রংপুরে বর্ধিত সভা : তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি

আগের সংবাদ

বিশ্ব খাদ্য দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী : সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ থেকে দেশকে রক্ষায় খাদ্য উৎপাদন বাড়ান

পরের সংবাদ

মধ্যবিত্ত জীবন

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অফিসে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয়ে জামান খন্দকার জুতার ফিতা আটকাচ্ছেন। এমন সময় হকার এসে দরজার কাছে খবরের কাগজ রাখতেই দুজনের চোখে চোখ পড়ে যায়। জামান খন্দকারকে দেখতেই হকার ছাব্বু বলে ওঠে, ‘দেখেন স্যার, পত্রিকায় আইজ কী লিখছে!’
ডান পায়ের জুতার ফিতা আটকানো শেষ করে বাঁয়েরটায় হাত দিয়ে জামান বলেন, ‘কী লিখেছে, ছাব্বু?’
ছাব্বু জামানের থেকে ৫-৭ বছরের ছোট হবে। এ বাসায় ওঠার পর থেকেই সে পত্রিকা দিয়ে যায়। রোজ রোজ কথাবার্তা হওয়ায় দুজনের কথা বলার জড়তা নেই। তাই জামান ছাব্বুকে ‘তুমি’ করেই বলে। আর দেখা হলেই ছাব্বুও কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ জমায়। দুজনই মিশুক গোছের মানুষ। বড় কথা, জামানের গায়ে অফিসের ড্রেস থাকলেও মনে কোনো অহংকারবোধ নেই। সব পেশার মানুষকে তিনি সমান করেই দেখেন বলে হকারের সঙ্গেও তার চমৎকার সখ্যতা।
পত্রিকার পাতা থেকে হকার ছাব্বু গড়গড় করে পড়তে থাকে, ‘ছয় মাসেও মাংস খেতে পারেনি জমির মিঞা।’
এটা কি পত্রিকার কোনো খবর হতে পারে- এই ভেবে জামান জুতার ফিতা আটকানো শেষ করে ছাব্বুর থেকে পত্রিকাটি নিয়ে পুরো সংবাদটা পড়তে থাকেন। করোনাকালের পরের সমাজচিত্র নিয়ে একটা খরব বেরিয়েছে, তারই শিরোনামটা ছাব্বু পড়েছে মাত্র। জামান পড়ছেন আর ছাব্বু পত্রিকার বাণ্ডেল হাতে ধরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। এটা দেখে জামান জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা নিয়ে তোমার এত চিন্তা কেন, ছাব্বু?’
‘স্যার, আমি ওই সাংবাদিককে যদি পাইতাম, তারে আমিও কইতাম, ৫-৬ মাস ধইরা আমার ছোট্ট মেয়েকেও মাংস তো দূরে থাক মাছও দিতে পারি নাই। ছেলেটাও ডায়রিয়া হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। পত্রিকা বিলি করা শেষ হইলে হাসপাতালে যামু।’
হকার ছাব্বুর কথায় জামান একটু মর্মাহত হলেন। তিনি এবার বুঝতে পারলেন পত্রিকায় পদ্মা সেতু উদ্বোধন, সিলেটে ভয়াবহ বন্যা, এসএসসি পরীক্ষা স্থগিতের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ থাকতেও হকার ছাব্বু কেন ওই লাইনটা পড়ে শোনাচ্ছিল তাকে।
অফিসের ব্যাগ কাঁধে তুলে ছাব্বুকে নিয়ে চারতলা থেকে নিচে নামেন জামান খন্দকার। এ বিল্ডিংয়ে পত্রিকা বিলি শেষ হয়েছে কিনা জানার পর ছাব্বুকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ছাব্বু, তোমার ছেলেমেয়ের জন্য মাংস কিনতে কি টাকার খুব দরকার?’
টাকা যে দরকার এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সে কীভাবে বলবে যে, কিছু টাকা পেলে তার মনের ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারত সে। জামান আবারও জিজ্ঞেস করায় সে মাথা নাড়ায়।
জামান খন্দকারও একজন বাবা। তার ঘরে একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। সারাদিন কত কী বায়না করে, সবই পূরণ করেন তিনি। অফিস থেকে ফেরার পথে রোজ রোজ চিকেন বার্গার, চিকেন স্যুপ, বিফ কাচ্চি, পিৎজা, রেজালাসহ আরো কত কী আনেন। তিনি মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরি করেন, তেমনটাও নয়। কিন্তু মেয়ের কোনো ইচ্ছেই যেন অপূরণ না থাকুক, বাবা হিসেবে তিনি এটা আশা করেন।
জামান খন্দকার একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করেন। মাসে খুব বেশি বেতন পান, তাও নয়। বাসা ভাড়া, থাকা-খাওয়ার খরচাপাতি মেটাতেই সব শেষ হয়ে যায়। সঞ্চয় বলতে শুধু চাকরিটাই আছে। গ্রামের বাড়িতে থাকা বৃদ্ধ বাবা-মাকে ভরণপোষণের দায়িত্বটা একা পুরোটা কাঁধে তুলে নিতে পারেননি ১০ বছরের চাকরিজীবনেও। বড় ভাইদের সঙ্গে ভাগবাটোয়ারা করে বাবা-মাকে দেখাশোনা করেন। নিজের ভেতর মানবিকতা থাকলেও মাসের শেষ না হতেই পকেট যখন টাকা শূন্য হয়ে যায়, তখন তিনি আর পেরে ওঠেন না।
করোনাকালে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে, ছেড়েছে কর্মের শহরও। জামান খন্দকার পরিশ্রমী হওয়ায় কোম্পানি তাকে ছাঁটাই না করলেও বেতন কমিয়ে রেখেছে। কবে যে এই বেতন আবার বাড়বে, তার জানা নেই। কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে কোন মুখে যে বেতনটা বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলবে? বলতে গিয়ে যদি চাকরিটাই চলে যায়, তবে যে তাকে পথে বসতে হবে। মাঝে মাঝে তিনি শহর ছেড়ে চলে যেতে চান, কিন্তু ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সেই ভাবনাটা ভাবনাই থেকে যায়। মেয়েটা শহরে বড় হবে, মানুষের মতো মানুষ হবে, এটা চান জামান খন্দকার।
চাল, ডাল, মাংস, তেল থেকে শুরু করে বাস, রিকশা ভাড়া পর্যন্ত বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। সন্ধ্যায় অফিস থেকে এসে খবরের কাগজে এসব খবরই পড়তে হয় জামানকে, যে খবরের কাগজের দামও বেড়েছে দুই টাকা। আগে ছিল ১০, আর এখন ১২। কিন্তু মানুষের যে দাম বাড়েনি, বাড়েনি মূল্যবোধের দামও, সে নিয়ে দামি দামি পত্রিকায় এক কলমও লেখা হয় না!
ছাব্বুুর মাথা নাড়ানো দেখে গেট বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে জামান তার পকেটে হাত দেন, মানিব্যাগ বের করেন। না, মানিব্যাগে ঢের টাকা নেই। ১০০ টাকার মতো আছে, যা তার আসা-যাওয়ার বাস ভাড়া। বাসা থেকে ১০ মিনিট হেঁটে রেলগেট পার হয়ে পাবলিক বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিসে যাবেন তিনি।
হকার ছাব্বুর ছেলেমেয়ে মাংস খেতে চেয়েছে, জামানের থেকে চেয়েও বসেছে, এখন যদি জামান তার দিকে একটু হাত না বাড়ায়, তখন সে তো নির্ঘাত গালি দিয়ে বসবে, ‘শালা ছ্যাঁচড়া চাকরিজীবী, টাকা দিবার পারব না, হে আবার আমারে জিগায় মাংস কিনতে টাকা লাগব নাকি?’
গরিবের আবার এই এক স্বভাব, কেউ দিলে খুব খুশি হয়ে মাথায় তুলে স্যার স্যার করে। আর না দিলে মুখে যত প্রকারের গালি আসে, তা অপ্রকাশ্যে পাঠ করতে থাকে।
মানিব্যাগে যেহেতু টাকা নেই, তাই উপায় এখন এটিএম বুথে গিয়ে টাকা তোলা। ছাব্বুকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকের দিকে হাঁটতে থাকেন জামান। পত্রিকার বাণ্ডেল হাতে নিয়ে ছাব্বুও খুশিতে আগাতে থাকে। তার যে আরো বাসায় পত্রিকা বিলি করতে হবে, সেটা সে একদম ভুলে গেছে।
ছাব্বুকে দাঁড় করিয়ে রেখে জামান এটিএম বুথে ঢোকেন। একটু পর বের হয়ে এসে ছাব্বুকে ৫০০ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুমি এইটা দিয়ে মাছ কিনে নিয়ে যাও।’
ছাব্বু টাকাটা হাতে নেয়। কিন্তু একটু আগের হাসির রেখাটা তার মুখে নেই আর। সে তো তার ছেলেমেয়েকে মাংস খাওয়াতে চায়, মাছ না। এই টাকায় তো মাংস হবে না। ছাব্বুর মন ভরে নাই এই টাকায়, এটা জামানের বুঝতে কোনোমতেই দেরি হয় না। ছাব্বু টাকাটা নিয়ে চলে যাওয়ার সময় জামান পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলেন, ‘এই ছাব্বু, দাঁড়াও।’ এটা বলে তিনি আবারো এটিএম বুথে ঢোকেন। একটু পর আরেকটা ৫০০ টাকার নোট এনে দিয়ে বলেন, ‘এই নাও, এক হাজার হলো। মাংস কিনো এবার।’
এবার তো ছাব্বুর মুখে গগণচুম্বী হাসি। মনের কোণে একমুহূর্তে জমানো আষাঢ়ের কালো মেঘ কেটে যায়। কৃতজ্ঞতার স্বরে জামানকে বলে, ‘হয় স্যার, এইবার হইব, এক কেজি মাংস হইব। এক কেজি মাংস ৭৫০ আর তেল, পেঁয়াজ, আলু, সব মিলা এক হাজার টাকায় হইব, স্যার।’
‘সব কিছু কিনো কিন্তু। তোমার ইচ্ছে পূরণ হোক।’
‘হয় স্যার, কিনমু। আমার ছেলেমেয়ে কবে থেইক্যা মাংস খায় না। ওরা আইজ বহুত খুশি হইব। স্যার, আপনিও দাওয়াত লন।’
ছাব্বুর পিঠে আলতো থাবা দিয়ে জামান একটা রিকশায় উঠে পড়েন। যে মানুষ প্রতিদিন রেলগেট পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে যান, ২০ টাকা রিকশা ভাড়া বাঁচান, হঠাৎ করেই তিনি রিকশায় উঠে পড়েছেন। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন। পাশে রিকশা দাঁড়ানো ছিল বলে সেই আবেগটা আর ধরে রাখতে পারেননি।
রিকশা আগাতে থাকে। জামান খন্দকার ভাবতে থাকেন, নি¤œবিত্ত মানুষ না হয় মুখ ফুটে চাইতে পারে, বলতে পারে তাদের পেটের ক্ষুধার কথা; কিন্তু আমরা?
:: আশকোনা, উত্তরা, ঢাকা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়