বুয়েটে ছাত্রলীগের ব্যানারে সভা, বিক্ষোভ শিক্ষার্থীদের

আগের সংবাদ

উত্তরায় গার্ডার চাপায় নিহত ৫

পরের সংবাদ

শোক থেকে শক্তি : চেতনার মৃত্যু নেই

প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৪, ২০২২ , ১১:২৮ অপরাহ্ণ

১৫ আগস্টের কালরাতে শাহাদতবরণকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ পরিবারের সবার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। সেদিনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে খুনিচক্র দেশের অগ্রগতিকে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সব অর্জনকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। অবৈধপন্থায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সংবিধানের ওপর কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি বিল’ চাপিয়ে খুনিচক্রের দোসর সামরিক সরকার এই ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিল। ২১ বছর সংগ্রাম শেষে ১৯৯৬-এ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন এবং ‘ইনডেমনিটি বিল’ সংবিধান থেকে অপসারণ করে। প্রচলিত আইনে একজন বিচার প্রার্থী বিধানানুযায়ী যে সুবিধাদি পান, সেভাবেই চলে বিচারিক প্রক্রিয়াটি। দীর্ঘ সওয়াল-জবাব শেষে বিজ্ঞ আদালত খুনিদের ফাঁসির রায় ঘোষণা করে। ২০০১-এ বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে বিচারের রায় অকার্যকর ও খুনিচক্রকে রক্ষা করতে নানাবিধ ষড়যন্ত্র করে। এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ রাজপথে-সংসদে সংগ্রাম করে ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে গণরায়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। ফলে খুনিচক্রের দণ্ডাদেশ কার্যকরের পথ অর্গলমুক্ত ও দীর্ঘ ৩৪ বছর পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করে বাঙালির ইতিহাস কলঙ্কমুক্ত হয়। সমগ্র জাতি সেদিন কী হারিয়েছিল তা সামগ্রিকতায় উপলব্ধির দিগন্ত উন্মুক্ত হয়।
বঙ্গবন্ধু সমগ্র জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, বাংলা ও বাঙালির মুক্তির জন্য নিজকে উৎসর্গ করা। এই সাধনার শুরু ’৪৭-এ দেশভাগের পরপরই। ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ এবং ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ গঠন করেন। সেই থেকে ধাপে ধাপে প্রতিটি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব ’৪৮-এর ১১ মার্চে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্বে ’৪৮-এর ১১ মার্চ ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর কাছে থাকার দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী আমি। বঙ্গবন্ধুর কাছেই শুনেছি, তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উপলব্ধি করেছি, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে।’ সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে মহান ভাষা আন্দোলন সংঘটিত করে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে সমগ্র জাতিকে জাতীয় মুক্তির এক মোহনায় দাঁড় করিয়েছেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। কোনোদিন মাথা নত করেননি। আজ তিনি টুঙ্গিপাড়ার কবরে শায়িত। আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না, দরদী কণ্ঠে বাঙালি জাতিকে ডাকবেন না ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে। তাঁর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সোনার বাংলা কায়েম করা। গর্ব করে বলতেন, ‘আমার বাংলাদেশ হবে রূপসী বাংলা, সোনার বাংলা, প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড।’
’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৫৬-এর শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪-এর সাম্প্রদায়িকতা
বিরোধী আন্দোলন এবং ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন- প্রতিটি সংগ্রামেই বঙ্গবন্ধুর একচ্ছত্র নেতৃত্ব। বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখি ’৫৭ সনে, ভোলার সরকারি স্কুল মাঠের উপনির্বাচনী জনসভায়। তখন আমি ৮ম শ্রেণির ছাত্র। ভোলায় অনুষ্ঠিত এক জনসভায় সোহরাওয়ার্দী সাহেব ও বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেছিলেন। আমরা স্কুলের ছাত্ররাও এসেছিলাম প্রিয় নেতার বক্তৃতা শোনার জন্য। কৈশোরের সে অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করার নয়। ’৫০-এর দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ’৬৬-এর ৭ জুন ৬ দফা আন্দোলন চলাকালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী, ইকবাল হল (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। সেদিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটী ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করলে তেজগাঁয় শ্রমিক মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শহীদ হন এবং প্রায় ৮০০ লোককে গ্রেফতার করা হয়। আমাদের স্বাধিকার তথা স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল এদিনটিতে। ’৬৭-এর ১৭ জানুয়ারি ডাকসু’র ভিপি নির্বাচিত হই। তখন ৬ দফা আন্দোলন চলছে, বঙ্গবন্ধু কারাগারে অন্তরীণ। সেদিন রাতে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে গোপন চিঠি পাই। তিনি লিখেছেন, ‘স্নেহের তোফায়েল, তুই ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ায় আমি খুশি হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, এই ডাকসু’র নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি আন্দোলন গড়ে উঠবে। -মুজিব ভাই।’ ’৬৯-এর ১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারি, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি ‘শপথ দিবস’ পালনের পর স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি লাগাতার সংগ্রাম শেষে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম প্রদান করি। অতঃপর ২২ ফেব্রুয়ারি সব রাজবন্দির মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মুক্ত মানব শেখ মুজিবকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা হয়।
’৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা এবং ছাত্রসমাজের ১১ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমাকে জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হই। ’৭০-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভোলায় নির্বাচনী জনসভা। এদিন ভোলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ সমাবেশে বঙ্গবন্ধু আমার গুণবাচক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বক্তৃতা করেন। তিনি নেতাকর্মীদের এভাবেই সম্বোধন করতেন। যখন যে এলাকায় যেতেন সে এলাকার সংগঠক বা নেতাকর্মীকে মহিমান্বিত করে বক্তব্য রাখতেন। নিজে কর্মী থেকে সংগঠক হয়েছেন, সংগঠক থেকে নেতা হয়েছেন, নেতা থেকে জাতীয় নেতা এবং পরিশেষে জাতীয় নেতা থেকে জাতির জনক হয়েছেন। এটি সম্ভব হয়েছে অসংখ্য কর্মীকে তিনি নেতা বানিয়েছেন, অসংখ্য নেতাকে স্থানীয় পর্যায় থেকে উন্নীত করেছেন জাতীয় নেতায়। ফলত সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করে টিকে আছে।
’৭১-এর ৩ জানুয়ারি, রেসকোর্স ময়দানে নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘৬ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। ৬ দফা আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত কবর দেবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ জনগণের জন্যই ছিল তার রাজনীতি ও কর্মসূচি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সেদিন আরো বলেছিলেন, ‘আমাকে মোনায়েম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আইয়ুব খানও পারেনি- কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারি।’ বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশ পাথরের মতো। তাঁর চেতনায় গোটা বাঙালি জাতি নিরস্ত্র থেকে সশস্ত্র হয়ে সচেতনতার এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল যে আমরা স্বপ্ন দেখতাম শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি, পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে রেসকোর্সের গণমহাসমুদ্রে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ অশ্রæসিক্ত বলেছিলেন, ‘কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, তুমি ভুল প্রমাণিত হয়েছো, তোমার কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে…।’ মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতেন প্রিয় মাতৃভূমিকে, বাঙালি জাতিকে। বঙ্গবন্ধু কখনোই মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না। তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল মার্জিত। বঙ্গবন্ধুর সময়ানুবর্তিতা-নিয়মানুবর্তিতা ছিল অসাধারণ। নীতির প্রশ্নে ছিলেন অটল। ’৭৪-এ দলের কাউন্সিলে দলীয় পদ ত্যাগ করে সভাপতির পদটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তদস্থলে আসীন হয়েছিলেন জাতীয় নেতা শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেব। আর ’৫৭-তে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলীয় পদে বহাল করেছিলেন নিজেকে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটি যেমন বুঝতেন; তেমনি কে কোথায় যোগ্যতর আসনে অধিষ্ঠিত হবেন তাকে সে জায়গাটিতে যথাসময়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে ভুল করতেন না মোটেও। বক্তৃতার মাধ্যমে জনসাধারণকে আন্দোলিত করার ঐন্দ্রজালিক ভূমিকার জন্য তাঁকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। এই মহান নেতার সংক্ষিপ্ত অথচ বিপুল কর্মময় জীবনে যে আচরণ কাঠামো প্রতিফলিত হয়, তার মধ্যে ছড়িয়ে আছে হিরন্ময় দ্যুতি ছড়ানো মানবিক কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিমানবিক সব আচরণ বৈশিষ্ট্য। আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল ইতিহাসের এই মহামানবের একান্ত সান্নিধ্যে আসার। আমার জীবন ধন্য। বঙ্গবন্ধুর চেতনা অমর, অবিনাশী- এর মৃত্যু নেই!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়