফর্ম ফিলাপের টাকা আসেনি। তাই সে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল।’
সোহেলের মুখে এ কথা শোনে কফিল উদ্দিন খুব আবেগ আল্পুত হয়ে পড়েন। পিকুকে তিনি ফাঁকিবাজ বলেই জানতেন। অথচ তিনি দেখলেন যে পরীক্ষার প্রতি ছেলেটার কী দুর্বার টান! তিনি পিকুর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত¡না দিলেন। তারপর নিজের পকেটে যা ছিল তা না গুনেই পিকুর হাতের মুঠোয় দিলেন।
‘বোকা ছেলে। যাও ফর্ম ফিলাপ করে এসো।’
স্যারের উদারতায় পিকু হাউ মাউ করে কেঁদে দিয়েছিল। টাকার পরিমাণ ফর্ম ফিলাপের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই ছিল। কিন্তু পিকুর ফর্ম ফিলাপের টাকা ঠিক সময়েই বাড়ি থেকে এসেছিল। নিখুঁত অভিনয়ের মাধ্যমে কফিল উদ্দিনের কাছ থেকে আদায় করা টাকাটা দিয়ে সেবার তিন বন্ধু ফুর্তি করে বেড়িয়েছিল।
এত সব ঘটনায় কখনোই পিকুর বিবেকবোধ জাগ্রত হয়নি। কিন্তু আজ পিকুর মাঝে আত্ম-পরিচয়ের সংকট দেখা দেয় যখন স্যার তার পিঠে হাত রেখে সেই প্রশ্নটা করেছিলেন। কোন প্রশ্নটা? সকাল ১০টায় কফিল উদ্দিন স্যারের কোর্সের পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষার মাঝামাঝি অবস্থায় তিনি পরীক্ষার হল সংলগ্ন বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। পিকু তখন পাশের ডেস্কে বসা আরেকজনের খাতা দেখে লিখছিল। হঠাৎ নিজের কাঁধে মমতার স্পর্শে পিকু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কফিল উদ্দিন স্যার তার কাঁধে হাত রেখে পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। পিকু ভাবল স্যার আজ তার খাতাটা নিয়েই নেবেন। কিন্তু কফিল উদ্দিন সেটা করেননি। কোনো রকম তিরস্কার বা অপমানও করলেন না। শুধু প্রশ্ন করলেন,
‘তোমার পেছনে যা লেখা আছে তুমি কি তাই?’
পরীক্ষার হলে সবাই তাকিয়ে ছিল কফিল উদ্দিন স্যার ও পিকুর দিকে। পিকু যে টিশার্টটা গায়ে দিয়ে পরীক্ষায় বসেছিল সেটার পেছনে ইংরেজিতে লেখা ছিল- ইউ বি ইউ। যার মানে হচ্ছে, তুমি হও তোমার মতো। পিকু স্যারের মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু স্যারের চাহনিতে ক্ষোভের চেয়ে কষ্টটাই যেন বেশি। লজ্জায় পিকু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এই প্রথম তার মাথা নত করা। শিক্ষকের কাছে মাথা নত করা ছাত্রের ব্রত- গুরুজনের এ কথার ধার সে কখনো ধারেনি। কফিল উদ্দিন পিকুর খাতাও টেনে নেননি কিংবা তাকে বহিষ্কারও করেননি। তিনি মন খারাপ করে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। সবাই মনোযোগে পরীক্ষা দিচ্ছে। আর পিকু কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থেকে বেরিয়ে আসলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সিনিয়র ব্যাচ তদের সমাপনী উদযাপন করতে ‘ইউ বি ইউ’ সেøাগান দিয়ে টিশার্ট বানিয়েছিল। সেøাগানটা পছন্দ হওয়ায় পিকু হলের এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে একটা টিশার্ট চেয়ে নিয়েছিল। আজ সে সেটিই গায়ে দিয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছিল।
পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে পিকু ক্যাম্পাসের নির্জন যে জায়গাটায় বসেছিল এখনো সেখানেই একাকী বসে আছে। তার মাথাটা অনেক ভার ভার লাগছে। কফিল উদ্দিন চিন্তার বোঝাটা চাপিয়ে দিয়েছেন। এক পর্যায়ে সে ওঠে দাঁড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সোহেল ও দুলালের কথা ভাবে। ওরা এখন কোথায় আছে সে জানে না। দুষ্টুমি, পড়াশোনা আর ফাঁকিবাজিতে তিন বন্ধুর ভাবনা এক রৈখিক। তারা ক্যাম্পাসে এক সাথে আড্ডা দেয়, গান গায়, ক্যান্টিনে খায়। আবাসিক হলেও তারা এক রুমের বাসিন্দা। চারজনের রুমে তিন বন্ধু নিজেদের সিঙ্গেল খাটে না শুয়ে ফ্লোরিং করে এক বিছানায় ঘুমায়। রুমের এক পাশে তাদের খাট তিনটি একটির ওপর আরেকটি তুলে রাখা হয়েছে। তিন বন্ধুর যন্ত্রণায় রুমের অন্য ছেলেটি অতিষ্ঠ। দুলাল বাংলা শব্দের আদ্যাক্ষর ‘ল’ উচ্চারণ করতে গিয়ে ‘ন’ উচ্চারণ করে ফেলে। ক্যাম্পাসে লাভলী নামের একটা মেয়েকে সে ভালোবাসে। কিন্তু বেচারা লাভলীকে ‘লাভলী’ বলতে পারে না। লাভলী উচ্চারণ করতে গেলে তার মুখ দিয়ে ‘নাভলী’ চলে আসে। একদিন লাভলীকে প্রপোজ করতে গিয়ে বলে ফেলেছিল, নাভলী আই নাভ ইউ। আর তার কপালে জুটেছিল লাভলীর তিরস্কার। পিকু আর সোহেলের পরামর্শে দুলাল তার উচ্চারণ ঠিক করতে রেওয়াজ শুরু করেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় গেটের কাছে পিকুর আর যাওয়া হয়নি। সে হলের দিকে পা বাড়ায়। রুমে ঢুকে পড়ার টেবিলে বসল। তিন দিন পর কফিল উদ্দিন স্যারের আরেকটি কোর্সের পরীক্ষা। পরীক্ষার হলে পিকুর কাছে সোহেল নকলের কপি চাইল। পিকু সোহেলের দিকে একটা কাগজ ঠিকই বাড়িয়ে দিল। সোহেল কাগজ হাতে নিয়ে দেখে তাতে প্রশ্নের উত্তরের পরিবর্তে লেখা, ইউ বি ইউ। সে ক্ষুব্ধ হয়ে কপিটি পাশের জনকে দিল। পরীক্ষার হলে পিকুর দেয়া কাগজটি এক এক করে হাত বদল হতে গিয়ে কফিল উদ্দিন স্যারের হাতে ধরা পড়ে। তিনি সেটাকে নকলের কপি মনে করে হাতে নিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসি হাসেন। তাকিয়ে দেখেন পিকু অন্যের খাতার দিকে না তাকিয়ে নিজের চেষ্টায় পরীক্ষার লেখার চেষ্টা করছে।
হ্যাঁ, পিকু শেষ পর্যন্ত নিজের চেষ্টায় কোনো রকমে অনার্সটা পাস করেই ফেলল। অনেকের কাছে এটা এক বিস্ময়কর ঘটনা। পিকু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এই পাস তার কাছে একটা মুক্তি। সে সিদ্ধান্ত নেয় আর পড়াশোনা না করে বিদেশ চলে যাবে। সহপাঠীরা পিকুর জন্য ডিপার্টমেন্টে একটি বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের শিরোনাম- মুক্তি। অনুষ্ঠানে একমাত্র অতিথি অধ্যাপক কফিল উদ্দিন। সেই অনুষ্ঠানে পিকু তার এত দিনের কৃতকর্মের জন্য স্যারের পা ধরে ক্ষমা চাইল। পিকুর পরিবর্তন ও আত্মোপলব্ধি দেখে স্যারের চোখেও পানি আসে। এরপর পিকুর ভাবনায় আরেকটি পরিবর্তন আসে। সে সিদ্ধান্ত নেয় যে ক্যাম্পাস ত্যাগ না করে মাস্টার্স শেষ করবে।
এদিকে দুলাল শুদ্ধ উচ্চারণে লাভলী বলার চর্চা অব্যাহত রাখে। এ কাজে তাকে সহায়তা করে পিকু আর সোহেল। একদিন সে ঠিকই শব্দের আদ্যাক্ষর ‘ল’কে ‘ন’ না বলে ‘ল’ই বলে ফেলল। এখন লাভলী বলতে গিয়ে তার মুখ দিয়ে নাভলী চলে আসে না। সে লাভকেও নাভ বলে না। দুলাল একদিন সত্যি সত্যি লাভলীর সামনে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে বলে ফেলল,
‘লাভলী, আই লাভ ইউ।’
অথচ এক সময় তার মুখ দিয়ে চলে আসত- নাভলী, আই নাভ ইউ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়