জি এম কাদের : ৩০০ আসনেই শক্তিশালী প্রার্থী দিবে জাপা

আগের সংবাদ

নাটকীয় সমঝোতার পথে জাপা :

পরের সংবাদ

মুমুক্ষু

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৩১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বড্ড গুমোট আবহাওয়া আজ। চারদিকে কেমন আগুন আগুন ভাব। শরীর ঘেমে প্যাচপ্যাচ হয়ে যাচ্ছে। রান্নাঘরের কাজ সেরে সোজা বাথরুমে ঢুকলাম।
দ্রুত বদলে ফেললাম শাড়ি, ব্লাউজ। নতুন পোশাক পরে এসি চালিয়ে এককাপ চা নিয়ে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। আবেশে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো। তন্দ্রাচ্ছন্ন হতেই মোবাইলটা বেজে উঠল।
– হ্যালো।
– হ্যালো রূপা, কেমন আছো?
– ভালো, তুমি?
– আমিও ভালো। শোনো এবার বোধহয় বিয়েটা হয়েই যাচ্ছে আমাদের।
– দূর হেয়ালি করো না তো! কী হয়েছে বলো।
– তোমার সঞ্জিব দাকে খুঁজে বের করেছি। তোমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেব এবার।
– কী বলো! দাদা তোমায় চিনতে পারলেন?
– কী যে বলো! সঞ্জিব দাই তো আমায় দেখে চিনে ফেললেন।
– কী বললেন?
-তুই মাস্টার পাড়ায় থাকতিস না? সজীব, আরে রূপার প্রেমিক…! বুঝো ঠ্যালা। বিকালে আসছি ম্যাডাম সঞ্জিব দাকে ধরে নিয়ে। তৈরি থেকো।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। কী করব, না করব বুঝতে সময় নিচ্ছি। মাকে খাইয়ে নিজে একটু ফিটফাট হতে হবে।
ফোন রাখছি… বলেই ডুবে গেলাম স্মৃতির অতল গহ্বরে। আমি তখন ক্লাস টেনে। সঞ্জিব দা এলেন আমার শিক্ষক হয়ে। বড় ভাইয়ার বন্ধু। সবে ফিজিক্সে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করেছেন। বিয়েও করে ফেলেছেন প্রেমিকাকে। বউদি দাদার ক্লাসমেট। দাদা এলেন, শান্ত মিষ্টি একটা মানুষ। অঙ্কে আমি বরাবর কাঁচা। দাদা ধীরে ধীরে আমাকে অঙ্ক বুঝতে শেখালেন। দাদা আমায় বড্ড স্নেহ করতেন। ম্যাথ আমার কাছে সহজ হয়ে উঠতে লাগল। স্বভাবতই সঞ্জিব দা আমার প্রিয় মানুষে পরিণত হলেন। সারাদিন সঞ্জিব দাকে নিয়ে আমার ভাই-বোনদের সঙ্গে গল্প আলোচনা চলত। সঞ্জিব দা এলে দাদার জন্য নতুন নতুন রেসিপি বানানোর হিড়িক পড়ে যেত।
মধ্যবিত্ত পরিবারের গর্ব বলতে আটা, লবণ, চিনি, ডিম আর তেলে! এ নিয়ে বিভিন্ন আয়োজন! আমার বাবা ছিলেন সরকারি কলেজের লাইব্রেরিয়ান। অসম্ভব মুখ খারাপ আর সন্দেহপ্রবণ। মাকে সব সময় গালাগাল করতেন। আমরা তাকে এভয়েড করতাম। যাতে সামনে না পড়ি সহজে, সে চেষ্টা করতাম। আমি তখন এসএসসি দেব। সঞ্জিব দাকে নাস্তা করে খাওয়ানো নিয়ে আমাকেও কয়েক বার নোংরা কথা শুনতে হয়েছে। আমাদের সবার এগুলো গা সওয়া। মা আড়ালে আমাদের সাপোর্ট করতেন বলেই আমরা এসব পারতাম। আমার এসএসসি পরীক্ষা সামনে। জোর কদমে পড়াশোনা চলছে। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য একটা ফোনও আমার ছিল না। বন্ধুরা এসব নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়ত না। বাবার কাছে একদিন ফোন চাইতেই বাবা মুখ করা শুরু করলেন। আমার মেজাজ সপ্তমে উঠে গেল। খুব ঝগড়া হলো আমার আর বাবার- ‘নাগর জোগাড় কর গা যা…।’ ‘হ্যাঁ তাই করব দরকার হলে।’ এ জাতীয় ঝগড়া। এর মধ্যে সঞ্জিব দা যে কখন এসে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়েছেন আর সব কথাই শুনেছেন- আমি দেখিনি! টেবিলে বসে সঞ্জিব দার হাতে মুখ রেখে লজ্জায় কেঁদে ফেললাম।
– আরে দূর পাগলি! এভাবে কেউ কাঁদে! এটুকু বলে সেদিন মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন তিনি।
যেহেতু আমার বাবা একটু সন্দেহপ্রবণও ছিলেন, তাই আমরা চার ভাই-বোন, আম্মা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। পরীক্ষা দ্বার প্রান্তে। সঞ্জিব দা আমায় খুব সময় দিচ্ছিলেন। তার মধ্যে আমার জন্মদিন পড়ে গেল। তেমনভাবে জন্মদিন পালন হতো না আমাদের, বাবার কৃপণতার জন্য। সেবার সঞ্জিব দার জন্য মা বিভিন্ন রান্না করলেন। বাবার অনুপস্থিতে খাওয়া-দাওয়া হলো। যাওয়ার সময় সঞ্জিব দা আমায় একটি স্মার্টফোনের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। বললেন, এটা তোর রে পাগলি। তোর বউদি কিনে দিয়েছে।
আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে ‘আসছি’ বলে বাবা-মায়ের ঘরে গেলাম। ফোনটা বাবাকে দেখাতেই তিনি খিস্তি করতে লাগলেন- ‘নাগর তো ভালোই পটিয়েছিস! যা যা ওই বিবাহিত বেধর্মীর সঙ্গে ভাগ…’ ইত্যাদি ইত্যাদি খারাপ কথা।
আমি অসহায়ের মতো ঘর থেকে পালিয়ে এলাম। দেখলাম সঞ্জিব দা নেই।
এরপর আর তিনি আমাদের বাড়ি আসেননি। আমিও লজ্জায় ওনার সামনে দাঁড়াতে পারিনি। ভাইয়া একদিন এসে জানালেন সঞ্জিব দা চলে গেছেন পাড়া থেকে। ভাইয়াও বিদেশে চলে গেলেন। আমি এসএসসিতে গোল্ডেন এ পেয়ে পাস করলাম। বাবা মারা গেলেন। পড়াশোনা-বিয়ে সব কমপ্লিট করে ভাই-বোন যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে গেছে। বাড়িতে আমি আর মা। আমি এখন সরকারি কলেজে পড়াই। সজীবের সঙ্গে পাড়ায় একটা অল্প বয়সের প্রেম ছিল। মাঝখানে ব্রেকআপ হলেও একই কলেজে পড়াতে গিয়ে আবারো নতুন করে আবেগ জমে ওঠে। বিয়ে নিয়ে কোনোই পরিকল্পনা আমার নেই দেখে একদিন সে কারণ জিজ্ঞেস করল। তাকে সঞ্জিব দার গল্প বললাম। সঞ্জিব দার কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত, নিজের কষ্ট থেকে মুক্তি না মেলা পর্যন্ত জীবনের কোনো সিদ্ধান্ত নেব না। তারপর সজীবও চেপে গেছে, জানে আমি একরোখা!

২.
সন্ধ্যাবেলায় একটা ঝড়ো বাতাসের ঝাপটা এলো। সারাদিনের গুমোট ভাবটা কমেছে। সাড়ে ৭টায় কলিং বেল বাজল। তড়িঘড়ি করে দরজা খুললাম। দেখি সঞ্জিব দা দাঁড়িয়ে। অর্ধযুগেরও বেশি সময় পর দেখলাম সঞ্জিব দাকে। আরো সুন্দর আর পরিণত চেহারা। বুঝলাম সজীব আসেনি। ওনার হাত দুখানা জাপটে ধরলাম। স্বভাবসুলভ আমার মাথায় হাত দিলেন। মায়ের সঙ্গে দেখা করলেন। নিজের হাতে চা বানিয়ে নিজের বাসায়, নিজস্ব ড্রইং রুমে সঞ্জিব দাকে বসালাম। এরই মাঝে চলল কথা।
– এত জেদ তোর?
– তুমিও তো… একটিবার আমায় বলে গেলে না।
– আসলে মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেছিল রে। তোর এত গল্প করতাম তোর বউদির কাছে। তখন দুজনেই প্রাইভেট পড়িয়ে চলি। ওর বাবার দেয়া নেকলেসটা বেচে তোর জন্মদিনের উপহার কিনে দিয়েছিল!
– বাবাকে মাফ করে দিও সঞ্জিব দা। আমাকে বউদির কাছে নিয়ে চলো প্লিজ। আমি তার পা জড়িয়ে ধরে মাফ চাইব।
– সে আজ নেই রে রূপা। সঞ্জিব দার গলাটা ধরে এলো।
– নেই মানে?
– তোদের ওদিক থেকে আসার পর আমার ব্যাংকের চাকরিটা হয়। তোর বউদি তখন অন্তঃসত্ত্বা! বিসিএসে বসবার জন্য খুব জান লড়িয়ে পড়ছে। ভেতর ভেতর এত দুর্বল হয়ে গেছিল, তা ও নিজে বা আমি কেউই খেয়াল করতে পারিনি। বাচ্চাটা হওয়ার পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তোর বউদি মারা যায়।
আমার গলা শুকিয়ে গেছে। আমি যেন স্থবির হয়ে গেছি। বুকের মধ্যে যেন একটা রক্তক্ষরণ বয়ে যেতে লাগল!
বউদি গো! একটা গোংরানি হচ্ছিল নির্বাক-ধূসরে। কিছুটা নীরবতার পর সঞ্জিব দা কথা বললেন।
– আজ যেতে হবে রে বুড়ি, মেয়ে বাসায় একা।
– মেয়ে হয়েছে বুঝি?
একদম তোর বউদির মতো দেখতে আর ওর মতই শান্ত স্বভাবের। আমি কিন্তু এখনও এই শহরে ফিরিনি। আমি ঢাকায় থাকি। ব্র্র্যাঞ্চের কাজে এসেছি। বড়দির বাসায় উঠেছি। কাল ভোরে আমার ফ্লাইট।
– ওর কী নাম রেখেছো?
– তার আগে বল এবার সজীবকে বিয়েটা করে ফেলবি?
এবার হি হি করে হেসে উঠলাম। মাথা ঝাঁকালাম। কথা দিলাম। তোমার আদেশ শিরোধার্য মনে মনে বললাম।
রিকশায় উঠতে যাওয়ার আগে ডাকলেন তিনি।
– রূপা।
– হুঁ।
– আমার মেয়ের নাম।
চমকে উঠলাম! দুজনে দুজনার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম। অজান্তেই দুজনের চোখগুলো রোদ্রে পোড়া বালির মতো চিকচিক করে উঠল!
তারপর আমাদের আর দেখা হয়নি।

মোহাম্মদপুর, ঢাকা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়