করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

বাঁশি বাজানোর দিনগুলো

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আগন্তুকের চোখে দেখা
খালের নাম গরুলুটা। গ্রামের নাম মনসা। মনসার গার্হস্থ্য পরিবেশ ছাড়িয়ে, সবুজ চৌহদ্দী পেরিয়ে গরুলুটা খাল মিশে গেছে কর্ণফুলীতে। কর্ণফুলীর ওপারে আরেকটা জগৎ। ওটা একটা শহর। এপাড় শান্ত, নির্জন, ওপাড়ে কোলাহল। এপাড়ের প্রতিটি মানুষ প্রতিজনকে চেনে। ওপাড়ে কেউ যেন কাউকে চেনে না। প্রত্যেকে যে যার কাজে ব্যস্ত। আমার বাবা থাকত ওপাড়ে। শহরে। ওখানে দাদার আমলের সওদাগরি প্রতিষ্ঠান। শনিবারে বাবা বাড়িতে আসে। রবিবার বন্ধের দিনটা বাড়িতে কাটিয়ে সোমবার ভোরে চলে যায়। বাড়ির কাছেই গরুলুটা খালের ঘাট ছিল। সে ঘাটে সাম্পান বাঁধা থাকত। নানা বাঁক পেরিয়ে সাম্পান চিরচেনা শব্দ তুলে এগিয়ে যেত। একসময় গাছের আড়াল হতো সেটি। আর আমরা আরেকটি শনিবারের অপেক্ষায় থাকতাম।
আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ। শিক্ষার একটা পর্যায় শেষ করে আরেকটা নতুন ধাপে উঠব। উচ্চ বিদ্যালয়ে যাব। নতুন বই, নতুন বিদ্যালয়, নতুন বন্ধু পাব। ঠিক এরকম একটা উত্তেজনার মধ্যে বাবা শহর থেকে এসে আমাকে কাছে ডাকলেন। একটা নতুন কলম আনলেন, নাম পাইলট। কালি আনলেন পেনিকেন। নতুন কলম পেয়ে খুশিতে আমি আত্মহারা। বাবা বললেন, ভালো করে পড়ালেখা কর, দেখবে শুধু কলম নয়, আরো অনেক কিছু পাবে। তোমাকে আমি অনেক বড়, নামকরা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব, ওখানে সেরা সেরা সব শিক্ষক, ভালো ভালো সব ছাত্র। তুমিও পড়বে। তোমাকে শুধু একদিন এক ঘণ্টার একটা পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষাতে পাস করলেই আর কিছু লাগবে না। তুমি হয়ে যাবে দেশের সেরা স্কুলের ছাত্র। তোমার জীবনটাই অন্যরকম হয়ে যাবে।
পরীক্ষার কথা শুনে মনে মনে ভয় পেলেও নামকরা স্কুলের কথা শুনে মনটা খুশিতে ভরে গেল। আমি মহোৎসাহে, আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের সব স্বজনের মহাপ্রেরণায় পড়ালেখা শুরু করি। একদিন বাবার সঙ্গে ঘাটে বাঁধা সাম্পানে উঠি। ঘাটের কিনারে একটি সুউচ্চ তালগাছ। সেই তালগাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ালে যতদূর চোখ যায় ধানখেত। বাতাসে ঢেউ খেলানো সেই খেতের প্রান্তে ঝাপসা দেখা যায় দুই একটা ছোট ছোট ঘর। খালের আরেক পাড়ে ঘন ঝোপ, জঙ্গল। দিনের বেলা খুব কষ্ট করে সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছুতে পারে। সেখান থেকে অচেনা পাখিরা ডেকে উঠত সবসময়। জঙ্গল পেরিয়ে মানুষের ঘরবাড়ি। প্রতিটি বাড়ির সামনে উঠোন, পাশে গোয়ালঘর, খড়ের গাদা। আর কয়েক হাত অন্তর বড় বড় পুকুর। পুকুরগুলোর এক একটা নাম। সেই সব পুকুরের পারে পাটি পাতার ঝোপ। চারপাশে আম, কাঁঠাল, শিরিষ, বাদাম, আমলকি আর নাম না জানা কত শত গাছ। এসব পেছনে ফেলে আমি বাবার সঙ্গে সাম্পানে চড়ে অন্য একটা জগতে চলে গেলাম। ভিন্ন একটা জগৎ। আমার এতদিনকার দেখা সবুজ জগতের উল্টো এক চিত্র। শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারাদেশের তখনকার বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র চাক্তাই এলাকায় ছিল আমাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। নিচের তলায় দোকান, দোতলায় আমাদের বাসা। ওই বাসার বাসিন্দা আমি আর বাবা। আমি প্রতিদিন রিকশায় কিংবা হেঁটে স্কুলে যেতাম। আমার স্কুলের নাম কলেজিয়েট স্কুল। স্কুল থেকে ফিরে এসে একা একা বসে মায়ের কথা, আপুদের কথা, দাদির কথা আর বন্ধুদের কথা ভাবি। রোজার সময় লম্বা ছুটি এলে মনে হতো দূরের আকাশটা খুব কাছাকাছি চলে আসছে। খুশি লাগত। বাড়ি যেতে পারব বলে। ঈদ এলে যত না ঈদের খুশি তার চাইতে বেশি খুশি বাড়িতে যাওয়া হবে বলে। সেই আনন্দের রেশটুকু এই বয়সে রয়ে গেছে। এখনো কেউ বাড়ি যাওয়ার কথা বললে নিজের অজান্তে মনটাতে একটা মুক্তির ভাব আসে।
আমি শহর থেকে বাড়িতে বেড়াতে এসে এখানকার অনেক কিছু নতুন করে আবিষ্কার করতে শুরু করলাম। যা আগে কোনদিন খেয়াল করিনি সেই দিকে নজর পড়তে শুরু করল। বাড়িতে থাকার সময় তারই একটা অংশ ছিলাম, তার জন্য কোন কিছুই তেমনভাবে খেয়াল করতাম না। এখন আমি একটা আগন্তুকের মতো আসি, আর পরখ করতে থাকি সবকিছুকে। এই যেমন আগে গোসলের সময় কখনো ভাবিনি মানুষ কীভাবে গোসল করে। হাফপেন্ট খুলে কিংবা না খুলে তীর থেকে লাফ দিয়ে এক ডুবে মধ্যপুকুরে মাথা তুলে আবার তীরে ফিরে আসা। জলের সঙ্গে এমন উচ্ছ¡াসের স্নানতো শহরে নেই। ওখানে বালতি থেকে মগে পানি নিয়ে মাথায় ঢালি। পুরো পদ্ধতিটাই আলাদা। বাড়ি গেলে আমি এখন পর্যবেক্ষকের মতো দেখি মানুষের অবাধ সাঁতার, কথাবার্তা, জীবনযাপন। আমি আর ওদের সঙ্গে মিশে যেতে পারছিলাম না। ঠিক তেমনি ছোটবেলাতেই ঈদের আনন্দ নিজে করার চাইতে অন্যদের আনন্দটা অবলোকন করেছি বেশি। সেরকম অবলোকনের দু’একটা টুকরো এখানে পেশ করছি।
ছেলেটির নাম ছিল আকতার কামাল। আমার সঙ্গে পড়ত। আমার সঙ্গে ঘুরত। আমি ছিলাম শান্ত। সে ছিল অশান্ত। আমি ছিলাম খেলায় দুধভাত, সে ছিল সামনে সারির সৈনিক। তার ডাঙ্গুলির বাঁট কতজনকে আঘাত করেছে তার ইয়ত্তা নেই। আমার শহরে যাওয়াটা সে মেনে নেয়নি। যখন বেড়াতে আসতাম, তখন সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত, অচেনা কোনো মানুষের মতো আচরণ করত। একবার ঈদে পুকুরে গোসলের সময়, নামাজে, কবর জেয়ারতে, কোথাও আকতার কামালকে না দেখে তার ঘরে গিয়েছিলাম। দেখি সে বিছানায় শুয়ে। ওর মা আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর নয়নে কাঁদল। তারপর শোনাল তার বিছানায় শুয়ে থাকার পটভূমি। নতুন নতুন সাইকেল চালানো শিখেছে সে। ভাড়াকরা সাইকেল নিয়ে দিনরাত চষে বেড়াচ্ছে গ্রামের রাস্তাঘাট। দুঃসাহসী ছেলে। কিছুই পরোয়া করে না। কাউকে মানে না। বাবার একমাত্র ছেলে হলে নাকি এরকমই হয়। ওরা বেশি বারণ মানে না। আকতার কামালও এরকম। ওর কোন ভাই নেই। একটা বোন আছে। কাঁচা রাস্তার গণ্ডি পেরিয়ে সাইকেল চালাতে সে গিয়েছিল গ্রাম পেরিয়ে চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কে। সাইকেলসহ তাকে চাপা দিয়েছে একটি ট্রাক। পাকা রাস্তায় সাইকেল চালানোর মজা বুঝতে গিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলেছে। ওর মা বিলাপ করে করে বলল, আঁর ফোয়ার মাজা ভাঙি গেইয়েগুই। আত্তে তো টেয়া পইসা নাই, তোর বাপর টেয়া দি চিকিৎসা গড়ির। (আমার ছেলের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। আমার তো টাকা পয়সা নেই, তোমার বাবাই চিকিৎসা চালাচ্ছে।) আমি অবাক হলাম। বাবা তাহলে এই দুর্ঘটনার কথা জানে। অথচ আমাকে বলেনি। আমি আমার বন্ধুর শয্যায় গিয়ে পাশে বসলাম। তার মুখখানি সাদা, শুকনো। আমাকে বলল, সবাই ঈদের দিনে কত মজা করছে, নতুন কাপড় পরে ঘুরছে, টাকা তুলছে। অথচ আমি বিছানায় গুঁইসাপের মতো গড়াচ্ছি। কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। এই দুঃখের মধ্যেও আকতারের মা আমাকে আদর করে সেমাই খাওয়ালেন। গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাওয়ার কারণে আমাকে না দেখে মাঠ, পুকুর ঘাট এবং তার বুকটা যে খালি খালি লাগে তার এক আশ্চর্য বয়ান তিনি দিলেন। আমি অনড়, স্থবিরের মতো বসে থাকলাম বন্ধু আকতারের পাশে। সে উঠে বসতে পারে না, হাতদুটো নড়াচড়া করতে পারে। দুটো হাত দিয়ে আমাকে ধরে বলল, ভালো হয়ে গেলে তোকে আমি সাইকেল চালানো শেখাবো। দুই চোখের কোণা দিয়ে পানি ঝরছে, সেগুলো গড়িয়ে পড়ছে তার কানের ওপর। এ কথা শুনে তার মা রেগে গিয়ে বলল, ওরে আর ফঅল পোয়ারে… আইজু সাইকল সপ্পনত দেহত দে… (ওরে আমার পাগল ছেলে, এখনো সাইকেলের স্বপ্ন দেখছিস)। পরের বছর ঈদে গিয়ে আকতার কামালকে আর ওই অবস্থায় দেখতে হয়নি। কারণ সে ঈদ আসার আগেই পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। এরপর থেকে প্রতিবার আমার জীবনে ঈদ আসে এক শোকাতুর মায়ের আহাজারির ভেতর দিয়ে।
আকতার কামালদের ঘরে পাশে আমার আরেক চাচির ঘর। ওদের ঘর থেকে বের হয়ে আমি যাই তাদের ঘরে। তার দুই ছেলে। এক ছেলে আমার শ্রেণিসঙ্গী। আমাকে দেখেই চাচি বললেন, পড়ালেখার উন্নতির জন্য তোর বাবা তোকে শহরে নিয়ে গেছে। আমারটাকে কে দেখবে? সে পড়লেও কেউ দেখার নাই, না পড়লেও দেখার নাই, সে খেলো কি খেলো না, মরল কি বাঁচল সেটাও তো কারও দেখার নেই। আমার সেই শ্রেণিসঙ্গীটির নাম জুনু। জুনুর বাবা একটি ইটভাটায় চাকরি করত। ১৯৭১ সালে একদিন কাজের সময় সেখানে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য আসে। তারা জুনুর বাবাকে বলল, গাছ থেকে ডাব পেড়ে খাওয়ানোর জন্য। নারকেল গাছে চড়ার অভ্যাস তার ছিল না। তিনি বয়স্ক মানুষ। তারপরও মিলিটারিদের ভয়ে তিনি বহু কষ্টে গাছে উঠে ডাব পাড়লেন। সেগুলো কেটে দশ-বারোজন পাকি সৈন্যকে খাওয়ালেন, ওরা খেয়ে বেশ তৃপ্ত হয়ে জুনুর বাবাকে বলল, তুমি এবার বাড়ি চলে যাও। জুনুর বাবা বলল, আমার তো এখানে কাজ আছে। ওরা বলল, না তুমি এখনি বাড়ি যাবে। কথা না বাড়িয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন। পেছন থেকে তার বাড়ি যাওয়া দেখতে দেখতে পাকি সৈন্যরা গুলি করে তাকে ঝাঁঝরা করে দিল। একাত্তরের শহীদ জায়া আমার এই চাচিটি এখনো ভুলতে পারছেন না তার স্বামীর কথা। তিনি উৎসবের দিনে ঘরের দাওয়ায় বসে বিলাপ ধরতে থাকেন।
জুনুদের ঘরের পাশে আমার ছোট দাদির ঘর। আমার বাবাদের চাচি। এই দাদা মারা গেছেন। তার দুই ছেলে। ইসমাইল চাচা আর জাফর চাচা। ইসমাইল চাচার দুই ছেলে এক মেয়ে। একদিনের ঘটনা, আমি তখনো শহরে যাইনি। অনেক রাতে কুপি জ্বালিয়ে আমাদের ঘরের সামনে কে যেন এলো। তাড়াহুড়ো করে আমার মায়েরা ঘর থেকে বের হয়ে ছোট দাদির ঘরে গেল। কিছুক্ষণ পর ওখান থেকে রাত্রির নির্জনতা ভাঙা চিৎকার, কান্নাকাটি ভেসে এলো। ইসমাইল চাচাকে কারা যেন তাবিজ করে বান মেরেছে। বুকে তার প্রচণ্ড ব্যথা। ঘামতে ঘামতে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। এসব ঘটনার সময় আমার মনে তেমন কোনো দাগ কাটেনি। কিন্তু একটু বড় হয়ে আমি যখন শহর থেকে বাড়িতে আসি, তখন বাড়ির মানুষগুলোকে, পরিবারগুলোকে একটু দূর থেকে দেখার অবকাশ পাই। আমি স্পর্শ করতে পারি এখানকার ভেতরের কান্নাগুলোকে। ঈদের দিন যখন ওদের সালাম করতে যাই, তখন একই ছাদের নিচে দুই প্রজন্মের দুই বিধবা মহিলার হাহাকার আমাকে কেমন যেন করে ফেলত। আমি তখন ভাবতাম আমাদের গ্রামটা কত বড়, সেই গ্রামের একটি বাড়িতে, কিছু জায়গা জুড়ে এত দুঃখ, না জানি পুরো গ্রামের কত কষ্ট, আর যদি পুরো দেশটার কথা বলি তখন ব্যাপারটা ভাবা আমার সেই বয়সে কঠিন ছিল।
ঈদের নতুন জামা-কাপড়, মিষ্টান্ন, নতুন জুতো, সেলামি পাওয়া আর শহরের বন্দিদশা থেকে মুক্ত থাকার আনন্দের পাশাপাশি এইসব বেদনাও থাকত। ভাবি এটাইতো মানুষের নিয়তি। জীবনে এটাই স্বাভাবিক। প্রতি বছর ঈদ আসে। আর প্রতি বছর আমাকে মানুষের কাছাকাছি করে, যারা আমার প্রকৃত স্বজন। ঈদ আমাকে আমার স্বজনদের অনুভব করতে শেখায়। তাদের দেখতে শেখায়।

দুই.
কবে বাড়ি যাব
শহরের চাক্তাই বাণিজ্যিক এলাকায় বাবার সঙ্গে দুইটা বছর কাটালাম। পরে বাবার মনে হলো সওদাগরী প্রতিষ্ঠানের উপরের তলায় থেকে থেকে ছেলেটা কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। মায়ের জন্য ছেলেটা সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। তার উপর আবার ছোটভাই আজগরও কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হলো। সবমিলিয়ে বাবা ঠিক করলেন মাকে শহরে নিয়ে আসবেন। সেই জন্যই নন্দনকাননে ডিসি পাহাড়ের কাছে, তুলসী ধামের পাদদেশে একটা জায়গা কিনলেন। টিনের ছাউনি দেয়া ওই বাড়ির সামনে ছিল উঠোন। উঠোনে শিউলি, বরই, কাঁঠাল আর আম গাছ ছিল। আমাদের কৈশোর আনন্দময় করতে বাবার এই আয়োজনের জন্য কখনো তাকে ধন্যবাদ দিতে পারিনি। এখন খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু তিনি শেষে নন্দনকাননের বাসাটাকে পাকা দালান করে দিয়ে উনি চলে গেছেন। বাবার কবরের পাশে গিয়ে এখন তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি কী এসব শুনতে পান?
তো, আমাদের নন্দন কাননের বাসায় রমজানের সময় ভোর রাতে একটা লোক মাখন বিক্রি করতে আসতেন। বৌদ্ধ মন্দির সড়ক থেকে গলিতে ঢুকেই তিনি একটা বিশেষ সুরে মাখন মাখন বলে ডাক দিতেন। আর তাতেই আমাদের সবার ঘুম ভাঙত। সাহরির সময় নানা মাছ-মাংস তরকারি ছাড়াও ঘি, দুধ কিংবা দৈ দিয়েও ভাত খেতাম। মাখন কখনো খেতাম না। আমার দাদি বলত, ও প্রতিদিন এসে আমাদের ঘুম ভাঙায়, রাতের অন্ধকারে একা একা মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘোরে। ক্রেতা না পেলে তার চলবে কী করে। দাদির পরামর্শে বাবা মাঝে মাঝে তার কাছ থেকে মাখন কিনত। আধো ঘুম আধো জাগরণে অন্ধকারের ভেতর থেকে ভেসে আসা শৈশবের সেই ডাক সকল কুয়াশা ভেদ করে আজও যেন আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে।
পড়ালেখার প্রাথমিক পর্বটি আমার কেটেছে আমার জন্মস্থান পটিয়ার মনসা গ্রামে। রমজানের সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল স্কুল বন্ধ থাকা। সেসময় রমজান আসত শীতে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে অন্যরকমভাবে দিন কাটানোর আনন্দে বিভোর থাকতাম। বড়রা চাইতো সাহরির সময় ছোটরা যাতে ঘুম থেকে না উঠি। কিন্তু আমরা খুব সজাগ থাকতাম। সামান্য আওয়াজে ঘুম ভাঙত। আর লেপ কাঁথার ভেতর থেকে উঠে সরাসরি খাওয়ার ঘরে চলে যেতাম। দিনের বেলা মা, দাদি চেষ্টা করতেন কিছু খাওয়ানোর। বলত, আরেকটু বড় হলে রাখবি। কষ্ট হলেও আমরা প্রতিযোগিতা করে রোজা রাখতাম। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে চাচাতো জেঠাতো ভাইবোনদের ভিড়ে আমরা হৈহুল্লোড়ে বড় হয়েছি। প্রত্যেকে সমবয়সীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতাম। আমার প্রতিযোগী ছিল জেঠাতো বোন রোকেয়া। সে ছিল কঠিন মনোবলের এক মেয়ে। তাকে তার প্রতিজ্ঞা থেকে সরানো যেত না। এদিকে আমি খিদা খুব সহ্য করতে পারতাম না। অবশেষে প্রতিযোগিতায় হেরে মায়ের আঁচলের নিচে কাঁদতে কাঁদতে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতাম। তখন বয়স কত হবে। পাঁচ কী ছয়।
বিকেলের পর থেকে কী অধীর আগ্রহ কখন সূর্যটা ডুববে। ইফতারের সময় তোপধ্বনি শুনতাম। অনেক দূর থেকে আসা ক্ষীণ সেই তোপের আওয়াজ শুনতে উৎকর্ণ থাকতাম। কদাচিৎ শুনতে পেতাম। অধির অপেক্ষার ভেতর মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসত আজানের আওয়াজ। ইফতারের অনুমতি।
রাতে তারাবি নামাজ পড়ার সময় অন্ধকারে কীভাবে যাব? বড়দের থাকত টর্চলাইট। কেউ কেউ হারিকেন নিয়ে যেতেন। এ দুটো হাতে নেয়ার অধিকার ছোটদের ছিল না। আমার জেঠাতো ভাই জাহেদ ছিলেন আবিষ্কারক। নতুন নতুন জিনিস বানাতেন। তিনি ঘুড়ি থেকে শুরু করে, বাঁশ কেটে নাটাই বানানো, সুতা মাঞ্জা দেয়া সবকিছুতে দক্ষ। তিনি কনডেন্সড মিলকে ছোট টিনের কৌটায় তার লাগিয়ে হাতল বানাতেন। তাতে মোমবাতি বসিয়ে জ্বালিয়ে দিতেন। আমার হাতেও একটা দিতেন। তার এই মজার বাতি পেয়ে ভীষণ আনন্দ হতো। মসজিদে ঢোকার আগে সেই মোমবাতি নিভিয়ে দিতেন। বের হওয়ার আগে আবার জ্বালাতেন। তার জন্য একটা ম্যাচের বাক্স লুঙ্গির খাঁজের মধ্যে রাখতেন। সেই বাতি এখনো মনের অন্ধকারে আলো ফেলে।
তারাবি চলত এক মাস। যে ইমাম সাহেব আমাদের নামাজ পড়াতেন তিনি ছিলেন কুরআনে হাফেজ। কুরআন শরিফ তার মুখস্ত। এত বড় একটা কুরআন কীভাবে মুখস্ত রাখলেন সেটা ভেবে অবাক হতাম। নামাজের ভেতর দিয়ে প্রতিদিন একটা পারা শেষ করতেন। এইভাবে তিরিশ দিন চলত।
আমাকে মসজিদে নিয়ে যেত জাহেদ দাদা। সাইকেলে চড়ানো, ঘুড়ি ওড়ানো, তারাবির নামাজে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে তার বিশেষ ভক্ত ছিলাম। তিনি বলতেন, আমার কথামতো চলবি, তাহলে সাহরির সময় ঘুম থেকে ডেকে দেব। সাহরির সময় ছিল খুব তাড়াহুড়ো। মোরগ ডাকার আগেই খাওয়া দাওয়ার কাজ সেরে ফেলতে হবে। একদিন আমার ঘুম ভেঙেছিল দেরিতে। মা দুধ কলা মেখে ভাত দিয়েছিল। খেতে খেতেই মোরগ ডাকছিল। আর ভাইবোনেরা সবাই এটা নিয়ে হাসাহাসি করছিল। আমি খাওয়া বন্ধ করে মুখ ভার করে রইলাম। দাদি ওদের বকা দিয়ে আমার কাছে এসে বলল, পাতের খাবার নষ্ট করা গুনাহ। খাওয়া শুরুর পর মোরগ ডাকলে অসুবিধা নেই, খাওয়ার আগে মোরগ ডাকলে অসুবিধা। এই বলে দাদি নিজেই আমাকে খাওয়াতে শুরু করে।

তিন.
গরুলুটার পাড়ে পাহাড় আর সাগর
কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে জন্ম থেকে আমার ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত গরুলুটা খালের পাড়ের গ্রামটিতে কেটেছে। আমার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মনসা প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমার চিন্তার, চেতনার একটি ভিত্তি তৈরি হয়েছিল এই স্কুলে। এই স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে আমি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। কিন্তু আমার কাছে এখনো মনসার সেই প্রথম স্কুলটিকেই প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে মনে হয়। তার প্রধান কারণ এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ আহমদ স্যার। ছাত্রজীবন পার করে পেশাগত জীবনে আমি বহু প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আবার প্রশিক্ষক হিসেবেও প্রশিক্ষণ নিয়েছি। শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষণার্থী আর ছাত্রদের সঙ্গে কীভাবে মনোসংযোগ তৈরি হবে, কীভাবে দৃষ্টিসংযোগ অব্যাহত রাখতে হবে উপস্থিত সবার সঙ্গে কিংবা বিষয়ের উপস্থাপনা কীভাবে হবে, শিক্ষার উপকরণ কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে শিক্ষার্থীদের মনোরঞ্জন করতে করতে তাদের মনের ভেতর একটি বিষয় ঢোকাতে হবে- এসব বিষয় নিয়ে যখন পদ্ধতিগত আলোচনা হয় তখন আমার চোখের সামনে ছেলেবেলার স্কুলের শিক্ষকের কথা মনে পড়ে। উনি সারাক্ষণ আমাদের এক ঘোরের ভেতর রাখতেন। সৈয়দ স্যারের হালকা পাতলা গড়ন, হাঁটতেন প্রায় দৌড়ের গতিতে, কাছে ডাকতে পরম মমতায়, পড়াতেন সত্যিাকার অর্থে আমাদের আলোকিত করতে। শ্রেণিকক্ষে উনি লাফাতেন, অভিনয় করতেন, গাইতেন, হাসাতেন। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হয়তো একটা কিছু বোঝাচ্ছেন। তখন যদি কিছু লেখার প্রয়োজন হতো তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে যেতেন এক লাফে। তার সেই লাফে আমরা হাসতাম। স্যারের ক্লাসে বেশি শিখতাম। আবার সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতাম। তখন ভাবিনি, বুঝতে পারিনি। এখন ভাবছি তিনি আসলে সব করতেন আমাদের আনন্দে রাখতে, আমাদের খুশি করতে। স্যার অংক, বাংলা, ভূগোল, ইতিহাসসহ সব পড়াতেন। একবার তিনি আমাদের ভূগোল পড়াচ্ছিলেন। নদীর গতিপথ নিয়ে। নদীর উৎপত্তি নিয়ে। সেদিনই স্যার বললেন, নদীর জন্ম কী করে হয়, তা তোদের সবাইকে কাল দেখাব। আমরাতো সবাই অবাক। তারপর দিন আমরা স্যারকে মনে করিয়ে দিতেই বলল, হুম। দেখাব। রাজমিস্ত্রিকে খবর দিয়েছি। আমাদের প্রচণ্ড কৌতূহল। রাজমিস্ত্রি কীভাবে নদীর জন্মকাহিনী দেখাবে। তারপরও আমরা অপেক্ষায় থাকলাম। কিছুক্ষণ পর স্যার আমাদের ক্লাসের সবাইকে নিয়ে গেলেন স্কুলের পেছনে। আমাদের স্কুলের পেছনেই ছিল গুরুলুটা খাল। সেই খালের পাড়ে পাঁচ ফুটের একটা জায়গা সমান করে ইট বিছালেন মিস্ত্রি। স্যার তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন। সিমেন্ট আর বালু মিশিয়ে মিস্ত্রি প্রথম সেগুলো স্তূপ করলেন। কয়েকটি ছোট বড় ছয়-সাতটা স্তূপ। স্যার বললেন, এগুলো পাহাড়। সিমেন্টের পাহাড়গুলো সত্যিকারের পাহাড়ের মতো উপরের দিকে সরু। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম কয়েক মিনিটের মধ্যে স্যারের কথামতো সুউচ্চ পাহাড়শ্রেণির ক্ষুদে ভাস্কর্য তৈরি করলেন মিস্ত্রি। পাঁচ ফুট জায়গার মধ্যে প্রায় দেড় ফুটে তৈরি হলো পাহাড়। এবার স্যার পুরো জায়গায় একটা সীমানা দিলেন। তাও বালু আর সিমেন্টের মিশেল দিয়ে। সেখানে পানি ঢাললেন। বললেন, এটা সাগর। এই সাগর থেকে পানি বাষ্প হয়ে, মেঘ হয়ে উড়ে উড়ে যাবে পাহাড়ের দিকে। যেতে যেতে সেই মেঘ পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হবে। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ আবার পানি হবে। সেই পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড় থেকে নিচে নামবে। স্যার পাহাড়ের চূড়ায় পানি ঢালতে শুরু করলেন ধীরে ধীরে। মিস্ত্রি এবার তৈরি করে দিলেন সেই পানির কয়েকটি ধারা। চোখের সামনে দেখলাম পাহাড়, সাগর, নদীর ধারা আর সমতল তৈরি হতে। সেই পাকা কাঠামোটি বহুদিন ছিল গরুলুটার পাড়ে। প্রায় শহর থেকে গিয়ে স্কুলের পেছনে সেই কাঠামোটি দেখে আসতাম। আর সেই ঘাসে ঢেকে যাওয়া ক্ষুদ্র পাহাড়ের চূড়ায় চোখের জল ফেলতাম। শুকনো পাহাড় সবটুকু শুষে নিত। নিচের দিকে আর গড়িয়ে পড়ত না। এই ২০২১ সালে গিয়ে সেই কাঠামো আর দেখলাম না। স্কুলের নতুন ভবনের নিচে সেই স্মৃতি চাপা পড়ে গেছে। স্যারের হাতে একটি পত্রিকা দেখতাম। সেই পত্রিকার নাম ‘একতা’। বড় হয়ে যখন ছাত্র ইউনিয়ন পড়তাম। তখন বুঝে গেলাম স্যার কেন এই পত্রিকা পড়তেন। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্মৃতির সঙ্গে মানব সভ্যতার একটা বড় ঘটনার সংযোগ আছে। একদিন স্যার এসেই ব্ল্যাকবোর্ডে একটা সূর্য আঁকলেন। তারপর একের পর আঁকলেন সকল গ্রহের কক্ষপথ। যতই আঁকুক সৌরজগতের বিষয়টি আমার কাছে তখন বিমূর্তই ছিল। স্যার পৃথিবীর পাশের চাঁদ একে বললেন, আমাদের পৃথিবীর তিনজন মানুষ চাঁদে গেছে। এটা মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে এক বিরাট খবর। বড় আনন্দের বিষয়। এই জন্য আজ স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। আমাদের গ্রাম থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে আমেরিকায় নীল আর্মস্ট্রং নামে একজন মানুষ তার বন্ধুদের নিয়ে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৮৫৫ মাইল দূরে চাঁদের দেশে গেছে। এতে বাংলাদেশের দূর প্রান্তের এক গ্রামের কিসের আনন্দ, যাতে স্কুল ছুটি দিতে হবে? অভূতপূর্ব দেহভঙ্গি, উচ্ছ¡াস আর আবেগ দিয়ে সৈয়দ স্যার আমাদের কীভাবে জানি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন এতে আমাদের কিছুটা আনন্দ আছে বৈকি। একটা বৈশ্বিকবোধ আমাদের ভেতর সেই শিশুকালে কেমন করে জাগ্রত হয়েছিল ক্ষীণভাবে। ভেবেছিলাম মানুষের এই জয় আসলে আমাদের সবার। শিক্ষার মূল বিষয়টা ছিল এটিই। সেই মূল থেকে পরবর্তীতে আমরা বহুদূরে ছিটকে পড়েছি মহাকাশের খসে পড়া উল্কার মতো।

চার.
বাজি পোড়ানোর মেলা
আকাশজুড়ে আলোর কুসুম ফুটছে মুহুর্মুহু। বাজির শব্দ মনের ভেতর তীরের মতো ছুটছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে মানুষের হৃদয়কে আলোকিত করে গ্রামীণ জনপদে এক আনন্দধারা বইয়ে দিতো ‘বাজি পোড়ানোর মেলা’। পশ্চিম পটিয়ার চরকানাই গ্রামের বিখ্যাত সেই মেলা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এই মেলার আলো পেয়েছিলাম শৈশবে। সেই আলোয় এখনো আলোকিত হয়ে আছি।
পশ্চিম পটিয়ার চরকানাই গ্রামের শাহ মুন্সির হাট। বিভিন্ন গ্রাম থেকে এঁকে বেঁকে অনেকগুলো রাস্তা এই হাটে এসে মিশেছে। চারপাশে ধানখেতের দিগন্তছোঁয়া বিস্তার। শীতকালে ধানকাটা হয়ে গেলে শূন্য খেতেই জমত বাজি পোড়ানোর মেলা। আর এই মেলা এলেই আনন্দ, ভয়, রোমাঞ্চ মিলিয়ে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হতো আমাদের ভেতর। সারা বছর এই মেলার জন্য অপেক্ষা করতাম। মেলা দুইতিনদিন ধরে চলত। সারা দিন শত শত দোকানে নানা রকমের পণ্য বেচাকেনা হতো। নাগরদোলা, যাত্রা, সার্কাস এসব তো ছিলই। কিন্তু এই মেলার একটা বিশেষ দিক ছিল। সন্ধ্যা হলে চারদিক যখন অন্ধকারে ছেয়ে যেত তখনই জ্বলে উঠত বাজির আলো। বিচিত্র সব বাজি। কোনো বাজি আকাশে আলোর ফুল ফোটাচ্ছে। কিছু বাজি রকেটের মতো উপরে উঠে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হতো। কোনটা অনেকক্ষণ আলোর ফুলকি ছড়িয়ে ফুটিয়ে তুলতো বড় বড় মনীষীর ছবি। আগুনের গোলার ভেতর থেকে কী করে মানুষের ছবি ভেসে আসত সে এক আশ্চর্য ব্যাপার ছিল গ্রামের মানুষের কাছে। আলোর সেই শিল্পিতরূপ দেখে হাজার হাজার মানুষ তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনিতে মাতিয়ে রাখতো পুরো এলাকা। আলোর খেলা দেখে বিস্ময়ে আনন্দে ঘরে ফিরত মানুষ। আর একটা বছর অপেক্ষা করত পরের বছরের মেলার জন্য। এখন আর সেই অপেক্ষা কেউ আর করে না। আমাদের সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ গ্রামীণ মেলাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বা ক্রমে জৌলুস হারিয়ে ফেলছে। গ্রামের মেলার সবচেয়ে সুবিধার দিক ছিল মেলার আঙিনাকে ঘটা করে সাজাতে হতো না। প্রকৃতি নিজেই একে সাজানোর দায়িত্ব নিত। এই সাজ বহু বিচিত্র। একেক ঋতুতে একেক রকমের সাজ। গ্রামের মানুষের অন্তরে যে সৌন্দর্য বোধ আছে আর মানুষে মানুষে যে মিলনের আকাক্সক্ষা আছে তাই প্রকাশ পেত মেলায়। এই মেলাকে তাই সে নিজের মতো সাজাতো। আমাদের গ্রামীণ জনপদের মানুষের অন্তরের শিল্পবোধ প্রকাশ ঘটত মেলার মাধ্যমেই। তাই মেলায় আমরা দেখি গ্রামের যত রকমের চারু ও কারু শিল্পের আয়োজন। বলতে গেলে বৃহত্তর গ্রামীণ সমাজের একমাত্র জৌলুস ছিল এই মেলা। মেলা মানেই নানা শিল্পের সমাহার। মেলা মানেই যাত্রা, সার্কাস, খেলনাপাতি, মিঠাই মন্ডা, আরো কত কী। নববর্ষ বা বৈশাখ এলেই এই মেলা জমতো বেশি করে। একেকটা মেলা এক একটা পণ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। ছোটদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল মেলাগুলো। এখন যেমন হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় নানা ইলেট্রনিক্স খেলনা। আগের দিনে তো তা ছিল না। তখন মেলার খেলনাপাতিই ছিল ছোটদের প্রধান আকর্ষণ। প্রায় প্রতিটি মেলায় পাওয়া যেত তালপাতার সেপাই, টমটম গাড়ি, মাটির পুতুল, ঘুড়ি, বেলুন।
আমাদের বাজি পোড়ানোর মেলা থেকে প্রতিবছর বাঁশি কিনতাম। বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সুর তোলার চেষ্টায় সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতাম। একসময় বাঁশিটি পুরনো হতো। আমি আবার অপেক্ষায় থাকতাম কবে মেলা বসবে। নতুন বাঁশি কিনব। এখন আর অপেক্ষায় কাজ হয় না। বাজি পোড়ানোর মেলাও শেষ। আমার বাঁশি বাজানোর দিনও শেষ। সেই বাঁশি বাজানোর দিনগুলো, সেই মেলাগুলো সত্যিই সুন্দর ছিল।

পাঁচ.
শ্রæতির স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু
একটি ফিলিপস রেডিও। সেটা ঘিরে কিছু উৎসুক উদ্বিঘœ মানুষের জটলা। একই পাড়ার, একই গ্রামের মানুষ তারা। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। সবার মনোযোগ রেডিওটার প্রতি। শুনছেন বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা খবর আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। ১৯৭১ সালে আমাদের বাড়িতে এমন দৃশ্য প্রতিদিনকার। আমরা ছোটরাও সেই শ্রæতির আসরে যোগ দিতাম। বড়দের উৎকণ্ঠা আমাদের মধ্যেও কেন জানি ছড়িয়ে গিয়েছিল। কেউ বলেনি, কী ঘটছে দেশে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারতাম। বছরের শুরুর দিকে আমাদের কলেজিয়েট স্কুলের একজন স্যার দেশে কী হচ্ছে তার একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বুঝতে পারছিলাম ন্যায্য পাওনা চাইতে গিয়ে এদেশের মানুষ নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্যরা এসে নির্বিচার মানুষ খুন করছে। নিজের অলক্ষ্যে পাকিস্তান শব্দটির ওপর একটা ঘৃণা অনায়াসে জন্ম নিয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে দেশের গান শুনে তখনও আবেগপ্রবণ হয়ে যেতাম। রক্ত টগবগ করে উঠত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বজ্রকণ্ঠ শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটির কিছু কিছু অংশ প্রচার করত। বঙ্গবন্ধুকে আমি পেয়েছি তার ভাষণের মাধ্যমে। তিনি আমার শ্রæতির স্মৃতিতে সবসময় বিরাজমান। ইতিহাসের বাঁক ফেরানো সেই ভাষণটি বুকের ভেতর কবিতার মতো সবসময় বাজে। যে মানুষকে কখনো দেখিনি, তার কণ্ঠ শুনে বুকের ভেতর কেমন যেন একটা তোলপাড় হয়ে যেত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তার যে নাম শুনিনি তা নয়। সারাদেশে ছয় দফা, এগারো দফা আন্দোলনের ঢেউ আমাদের গ্রামটিকে যেন একটু বেশি দোলা দিয়েছিল। তার অবশ্য একটা কারণও ছিল। আমাদের বাড়ির সামনের পুকুরের অন্যপাড়ে ছিল তখনকার তুখোড় ছাত্র নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ নেতা এস এম ইউসুফের বাড়ি। আমাদের একই গ্রামের ছিল ন্যাপ নেতা চৌধুরী হারুনুর রশিদের বাড়ি। তাদের অনুসারীরা আমাদের গ্রামের মিছিল সভা ইত্যাদি করত। আমরা ছোটরা ৬ দফা, ১১ দফা দুটোর সঙ্গেই যোগ দিয়ে মজা পেতাম। খুব ছোটবেলাতেই দেশপ্রেমের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে আমাদের প্রজন্মের মানুষের। পড়াশোনার চাপ, ভর্তি পরীক্ষা, জিপিএর পেছনে দৌড়ানো, ক্যারিয়ার গঠন আমাদের শৈশবকে বিনষ্ট করেনি। বরং এইসব মিছিল সভা আমাদের ভেতরে লালসবুজের পতাকার প্রতি প্রেম তৈরি করেছে। সেই প্রেম থেকে কখন যে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হয়ে গেছি, তাকে প্রাণের নেতা হিসেবে বরণ করে নিয়েছি বুঝতেই পারিনি। আমার খুব মনে আছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের শুরুর তিন নম্বর শব্দটির মানে আমি বুঝিনি। আমি আমার এক বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম ভারাক্রান্ত মন মানে কী? তিনি আমাকে ভালো করে বোঝাতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, দুঃখে একেবারে কাহিল হয়ে পড়া। কিন্তু পুরো ভাষণ শুনে এমন তো মনে হতো না। বরং মনে হতো তার মধ্যে প্রবল শক্তি। মনে হতো অন্তরের কোন্ গহীন থেকে কেউ যেন অসীম শক্তি সাহস দিয়ে চলেছেন, আর তিনি একের পর এক বাণী উচ্চারণ করে যাচ্ছেন, যা একটি পুরো জাতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিচ্ছে। তিনি বলছেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। …সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’
ভারাক্রান্ত শব্দটার অর্থ বুঝতে ছোটবেলায় কষ্ট হলেও শব্দটার সৌন্দর্য শুরুর বাক্যটাকে কবিতার মর্যাদা দিয়েছে। আমি পড়ে বহুবার ব্যক্তিগত চিঠিতে, লেখায় এই শব্দ ব্যবহার করতাম।
প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দৃশ্যমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণসহ নানাভাবে তাকে দেখেছি। কিন্তু কখনো সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়নি। পাকিস্তান থেকে ফেরার পর তিনি একবার চট্টগ্রাম এসেছিলেন। পলোগ্রাউন্ড ময়দানে ভাষণ দিয়েছিলেন। আমার বাবা আমাকে বঙ্গবন্ধুকে দেখানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে বাবা আমাকে কাঁধের ওপর তুলে অনেক চেষ্টা করেছিলেন প্রিয় নেতাকে একটু দেখানোর জন্য। যখন কাঁধে চড়েও দেখতে পারছিলাম না, তখন বাবা তাঁর দুই হাত দিয়ে ধরে আমাকে উপরে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। আমি দূর থেকে হয়তো আবছা দেখেছি, কিন্তু বাবার কষ্ট দেখে খুশির ভান করে বলেছিলাম, দেখেছি। বাবা বলেছিল, আরেকটু বড় হলে আরও ভালোভাবে দেখবি। তবে সেই সুযোগ আমার আর হয়নি। আমাদের বড় হওয়ার আগেই ঘাতকের নির্মম বুলেট নেতাকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে আরেকবার দেখার সুযোগ এসেছিল ১৯৭৫ সালে। তাঁর জীবনের শেষ বছর। সেবার তিনি চট্টগ্রাম এসেছিলেন বেতবুনিয়া ভূউপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করতে। শুনলাম তিনি পতেঙ্গা বিমান বন্দর থেকে গাড়িতে করে বেতবুনিয়া যাবেন। বাবা আমাকে বললেন, যে পথ দিয়ে তিনি বেতবুনিয়া যাবেন সে পথের কোথাও দাঁড়ালে বঙ্গবন্ধুকে দেখা যাবে। আমি নিউমার্কেটেই গেলাম। গিয়ে দেখলাম এক অভাবনীয় কাণ্ড। নন্দনকাননের বাসা থেকে হেঁটে অপর্ণাচরণ স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে আর এগুতে পারলাম না। পথজুড়ে হাজার হাজার মানুষ। এক চুল এগুনো যাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু এই পথ দিয়ে আসবেন, তাঁকে একনজর দেখবেন এই আশায় এতগুলো মানুষ আজ ঘর থেকে বের হয়েছে। আর তাতে চিরচেনা আমতল, নিউমার্কেট, স্টেশন রোড আমার অচেনা লাগছে। এত মানুষ, বঙ্গবন্ধুর এত ভক্ত! আমি হালকা, পাতলা গড়নের, বয়সের তুলনায় দেখতে আরও ছোট মনে হয়। কীভাবে জানি সেই মানুষের ভিড়ের ভেতর এগুতে এগুতে কোনো রকমে নিউমার্কেট মোড় পৌঁছলাম। তারপর অপেক্ষার শুরু। এক পর্যায়ে শুরু হলো আকাশ ফাটানো সেøাগান। বঙ্গবন্ধু আসছে, ওই তো দেখা যাচ্ছে, ওই তো। সবাই হাততালি দিচ্ছে, চিৎকার করছে। নিউমার্কেট মোড় থেকে গলা উঁচিয়ে দেখলাম সেই মুজিব কোট, সেই এক হাত ঊর্ধ্বে তোলা বঙ্গবন্ধু নয়, বঙ্গবন্ধুর বিশাল এক প্রতিকৃতি আসছে ট্রাকে করে। খুবই হতাশ হলাম। এসময় অচেনা এক মানুষ আমাকে বললেন, বঙ্গবন্ধু এদিক দিয়ে আসবে ঠিক, কিন্তু যখন আসবে তখন তুমি মানুষর ঠেলাঠেলিতে পড়ে যাবে। এটা চার রাস্তার মোড়, তাই ভিড় বেশি। আর এখানে তিনি দাঁড়াবেন না। তুমি বরং চট্টগ্রাম কলেজের সামনে চলে যাও। ওখানে ভিড় কম হবে। লোকটির পরামর্শে আমি ভিড় ঠেলে বেরিয়ে চট্টগ্রাম কলেজের দিকে রওনা হলাম। নন্দনকানন, মোমিন রোড, জামাল খান পার হয়ে, সেন্ট মেরিস স্কুলে এসে দেখা পেলাম আমার কলেজিয়েট স্কুলের বন্ধু উজ্জ্বলকে। সে খুব খুশি। উচ্ছ¡সিত। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে জানাল বঙ্গবন্ধুকে সে দেখেছে। বন্ধু যতটা উচ্ছ¡সিত, আমি ততটা হতাশ। জানতে চাইলাম, উনি ওখানে দাঁড়িয়েছেন কিনা। বলল, কয়েক মিনিটের জন্য দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু একটি কবিতা আবৃত্তি করেছেন। কিন্তু কী কবিতা সেটা বলতে পারল না। পরে আমি আমার বন্ধু ছড়াকার অজয় দাশগুপ্তের কাছে শুনেছি, তিনি রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত চরণ আবৃত্তি করেছিলেন- ‘চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস, শান্তির ললিতবাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ তবে কী তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন, শান্তির বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে এক ঘোর ষড়যন্ত্র চলছে? তিনি কী বুঝতে পেরেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন বাঙালির স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তুলতে সাপেরা ফনা উদ্ধত করে রেখেছে?
বঙ্গবন্ধুকে আমি দেখিনি, কিন্তু যে ভাষণ, যে কথা, যে অমোঘ বাণী আমি শুনেছি তা দেখারও অধিক কিছু। সেই শোনা বাণী পুরো একটা জীবনের চলার নির্দেশনা হয়ে আছে একটা জাতির জন্য। বেতারের মাধ্যমে তাঁর বহু ভাষণ শুনেছি। তাঁর সেই সব কথা সময়ে অসময়ে আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এখনো সেগুলো অবিকল্প হয়ে আছে। এখনো ধ্রæবতারার আলো হয়ে আছে তার বাণী।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে দুর্নীতিবাজ, মুনাফাখোর, সুদখোরদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি অতীষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন এদের কর্মকাণ্ডে। যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশ যাতে উপরের দিকে উঠতে না পারে তার জন্য দুর্নীতিবাজেরা লাগাম ধরে রেখেছে। সেটা তিনি বুঝেছেন হাড়ে হাড়ে।
এখনো যতবার শুনি ততবার মনে হয় এমন আবেগময়, অকৃত্রিম অন্তরের গহীন থেকে উৎসারিত বাক্য উচ্চারণকারী নেতা আমাদের দেশে আর কখনো আসবে না। মাটির প্রতি তাঁর মায়া, দেশের প্রতি তাঁর দরদ, মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা তার কথায়, বাণীতে স্পষ্ট হয়ে উঠত। ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি কথা, প্রতিটি শব্দ বাঙালির চিরকালের কাব্য, বাঙালির জেগে থাকার মন্ত্র। আমার কানে সবসময় বাজে- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
শুধু ৭ মার্চের ভাষণ নয়, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অনেক বাক্য এখনো কানের কাছে সরব হয়ে থাকে। যেসব বাক্য শুধু একটা জাতির নয়, পুরো বিশ্বের মানুষের জন্য দিকনির্দেশনা রয়েছে।
আজ সারা বিশ্বে অদৃশ্য ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। দেশে দেশে বর্ণে বর্ণে, ধর্মে ধর্মে হিংসার বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে উগ্রবাদ। ঠিক এই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণ চেতনায় আঘাত হানছে। সনটা ঠিক মনে নেই। ৭৪ অথবা ৭৫ সালে বেতারের মাধ্যমে তিনি একবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে আমাদের সংবিধানের চারটি মূল ভিত্তির কথা বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন চারটি মূলনীতির। এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।’ জাতিকে বোঝানোর চেষ্টায় প্রাণ থেকে উচ্চারণ করেছিলেন, মানবতার সেই অমর বাণী। সেই কথাটা তিনি সেদিন শুধু কথার কথা বলেননি। উচ্চারণভঙ্গিই বলে দিয়েছিল মানুষের প্রতি কতটা ভালোবাসায় তিনি অকৃত্রিম উচ্চারণ করেছিলেন। সমস্ত ঘৃণা, বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার অনঢ় মানবিক অবস্থান। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ যাতে সেই অবস্থান থেকে দূরে সরে না যায়। তার জন্য আমাদের প্রয়োজনে একাত্তরের মতোই কঠিন হতে হবে।

ছয়.
মানুষ মারার যন্ত্র
যুদ্ধের শুরুর দিকে আমি কয়েকদিন ক্লাস করেছিলাম। আমাদের কলেজিয়েট স্কুলটি ছিল পাকহানাদারদের অস্ত্রের ঘাঁটি। স্কুলের প্রধান ভবন ছাড়িয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টসের ল্যাবরেটরিতে যাওয়ার পথে বাম দিকে কয়েকটি ভবন ছিল। সেই সব ভবনে রক্ষিত ছিল বড় বড় গোলাবারুদ। আমি অবাক হয়ে একদিন সেগুলোর দিকে তাকাচ্ছিলাম। তখন পাক হানাদার বাহিনীর একজন দোসর আমাকে দেখে বলেছিল, এই ছেলে কী দেখ? এগুলো সব মানুষ মারার যন্ত্র। এরপর থেকে সে বছর আমি আর স্কুলে যাইনি। বাবাকে বলেছিলাম, বাবা ওখানে মানুষ মারার যন্ত্র আছে, আমি যাব না। সেই সময় আমাদের ক্লাসে একজন স্যার দেশের পরিস্থিতির কথা বলতেন। যুদ্ধ কেন চলছে, মানুষ কীভাবে প্রাণ হারাচ্ছে, নারী জাতির সম্মান কীভাবে লুণ্ঠিত হচ্ছে সেই সব কথা অবলীলায় বলতেন। স্বাধীনতার পর শুনলাম সেই বীর মানুষটি শহীদ হয়েছেন।

সাত.
বেঁচে থাকাটাই অস্বাভাবিক
যুদ্ধ শেষে সদ্য স্বাধীন দেশে আমরা যেদিন প্রথম স্কুলে গিয়েছিলাম সেদিন কোনো পড়ালেখা হয়নি। সবাই একে অপরকে জড়িয়ে কোলাকুলি। কোথাও হো হো হাসি, কোথায় জয় বাংলা ধ্বনি, কোথাও বা আবার কান্না। আমাদের একজন স্কাউট স্যার ছিলেন, মুখলেসুর রহমান। তবে তাকে সবাই অন্য নামে চিনতেন। যুদ্ধের পরে স্কুলে ছাত্র শিক্ষক যাকেই দেখেছেন তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, ‘বেঁচে আছো? আশ্চর্য তো, বেঁচে থাকাটাই অস্বাভাবিক, মৃত্যুই স্বাভাবিক। আমাদের এমন দিন কীভাবে গেল?

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়