৫ জন গ্রেপ্তার : বিমানের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস

আগের সংবাদ

ব্যর্থ মেটার হরাইজন ওয়ার্ল্ডস

পরের সংবাদ

নির্বাচনী বছর এলেই কমে আসে রিজার্ভের ডলার

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : রেমিট্যান্স বাড়ছে, রেকর্ড গড়ছে রপ্তানি আয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে লাগাম টানা হয়েছে আমদানি ব্যয়ে। তবুও কমছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ)। ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট রেকর্ড গড়া ৪ হাজার ৮শ কোটি ডলারের রিজার্ভ এক বছরের মধ্যে এখন ৩ হাজার ৭শ কোটি ডলারের নিচে নেমে এসেছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬৯৭ কোটি ডলার।
বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে পরিমাণে রয়েছে তা থেকে এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) ঋণসহ বিভিন্ন তহবিলে দেয়া ৮শ কোটি ডলার বাদ দিলে দেশের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়াবে প্রায় ২ হাজার ৯শ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে ডলার সংকটের কারণেই ধারাবাহিকভাবে কমছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কিন্তু আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা এ সংকটকে দেখছেন ভিন্ন দৃষ্টিতে। তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভের পতন শুরু হয়। গত ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে এক বছরের ব্যবধানে রির্জাভের পরিমাণ ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি কমেছে। বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় এর ফলে অনেকে বিদেশে টাকা পাচার করে দেন। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বা হুন্ডির মাধ্যমে এসব টাকা পাচার হয়। যে কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ে। আবার অনেকে মনে করছেন, রপ্তানিকৃত পণ্যের সবটাই আমদানিনির্ভর। তাই আয় বাড়লেও তা দৃশমান নয়। ফলে আমাদের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে সবুজ থেকে হলুদে চলে যাচ্ছে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উত্থান-পতন হয়েছে। নির্বাচনের বছরের শুরুর দিকে রিজার্ভ বেড়ে রেকর্ড পরিমাণ উচ্চতা ছুঁয়েছে। এরপর নির্বাচনের কমপক্ষে ৬ মাস আগে থেকে রিজার্ভ কমতে শুরু করে। কোনো কোনো মাসে বাড়লেও পরিমাণে তা খুব কম। নির্বাচনি বা তার আগের মাসে রিজার্ভ কমে যায় বেশ। নির্বাচনের পর আবার বাড়তে শুরু করে। চলতি বছরে নির্বাচনকে সামনে রেখেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ওঠানামা চলছে।
আমদানি কমেছে, রেমিট্যান্স-রপ্তানিতে সুবাতাস বইছে, অথচ এরপরেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কেন কমছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, আমদানি কমলেও অর্থনীতিতে তা খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি এখনো। আনসেটেলড ডেফার্ড বা অনিষ্পত্তি এলসি ছিল অনেক- যা এখন শোধ দিচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ইডিএফ বা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের ঋণ সহজে কেউ শোধ দেয় না। সেগুলো হয়তো পেন্ডিং অবস্থায় আছে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) গতিও শ্লথ দেখা যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, আরো একটি বড় বিষয় হচ্ছে, এখনো হয়তো টাকা-পয়সা পাচার হচ্ছে। আবার যারা রপ্তানি করছে তাদের টাকা হয়তো হোল্ডঅন করে রাখছে। এছাড়া যারা ইডিএফ ফান্ড থেকে টাকা নিয়েছে, তারা হয়তো শোধ করছে না। সবগুলো মিলেই রিজার্ভের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেছে।
নির্বাচনকে ঘিরেও এক ধরনের অস্থিরতায় রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। এ বিষয়ে বলেন, রাজনৈতিক টানাপড়েনও আছে। এছাড়া বৈশ্বিক অস্থিরতায় সবাই চায় একটু নিরাপদ থাকতে। অর্থাৎ টাকা যেখানে আছে সেখানেই থাক। সামনেই নির্বাচন, কী হবে, না হবে। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মুদ্রা পাচার থেকে শুরু করে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং হচ্ছে কি না তা কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। বিগত ইতিহাস অনুযায়ী, নির্বাচনের আগে আগে রিজার্ভ কমার একটি বিষয় থাকে। হতে পারে যারা মনে করছে, এখানে টাকা-পয়সা রাখা রিস্ক, তারা টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে বা রপ্তানিকৃত টাকা দেশে আনছে না।
জানা গেছে, দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব টাকা অর্জিত হয় সেগুলো নির্বাচনী বছরে একটি চক্র বিদেশে পাচার করে দেয়। যে কারণে নির্বাচনী বছরে আমদানি ব্যয় অস্বাভিকভাবে বেড়ে যায়। রপ্তানি আয়ের মূল্য দেশে না আসার প্রবণতাও বাড়ে। একই কারণে কার্ব মার্কেটে ডলারের দামে বড় ধরনের ওঠানামা হয়। এ জন্য ২০১৮ সালে ডিসেম্বরের শুরুতে কার্ব মার্কেটের প্রতি ডলার ৮৭ টাকা ছুঁয়ে যায়- যা এর আগের বছরেও ছিল ৮১-৮১ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩১৭ কোটি ডলার। ৩১ অক্টোবর তা কমে ৩ হাজার ২০৮ কোটিতে নেমে যায়। প্রাপ্ত্য তথ্যে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে ১ হাজার ৬২৫ কোটি ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে কমে ১ হাজার ৬১৫ কোটি ডলারে নেমে যায়। অক্টোবরে তা বেড়ে ১ হাজার ৭৩৪ কোটি ডলারে ওঠে। নভেম্বরে ১ হাজার ৭১০ কোটি ডলারে নেমে যায়। ডিসেম্বরে বেড়ে ১ হাজার ৮০৯ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এটি আবার বাড়তে থাকে। ওই মাস শেষে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৮১২ কোটি ডলারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের জুনে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৬১৫ কোটি ডলার। জুলাইয়ে তা কমে হয় ৫৮২ কোটি ডলার, আগস্টে সামান্য বেড়ে ৫৯৬ কোটি ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে তা আবার কমে ৫৮৬ কোটি ডলার নেমে যায়। অক্টোবরে আরো কমে ৫৫৫ কোটি ডলারে এবং নভেম্বরে ৫২৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই মাসে রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ৫৭৯ কোটি ডলারে ওঠে। জানুয়ারিতে কমে ৫৫৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ফেব্রুয়ারিতে তা আবার বেড়ে ৫৯৫ কোটি ডলার ওঠে।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনের আগে-পরেও রিজার্ভে উত্থান-পতন হয়। ২০০১ সালের জুলাইয়ে রিজার্ভ ছিল ১১৪ কোটি ডলার। আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২৫ কোটি ডলারে। সেপ্টেম্বরে কমে ১১৫ কোটি ডলারে নেমে যায়। অক্টোবরে আরো কমে ১০৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। নভেম্বর থেকে রিজার্ভ আবার বাড়তে থাকে। নভেম্বরে হয় ১১১ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে তা আরো বেড়ে ১৩০ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।
নির্বাচন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশ থেকে টাকা পাচারের আশঙ্কা বিভিন্ন মহল থেকে করা হচ্ছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ সঙ্কোচন নীতি গ্রহণ করেছে। কিছুটা আমদানি ব্যয় কমেছে। তবে আমদানি ব্যয়সহ অন্যান্য খাতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বাড়ার কারণে রিজার্ভে গিয়ে চাপ পড়ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ভোরের কাগজকে বলেছেন, সরকারের কৃচ্ছ্রসাধনের পদক্ষেপগুলো সঠিক ছিল। সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে যে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে সেগুলো সঠিক। কিন্তু আমদানি মূল্য যে পরিমাণে বেড়েছে, কৃচ্ছ্রাসাধন সেই পরিমাণ প্রভাব রাখতে পারছে না। এমনকি রেমিট্যান্স আয় এবং রপ্তানি ভালো থাকার পরেও এটা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। তিনি বলেন, আমদানি পণ্যের মূল্য শুধু যে জ¦ালানি, সার বা খাদ্যপণ্যে দেয়া হয়- তাই নয়, রপ্তানির যে টাকা আমরা দেখছি তার প্রায় সবটাই হচ্ছে আমদানিকৃত কাঁচামালের দামের কারণে। তিনি আরো বলেন, প্রকৃত অর্থে আমদানি থেকে নিট আয় খুবই কম। রেমিট্যান্সের আয়ও সেই অর্থে সরকারের না, জনগণের। এজন্য আমরা ক্রমান্বয়ে সবুজ থেকে হলুদে চলে যাচ্ছি।
এ থেকে উত্তরণের পথ কী- জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন জাঁতাকলে আছে। আমি মনে করি, এখনই সময় অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী বিভিন্ন শিল্প গড়ে তোলা এবং আমদানি প্রতিস্থাপন করার ব্যবস্থা করা। ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের আরো বেশি করে প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। তারা যাতে দেশীয় কাঁচামালের ভিত্তিতে পণ্য উৎপাদন করে অভ্যন্তরীণ বাজারকে চাঙা করে তুলতে পারে। সবচেয়ে বড় খাত বলে আমি মনে করি, কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদন। এখানে ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প এবং বিকেন্দ্রায়িত শিল্পায়নের সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি। ড. দেবপ্রিয় বলেন, অস্থিতিশীল ভাগ্যল²ীর থেকে স্থিতিশীল অভ্যন্তরীণ বাজারে মনোযোগ দেয়া উচিত। মানুষের আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। সুতরাং দেশের বাজারে দেশীয় পণ্যকে জনপ্রিয় করা উচিত।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তার নির্ধারিত দামে খাদ্য, জ¦ালানিসহ জরুরি আমদানির জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। আর এজন্যই ক্রমান্বয়ে রিজার্ভ কমছে। ডলার বিক্রি বন্ধ না করলে রিজার্ভ কমতেই থাকবে। তিনি বলেন, বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমেছে, তবে বড় অঙ্কের ঘাটতি এখনো রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে যদি বাজারের দামে ডলার কিনে আমদানিতে ব্যয় করতে বাধ্য করত, তবে হয়তো কিছুটা সমন্বয় করা যেত।
অর্থনীতির এ বিশ্লেষক আরো বলেন, রিজার্ভ ঠিক রাখতে সরকার এখন উভয় সংকটে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কম দামে ডলার বিক্রি না করে বাজার দরে বিক্রি করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আয় বাড়বে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আয় বাড়লে সরকারের ননট্যাক্স রেভিনিউ বাড়বে। অবশ্য এ কারণে সরকারি ব্যয়ও বাড়বে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়