মাসুদ বিন মোমেন আরো দুই বছর পররাষ্ট্র সচিব

আগের সংবাদ

বিশ্বকাপ উন্মাদনায় মেতেছে বিশ্ব

পরের সংবাদ

স্মরণ : যে পথে সোহাগ গেল

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিদ্যুতের হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে যখন দৃষ্টি স্তম্ভিত; সে চমকের অসহায় মুহূর্ত শেষ হওয়ার আগেই প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এমন দুঃসহ সময়ে এমন একটি বিষয়ে লিখতে বসা সহজ কাজ নয়। কবি সোহাগ সিদ্দিকীর আকস্মিক মৃত্যু সংবাদে যখন বুকের ভেতর কষ্টের নোনাজল প্রবহমান; এমন সময়ে সোহাগের স্মৃতিতর্পণ করে লেখাটা দুরূহ। যে রাতে সোহাগ সিদ্দিকীর মৃত্যু সংবাদ শুনেছিলাম; সে রাতে আর ঘুমাতে পারিনি; রাত জেগে সোহাগের স্মৃতিতর্পণে একটি কবিতা লিখেছিলাম; কিন্তু আজ লিখতে বসে আঙুল আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে বারবার। আঙুলের আড়ষ্টতা ভাঙতে আমি বরং সে রাতে লেখা কবিতাটি উচ্চারণ করি-
মুহূর্তে তোমার শোক ছড়ায় ভাইরাল সামাজিক যোগাযোগে
হতাশাব্যঞ্জক মৃত্যু তোমার অদ্ভুত অগস্ত্যযাত্রা হলো না কোন রোগে!
অনিবার্য ছিলে তুমি গতি দিয়েছিলো ব্যাধির পায়ে
কী অদ্ভুত গতিময়তায় চড়ে বসলে অনন্ত যাত্রী না’য়ে।
তোমার বিরহে থামেনি দূরপাল্লার কোন বাস
বরিশালগামী কোন লঞ্চ জানালো না শোক ফেলে দীর্ঘশ্বাস
স্থগিত হলো না কোন উৎসব পতাকা উত্তোলন
অশ্রæসিক্ত হলো না কোথাও বিনোদন আয়োজন।
অদৃশ্য বাতাস দৃশ্যমান বৃক্ষরাজি পৃথিবীর বারোআনা জলরাশি
অনিবার্য তবু অনাদৃত মানুষের কাছে যারা কষ্টে হাসি!
শত্রæ ছিলো তোমার আবেগ বঞ্চনা তোর সাথি
আত্মকেন্দ্রিক-স্বার্থান্ধ মানুষের ভিড়ে কুড়াও অখ্যাতি
সারল্য-বিশ্বাস পরিয়েছে নাকে দড়ি
তবু সুযোগ দিলো না তোমায় মহাকালের ঘড়ি
কখনো বিশিষ্ট কেউ নও তবু অনিবার্য প্রণয়ে সোহাগ
গোপনে তোমার প্রতি সবার জাগবে অনুরাগ।
(দুঃসময় পিছে ফেলে গেলে \ ফরিদ আহমদ দুলাল)
গত ১০ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে সোহাগ সিদ্দিকীর স্ট্রোক হয় বরিশালে; চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেয়া হলে ১১ নভেম্বরের প্রথম প্রহরে তিনি প্রয়াত হন। ১৭ নভেম্বর রাইটার্স ক্লাবের সম্পাদক কবি মোহাম্মদ সানাউল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের একটি দল সোহাগ সিদ্দিকীর গ্রামের বাড়িতে যায়, তার সফরসঙ্গীরা হলেন কথাসাহিত্যিক ইসহাক খান, কবি ইউসুফ রেজা, কবি গোলাম মোর্শেদ চন্দন, কবি জাহাঙ্গীর হোসেন, কবি আনিসুল হক হীরা, কবি মাশরুরা লাকী, বাচিকশিল্পী মাসুম আজিজুল বাসার, কবি নাঈম আহমেদ, কবি নির্বান পাল, রহিম রানা প্রমুখ; বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা পিরোজপুরে যুক্ত হয়ে নেতৃত্ব নেন; সেখানে কবর জিয়ারত এবং দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সোহাগের মৃত্যুর পর এ ক’দিনে আমরা উপলব্ধি করলাম, বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে তার গ্রহণযোগ্যতা কতটা ছিল। যারা এ ভ্রমণে যুক্ত হতে পারেনি তাদের আগ্রহ ও আবেগও আমরা প্রত্যক্ষ করলাম বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের গ্রুপে। কবি-গবেষক তপন বাগচী ‘সোহাগ সিদ্দিকী স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশের প্রস্তাব করেছেন। কবি কাজী আনারকলি, প্রকাশক সৈয়দ জাকির হোসেন, বাচিকশিল্পী রুবীনা আজাদ, গল্পকার রোকেয়া ইসলাম, কবি নাহার ফরিদ খান, কবি রোখসানা সাথী, কবি আবদু রাজ্জাক প্রমুখ তার সাথে সহমত প্রকাশ করেছেন এবং শুভকামনা জানিয়েছেন। অদ্ভুত জাদুমন্ত্র বলে সোহাগ যেন সবাইকে আচ্ছন্ন করেছিলেন। কোথায় পেয়েছিলেন সোহাগ এ শক্তি? এ প্রশ্নের উত্তরে সহজেই বলতে পারি তার সারল্যের কথা; বলতে পারি তার নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং বিশ্বস্ততার কথা; বলতে পারি তার অভিনিবেশনের কথা। একবার যার সাথে সোহাগ কথা বলতেন, তাকেই জড়িয়ে ফেলতেন মায়া-বন্ধনে।
যদ্দূর মনে পড়ে, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের কর্মকাণ্ডের সাথে যখন সোহাগ ঘনিষ্ঠ হন, আমি তখন রাইটার্স ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক; আমার বন্ধু কবি-গল্পকার নিশাত খান সাধারণ সম্পাদক। নিশাত সম্পাদক হলেও ক্লাবের অনেক সম্পাদকীয় দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়; এক পর্যায়ে নিশাত খান ক্লাবের কাজে কিছুটা মনোযোগী হতে চেষ্টা করেন; বিশেষ করে আমরা যখন ক্লাব থেকে ছন্দবিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করি, নিশাত তখন যথেষ্ট তৎপর হয়ে ওঠেন। কর্মশালা আয়োজনে সোহাগ সিদ্দিকী প্রধান দাপ্তরিক কর্মী। কিছুদিন পর নিশাত খান অসুস্থ হয়ে পড়লে, তার পক্ষে আমিই সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে থাকি; ইতোমধ্যেই আমাদের দ্বিতীয় যুগ্ম সম্পাদক শিশু-সাহিত্যিক নাসের মাহমুদ প্রয়াত হন; কবি সোহাগ সিদ্দিকী তখন ক্লাবের অঘোষিত যুগ্ম সম্পাদক কাম দপ্তর সম্পাদক। পদ-পদবি নিয়ে আমার এবং আমার বন্ধু নিশাত খানের মধ্যে সামান্য টানাপোড়েনও ছিল না; আমরা সবাই কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার নেতৃত্বের প্রতি নিরঙ্কুশ আস্থা পোষণ করতাম; যা আমি আজো করি, আর আস্থার বিষয়ে আমৃত্যু সোহাগ সিদ্দিকী ছিলেন তার গুরু হুদায় নিবেদিত।
সোহাগ কি কবি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন রাইটার্স ক্লাবে? প্রথমত মনে হতো- না; মনে হতো সোহাগ আমাদের সাথে মিশতেন কবিতার প্রেমে, কবিতার কর্মী হতে চেয়েছিলেন সোহাগ সিদ্দিকী; দ্বিতীয়ত মনে হতো সোহাগ আমাদের সাথে মিশতেন তার গুরুর সান্নিধ্য পেতে; মনে হতো গুরুর মনোতুষ্টিতেই তার আনন্দ। রাইটার্স ক্লাবের মঙ্গল চিন্তায় সারাক্ষণ নিবেদিত থাকতেন সোহাগ সিদ্দিকী। সে সময় সোহাগ রাইটার্স ক্লাবের পাশাপাশি সমধারা ম্যাগাজিনের কর্মকাণ্ডেও নিয়মিত ঘনিষ্ঠ থাকতেন। ২০১৭ বা ২০১৮ তে রাইটার্স ক্লাবের ঠিকানা বদলে গেল; ক্লাব নবাব হাবীবুল্লাহ রোড থেকে কাঁটাবন মোড়ে স্থানান্তরিত হলো; এ সময় ক্লাবের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেল। ২০১৯-এ প্রয়োজনের অবশ্যিকতায় গঠিত হলো ক্লাবের নতুন কমিটি; সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সোহাগ সিদ্দিকীর। ২০২০-এর করোনাকালে ক্লাবের কর্মকাণ্ড হয়ে উঠলো অনলাইননির্ভর; আমাদের অনলাইনভিত্তিক আয়োজনের প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠলেন সোহাগ। এই যে আমাদের সোহাগনির্ভর হয়ে ওঠা, তারপরও কোনোদিন তাকে এমন আচরণ করতে দেখিনি, যাতে মনে হতে পারে সোহাগ তার ওপর আমাদের নির্ভশীলতার ফায়দা তুলতে চেয়েছেন; এমন নিবেদন এ সময়ে সত্যি বিরল।
আগেই বলেছি, সোহাগ কবি হতে আসেননি আমাদের কাছে; আমি অন্তত ব্যক্তিগতভাবে কবি হিসেবে গুরুত্ব দিতে চাইনি; কিন্তু যেদিন- ‘কবিতার জয় হোক!’ সেøাগানের উত্তরে সোহাগ বললেন- ‘শুদ্ধ কবিতার জয় হোক!’ সেদিনই আমি তার কবিতার প্রতি মনোযোগী হলাম। ততদিনে সোহাগ সিদ্দিকীর কবিতার বই প্রকাশিত হয়ে গেছে, অথচ আমার পড়া হয়নি।
মা-মাটি ও দেশের প্রতি সোহাগের ছিল গভীর ভালোবাসা, সে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি তার কবিতায়; আসুন আমরা তার তেমন একটি কবিতা পাঠ করি-
আমি আবার এসেছি তোমার দুয়ারে
আমাদের এই দেখা অনিবার্য সত্য।
নিয়মের বাইরেও এ যে সত্য সূর্য!
মা, দরজা খুলে দেখ আমি দিব্য আছি।

শরীরের ক্ষতগুলো প্রায় নেই আর
বিষফোঁড়া উপড়েছি এ শরীর থেকে।
এখনো সামান্য আছে, ঘৃণা ঔষধিতে
সেও যে নিশ্চিহ্ন হবে কাল গহ্বরে।

কেমন সুস্থ সুন্দর একদিন এসে
তোমার কোলে থাকবো সুখের নিদ্রায়।
কণ্ঠের এ জড়তাও কেটে যাবে সত্যি
সময়ের পরীক্ষায় বিজয়ী হবোই।

তাই ইতিহাসে নাম, বিজয় আমার
মা, দুয়ার খুলে দেখো, অনিবার্য আমি।
(অনিবার্য আমি \ সোহাগ সিদ্দিকী)
এত ব্যস্ততায়ও সোহাগ লিখতে চাইতেন প্রেমের কবিতা; সোহাগ সিদ্দিকীর অসংখ্য প্রেমের কবিতা থেকে নিচে আমরা দুটি ছোট্ট প্রেমের কবিতা পড়ব-
চাঁদের গায়ে রোদ পড়ছে/ অবাক যাদুর সাজ!/ মনবাড়িতে খুশির জোয়ার/ দেখছি চেয়ে আজ!!

চিড়ল দাঁতের মিষ্টি হাসি/ হৃদয়পুরে আলো!/ কপোল জুড়ে জোসনা ভাসে/ মন হয়ে যায় ভালো!!

মনে আগুন বনেও আগুন/ আগুন আছে জলে!/ আগুন দিয়ে আগুন নিভাই/ আগুন জ্বালার ছলে!!

চোখ পেতেই দেখে ছিলেম/ অবাক রঙের জ্যোতি!/ সেই জ্যোতিতে অন্ধ হলেও/ কি-বা এমন ক্ষতি!!
(গহীনের ভাষা \ সোহাগ সিদ্দিকী)
যদি তুমি থাকো পাশে/ নাইবা হলো ফাগুন/ মাঘের শীতও পালিয়ে বাঁচে/ তুমিই যখন আগুন \
(শীতাণুকাব্য-১ \ সোহাগ সিদ্দিকী)
বিরহ শীতে কাঁপছি ভীষণ/ হিমে যাচ্ছি জমে/ তুমি এলেই যুদ্ধ হবে/ উঠব তখন ঘেমে \
(শীতাণুকাব্য-২ \ সোহাগ সিদ্দিকী)
শরৎ কিংবা বসন্ত নয়/ শীতকে ভালোবাসি/ কাঁথাটাই অবাক আকাশ/ দুজন পাশাপাশি \
(শীতাণুকাব্য-৩ \ সোহাগ সিদ্দিকী)
কবিতায় সোহাগ শুদ্ধতা চাইতেন এবং নিজের একান্তে তিনি শুদ্ধতা চর্চার চেষ্টাও করতেন। কবিতার প্রতি দায়বদ্ধতার কথা পাঠ করব তার নিচের কবিতায়-
পূর্ণতার কাছে থাকে অপূর্ণর ঋণ
যেমন জলের কাছে জলজ সে দায়।
কবিতাকে চিনে নিতে অপারগ তুমি
অচেনা যেমন তুমি বনলতা, নীরা আর নীলাম্বরীদের।
শব্দের লাবণ্য ভরা অপরূপ কবিতার কথাই বলছি!
তোমার বাড়ির পাশে ছিল যার প্রকৃতির ঘর।
তোমার দুয়ারে রোজ যাওয়ার পথে
বিশ্বাসের আলো জ্বেলে দেখেছে আমাকে
লীনুয়া, তোমাকে পেতে উপেক্ষা করেছি
আলোর ঠিকানা তার গহীনের টান

সেদিনের নীলাভ সে মুক্তোগুলো নিয়ে
তোমার আঙ্গিনা পেরোতেই, কবিতা আমার
হাত ধরে নেমে এলো আজন্ম বন্ধনে
সেই থেকে তার সাথে সহবাস আমার
লীনুয়া, তোমার অপূর্ণতে পূর্ণ শুধু আমি
আমার অপূর্ণতায়, পূর্ণ আমার শব্দরা।
(লীনুয়াকাহন \ সোহাগ সিদ্দিকী)
নিজেকে কবিতায় পূর্ণ করে তোলার আগেই তাকে জগৎ সংসারের মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হলো; কিন্তু সোহাগ সিদ্দিকীর এই চলে যাওয়া আমাদের কি কিছু শিক্ষা দিয়ে যায়নি? আমার বিশ্বাস নিরহংকারী সোহাগ তার আন্তরিকতা-বিশ্বস্ততা আর নিবেদন দিয়ে শিখিয়ে গেলেন, এ জগতে ভালোবাসাই মহত্তম নিবেদন। যে পথে সোহাগ চলে গেল, আখেরে এ পথ সবার; কিন্তু চলে যাওয়ার আগে আমরা যেন নিজের চলে যাওয়াটিকে অর্থময় করে তুলতে নিজেকে নিজের কর্ম আঙিনায় অনিবার্য করে তুলি; আমরা যেন নিজেকে নিজের নিবেদনে আলোকিত করে যাই। সোহাগের কর্মস্পৃহা যে আমাদের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকে। বিদায় অভিবাদন কবি সোহাগ সিদ্দিকী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়