কাদেরের প্রশ্ন : আগামী নির্বাচনে বিএনপির ইমাম হবেন কে

আগের সংবাদ

জীবনযাত্রায় চাপ বাড়বে, সর্বত্র ক্ষোভ : অসহনীয় হবে মূল্যস্ফীতি > উত্তাপ ছড়াবে নিত্যপণ্যের বাজার > ব্যাহত হবে শিল্প উৎপাদন > বেড়ে গেল কৃষকের উৎপাদন ব্যয় > খরচ বাড়বে আমদানি-রপ্তানির

পরের সংবাদ

সড়কে যেন অনিয়মই নিয়ম : মালিক-শ্রমিকদের বাধায় আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি

প্রকাশিত: আগস্ট ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৬, ২০২২ , ২:৩৭ পূর্বাহ্ণ

দেব দুলাল মিত্র : নিরাপদ সড়কের দাবি, সড়ক পরিবহন আইনের বাস্তবায়ন, সুষ্ঠু সড়ক ও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনা অধরাই রয়ে গেল। চার বছরেও সড়ক আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। আগের মতোই সড়ক-মহাসড়কে চলছে নৈরাজ্য। প্রতিদিনই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মানুষ। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যু মিছিল। যানবাহনের চালকরা আগের মতোই বেপরোয়া। এখনো বন্ধ হয়নি বাসের গেট। যাত্রী ওঠানামা করানো হচ্ছে আগের মতোই। যানবাহন চালক ও পথচারী- কেউই আইনের তোয়াক্কা করেন না। হেলমেট ছাড়াই সড়ক দাপিয়ে বেড়ান মোটরসাইকেল চালকরা। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনকে ঘিরে সড়ক ও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় যে পরিবর্তনের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা করা হয়েছিল, ক্রমেই তা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া পাঁচ দফা সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে শিক্ষার্থীদের দেয়া ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান শুধু স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। সড়কে-যানবাহনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। দেশে বড় ধরনের কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে অথবা কোনো দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে আলোচনার ঝড় উঠলে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তৎপরতা দেখা যায়। নানা প্রতিশ্রæতি আসে, তদন্ত কমিটি গঠন হয়, সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। কিছু দিন পর সব উদ্যোগ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। ফলে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে, অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
সড়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছরের ৬২ শতাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হচ্ছে যানবাহন চালকদের বেপরোয়া আচরণ ও গতি। রাজধানীর সড়কেও চালকদের এ আচরণের কারণে প্রায় প্রতিদিনই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া চালকদের অদক্ষতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সরকারি সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি, গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের অসচেতনতার কারণে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। প্রতি মাসে সারাদেশে গড়ে পাঁচ শতাধিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় ছয় শতাধিক নিহত ও এক হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। সড়কের অনিয়ম প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সদস্যরা সব কিছু দেখেও না দেখার অভিনয় করে চলছেন। কিছু কিছু অনিয়মকারীকে জরিমানা করেই তারা দায়িত্ব শেষ করেন, শৃঙ্খলা ফেরাতে আইনের কঠোর প্রয়োগ করেন না।
সড়কে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের আন্তরিকতার অভাবেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না। পুরনো সড়ক ব্যবস্থাপনা বহাল রেখে শৃঙ্খলা ফেরানো যায় না। যত দিন না গণপরিবহন ‘ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক’ পরিবহন ব্যবস্থার আওতায় না আসবে, তত দিন গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে না। চালকদের ‘বেপরোয়া’ আচরণও থাকবে। সড়ক পরিবহন আইন পুরোপুরি এবং কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ দ্রুততার সঙ্গে সংসদে পাস করে। দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল নতুন আইনের ফলে দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইনটির পুরোপুরি বাস্তবায়নই হয়নি। এতে সরকার এবং রাষ্ট্রের সদিচ্ছার অভাবই দৃশ্যমান হয়েছে। সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। শুধু জনসচেতনতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। সব সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার টাস্কফোর্স গঠন করে। এখনো সেই সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি। এই অবস্থায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো অধরাই থেকে যাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং সেফ রোড এন্ড ট্রান্সপোর্ট এলায়েন্সের (শ্রোতা) সভাপতি ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সড়কে নিরাপত্তহীনতা দেশের একটি অন্যতম মানবিক বিপর্যয়। সড়ক ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা রয়েছে। ইতিবাচক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনপরিষেবা খাতকে সুষ্ঠুভাবে গুরুত্বের জায়গায় নিতে হবে। এখানে সেই উদ্যোগ নেই। জনস্বার্থের বিপরীতে গোষ্ঠীস্বার্থ রাজনৈতিক আনুকূল্য পাওয়ায় পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরছে না।
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। আইন মানার ব্যাপারে সড়ক ব্যবহারকারী যাত্রী, চালক, পথচারী সবাইকে সচেতন হতে হবে। শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নগরীর দেড় কোটি মানুষকে পুলিশ জোর করে শৃঙ্খলায় আনতে পারবে না। মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এখন সড়কের অবস্থাও ভালো নয়। তবে এসব কাজ শেষ হলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় উন্নতি আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সব সরকারের আমলেই আদর্শহীন রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের কাছে দেশের সড়ক ও সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা হয়ে আছে। সড়কে অব্যবস্থাপনার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। তাদের বাধার মুখে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ কাটছাঁট হয়েছে। আইনের জামিন অযোগ্য ধারা, দুর্ঘটনা-অনিয়মে সাজা ও জরিমানা বাড়ানোর বিধান থাকায় পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা প্রথম থেকেই আইনটি বাস্তবায়নে আপত্তি তোলেন। তাদের দাবি মানা না হলে ধর্মঘটের মাধ্যমে মানুষকে জিম্মি করার হুমকিও দিয়েছেন। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরলে এই সেক্টরের চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। ‘যত বেশি অব্যবস্থাপনা-নৈরাজ্য, তত বেশি চাঁদা আদায় হয়’- এটাই তাদের কৌশল।
রাজধানীসহ সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা। রাজধানীর সড়কে গণপরিবহন আবারো বেপরোয়া। চলতি অবস্থায় গেট বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও চালকরা তা মানছেন না। ইচ্ছামতো রাস্তার যে কোনো স্থানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠানো ও নামানো অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। গাড়ির সামনে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপি ও ছবিসহ পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। মোটরসাইকেল চালকরা হেলমেট ছাড়া এবং তিনজন একত্রে চলাচল করছেন। উল্টো পথেও রিকশা, গাড়ি, মোটরসাইকেল চলছে। অসচেতন পথচারীরা ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করে, হাত তুলে গাড়ি থামিয়ে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার হচ্ছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, মগবাজার, বাংলামোটর, কারওয়ানবাজার, শাহবাগ, এলিফ্যান্টরোডসহ সব বাসস্ট্যান্ডে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে।
অন্যদিকে মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত ধীরগতির ইজিবাইক, অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু, মাহিন্দ্র, বোরাক, টমটম, চান্দের গাড়ি নামক অবৈধ যানবাহন আইনের তোয়াক্কা না করেই চলছে। অতিসম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে রেলক্রসিংয়ে শিক্ষার্থীদের মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় ১২ শিক্ষার্থী নিহত ও আরো পাঁচজন আহত হয়। এখানে মাইক্রোচালকের অসতর্কতার তথ্য রয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ২৮৪ জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জনই শিক্ষার্থী। অর্থাৎ ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় এমন মৃত্যুকে সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা ‘হত্যা’ বলে মনে করছেন। তাদের মতে, এই মৃত্যুর পেছনে পরিবহনের চালকরাই দায়ী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়