করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

স্মৃতির ড্রয়ার থেকে

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সম্ভবত ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে। তখন আমি সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের সহকারী সম্পাদক। এক সকালে অফিসে এসেই সম্পাদক শফিক রেহমান আমাকে ডেকে সহাস্যে বললেন, তোমার কপাল খুলেছে। দেশের
সিনিয়রমোস্ট মন্ত্রী তোমাকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন।
আমার বিস্ময় দূর করার জন্য শফি ভাই কালক্ষেপ না করে বলেন, তোমার জন্য মির্জা চাচা গাড়ি পাঠাচ্ছেন। মির্জা চাচা মানে যে মির্জা গোলাম হাফিজ, সেটা বুঝলাম। শফি ভাইয়ের বাবা প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমান আর মির্জা সাহেব ছিলেন বন্ধুস্থানীয়। তাই তিনি শফি ভাইয়ের চাচা। তখন মির্জা সাহেব খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী।
কিন্তু তার সঙ্গে আমার কী দরকার? তিনি আমাকে ডাকবেন কেন? চায়ের দাওয়াত যে আসলে তলব করা সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম।
যাক, মিনিট কয়েকের মধ্যে একটি গাড়ি এসে থামল যাযাদিন অফিসের সামনে। আমার ডাক পড়ল। বিনা ভাড়ায় সচিবালয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলাম।
মন্ত্রীর রুমে ঢুকে আমি অবাক হয়ে চারদিকে চোখ বুলালাম। তার আগে কোনো মন্ত্রীর অফিস দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মির্জা সাহেব একটি বড় টেবিলের একদিকে বসে একমনে টেলিফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছিলেন। সম্ভবত পঞ্চগড়ে। কথা শেষ করে আমার সঙ্গে সহাস্যে হাত মেলালেন, আমার বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন, তার পেশা জানতে চাইলেন। আমি বললাম এবং তিনি যে জীবিত নেই সেটাও জানালাম।
মন্ত্রী সাহেব আমার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বললেন, খুব ভালো মানুষ ছিলেন তিনি।
তার সঙ্গে নাকি তার ভালো সম্পর্ক ছিল।
কথাটা সত্য নয়। আমার বাবার সঙ্গে মন্ত্রীর জীবনে কখনো দেখাই হয়নি। বুঝতে পারি আমাকে খুশি করার জন্যই বাবার সঙ্গে পরিচয়ের কথা বলেছেন।
আমাকে প্রচুর নাস্তাপানি খাওয়ানো হলো।
তারপর বললেন, তুমি আমার জেলার মানুষ। আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ারও কোনো আগ্রহ হয়নি তোমার?
আমি ‘না’ সূচক জবাব দিলাম। মন্ত্রী কী বুঝলেন আমি বুঝতে পারলাম না।
এবার ড্রয়ার থেকে তিনি মেহরাব আলীর লেখা একটি বই বের করলেন। দিনাজপুরের সাংবাদিকদের নাম-পরিচয় নিয়ে লেখা বই। ওই বইয়ে আমার নাম না থাকায় মির্জা সাহেব অখুশি হলেন। বলেন, মেহরাব কাজটি ভালো করেনি।
দিনাজপুরের সাংবাদিকতার ওপর বই, আর তাতে তোমার নাম নেই! এটা কী করে হয়? মেহরাবের এই বই আমি বন্ধ করে দেব।
আমি কিন্তু তখন পর্যন্ত বুঝে ওঠিনি, তিনি আমাকে কেন ডেকেছেন।
চা-টা খাওয়া শেষে তিনি ড্রয়ার খুলে বের করলেন ওই সপ্তাহের এক কপি যায়যায়দিন। তারপর পাতা উল্টে একটি লেখা বের করতেই আমি বুঝলাম, আমার কপাল খারাপ। আমি পঞ্চগড়ের রাজনীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম। তাতে লিখেছি : মির্জা সাহেবের বয়স হয়েছে। তার পরিবর্তে পরের নির্বাচনে পঞ্চগড়-১ আসন থেকে যেন ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকারকে মনোনয়ন দেয়া হয়।
এই লেখা পড়ে দারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি আমাকে তিরস্কৃত করার জন্যই যে ডেকেছেন, ততক্ষণে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম।
মির্জা গোলাম হাফিজ প্রবীণ মানুষ। তার সঙ্গে তর্ক করা কিংবা মুখের ওপর কোনো কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি কীভাবে আক্রমণ ব্যুহ রচনা করবেন, আমি কীভাবে সামাল দেব- সেসব মনে মনে ভাবছিলাম।
মির্জা সাহেব অভিজ্ঞ মানুষ। যাকে বলে ত্রিকালদর্শী। তিনিও আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছেন। তবে তিনি যে নরমে-গরমে চলবেন, সেটা বুঝতে পারলাম।
যাযাদিনের পাতা উল্টাতে থাকলেন, আর বলতে থাকলেন, কাজটি তুমি ভালো করোনি। আমার নির্বাচনী এলাকা তুমি জমিরকে দিয়ে দিলে? আমি এমপি এবং মন্ত্রী। এলাকায় আমার চেয়ে জনপ্রিয় আর কে আছে? আমার সঙ্গে জমিরের কোনো তুলনা চলে?
আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছেন না। আমি কাচুমাচু করছি। এবার তিনি রুম থেকে সবাইকে বের হয়ে যেতে বললেন। সহকারীদের বললেন, কেউ যেন রুমে না ঢোকে। বলবে, আমি একজন বিখ্যাত সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছি। তার বাড়ি আমার জেলায়। তার বাবা অনিল বাবু ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আগেই বলেছি, এটা মোটেও সত্য নয়। আমার বাবার সঙ্গে তার পরিচয়ের কোনো সুযোগ ছিল না।
রুম খালি হলে তিনি বললেন, আমার আসন জমিরকে দিয়ে তুমি যে বিরাট অন্যায় করেছ, সেটা কি তুমি বুঝতে পারছ? আমি যে তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াতে পারি, সেটা তুমি বোঝো?
এবার আমার মাথায় একটু দুষ্টু বুদ্ধি খেলা করে। আমি মিনমিমে গলায় বলি, আমি বিষয়টি দেখেছি একটু ভিন্নভাবে। আমি ভেবেছি, আপনার বয়স হয়েছে, এখন আপনি অবসর জীবন কাটাবেন। আপনারই শিষ্য জমির ব্যারিস্টার আপনার স্থলাভিষিক্ত হবেন। তিনিও এমপি-মন্ত্রী হওয়ার মতোই উপযুক্ত লোক।
এবার তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, তোমার এই ভাবনায় বিরাট গলদ আছে। আমার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ঠিক করার তুমি কে হে? আমি জমিরকে কেন দায়িত্ব দেব। আমার আর জমিরের মধ্যে কোনো তুলনা চলে? আমার উপযুক্ত নিজের সন্তান থাকতে আমি কেন জমিরকে আমার আসন ছাড়ব! বিষয়টি নিয়ে তিক্ততা না বাড়ানোর জন্য আমি বলি, চাচা, ভুল হয়ে গেছে। আসলে আমার এই প্রতিবেদন লেখা উচিত হয়নি।
তিনি বলেন, আমি যে এখন তোমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে পারি, ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারি- সেটা জান?
আমি একেবারেই নিচু গলায় বলি, আপনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী, আমি সেটা জানি। সরকারে খালেদা জিয়ার পরই আপনার স্থান। আপনার মতো ‘অ্যাসেট’ বিএনপিতে আর আছে নাকি? আপনি আমাকে জেল-জরিমানা করতে পারেন, সেটাও আমি জানি। কিন্তু‘ চাচা, আমি এটাও আমি জানি, আপনি আমার বিরুদ্ধে কিছুই করবেন না। কারণ আপনার মতো বড় মনের, উদার মানুষ পঞ্চগড় জেলায় আর কেউ আছে নাকি? আপনার মতো মানবিক, পরোপকারী, দয়ালু মানুষ তো আমি আমার এই সাংবাদিক জীবনে দ্বিতীয়জন দেখিনি।
তেলে কাজ হলো। তৈলাক্ত হয়ে তিনি দিলেন আকীর্ণ বিস্তৃত হাসি। শিশুসুলভ সরলতা নিয়ে বললেন, পরের সংখ্যায় জমিরের সমালোচনা করে, আমার প্রশংসা করে একটি লেখা ছেপে দিও। তুমি আমার বন্ধুর ছেলে, মানে আমারও ছেলেরই মতো। এরপর জমিরের পক্ষে কিছু লিখ না। আমার পক্ষে থাক, তাতে লাভ হবে। যাও তোমাকে মাফ করে দিলাম।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে এটা ভেবে কিছুটা অবাক হলাম যে এক দল করলেও দুজন সিনিয়র নেতার পারস্পরিক সম্পর্ক কতটা তিক্ত। অথচ একসঙ্গে বসে তারা যখন কথা বলেন তখন নিশ্চয়ই অন্তরের বিষ চেপে রাখেন!
বলে রাখা ভালো, তিনি তার কত ‘পাওয়ার’ সেটা বোঝানোর জন্য আমাকে এটাও বলেছিলেন যে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য আওয়ামী যে বিল সংসদে জমা দিয়েছে, তা তিনি (মির্জা গোলাম হাফিজ) আইনমন্ত্রী থাকতে আলোর মুখ দেখবে না। বিলটিকে তিনি তার ড্রয়ারের একেবারে নিচে ঢুকিয়ে রেখেছেন। ওতে অনেক প্যাঁচ। ওই প্যাঁচ খোলা যারতার কর্ম নয়। আমি পারতাম। কিন্তু খুলব না। কারণ মুজিব হত্যার বিচার হলে আওয়ামী লীগের লাভ। আর আওয়ামী লীগের যেটায় লাভ, বিএনপি সেটা করবে কেন?
কথাটা যে মিথ্যা বলেননি, তা পরে প্রমাণ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যাতে না হয় তার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়