কিউআর কোডযুক্ত : ২ লাখ রিকশার নিবন্ধন দেবে ডিএনসিসি

আগের সংবাদ

সড়কে যেন অনিয়মই নিয়ম : মালিক-শ্রমিকদের বাধায় আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি

পরের সংবাদ

রবীন্দ্র সাহিত্যে মানবিকতার জাগরণ

প্রকাশিত: আগস্ট ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্র সৃষ্টিজুড়ে মানবিকতা ও মানব কল্যাণবোধ বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। এক্ষেত্রে তার মানসজুড়ে নানামাত্রিক চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। উন্মোচিত হয়েছে নানামাত্রিক দিগন্তের। তবে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল মানবকল্যাণ বা মানবিক জাগরণের সুতীব্র আকাক্সক্ষা। মানবিক জাগরণ ও মানবকল্যাণের আকাক্সক্ষাই তার সব সৃষ্টির নেপথ্য প্রেরণা ও প্রণোদনার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। মানবকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি বহুবিধ পথ অবলম্বন করেছেন। এ ব্যাপারে তার সৃষ্টি, বাস্তব জীবন ও যাপিত জীবনের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের বিপুল সৃষ্টি সৃজনশীলতা ও প্রতিভার কালজয়ী স্বাক্ষরে ভাস্বর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সংগীত, প্রবন্ধ, নাটক, চিত্রকলায় আমরা তা লক্ষ করি। এর বাইরে তার দীর্ঘ জীবনের আলো-ছায়ায় তার বোধ, অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ তার মনন ও সাহিত্য জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। কালের পরিক্রমায় তিনি হয়ে উঠেছেন ঋদ্ধ সাধক। তার জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই ঔপনিবেশিক আমলে অবিভক্ত ভারতে। স্বাধীনতাকামী মানুষের সংগ্রাম তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। নিজেও সরবে-নীরব সমর্থন যুগিয়েছেন। সে সময়ের চলমান স্বাধীনতাকামী নেতাদের সঙ্গে অনেক বিষয়ে তার ভিন্নমত ছিল। তবে মানুষের স্বাধীনতা ও স্বাধিকার প্রশ্ন তিনি ছিলেন অবিচল। এজন্য প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, ঔপনিবেশিক শাসন, উগ্র ধর্মীয়বোধ, সামাজিক শোষণ ও কথিত কৌলিন্যবোধ নানাভাবে তাকে আটকে রাখতে সচেষ্ট ছিল। তবে মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা, মমত্ববোধ তাকে এ সব বাধা অতিক্রমে সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে। তার এসব শুভবোধ বাস্তবায়নে তার প্রবল মানবিকতা, আন্তরিকতা শক্তি ও ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। বাংলা সাহিত্যে তার আধিপত্য, পৈত্রিক জমিদারি, উচ্চবংশীয় আভিজাত্য এবং একজন সাধক হিসাবে মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতাকে তিনি বাহন হিসাবে গ্রহণ করেননি। এখানে রবীন্দ্র মানসের আরেক অনন্য দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ মানবকল্যাণ সাধনের কাজটি যেমন তার সৃষ্টিজুুড়ে ব্যক্ত করেছেন তেমনি বাস্তব কর্মকাণ্ডেও তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। আর এক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা ও প্রয়াস জীবনের যৌবনদীপ্ত দিন থেকে শেষ দিনগুলো পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য রচনায় সাধারণ মানুষের ওপর উচ্চবিত্ত মানুষের অবহেলা ও নির্যাতনের কাহিনী তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি সব সময় মানব হৃদয়কে সাহিত্য ও সৃজনে অনন্ত মঙ্গলালোকে জাগ্রত অভিপ্রায় লালন করতেন। আর তার সেই বোধ ও শুভকামনার প্রতিফলন ঘটেছে তার অনেক লেখায়, অনেক গ্রন্থে। ছোট গল্প, কবিতার পাশাপাশি তিনি সেই চেতনা সরাসরি প্রকাশ করেছেন তার অনেক প্রবন্ধে। তার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘আধুনিক সাহিত্য, ‘সাহিত্য’ গ্রন্থের প্রবন্ধসমূহে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। ‘সাহিত্য স্বরূপ’ গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধসমূহে রবীন্দ্র সাহিত্য মানসের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গে তিনি তার মতামত তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, সাহিত্য ও সৌন্দর্যের সঙ্গে মঙ্গলের একটা গভীর, নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। তার কাছে সাহিত্য হলো মানবাত্মার মুক্তির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়। এ বোধে তাড়িত হয়ে তিনি জীবনব্যাপী তার সৃষ্টি, কর্ম ও ধর্মে তা লালন করেছেন। অনেক গানে তিনি মানব জাগরণ ও চিত্ত পরিশোধনে মানুষকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াশ চালিয়েছেন। ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি’ আমরা মেলেছি আজ মায়ের ডাকে, ও আমার দেশের মাটি, শুধু তোমার বাণী নয় হে বন্ধু হে প্রিয়, এরকম অনেক গানে এ জাগরণের প্রকাশ লক্ষণীয়।
মানুষের সীমাহীন কষ্ট ও দুর্দশাগ্রস্ত জীবন যে অনেকটা সমাজ আরোপিত, তিনি এ বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন। জমিদারগণের নানা ধরনের খাজনা, বাহানা, কৌলিন্যবোধের নানা কর্মকাণ্ড মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট, সীমাহীন দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রবীন্দ্র সাহিত্য, সংগীতে তার প্রতিফলন ঘটে শিল্পের পরিভাষায়। জীবনের বিভিন্ন অনুষঙ্গের পাশাপাশি মানবিকতার জাগরণের বিষয়টিকে তিনি তার সৃষ্টির ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ১৮৯১ সালে দায়িত্ব নিয়ে পতিসরে আসেন জমিদারি দেখভাল করতে। কিন্তু পুণ্যাহ বা কর প্রদান অনুষ্ঠানে আসন ব্যবস্থার বৈষম্য দেখে তিনি ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হন। স্টাফদের প্রবল বিরোধিতার মুখে পুরনো এ কৌলিন্য ব্যবস্থার বদলে সব ধর্মের সব বর্ণের প্রজাদের নিয়ে একসাথে উৎসবে মেতে ওঠেন। মানুষকে তিনি সব সময় বড় করে দেখেছেন। প্রজারা তাকে সম্মান করে হুজুর বা বাবুমশাই বলে সম্বোধন করতেন। সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিক শাসন নানাভাবে শোষণ ও নিগ্রহের বেড়াজালে আবদ্ধ করেছিল। সেটা রাজনৈতিকভাবে যেমন ছিল সামাজিক ও ধর্মীয় আদলে ছিল আরো প্রবল। নিম্নবর্ণের সাধারণ মানুষ এক্ষেত্রে নিগৃহীত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। তা তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। চারদিকের চলমান ঘটনা, নিত্য জীবন যাপনের বহমান ক্ষত মানুষের জীবনকে কত যে দুর্বিষহ করে তোলে তিনি তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেন। সামাজিক শোষণ, সামাজিক বৈষম্যের শেকড় আলগা করার জন্য যে মানসিক উৎকর্ষতার দরকার তা একদিনে সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ তাই গভীরভাবে অনুধাবন করেন যে, যেসব মানুষকে নানা কলাকৌশল, যুক্তি বা ধর্মীয় অপব্যাখ্যার আবরণে দাবিয়ে রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে আত্মজাগরণ ঘটানো জরুরি। আর তার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক চেতনা ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। তিনি পুঁথিগত লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি কর্মমুখী শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তাই বোলপুরে নিজ অর্থে ক্রয়কৃত ২৫ একর জমির ওপর তার অভীক্ষা বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘শ্রীনিকেতন। তিনি বিশ্বাস করতেন এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সবল হয়ে ওঠলে তাদের মধ্যে সচেতনতা, দেশপ্রেম জাগ্রত হবে। তারা রাজনৈতিকভাবেও সংগঠিত হবে।
‘শাস্তি’ গল্পের উদাহরণ তুলে ধরে বলা যায় শ্রেণি শোষণ ও বৈষম্য সাধারণ কথিত নিম্নবর্ণের মানুষের জীবনকে কতটা নিষ্পেষিত করে তোলে তা তিনি অসামান্য কুশলতা ও মানবিক বোধে তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ অনেক নাটকে মানব জীবনের নানা রহসা উন্মোচনের সাথে সমাজসংস্কার ও সমাজ সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ‘বিসর্জন’ নাটকে তিনি প্রথাগত অমূলক রীতিনীতি ও অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস সামাজিক মূল্যবোধকে বিদীর্ণ করে, সমাজকে বিভ্রান্তির পথে চালিত করে তা দেখেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজ বিশ্বাস ও শুভবোধের বিপরীতে কিছুই করতে প্রয়াসী ছিলেন না কখনো। জীবনব্যাপী তিনি তার নিজস্ব বোধ, পর্যবেক্ষণ, পরিশুদ্ধ মননের আবেগ ও অনুরাগে পরিচালিত হয়েছেন। বিধবা বিবাহের পক্ষে ছিলেন সোচ্চার। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার এ ক্ষত নিরাময়ে কাজ করেছেন। যেমন করেছেন বিদ্যাসাগরের মতো মহান মনীষী। তাই বিধবা বিবাহের প্রচলনকে গ্রহণযোগ্য ও জোরদারে নিজ পুত্র রথীন্দ্রনাথের সাথে গগেন্দ্রনাথের বোন বিনয়িনী দেবীর বিধবা কন্যা প্রতিমা দেবীর বিয়ে দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সমবায় ভিত্তিক কৃষি আন্দোলনের পুরোধা। মানবিক উন্নয়ন ও জাগরণের লক্ষ্যে তিনি শিলাইদহ ও পতিসরে দুটি কৃষিব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯১৩ সালে নোবলে পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থ মূলধন হিসেবে পতিসরের ব্যাংকে মূলধন হিসেবে জমা দেন। উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের মধ্যে সুদমুক্ত ঋণ চালু করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য, শিল্প, সংস্কার ও উদ্ভাবনের নানা পথে, নানাভাবে মানব মুক্তি ও মানব জাগরণের কাজ করেছেন। তার গভীর, অতল, প্রসারিত জীবনস্পর্শী কর্মকাণ্ড কাল থেকে মহাকালের পাথেয় হয়ে আছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়