জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় : মাস্টার্স শেষ পর্ব পরীক্ষার ফল প্রকাশ

আগের সংবাদ

ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে দুর্ভোগ

পরের সংবাদ

অ্যাসাইনমেন্ট

প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তুলি স্বাধীনচেতা হলেও অবাধ্য ছিল না কোনোদিন। তাই মা যখন বারণ করছিল এই চাকরিটা নিতে তখন ও দু-একদিনের জন্য একটু থমকে গিয়েছিল। কিন্তু বাবা বলল যে, এই চাকরিটা শুধু চাকরি নয়, এর মধ্য দিয়ে একটা নতুন জীবন অভিজ্ঞতা হবে, তাই যাওয়াই উচিত। বাবার কথায় অনেকটা জোর পেল তুলি। আসলে বরাবরই ও একটু নিজের বাইরে গিয়ে ভাবতে বা দাঁড়াতে ভালোবাসে। বাবা-মা দুজনেই চাকরিতে ব্যস্ত আর সিঙ্গল চাইল্ড হিসেবে অনেকটা একা-একাই বেড়ে উঠেছে বলে, ওর ভিতরে একটা লোক-পিপাসা কাজ করত, বাড়িতে অনেক মানুষ এলে, বা কখনো সখনো অন্যদের বাড়িতে গেলেও যেটা খুশির ভিতর দিয়ে ফুটে বেরোত।
কিন্তু এসব তো একটু আগের কথা। ১০ বছর ধরে মানুষ মানুষের বাড়ি যাওয়া কমিয়ে দিল টিভি সিরিয়াল দেখা মিস হয়ে যাবে বলে আর কারো বাড়িতে হঠাৎ গিয়ে পড়লে সে যতদূর সম্ভব বিরক্তি গোপন করার চেষ্টায় বলতে লাগল, ‘এই আজকের এপিসোডটা একদম মিস করা যাবে না জানো তো’। তো এই পরিস্থিতিতে তুলির ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার’ প্রকল্প ভয়ংকর ধাক্কা খেল বলেই কিছুটা নিজের ভিতরে গুটিয়ে গেল ও। কিন্তু গুটিয়ে গেলেও সারাদিন যারা ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে মুখ ডুবিয়ে রাখে তাদের দলে ভিড়িয়ে দিতে পারল না নিজেকে। উলটে খুঁজতে লাগল, এমন কিছু যাতে অনেক মানুষের মধ্যে গিয়ে পড়া যায়। সেই তাড়না থেকেই ইউনিভার্সিটিতে ঢুকতে না ঢুকতেই রাজনীতিতে যোগ দিল তুলি। মা প্রথমে ভেবেছিল যে গার্লস কলেজের একঘেয়েমি কাটাতে তুলি বোধহয় একটু বেশি ছেলেদের সঙ্গে বন্ধু পাতাতে চাইছে কিন্তু বাবা ঠিক আন্দাজ করেছিল তুলির ক্রাইসিসটা। ‘একা কিংবা আমাদের মধ্যে থাকলেও ও ভীষণ লোনলি ফিল করে। অনেক গলার আওয়াজ শুনলেই তোমার মেয়ের মনে ড্রামস আর গিটার বেজে ওঠে। এটা বুঝতে হবে আমাদের’। বাবা একদিন মাকে বলছিল। তুলি শুনতে পেয়ে গিয়েছিল। আর শোনার পর থেকেই ওর খুব গর্ব হয়েছিল নিজের বাবার জন্য। তাই বাবা যখন একদিন গল্পচ্ছলেই তুলিকে বলল যে, শুধু মানুষ চিনলেই হবে না, দেশটাকেও চিনতে হবে, তখন কথাটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে নিল তুলি।
ততদিনে রাজনীতির ব্যাপারে একটু ক্লান্তি এসেছে তুলির। সেই ক্লান্তির কারণ চারপাশের অনেকেই ভিড়ের ভিতরে থাকলেও সারাক্ষণ নিজের কথাই ভাবতে ব্যস্ত, এটা ওর নজরে পড়ে গেছে। যাদের জন্য পড়ল, কৃত্তিকা তাদের মধ্যে একজন। একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে একটা লম্বা সিগারেট ধরিয়ে ও সম্বিত এবং মালবিকাকে প্রায় অর্ডার দেবার ঢঙে বলল যে, আগেরদিনের মিছিলে ওর ছবিগুলো যেন ওকে না দেখিয়ে আপলোড না করা হয়।
-মিছিল হয়ে গেছে, ওয়ার্ক ডান, এখন কোন ছবি ফেসবুকে দেবে না দেবে, কী আসে যায় তাতে? সাদা মনে জিজ্ঞেস করেছিল তুলি।
কৃত্তিকা বড় করে ধোঁয়া ছেড়ে জবাব দিয়েছিল, অনেককিছু। ফেসবুকে ছবি আপলোড করার ব্যাপারে আমি একটু কশাস। আর তোকেও সেটাই হতে বলব। কোন ছবি যে কবে কোন দুর্দান্ত এনআরআইর চোখে পড়ে যাবে, ইউ নেভার নো।
তুলি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়েছিল কৃত্তিকার দিকে। কিছু বলতে পারেনি।
কৃত্তিকাই চোখ মটকে জিজ্ঞেস করেছিল, কী বুঝছিস?
-তুই কি ফেসবুকে পাত্র খুঁজিস? তাহলে তন্ময়দার সঙ্গে তোর রিলেশনটা
কৃত্তিকা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেছিল, তন্ময় আমার পার্টনার। সব পার্টনার যে লাইফ পার্টনার হবে, এমন কথা তো নেই।
-স্টিল, একটা সম্পর্কে থাকতে থাকতে
-আবে, রাজনীতি তো সেটাই শেখায়। গ্রাম পঞ্চায়েতে ক্ষমতা দখলের পর পার্টি ভাবে জেলা-পরিষদ কীভাবে দখল করবে, জেলা-পরিষদ পেয়ে গেলে বিধানসভা আর বিধানসভায় জিতে গেলে লোকসভা দখলের ছক করাটাকেই তো পলিটিক্স বলে। তাহলে লাইফের পলিটিক্সটা অন্যরকম হবে কী করে?
তুলি কোনো উত্তর দেয়নি কথাটার। কিন্তু মানতেও পারেনি মন থেকে। আর পারেনি বলেই ওদের সংগঠনের দু-একজনের কাছে বলে ফেলেছিল। সেই বলাই হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে ঠিক কানে গিয়ে ওঠে কৃত্তিকার। আর তারপরই চুকলি করেছে সেই অভিযোগে তুলিকে সর্বসমক্ষে অপমান করতে শুরু করে কৃত্তিকা, খোঁচা দিয়ে কথা বলতে শুরু করে দেখলেই। তখন কেউ তুলির হয়ে একটাও কথা বলেনি, অতনু ছাড়া।
অতনু ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট কিন্তু লম্বা চুল গার্ডার দিয়ে বেঁধে রাখে আর গিটার হাতে বেসুরে গান গেয়ে ওঠে বলে, পাক্কা কেরিয়ারিস্টরা ওকে নিজেদের দলে নেয়নি। ওদিকে ছেঁদো বিপ্লবীরা আবার ওর রেজাল্ট দেখে কাছে ভিড়তে একটু অস্বস্তি বোধ করে। কিন্তু অতনু কথায়, আড্ডায়, সিগারেটে গাঁজা মিশিয়ে কাউন্টার দেয়া ও নেয়ার আন্তরিকতায় বেশ একটা জনপ্রিয়তার বৃত্ত তৈরি করে ফেলেছিল নিজের চারপাশে। তাই ও যখন প্রতিবাদ করে উঠল, কৃত্তিকার তুলির প্রতি দুর্ব্যবহারের তখন অল্পস্বল্প সাড়া পড়ল। তবে জল বেশিদূর গড়াল না। ছাত্র সংসদের নির্বাচনে সেই কৃত্তিকাকেই দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো প্রার্থী হিসেবে। আর তুলিকে আলাদা করে ডেকে এক হাফ-নেতা বোঝাল যে ক্যান্ডিডেট বাছাই করার সময় গø্যামার ফ্যাক্টরটাও মাথায় রাখতে হয়।
সেদিন বাড়ি ফিরে কেঁদে ফেলেছিল তুলি। দাঁড় করানো হয়নি তার জন্য খুব সামান্যই খারাপ লেগেছিল ওর কিন্তু মুখে বিপ্লবী বুলি আওড়ানো একটা অর্গানাইজেশনও প্রার্থী দেবার সময় কার কীরকম, ‘লুকস’ সেটা বিচার করে, এটা জেনে কষ্ট হয়েছিল ওর। তখনই পিছন থেকে এসে বাবা ওর কাঁধ দুটো ধরে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল তুলিকে আর বলেছিল, ‘এই মুখটার জন্য আমার মেয়েকে অনেকে চিনুক, আমি চাই না। আমি চাই তোর কাজের জন্য তোকে সবাই চিনুক’।
কাজ করতে চাওয়া এক, আর কাজ করে উঠতে পারা অন্য ব্যাপার। কারণ কাজ করতে গেলেই পদে পদে বাধা আর ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয় সেটার একটা আন্দাজ ততদিনে তুলি পেয়ে গেছে। এত যদি ভণ্ডামি দেশের লোকদের মধ্যে তাহলে এই দেশের ভালো হবে কী করে? তুলি বাবাকেই করেছিল প্রশ্নটা।
-দেশের লোক বলতে কি তোর ইউনিভার্সিটির কয়েকটা ছেলেমেয়ে না কয়েকজন প্রফেসর? মে মাসের গরমে রাস্তায় বেরিয়ে যে রিকশাটায় চাপিস, সেটা যে চালায় সেও কিন্তু তোর দেশ। তাকে পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে দেখিস, সে নিজের পাওনা কুড়ি টাকা নিয়ে বাকি টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবে তোকে। বাবা উত্তর দিয়েছিল।
সেই উত্তরটাই তুলির মাথায় বাজছিল যখন স্কাইপে ইন্টারভিউ নেয়ার দুদিন বাদেই দিল্লির এনজিওটা জানিয়ে দিল যে তুলিকে সিলেক্ট করা হয়েছে। মাইনে বেশ ভালো কিন্তু চাকরির শর্ত অনুযায়ী তুলিকে কখনো ছত্তিসগড়, কখনো ঝাড়খণ্ড, কখনো বা ওড়িশার গ্রামে থাকতে হবে, চাকরির প্রথম দুবছর। পরীক্ষা শেষ আর সত্যি-সত্যিই তুলির এমফিল বা পিএইচডি করে একাডেমিক্সে থাকার ইচ্ছে নেই। তাই ‘বাড়ি থেকে দূরে’ আর ‘জায়গাটা কেমন হবে’র বাইরে তেমন কিছু ভাবনার ছিল না। সেই ভাবনাকে একপাশে সরিয়ে তুলি যেদিন রওনা দিল সেদিন মায়ের পাশাপাশি, বাবারও চোখে জল। হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়তে যে বলে, সেও চায় না নিজের খুব কাছের মানুষটা সত্যিই ঝাঁপিয়ে পড়ুক।
কিন্তু তুলির মনে তখন পিছুটানের চাইতে বড় একটা ভালোলাগা, উত্তেজনার চেহারা নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। ট্রেন যখন মধ্যভারতের একটা অখ্যাত স্টেশনে থামল আর সুটকেস এবং ব্যাগ নিয়ে তুলি প্রায় লাফিয়ে নামল প্ল্যাটফর্মে, তখন ছাগল হাতে কিংবা মাথায় কাঠকুটোর বোঝা নিয়ে কয়েকজনকে দেখতে পেল স্টেশনে। সামনের ঢেউ খেলানো টিনের শেডে বিকেলের মায়াবী রোদ্দুর এক্কা-দোক্কা খেলছে তখন। তুলির মনে হল, ফেসবুক বা টুইটারের বানানো পৃথিবী থেকে ও একটা রক্ত-মাংসের ভূখণ্ডে পা রেখেছে। এই তো ভারত। এটাই তো তুলির জন্মসূত্রে পাওয়া পৃথিবী।

দুই.
দুমাসের মধ্যে আশপাশের কুড়ি-পঁচিশটা গ্রাম একদম হাতের তালুর মতো চেনা হয়ে গেল তুলির। ওদের এনজিওর অফিস যেখানে, সেটা কিছুটা হলেও গঞ্জ। চারদিকের গ্রামের মানুষরা বড় কিছু কেনাকাটা করতে সেখানেই আসেন। আসেন ডাক্তার দেখাতেও। যদিও আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলোয় এখনো টোটকার উপরেই বাঁচামরা নির্ভর করে শতকরা নব্বইজনের তবু ভাবনা পাল্টাচ্ছে। আর তার সঙ্গে-সঙ্গে পরিস্থিতিও। সেই বদলের পিছনে মানুষের যেমন, তেমনি রাষ্ট্রেরও ভূমিকা রয়েছে। তেমনটাই মনে হচ্ছিল তুলির। ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন ওর মাথার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল, রাষ্ট্র এমন একটা রাক্ষস যে বড়-বড় দাঁত বের করে চিবিয়ে খায়। কিন্তু এখানে এসে ও যখন ওদের এনজিওর দেয়া ওষুধ নিয়ে কুড়ি বেডের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে শুরু করল, ডাক্তার-নার্সদের সামনে থেকে কাজ করতে দেখল, বিভিন্ন সরকারি যোজনা থেকে গরিব মানুষকে চাল-গম পেতে দেখল সরাসরি, ওর ধারণা পাল্টাতে শুরু করল। হ্যাঁ, অনেক গাফিলতি আছে, পদে পদে চুরি-ডাকাতি আছে কিন্তু দেশ হিসেবে ভারত তার নাগরিকদের জন্য কিছু করেনি, এটা যারা বলে তারা ডাহা মিথ্যে বলে।
-তাহলে ধরে নে আমি মিথ্যে বলছি। হাতে খৈনি ডলতে ডলতে বলে উঠল অতনু।
বহুদিন বাড়ির, পাড়ার এমনকি শহরের কাউকে দেখতে পায়নি, এমন অবস্থায় অতনুকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল তুলি। ওকে কীভাবে আপ্যায়ন করবে, ভেবে ঠিক করতে পারছিল না। অতনুই ওকে শান্ত করে জানাল যে ও এখানে থাকতে এসেছে, তুলির সঙ্গে এখন ওর প্রায়দিনই দেখা হবে।
সেই দেখাটাই একটা ঝগড়ার চেহারা নিত যখন অতনু বলে উঠত, তুই এসেছিস পয়সাওলাদের হয়ে কাজ করতে, তারা তোকে পয়সা দিচ্ছে। আর আমি এসেছি দেশের সবচেয়ে গরিব মানুষগুলোকে বাঁচাতে।
-গরিব লোকগুলোকে আমরা বাঁচাচ্ছি না? সকাল-সন্ধে ছুটছি, এক-একদিন ভোরে বেরিয়ে দূরের গ্রামে যাচ্ছি, স্যানিটাইজেশন থেকে পরিবেশ রক্ষা সবকিছু নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বকছি, সরকারি মহলে চিঠিচাপাটি করছি অনবরত, আদিবাসী বাচ্চাদের ভ্যাকসিন দিচ্ছি, তারপরও তুমি…
অতনু তুলির কথার মধ্যেই গেয়ে উঠল, ‘সর্প হইয়া দংশন করো গুরু, ওঝা হইয়া ঝাড়ো’… তারপর গান থামিয়ে বলল, কীসের থেকে ভ্যাকসিন দিচ্ছিস? রাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তোরা এসেছিস ওদের জীবনযাত্রা ধ্বংস করতে। পারলে তোর দেশের সরকারকে একটা ভ্যাকসিন দে।
-আমার দেশ কি তোমার দেশ নয়?
-না রে তুলি, আমার কোনো দেশ নেই। মানুষ যেখানে অত্যাচারিত সেখানে আমি কোনো দেশের প্রতিনিধি হতে পারি না। আমি জানি, তুই মন দিয়ে কাজ করছিস, তোর ছবি বেরিয়েছে কাগজে…
-আমার ছবি? জানি না তো।
-আমি জানি। এই দ্যাখ! বলেই অতনু একটা হিন্দি খবরের কাগজের ভাঁজ করা পাতা মেলে ধরল তুলির চোখের সামনে। সেখানে তুলি এবং ওদের এনজিওর আরো কয়েকজনের ছবি। নিচে প্রশংসাব্যঞ্জক ক্যাপশন।
-আমি সত্যিই এটার কথা জানতাম না। তুলি বলল।
-কিন্তু জানার পরও গলে যাস না। মনে রাখিস একটা মানুষের ভালো তুই তখনই করতে পারিস যখন তুই তাকে নিজের মতো করে বাঁচতে দিস। তোর ছাঁচে অন্য একটা মানুষকে ঢালাই করলে সে কখনো ভালো থাকতে পারে না।
-তুমি কী বলছ আমার মাথায় ঢুকছে না। তুমি জানো এই অঞ্চলে বসন্ত আসলেই অজস্র লোক আত্মহত্যা করে। শুধু এখানে নয়, ছোট নাগপুর মালভূমির বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বসন্তই আত্মহত্যার মরশুম। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, এরা কি প্রেমে পড়ে সুইসাইড করে নাকি? তারপর দেখলাম, কারণটা অন্য। শীতে গাছের পাতা ঝরে যায় আর গরমের আগে নতুন পাতা প্রাণ পায় না। মধ্যের সময়টায় পাতা কুড়িয়ে বিক্রি করা যাদের জীবিকা তারা সিম্পলি না খেতে পেয়ে মারা যায়। আমরা ওই মানুষগুলোকে তিন মাসের জন্য ভাতা দিতে হবে বলে, সরকারের কাছে রেগুলার দরবার করছি। অন্যায় করছি? একশ বেডের একটা হাসপাতালের স্যাংশন করিয়ে এনেছি ওপরমহল থেকে। খারাপ করেছি? হ্যাঁ, এই কাজগুলো করার জন্য আমি একটা মাইনে পাই, আমার অফিস থেকে, কিন্তু তার জন্য কাজগুলো তো… তুলির গলা ধরে এলো।
-আমি একবারও বলছি না তুই খারাপ কিছু করেছিস। তুই এমন একটা মেয়ে, যে খারাপ কিছু করতেই পারে না কখনও। কিন্তু তুই ভালো ভেবে যা করছিস তার ফল কি সত্যিই ভালো হচ্ছে?
-মানে? তুলি চোখের জল মুছে তাকাল অতনুর দিকে।
-এই যে ঝাঁ-চকচকে রাস্তা হচ্ছে ব্লকের পর ব্লকে এটা কাদের জন্য? বড়লোকরা এখানে এসে বাগানবাড়ি বানাবে, সেখানে রক্ষিতা রাখবে, ক্যাবারে ডান্সার নাচাবে, তার জন্য। কী লাভ হবে এতে গরিব মানুষগুলোর? জঙ্গলটাকে জঙ্গল রাখ, আমায় আমার অতীত ফিরিয়ে দে।
-কিন্তু অতীত মানে তো কেউটের ছোবল খাওয়া লোককে জলপরা দেয়া আর কলেরায় গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়া। স্কুল হবে না, কলেজ হবে না, পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলো উন্নয়নের আলো দেখবে না?
অতনু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তুই তোর নিজের স্বপ্নে এই সর্বহারা মানুষগুলোকে কপি-পেস্ট করতে চাইছিস। পায়ে জুতো-মোজা, মুখে ইংরেজি স্ল্যাং এগুলো তোর-আমার মতো হিপোক্রিট মধ্যবিত্তদের স্বপ্ন হতে পারে, ওদের নয়। কারণ এই লোভ দেখিয়েই ওদের বারবার সর্বস্বান্ত করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান স্টাইলে উন্নয়নের নাম করে জঙ্গলের ধারের প্রত্যেকটা কুঁড়েঘরে পুলিশ ঢুকবে, মিলিটারি ঢুকবে। যেমন সারিঙ্গায় ঢুকেছে।
-ওখানে তো ব্রিজ তৈরি হচ্ছে।
-তোর মাথা। ব্রিজের নাম করে পুরো এলাকাটাকে হাতের মুঠোয় পোরার ছক হচ্ছে।
-কিন্তু নদী তো ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল গতবার। প্রায় ৫০ জনের ওপর লোক মারা গিয়েছিল। অসংখ্য গোরু-ছাগল…
-মরুক। মানুষ মরুক, গোরু মরুক, ফসল নষ্ট হয়ে যাক। প্রকৃতির হাতে ধ্বংস হতে দে, প্রকৃতিই আবার গড়ে তুলবে। বন্যেরা বনে সুন্দর।
-ব্রিলিয়ান্টরা বিদেশে। তুমি ইউএসএ গেলে না কেন? তুলি দুম করে জিজ্ঞাসা করে বসল।
অতনু ১ সেকেন্ড চুপ করে থেকে দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল। তারপর হতভম্ব তুলির সামনে নিজের মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, এই ছবিটা দেখে কিছু বুঝতে পারছিস?
আবছা ছবিটা দেখে বোঝার তেমন কিছু ছিল না, শুধু ছেঁড়া কাপড়, একটা বোতল আর কিছুটা রক্ত ছাড়া। তুলি তাকাল অতনুর দিকে।
-তোর সিআরপিএফ কী করেছে দ্যাখ। জনগণকে মাওবাদীদের থেকে রক্ষা করতে এসেছে ওরা না এখানকার নাবালিকাদের ধর্ষণ করতে? এইরকম অনেকগুলো মেয়ে রেগুলার ধর্ষিতা হবে, যদি না আমরা প্রতিবাদ করে ওদের তাড়াই এখান থেকে।
-ওরা তো ব্রিজ তৈরি করছে যারা তাদের সিকিউরিটি দিতে এসেছে শুনেছি…
-আর যে আদিবাসী মেয়েটা রেপড হয়ে মারা গেল, তার সিকিউরিটির কী হবে তুলি? সেই প্রশ্ন করবি না তুই? শুধু মাইনে পাস বলে তাঁবেদার হয়ে থাকবি?
তুলির সারা গায়ে যেন আগুন জ্বলে উঠল, না থাকব না। তুমি বলো আমায় কী করতে হবে?
-আমায় নেতৃত্ব দিতে হবে। কারণ একটা মেয়ের হয়ে একটা মেয়ে যখন গলা তোলে তখন প্রতিবাদ অন্য মাত্রা পায়। তুই সামনে থাকবি, আমরা তোর পিছনে, তারপর দেখি শয়তান জেতে না আমরা। কিন্তু এসব করতে গিয়ে তোর চাকরির যদি…
-লাথি মারি চাকরিতে। তুলি উঠে দাঁড়াল উত্তেজনায়।
-আমি কি ঝাঁসির রানীকে দেখছি আমার সামনে? তুলির দেখাদেখি উঠে দাঁড়াল অতনু। তারপর তুলির একদম কাছে এগিয়ে এসে নিজের তর্জনীটা বোলাতে শুরু করল তুলির মুখে।
তুলি নিজেকে সামলাতে পারল না আর। জড়িয়ে ধরল অতনুকে।

তিন.
সেই জড়িয়ে ধরার দিনটার ঠিক একবছর একদিন বাদে তুলি এমফিলের ক্লাস করে বেরোনোর সময় ইউনিভার্সিটির ছোট গেটের সামনে দেখতে পেল, অতনুকে। ইতোমধ্যে পৃথিবী নিজের কক্ষপথে ৩৬৬ বার আর সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে একবার ঘুরে এসেছে। আর তুলির জীবন যে কতবার ৩৬০ ডিগ্রি পাক খেয়েছে, তুলি নিজেও ভুলে গেছে। কিন্তু পাক খেতে খেতে যতবার ও চারদিকে তাকিয়েছে, একে-ওকে দেখতে পেলেও অতনুকে দেখতে পায়নি কখনো।
-পাবি কী করে? আমি তো আমেরিকায় ফিরে গেছি তখন। কিন্তু ওখান থেকেও আমি রেগুলার খেয়াল রাখতাম তোকে নিয়ে নেটে কী প্রবল আলোচনা, টিভিতে মাঝে-মাঝেই তোর বাইট। বিশ্বাস কর, ভীষণ ফোন করার ইচ্ছে হতো তোকে, কিন্তু তুই রেগে আছিস ভেবে ফোন করার সাহস পেতাম না। তারপর তো তুই নাম্বারও পালটে ফেললি মোবাইলের। অতনু রেস্তোরাঁয় তুলির মুখোমুখি বসে বলল।
-আমি তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝছি না। অবশ্য তোমার আচরণেরও বুঝিনি। ওভাবে পালিয়ে গেলে কেন?
-পালাইনি। কাজ হয়ে গিয়েছিল বলে চলে গিয়েছিলাম। শোন তুলি, তোকে আজ সবটা পরিষ্কার করে বলার সময় এসেছে। আমি একটা মস্ত মাল্টি-ন্যাশনালে চাকরি করি। আর সেই চাকরির সূত্রেই আমি ওই বানজার জায়গাটায় গিয়েছিলাম। ওখানে মাটির নিচে সোনা আছে। রিয়াল গোল্ড। আমাদের কোম্পানির রিসার্চ টিম সেটা আবিষ্কার করেছে। এবার তোর গভর্নমেন্ট আর তোদের দয়ালু এনজিওরা যদি ওখানে সব জনকল্যাণমূলক প্রোজেক্ট করে তাহলে আমরা নিলামে ওই জমি কিনব কী করে? ভারতের সোনা আমাদের হাতে আসবে কীভাবে? তাই একটা অশান্তি লাগানোর খুব দরকার হয়ে পড়েছিল।
-কী বলছ? তুমি আমাকে ইউজ করেছ? একটা মেয়ে যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিল তাকে…
-এগজ্যাক্টলি। তোর ওই ভালোবাসাটা বুঝতে পেরেছিলাম বলেই তোকে কাজে লাগিয়েছিলাম। তাতে আমার কোম্পানির খরচ অনেক বেঁচে গিয়েছিল।
-মানে?
-একটা মানুষ যখন ভালোবাসে তখন সে একাই একশ হয়ে ওঠে। তার ভিতরে একটা আবেগের বিস্ফোরণ হয় তো। নইলে তুই আর একটা মেয়েকে নিয়ে সিআরপিএফের ক্যাম্পের সামনে চলে গিয়ে হ্যান্ডমাইক হাতে চিৎকার শুরু করতে পারতি? ওরকম অনশনে বসতি? তোকে জবরদস্তি তুলতে আসা পুলিশটার গালে চড় কষিয়ে দিতে পারতি? আমাকে যে কোনো মুহূর্তে স্টেটসে ব্যাক করতে হত বলে আমি কায়দা করে ইনভলভড হতাম না, কিন্তু তোর পুরো কাজকারবারের হদিস রাখতাম বস। তোর প্রথমদিকের ছবিগুলো তো আমিই ভাইরাল করে দিয়েছিলাম, একটা ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে।
-এতটা চিট করলে?
-কে বলল, চিট করলাম? আমার জন্যই তো তুই ফেমাস হলি। চব্বিশবার লোকাল আর ন্যাশনাল টেলিভিশনে দেখানো হল তোকে। তোকে নিয়ে পেপারে আর্টিকল বেরোল।
-আমাকে ফেমাস করবে বলেই কি তুমি মোবাইলে ওই বানানো ছবিটা আমায় দেখিয়েছিলে?
-বানানো ঠিক নয়। মদ খেয়ে একটা ছোট্ট বাওয়াল হয়েছিল ওখানে। একটা মেয়েকে নিয়ে টানাটানিও। আমি শুধু পুলিশকে মিশিয়ে দিয়েছিলাম তার সঙ্গে। তোকে কনভিন্স করার জন্য। লোকে ছবিকে ফটোশপ করে না? আমি আমার কথাগুলোকে একটু ফটোশপ করেছিলাম। আর তার নিট রেজাল্ট কী হয়েছে জানিস? ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট ওই এলাকাটা থেকে নিজের সব প্রোজেক্ট উইথড্র করে নিয়েছে। আরে পুলিশ চৌকি না বসালে প্রোজেক্ট
করবে কী করে? লোকাল চোর-জোচ্চোরগুলো বালি-সিমেন্ট সব দুদিনেই হাওয়া করে দেবে তো। এবার পুরো এরিয়াটা আমাদের হাতে আসা শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা। একঢিলে কতগুলো পাখি মারলাম বল। অতনু চোখ টিপল।
-আমাকেও মেরেছ, পাখিগুলোর সঙ্গে। আমাকে চাকরিটা ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসতে হয়েছে। আমি যে ওরকম কাউকে কিছু না জানিয়ে আন্দোলন শুরু করে দিলাম, সেটা আমার এনজিও অ্যাকসেপ্ট করেনি। আর ওই ঘটনার ফলে এখন নতুন চাকরি পাওয়াও মুশকিল। বিপ্লবীকে কে চাকরি দেবে?
-আরে আমি দেব। পৃথিবীতে সত্যিকারের বিপ্লবীর চাকরি নেই কারণ সব চাকরি আমাদের মতো মিথ্যে বিপ্লবীরা হাতিয়ে নিয়েছে। অতনু হেসে উঠল।
-আমার ঘেন্না হচ্ছে তোমায় দেখলেই। তুলি উঠে দাঁড়াল।
অতনু ওর দুটো হাত ধরে ওকে আবার বসিয়ে বলল, প্লিজ তুলি আমায় ক্ষমা করে দে। তুই বিশ্বাস কর, আমিও তোকে ভালোবাসি। বাসি বলেই তো আবার কলকাতায় এলাম, তোর মুখোমুখি দাঁড়াতে।
-কিন্তু তুমি যা করেছ তারপর…
-ওটা আমার একটা অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। আর তার জন্যেই আজ মেরিল্যান্ডে আমি একটা বাংলো বাড়ি কিনেছি তুলি। মেরিল্যান্ড কোথায় জানিস? ওয়াশিংটনের কাছে। আমার দুটো গাড়ি তুলি। আমি কত হাজার ডলার মাইনে পাই মাসে, তুই জানিস?
-কী করব আমি জেনে?
-সংসার তোকে সামলাতে হলে, তোকে জানতে হবে না তোর বরের রোজগার?
-আবার ব্লাফ দেয়া শুরু করলে?
-না তুলি ব্লাফ নয়। অন গড। তুই আমাকে নিয়ে চল, আমি তোর বাবা-মার সঙ্গে কথা বলব। তোকে সারাক্ষণ মিস করি তুলি। তুই যেরকম অন্ধের মতো আমায় বিশ্বাস করেছিলি, আমি বাকি জীবনটা সেভাবেই তোকে বিশ্বাস করে বাঁচতে চাই। আই ওয়ান্ট ইউ ইন মাই লাইফ তুলি। তুই আমার সঙ্গে, আমার দেশে চল।
-তোমার দেশ? আমেরিকা?
-যে দেশ আমায় কিনতে পারে না, আমার মেধার প্রপার দাম দিতে পারে না, সেটা আমার দেশ হবে কী করে বল তো? হ্যাঁ, আমি সেখানে জন্মেছিলাম, মাঝেমাঝে ঘুরতে বা কোনো কাজে আসতেই পারি…
-এবারো কি কোনো অ্যাসাইনমেন্টে এসেছ? তুলি এই প্রথম হাসল।
-না। এবার তোকে নিয়ে যেতে এসেছি। আমায় ফিরিয়ে দিস না তুলি। আই লাভ ইউ।
-আমিও ভালোবাসি তোমায়। আমি তোমার সঙ্গে মেরিল্যান্ডে যেতেও পারি, বাট…
-আবার, কিন্তু কীসের?
-আমি প্রথমেই তোমাকে বিয়ে করে যেতে পারব না। তোমায় চেনার জন্য আমার একটু সময় দরকার। আমাকে যদি এমনি নিয়ে যেতে পারো, চলো। বাট তোমায় হাজব্যান্ড হিসেবে মানতে আমার একটু সময় লাগবে…
-পাগল আছিস তুই। লোকে বিয়েটাকেই সিকিউরিটি হিসেবে মানে আর তুই লিভ-ইন করতে রাজি অথচ…
-এরকম একটা পাগলকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়াবে কেন?
-এই পাগলটা ছাড়া কি আমি যেখানে পৌঁছেছি সেখানে পৌঁছতে পারতাম? অতনু নিজের তর্জনীটা তুলির ঠোঁটের ওপরে রাখল।
এবারে তুলি একটুও কেঁপে উঠল না।

চার.
টিভিতে আচমকা তুলিকে দেখে যেরকম কারেন্ট খেয়েছিল, প্রায় তার কাছাকাছিই একটা শক খেল তুলির মা, তুলির সিদ্ধান্তের কথা শুনে। আর যে বাবা প্রায় সবসময়ই তুলির সাপোর্টার সেও ঠিক মানতে পারছিল না ব্যাপারটা। কিন্তু তুলি অনড় রইল। আর তুলিকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে শুরু করল অতনু। তুলির সিভি বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে মেল করে, এক জায়গা থেকে অল্প একটু স্কলারশিপও জোগাড় করে ফেলল তুলির জন্য।
-তারপরও তো তোমার অনেক টাকা খরচ হবে আমার জন্য। তুলি ফোনে বলল একদিন।
-টাকা নয় ডলার। কিন্তু ভুলে যাস না, সেগুলো পাওয়ার পিছনে তোর ভূমিকা কতটা। আর একটা কথা। ইন্ডিয়া-ফিন্ডিয়া আমার কাছে ম্যাটার করে না। কিন্তু তুই করিস। সো ইফ ইউ ওয়ান্ট, আমাদের বিয়ে না হওয়া অবধি তোর জন্য হোস্টেল অ্যাকোমোডেশনের ব্যবস্থা করতেই পারি আমি।
তুলি হেসে ফেলল, ইন্ডিয়ার মেয়েরা এখন অনেক অ্যাডভান্সড হয়ে গেছে। আমি তোমার সঙ্গেই থাকব।
তুলির কথা শুনতে পেয়ে ওর পিছনে দাঁড়ানো বাবা অবাক হয়ে গেল। আমেরিকায় বসে অতনুও।
অতনুর অবাক হওয়ার অবশ্য আরো অনেক বাকি ছিল। আমেরিকার পুলিশ যখন ওকে হাতে হ্যান্ডকাফ দিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিজেদের গাড়িতে তুলল, তখনো ঘোর কাটেনি ওর। কিন্তু মিনিমাম দুবছর জেল হবে শুনে ভেঙে পড়ল ও। জিজ্ঞেস করল, আমার অপরাধটা কী?
-একটি মেয়েকে প্রপারলি বিয়ে না করে, হায়ার এডুকেশনের টোপ দিয়ে ইন্ডিয়া থেকে নিয়ে আসা তারপর তাকে দিয়ে নিজের মেইড সারভেন্টের কাজ করানো। একজন পুলিশ অফিসার খুব নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিল ওকে।
-মানে? অতনুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
উত্তরে কথার বদলে কতগুলো ছবি দেখানো হল ওকে। তার কোনোটায় তুলি ওর জুতো পালিশ করছে, কোনোটায় রান্না, কোনোটায় আবার ডিশ-ওয়াশারে না ভরে নিজের হাতেই বাসন মাজছে। আর একটা ছবিতে অতনু তুলির হাত থেকে একটা বই ছিনিয়ে নিচ্ছে।
-আগের ছবিগুলোর কথা জানি না, কিন্তু এই ছবিটার ঘটনা আমার মনে পড়ছে। তুলি রাতদিন ইউএস ল’র সব বই পড়ত। ‘এবার ঘুমিয়ে পড়, আর পড়তে হবে না’ বলে আমি দু-একদিন বই ছিনিয়ে নিতাম ওর থেকে। কিন্তু সেই ছবি তুলি তুলল কী করে? অতনু স্বগোতোক্তি করে উঠল।
-সেটা বলতে পারব না। কিন্তু ভদ্রমহিলা ফেডারাল ল’টা খুব মন দিয়ে পড়েছেন। তোমার বেরনো কঠিন হবে স্যর। ঠাণ্ডা গলায় বলে উঠল সেই পুলিশ অফিসার।
আমেরিকার এক-একটা রাজ্যে এক-একরকম আইন। মেরিল্যান্ডেরটা বোধহয় একটু কড়াই। তাই তিন বছর জেল হয়ে গেল অতনুর। অতনু ভাবছিল, ওকে জেলে পাঠিয়ে তুলি দেশে গিয়ে মুখ দেখাবে কী করে? কিন্তু বিচারক যখন জিজ্ঞেস করলেন যে ও নিজের কোর্সটা কমপ্লিট করতে চায় কি না, তুলি জানাল যে ও নিজের দেশে ফিরতে চায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
পুরো ব্যাপারটাতেই এত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল অতনু যে মুখোমুখি কোর্টরুমে বসেও ও তেমন কিছু বলতে পারেনি তুলিকে। শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিল, এরকমটা করলি কেন?
তুলি সেদিন কোনো জবাব দেয়নি কথাটার। কিন্তু তুলি আমেরিকা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর জেল কর্তৃপক্ষের হাত ঘুরে একটা চিরকুট এসে পৌঁছল অতনুর হাতে।
তাতে একটাই লাইন। বাংলায় লেখা।
‘ভুল বুঝো না প্লিজ। এটা আমার একটা অ্যাসাইনমেন্ট ছিল।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়