করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

বুনো ঝর্না সুজন বড়–য়া

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এতদিন ভাবতাম, আমি নিজেকে নিজে ভালো চিনি। কিন্তু আজ আমার সে ধারণা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমি শুভাশিস। বয়স ছত্রিশ। বিবাহিত। আমার স্ত্রী লিলি। আমাদের এক সন্তান, ছেলে। ছেলের বয়স ছয়। ছেলে দীপ্র আর স্ত্রী লিলিকে নিয়ে আমার সংসার। আমি সরকারি চাকরি করি। আমার স্ত্রীও সরকারি চাকরিজীবী।

আমাদের ভালো বোঝাপড়া। তবে আমি একটু চাপা স্বভাবের সাদাসিধে একজন মানুষ। আমি কিছুটা ভীতু প্রকৃতিরও। কারো সাতে পাঁচে থাকি না। কেউ আঘাত করলে বা কষ্ট দিলেও আমি মুখ বুজে থাকি, কিছু বলতে পারি না। সামাজিক রীতিনীতি অনুশাসনেই আমার জীবনের ছককাটা। এটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমি মোটামুটি এ রকম।
কিন্তু আজ আমার প্রথম মনে হলো, আমি আমাকে পুরোপুরি চিনি না। আমি যাকে চিনি সে ছাড়াও আমার মধ্যে আরেকজন বাস করে, যে খোলামেলা অকপট ও আবেগপ্রবণ, কখনো-বা কারো কারো কাছে যে উজাড় করে দিতে পারে নিজেকে, আর কখনো কখনো সে বেশ সাহসী। কীভাবে এই নতুন ‘আমি’র পরিচয় পেলাম সেই গল্পটা তাহলে এবার বলতেই হয়। আর সেই সঙ্গে একজনের কথা অবশ্যই বলতে হবে, তার নাম মুনিয়া।
মুনিয়া আমার কলিগ। চটপটে সচেতন সৌজন্য-পটু মেয়ে। আমার দশ বছরের ছোটো। চাকরিতে আমার বারো বছরের জুনিয়র। তবু অফিসের কাজের লেনদেনে আলাপে মুনিয়া আমার খুব কাছের। আমি মুনিয়াকে এখন মুনা বলে ডাকি।
এই মুনিয়া হঠাৎ পাঁচ দিনের ছুটিতে চলে গেল। গতকাল অফিসে এসেছে পাঁচ দিন পর। কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা করেনি। ওর ঘরে বসে চুপচাপ বসে কাজ করে চলে গেছে। এমনটা কখনো হয় না। কাজে অকাজে বা কারণে অকারণে দিনে দুয়েকবার আমাদের দেখা হয়ই। হয় সে আমার ঘরে আসে, না হয় আমি ওর ঘরে যাই। সেখানে পাঁচ দিন ছুটি কাটিয়ে অফিসে এসে দেখা না করা একটু কি অস্বাভাবিক নয়? বিকেলের দিকে অবশ্য মুনিয়ার পিয়ন রেজাউল একটি ফাইল নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। কাজের ফাঁকে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, জানেন নাকি, মুনিয়া ম্যাডাম তো বিয়ে করেছে।
রেজাউলের কথা শুনে আমি হা হয়ে গেলাম। রেজাউল বলে কী! মুনিয়া বিয়ে করেছে! অথচ আমি জানি না। অবশ্য আমাকে জানতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। মুনিয়া যথেষ্ট প্রাপ্ত বয়স্ক একটি মেয়ে, বিয়ে করতেই পারে। আমিও তো বিবাহিত। কিন্তু মুনিয়া বিয়ে করেছে শুনে আমি চমকে উঠলাম কেন? এমন অবাকই-বা হচ্ছি কেন? তার থেকে বড়ো প্রশ্ন মুনিয়া কেন বিয়ের কথা আমাকে নিজের মুখে বলতে পারল না? লজ্জা, সংকোচ? নিজে বলতে না পেরে বিয়ের কথা বলার জন্য মুনিয়াই কি তবে রেজাউলকে পাঠিয়েছে আমার কাছে? রেজাউলকে এ কথা জিজ্ঞেস করতে আমার বাধল। আমি জিজ্ঞেস করতে পারলাম না।
আমরা একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। মুনিয়া আর আমি একই গ্রেডের কর্মকর্তা। কিন্তু আমাদের কাজের ধরন ভিন্ন। শিশু-কিশোরদের সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও নানা ধরনের বইপত্র প্রকাশনা আমাদের একটি প্রধান কাজ। আমি এই বিভাগের যাবতীয় বইপত্র প্রকাশনা ও মুদ্রণ কাজ তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়েজিত। আর মুনিয়া কাজ করে প্রশাসনে। তবে ওর দায়িত্ব চেয়ারম্যানের দপ্তর সামলানো। আমাদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের পদটা আলঙ্কারিক। চেয়ারম্যানের নিয়মিত দায়-দায়িত্ব তেমন নেই। দৈনিক অফিস করতে হয় না তাকে। মিটিং সিটিং বা বিশেষ কাজ বা অনুষ্ঠান থাকলেই কেবল তিনি আসেন। তাই মুনিয়ার দাপ্তরিক কাজের চাপ অপেক্ষাকৃত কম।
মুনিয়া যখন চাকরিতে যোগ দেয়, তখন আমি এনসাইক্লোপিডিয়া প্রকাশের কাজ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। তিন বছরে পাঁচ খণ্ডে একটি পূর্ণাঙ্গ এনসাইক্লোপিডিয়া প্রকাশের পরিকল্পনা। এনসাইক্লোপিডিয়ার জন্য পাঁচজনের একটি সম্পাদনা পরিষদ ও ছেষট্টিজন লেখক নিয়োজিত আছেন। আমি ছাড়া অন্য সবাই বহিরাগত। প্রতি সপ্তাহে সম্পাদনা পরিষদের নিয়মিত একটি মিটিং করতে হয়। সম্পাদনা পরিষদের এই সভা অনুষ্ঠান, সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন, এনসাইক্লোপিডিয়ার জন্য মোটামুটি তিন হাজারের মতো বিভিন্ন বিষয়ের ভুক্তি রচনা, সম্পাদনা ইত্যাদি কাজ নিয়ে আমি একা অথই সাগরে সাঁতরাচ্ছি। আমাকে সাহায্য করার কেউ নেই। প্রায় দুই বছর শেষ। এনসাইক্লোপিডিয়ার প্রথম খণ্ড প্রকাশ দূরের কথা, প্রথম খণ্ডের কাজ গুছিয়ে আনার কিনারাই খুঁজে পাচ্ছি না। এমন সময় মুনিয়াকে তার নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি আমার সঙ্গে কাজ করার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হলো।
অফিস ভবনের তিন তলার একটি ঘরে এনসাইক্লোপিডিয়ার দপ্তর। নিরিবিলি ঘর। লেখাপড়া ও সম্পাদনা কাজের জন্য দারুণ উপযোগী। ঘরের মাঝামাঝি উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি একটি টেবিল বসানো। এই টেবিলের চারপাশে হাতলযুক্ত কুশন চেয়ার সাজানো। টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি বসে কাজ করতে থাকি আমরা দুজন। আমি আর মুনিয়া।
মুনিয়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ¯œাতকোত্তর। তবে সার্বিক জ্ঞান, পড়াশোনা ও বুদ্ধি-বিবেচনা বেশ ভালো। সবচেয়ে ভালো ওর জানার আর শেখার আগ্রহ। আমার সঙ্গে থেকে অল্প ক’দিনের মধ্যেই ও এনসাইক্লোপিডিয়ার কাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। আমরা সকালে অফিসে এসে কাজে বসি। কাজ করে যাই একটানা। দুপুরে আমি এ ঘরে বসেই লাঞ্চ সেরে নিই। মুনিয়া নিচ তলায় ওর ঘরে গিয়ে লাঞ্চ সেরে আসে। একসঙ্গে না খেলেও মুনিয়া প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো খাবার নিয়ে আসে আমার জন্য। প্রথম প্রথম আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগত। আমি আপত্তি করতাম। কিন্তু ওতে মুনিয়াকে নিরস্ত করতে না পেরে ক্ষান্ত দিয়েছি। এখন আর কিছু বলি না। ভাবি, মুনিয়া অন্যরকম, সবার থেকে আলাদা, ঘরোয়া, উন্নতমনা।
মুনিয়ারা তিন বোন এক ভাই। মুনিয়া সবার বড়ো। বাবা সরকারি চাকরি করেন। মা গৃহিণী। অন্য ভাই বোনরা সবাই স্কুল-কলেজে পড়ছে। সুতরাং সংসারে মুনিয়ার দায়-দায়িত্বও কম নয়। সব সময় বাবা-মার পাশে দাঁড়াতে হয়। এটাকে কর্তব্যজ্ঞান করে মুনিয়া। ভাই বোনদের নিয়ে যত ভাবে নিজের ব্যাপারে ততটাই উদাসীন ও। অথচ দেখতে শুনতে আকর্ষণীয় বেশ। মাঝারি উচ্চতা, সুগঠিত শরীর। দুধে-আলতা গায়ের রং। সুশ্রী অবয়ব, ডাগর কালো চোখ। মিষ্টি কণ্ঠস্বর। পোশাকে চলনে মার্জিত পরিপাটি। সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি দুটোতেই দারুণ মানায় ওকে। তবে ও শাড়ি পরে একটি বিশেষ কায়দায়। এমন গুছিয়ে শাড়ি পরে যে, অপূর্ব মোহনীয় মনে হয়।
কাজকর্মেও ধীর স্থির গোছালো। অল্প বয়স থেকে ওর বই পড়ার নেশা। বাংলার ক্ল্যাসিক আধুনিক উপন্যাসের আদর্শ নায়িকাদের সব গুণ যেন একাই নিজের মধ্যে ধারণ করেছে মুনিয়া। তবু চাঁদের কলঙ্কের মতো মুনিয়ারও ভাগ্য একটু মন্দ। ওর শরীরে একটি রোগ দৃশ্যমান, যার নাম শ্বেতী। মুখের বাঁ কপোলে, ডান হাতের মণিবন্ধের ওপরের অংশে আর দু’পায়ের পাতায় এই রোগের হালকা আঁচড় স্পষ্ট। যেন ভুবনজয়ী নায়িকা হতে হতে কক্ষচ্যুতি ঘটেছে ওর। এজন্য কেমন এক কুণ্ঠিত ভাব ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে সব সময়। অদ্ভুত মায়া জাগানো সে ভাব।
মুনিয়ার ¯িœগ্ধ ন¤্র আন্তরিক আচরণ অল্প ক’দিনেই অন্যরকম এক মুগ্ধতা ছড়াল আমার মনে। ওর বই পড়ার অভ্যেসের কথা জেনে আরো আকৃষ্ট হলাম আমি। আমার পাঠাভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখি ওর পাঠরুচি মন্দ নয়। আমার সংগ্রহ থেকে নিয়মিত ওকে বই পড়তে দিতে লাগলাম। বই সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহারে আমি সব সময় সচেতন ও যতœবান। আমি অবাক হয়ে দেখি, আমার দেয়া বইগুলো মুনিয়া আমার মতোই খুব যতেœর সঙ্গে ব্যবহার করে। আমার কোনো কোনো পুরনো বইয়ের জীর্ণদশা দেখে পড়তে শুরু করার আগেই মলাট লাগিয়ে নেয় ও। পড়ার পর যখন বই ফেরত দেয়, তখন আমার মনে হয় গভীর ভালোবাসার প্রলেপ জড়িয়ে দিয়েছে মুনিয়া। এভাবে আমার বইয়ের সংগ্রহ উজাড় করে দিলাম ওকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, আশাপূর্ণা দেবী, মৈত্রেয়ী দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদারের অনেক বই পড়ে ফেলল মুনিয়া। প্রতিটি বই পড়ার পর ওকে অদ্ভুত চনমনে লাগে আমার। যেন ওর চেহারা থেকে নতুন এক দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে। যতই দিন যায় আমি যেন নতুন মুনিয়াকে দেখি, গতকাল থেকে যে আজ আরো সপ্রতিভ, শানিত।
দেখতে দেখতে দুই বছর কেটে গেল। আমাদের এনসাইক্লোপিডিয়ার কাজও শেষ। আমরা আবার অফিসের নিয়মিত কাজে ফিরে এসেছি। আমি তিন তলার এনসাইক্লোপিডিয়া কাজের ঘরটা ছেড়ে দিয়েছি। আমার বসার জন্য নিচতলায় একটি ঘর দেয়া হয়েছে। অফিসে ঢুকতেই মুনিয়ার বসার ঘর। তারপর মাঝখানের করিডোর ধরে সামনে এগোলে ডানপাশে মাঝামাঝি আমার ঘর। এটাই আমার দপ্তর। এনসাইক্লোপিডিয়ার কাজ শেষ হওয়ার পর মুনিয়ার সঙ্গে আমার আর ধরাবাধা কাজ নেই। তবু হালকা অবসরে মুনিয়া আসে আমার ঘরে। আমিও যাই মাঝেমধ্যে ওর ঘরে। তখন নানা গল্প-কথা হয় আমাদের।
বাংলা একাডেমির মাঠে অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু হলো। মুনিয়া বলল, আপনার সঙ্গে একবার মেলায় যাব, বই দেখব।
এমন নির্মল প্রস্তাব ফেরানো যায়? আমি বললাম, গেলেই হয়। আজও যাওয়া যায়।
সেদিন বিকেলেই অফিস শেষে বইমেলায় গেলাম আমরা। স্টলের পর স্টল ঘুরে সন্ধ্যা পর্যন্ত বই দেখলাম। মুনিয়া কয়েকটা বইও কিনল। এক সময় একটি বই কিনে আমার হাতে দিয়ে বলল, এটি আপনার জন্য।
আমি প্যাকেট খুলে দেখি, সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস, নাম ‘কেউ কেউ একা’।
মুনিয়ার বইটা হাতে নিয়ে মনে হলো, আমারও ওকে একটা বই উপহার দেয়া উচিত। সঙ্গে সঙ্গে আবার নিজের ওপর রাগও হলো, আমি কেন আগে ওকে বই উপহার দিলাম না? যা হোক, দুই স্টল ঘুরে একটি বইও কিনে ফেললাম। আমিও সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস কিনলাম, নাম ‘মনের মতো মন’। তারপর বইয়ের প্যাকেটটা মুনিয়ার হাতে দিয়ে বললাম, এটি আপনার।
মুনিয়া আমার সামনেই প্যাকেটটা খুলল। মুখে অদ্ভুত এক হাসি ছড়িয়ে বলল, তাই বলে ঝটপট এমন জুতসই প্রত্যুত্তর!
মুনিয়া যেমন বই পড়তে ভালোবাসে তেমনি ভালোবাসে খেলাধুলা। ফুটবল ক্রিকেট দুটোই। এ দুটো খেলা আমারও প্রিয়। তবে আমাদের ফেভারিট দল আলাদা। ক্রিকেটে বাংলাদেশ ছাড়া ভারত আমার প্রিয় দল, মুনিয়ার পাকিস্তান। ফুটবলে আমার ইতালি আর মুনিয়ার ব্রাজিল। তবু এসব নিয়ে আড়াআড়ি নেই আমাদের। অফিস সময়ের মধ্যে যদি কখনো খেলা পড়ে আমরা কাজের ফাঁকে প্রায় একসঙ্গে বসেই খেলা দেখি বা শুনি।
বাংলাদেশ যেবার মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠে আইসিসি ট্রফির ফাইনাল খেলছিল, সেবার আমাদের কী উত্তেজনা! টিভিতে সে খেলা দেখার সুযোগ ছিল না, তবে অফিসে পাশাপাশি বসে রেডিওতে ফাইনাল খেলার পুরো কমেন্ট্রি শুনেছি আমরা। ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে ট্রফি জেতার পর বিকেলে প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে আমরা বিজয় র‌্যালিতে যোগ দিয়েছি। শুধু তাই নয়, পরের শুক্রবারে প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা নগরে ক্রিকেট দলের সংবর্ধনার আয়োজন করলে অফিস থেকে দলবেঁধে সেখানেও গিয়েছি আমরা। সেই দলেও ছিল মুনিয়া। তাছাড়া বাংলা নববর্ষ, বিজয় দিবস বা অন্য বিশেষ বিশেষ দিন উপলক্ষে অফিসের বাগানে বনভোজনের মতো খাওয়ার আয়োজন করি আমরা। এসব আয়োজনে রান্নাবাড়ার সানন্দ দায়িত্ব পালন করে মুনিয়া। রান্নাবাড়া ও খাওয়ানোর জন্য নিজেই ডেকচি-পাতিল, বাসন-কোসন-চামচ টেনে নিয়ে আসে বাসা থেকে। রান্নায় ওর হাতযশও দারুণ। আমরা খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি আর ওকে প্রশংসা-বন্যায় ভাসাতে থাকি। মুনিয়া আরো দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে পরবর্তী আয়োজনে। তবে সব আয়োজনে অফিসের এত মানুষের মধ্যেও খাবার বিতরণের সময় মুনিয়া আমার প্রতি যেন কেমন একটু উদার। মুনিয়ার এই বিশেষ পক্ষপাতও কখনো দৃষ্টি এড়ায় না আমার।
এভাবে মুনিয়া কখন আমার মনের কতটা জায়গা দখল করে নিয়েছে বা আমার মনের ভেতর মুনিয়ার জন্য নরম একটি জায়গা তৈরি হয়েছে, আমি বুঝতে পারিনি। মুনিয়া একদিনের ছুটিতে থাকলে বা অফিসে না এলে আমার কেমন যেন লাগে। মনে হয় বুকের কোথাও একটি জায়গা শূন্য হয়ে আছে। সেই শূন্যস্থান ভেতরে বারবার হাহাকার ছড়ায়। সেই মুনিয়া হঠাৎ পাঁচ দিন ছুটি কাটিয়ে এসে দেখা না করে চলে গেছে। তা কি মানা যায়?
কেমন যেন লাগছে হঠাৎ, খারাপ না, হতাশ- ঠিক কেমন অনুভূতি বুঝতে পারছি না। ‘অনুভূতিহীন’ এই অনুভূতি নিয়ে অফিস শেষে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু বাসায় ফিরতে ইচ্ছে হলো না। অফিসের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। সামনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। উদ্যানে ঢুকে একা একা অনেকক্ষণ হাঁটলাম নিরিবিলি। কিন্তু ভেতরের অস্বস্তি ভাবটা কাটল না। কেন এই অস্বস্তি তাও বুঝে উঠতে পারছি না। সন্ধ্যা নেমে আসছে। উদ্যান থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি এলেবেলে।
বাসায় ঢুকতেই লিলি বলল, কী হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন মন মরা লাগছে কেন?
আমি বললাম, কই, না তো, আমার কিছু হয়নি।
খানিক পর ফ্রেশ হয়ে বসতেই অভ্যেসমতো দীপ্র বলল, বাবা গল্প শোনাও।
গল্প! হ্যাঁ, গল্প হবে। আগে তোমার বইগুলো আনো, বইয়ের রঙিন ছবিগুলো দেখাই। ছেলের বইগুলো নাড়াচাড়া করেই ওর সঙ্গে সময় কাটালাম। অন্যদিনের মতো আর বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা হলো না। রাতে খেয়েদেয়ে প্রতিদিনের মতো শুয়ে পড়লাম। কিন্তু চোখের পাতা মুদে আসছে না। ঘুমটা যেন ঠিকমতো হচ্ছেই না। হঠাৎ এমন নিদ্রা-ব্যাঘাতের কারণও খুঁজে পাচ্ছি না। মুনিয়াই কি এর কারণ? কিন্তু মুনিয়া তো আগেও কতবার ছুটিতে গিয়েছে, কখনো তো আমার নিদ্রা-ব্যাঘাত হয়নি। তাহলে মুনিয়ার বিয়ের খবরটাই কি আমার এমন কষ্টের কারণ?
আজ সকালে আবার যথারীতি অফিসে এসেছি। আমি আমার ঘরে বসে কাজ করছি। মুনিয়া কি আজ এসেছে? জানতে ইচ্ছে করল। কিন্তু জানার চেষ্টা করলাম না। অন্যদিন এ সময়ের মধ্যে আমাদের দুয়েকবার দেখা হয়ে যেত। ও আমার ঘরে আসত নইলে আমি যেতাম ওর ঘরে। আজ আর তা হলো না।
আমার ঘরে আমি একা বসি। বাসা থেকে লাঞ্চ নিয়ে আসি। লাঞ্চ আওয়ারে দরজা বন্ধ করে আমি ঘরেই লাঞ্চ সারি। আজও লাঞ্চ করার জন্য দরজা বন্ধ করলাম। আমি আমার কাজের চেয়ারে বসেই সাধারণত লাঞ্চ করি। দরজা বন্ধ করে এসে চেয়ারে বসেছি, এমন সময় আমার ল্যান্ড ফোন বেজে উঠল। আমি ফোনের হ্যান্ডসেট তুলে কানে লাগাতেই ওপাশের কণ্ঠস্বর শুনে থমকে গেলাম। আমি নির্ভুল চিনতে পারলাম মুনিয়ার মিহিন কণ্ঠস্বর। মুনিয়া যেন আজ অনেক গভীর থেকে ধীর লয়ে বলল, হ্যা-লো-।
আমি অপ্রস্তুত। ফোনের হ্যান্ডসেট কানে লাগিয়ে চুপ করে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। কীভাবে শুরু করব সহসা ভেবে পাচ্ছি না। মুনিয়াই নীরবতা ভাঙাল, নিস্তরঙ্গ গলায় টেনে টেনে বলল, কেমন আছেন আপনি?
আমি চুপ করে রইলাম। কী বলব? মুনিয়ার প্রশ্নটা আমি নিজেকে করলাম, আমি কি ভালো আছি? ভালো আছি- বললে মিথ্যে বলা হবে। আবার ভালো নেই-তা-ই-বা বলি কী করে? মুিনয়া কী ভাববে? ভাবতে ভাবতে আমি এবার শীতল গলায় বললাম, আমার কথা থাক, আপনার কথা শুনি।
আমার আর কী কথা? এই আছি এক রকম।
আমি এবার বললাম, হঠাৎ ছুটি কাটালেন, কালও নাকি এসেছিলেন। দেখা যে হলো না।
মুনিয়া বলল, হ্যাঁ হঠাৎই ছুটিতে থাকতে হলো। দেখা করতে চেয়েছিলাম আরো আগে ছুটির মধ্যে, শুক্র-শনিবারে। দেখা করা খুব জরুরি ছিল, খুব মনে পড়ছিল আপনাকে।
কেন, কী হয়েছে?
মুনিয়া খানিক চুপ করে থেকে বলল, না মানে, বাড়ির সবাই চেপে ধরল, বিয়ে করতে হবে।
হ্যাঁ, ঠিক আছে, বিয়ে তো করতেই হতো। কিন্তু আমার কথা কেন মনে পড়ছিল?
জানি না, মনে পড়লে আমি কী করব? আমার কেবল মনে হচ্ছিল, বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আপনার সঙ্গে কথা বলা দরকার। -মুনিয়ার গলাটা কেমন যেন রহস্যময় শোনাল। অল্প বয়সের খেয়ালিপনা, নাকি গভীর হৃদয়াবেগ!
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সহসা কোনো কথাও মুখে আসছে না। এখন আমার কী বলা উচিত? বিয়ে বিষয়ে মুনিয়ার সঙ্গে তো আমার কখনো কথা হয়নি। তবু কেন মুনিয়ার এমন মনে হবে? মুনিয়া কি আমাকে নিয়ে মজা করছে? কিন্তু মুনিয়া তো তেমন মেয়ে নয়। আমি খানিক চুপ থেকে বললাম, বিয়ের ব্যাপারে বুঝি আমার কাছে অন্যরকম কোনো সূত্র ছিল?
জানি না, আমি জানি না। -বলতে বলতে মুনিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমি স্পষ্ট মুনিয়ার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মুনিয়া কাঁদছে অঝোরে, অবিরাম। মুনিয়ার কান্না এ পাশে আমাকেও ছুঁয়ে গেল। কিন্তু আমাকে ফোন করে এভাবে কাঁদছে কেন মুনিয়া? তাহলে আমার মন খারাপের সঙ্গে মুনিয়ার কান্নার কি কোনো সম্পর্ক আছে? যে কারণে গতকাল থেকে আমার মন খারাপ, সেই একই কারণে কি মুনিয়া কাঁদছে? আমার বুকটাও এবার ভারী হয়ে এলো। একেবারে অন্যরকম এই ভার। আমি বললাম, থাক না মুনা, এসব কথা থাক।
মুনিয়া এবার আরো জোর দিয়ে বলে উঠল, কেন থাকবে? আমি তো আপনাকেই আমার মনের কথা জানাব। আপনি সত্যি করে বলুন তো, আমার বিয়ের কথা শুনে আপনার কি মন খারাপ হয়নি?
আমি এবার একেবারে চুপ মেরে গেলাম। মুনিয়া কি মনোবিজ্ঞানী? মেয়েরা এ রকম! যেন আমার মধ্যে এক শীতল নীরবতার বরফ গলছে। অনেকক্ষণ পর বললাম, রেজাউলের কাছে শোনার পর থেকে আমার কেমন লাগছে এবং আমার ভেতরে কী চলেছে, বলতে পারব না। কাল রাতে আমি একটুও ঘুমোতে পারিনি।
তাহলে আমার এই কান্না নিশ্চয়ই মিছেমিছি নয়।
মুনিয়ার এ কথা শুনে আমি আর ধরে রাখতে পারলাম না নিজেকে। আমি যেন অন্য এক শুভাশিস হয়ে গেলাম। আমার বয়স অবস্থান সবকিছু ছাপিয়ে আমাকে আচ্ছন্ন করে বসল অচেনা বাঁধভাঙা এক আবেগ। টেলিফোনের এ পাশে আমিও কেঁদে উঠলাম ফুঁপিয়ে। অনেকক্ষণ মুখে কোনো কথা নেই আমাদের। দু’পাশে দু’জন টেলিফোন কানে লাগিয়ে বসে আছি চুপচাপ। যেন আমাদের অবচেতনে মনের গহীন কোণে চাপাপড়া কথাগুলোর তরজমা শুনছি, যা অনূদিত হচ্ছে কান্নার অনুচ্চ শব্দে অশ্রæজলে। যাকে এতদিন আমরা কেউ আমলেই নেইনি।
আমি ধীরে ধীরে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলাম নিজেকে। বেশ কিছুক্ষণ পর বললাম, মুনা, এমন করে না। আপনি বুদ্ধিমতী। বাস্তব দিকটাও মাথায় নিতে হবে। আমরা সামনের দিকে তাকাই। আপনার নতুন মানুষটা সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করছে, আমাকে জানানো যায়?
আমার কথা শেষ হতে না হতে মুনিয়া কেঁদে উঠল আরো জোরে। আমি স্পষ্ট ওর সশব্দ কান্না-জড়ানো নিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছি। আমি যেন অজান্তেই ঘি ঢেলে দিয়েছি আগুনে। হঠাৎ যেন মুনিয়ার ভেতরের চাপা আগুনটা দাউ দাউ করে ঝলকে উঠেছে। মুনিয়া এবার থমথমে গলায় বলল, এখন আর আপনার ওসব জেনে কী লাভ?
আমি একটু থমকে গিয়ে দ্রুত মুনিয়াকে শান্ত করার উপায় খুঁজলাম মনে মনে। নিজেকে শুধরে নেয়ার ভঙ্গিতে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ মুনা, ঠিক আছে, আমিই ভুল করেছি, মানছি আমার ভুল হয়েছে। আজ থাক, পরে আমরা কথা বলব। প্লিজ শান্ত হোন, এখন ফোন রাখুন।

দুই.
হঠাৎ আমি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলাম। এতদিনকার চেনা শুভাশিসকে ছাপিয়ে আমার মধ্যে জেগে উঠল আরেক শুভাশিস। যেন গহীন পাহাড়ের ভেতর চাপা পড়া এক বুনো ঝর্নার উৎসমুখ খুলে গেল হঠাৎ। সেই পাগলা ঝর্না ¯্রােত গিরি খাদ ভেঙে অবিরাম গড়িয়ে চলল অসীমের ডাকে, যেখানে মুনিয়া নামের আরেকটি বুনো ঝর্নার হাতছানি।
কেমন যেন এক অপূর্ব অনুভূতি আচ্ছন্ন করে বসল আমাকে। আমার কিছু করতে ভালো লাগে না আর। না কাজ, না পড়াশোনা, না খাওয়া-দাওয়া। ঘুমও আসতে চায় না ঠিকমতো। ঘুমের ভান করে বিছানায় শুয়ে থাকি চুপচাপ। উশখুশ করারও সুযোগ নেই। লিলি প্রশ্ন করবে। ভেতরের যত হাঁসফাঁস সব চেপে রাখি ভেতরে। হঠাৎ এ কি হলো আমার? কেন এমন হলো? নিজের কাছে নিজে উত্তর খুঁজি চুপচাপ।
পরদিন সকালে অফিসে ঢোকার সময় মুনিয়ার ঘরের দিকে তাকালাম। ঘর বন্ধ। আমি যথারীতি আমার ঘরে এসে কাজ নিয়ে বসলাম। ঘরে আর কেউ ছিল না, আমি একা। কিছুক্ষণ পর দরজার পর্দা নড়ে উঠল। দেখি মুনিয়া উঁকি দিচ্ছে। চোখাচোখি হতেই ¤øান হেসে ঘরে ঢুকল।
বিয়ের পর মুনিয়াকে আজ প্রথম দেখছি আমি। পরনে বেগুনি রঙের সিল্কের শাড়ি। ম্যাচিং ব্লাউজ। ঠোঁটে ম্যাচিং লিপস্টিক। গলায় ছোটো লকেটের চেন আর দু’কানে ছোটো দুটি দুল। ছিমছাম পরিপাটি সাজ। দারুণ মিষ্টি লাগছে দেখতে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিতে নিতে বললাম, বসা যাবে নাকি?
মুনিয়া আমার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখেমুখে কাজের তাড়া। না বসেই বলল, একটু কাজ আছে, যেতে হবে। -তারপর আঁচলের ভেতর থেকে ডান হাতটা বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল। হাতে একটি চিঠির খাম। আবার বলল, এই চিঠিটা একজন আপনাকে লিখেছে।
আমি চিঠির খামটা হাতে নিতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মুনিয়া। আমার একটু কৌতূহল হলো। কে লিখল চিঠি? খামের ভেতরের কাগজটা টেনে নিয়ে চোখের সামনে ধরলাম দ্রুত। আমার দু’চোখ বিস্ফোরিত। চিঠির হস্তাক্ষর চিনতে আমার সময় লাগল না। মুনিয়ার হাতের লেখা। চিঠির পৃষ্ঠাজুড়ে মুনিয়ার মুক্তা হরফ সাজানো। এক পৃষ্ঠার চিঠি। চিঠির শেষে লেখা- ‘ইতি তোমার মুনা’।
মুনিয়া চিঠি লিখেছে! আমি একইসঙ্গে চমৎকৃত ও বিচলিত। নিবিষ্ট মনে চিঠিটা পড়া দরকার। ঘরের খোলা দরজাটা বন্ধ করে চেয়ারে বসে চিঠিটা আবার হাতে নিলাম। চিঠিতে কোনো সম্ভাষণ নেই। মুনিয়া লিখেছে-
‘সম্ভাষণ না করেই চিঠিটা শুরু করছি। আমার মনে হচ্ছে, আপনার আর আমার মধ্যে সম্পর্কটা এমন এক বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে সম্ভাষণ অত্যাবশ্যক নয়। যে বিষয়গুলো জানানোর জন্য চিঠিখানা লেখা, সে বিষয়গুলো আমাকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে চলেছে। এই গোপন যন্ত্রণা আমি সইতে পারছি না। কাউকে বলে কিছুটা হালকা হতে চাই। আমি ভেবে দেখেছি, বিষয়গুলো একমাত্র আপনাকেই জানানো যায় এবং এগুলো আপনারই জানা দরকার। জীবনের এই একান্ত কথাগুলো যাকে বলা যায়, তাকে ‘আপনি’ সম্বোধন আমার কাছে অসঙ্গত ঠেকছে। তাই ‘তুমি’ করেই চিঠিখানা লিখতে চাই। অনধিকারচর্চা মনে হলে ক্ষমা করে দেবেন।
আমি খুব সাধারণ পরিবারের অতি সাধারণ একটি মেয়ে। তুমি হয়তো জানো, আমি বাবা-মায়ের বড়ো সন্তান। আমার ছোটো এক ভাই আর দুই বোন। আমার ছোটো দুই বোনও বড়ো হয়ে উঠেছে। তাই বাবা-মার চিন্তার শেষ নেই। বড়ো সন্তান হিসেবে তাদের কিছুটা চিন্তামুক্ত করা আমার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হয়ে পড়েছিল। মামা-মামিদের পক্ষ থেকে বিয়ের একটি সম্বন্ধ অনেক দিন ধরে অপেক্ষমাণ। আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমার আকাশ তো আগে থেকেই ছোটো হয়ে আছে। তবু বিধাতাকে দোষ দেব না। হয়তো কারো কারো ভাগ্য এমনই হয়।
যা হোক, তুমি নতুন মানুষটা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলে। আমি টেলিফোনে বলতে পারিনি। অবশ্য বলার মতো কিছু নেই। খুব সাধারণ একটা মানুষ, নাম আবুল খায়ের। শিক্ষাস্তর, পেশাগত দিক কিছুই বলার মতো নয়। সিম্পলি ইন্টারমিডিয়েট পাস, সিরাজগঞ্জের একটি টেক্সটাইল মিলে হিসাব বিভাগে কাজ করেন, সিরাজগঞ্জেই থাকেন। বাড়ি টাঙ্গাইল। পারিবারিক অবস্থা নি¤œবিত্ত। তিন ভাইয়ের মধ্যে আবুল খায়ের সবার ছোটো। এই ওনার পরিচয়, এই আমার ভাগ্য।
নিজের চেয়েও বাবা-মার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। বড়ো মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পেরে তাদের অপার আনন্দ- জোয়ারে ভাসবার কথা ছিল, সেখানে উল্টো তারা এখন বেদনার অশ্রæ-বন্যায় ভাসছেন। বিধাতার কাছে তাদের একটাই প্রশ্ন, তাদের বড়ো সন্তানের এমন মন্দ ভাগ্য হলো কেন? তাদের সান্ত¡না দেয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পাই না আমি।
জানি, তোমারও মন খারাপ করে দিলাম। দুঃখিত। আমার যে আর উপায় ছিল না। আশা করি, তুমি আমার দিকটা বুঝতে পারবে। তোমাকে ভারাক্রান্ত করতে হলো, সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
ইতি তোমার
‘মুনা’

চিঠিখানা পড়তে পড়তে কেমন এক বেদনার শীতল ¯্রােত ছড়িয়ে পড়ল আমার মনে। মুনিয়ার ভেতরের কষ্টটা যেন সঞ্চারিত হলো আমার মধ্যে, ওর চিঠির কথাগুলো ভীষণ নাড়া দিয়ে গেল আমাকে। ‘আমার আকাশ তো আগে থেকেই ছোটো হয়ে আছে।’ আমার বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠল হঠাৎ। মুনিয়ার জীবনটা এমন হলো কেন? ত্বকের সামান্য রোগ-চিহ্ন ওর অন্য সব রূপ-গুণ-যোগ্যতাকে আড়াল করে দিল! বিয়ের বাজারে বাহ্যিক রূপটাই মুখ্য! গুণ-যোগ্যতা এতটাই গৌণ! বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়া চটপটে গুণী একটি মেয়েকে কিনা বিয়ে করতে হলো ইন্টারমিডিয়েট পাস একটি ছেলেকে! হায় মুনিয়া!
আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ারে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। ঘরের দরজা খুলে দিয়ে এলাম এক সময়। কোনো কাজে মন বসছে না আর। চুপচাপ বসে রইলাম একা একা। আরো ঘণ্টাখানেক পর লাঞ্চ আওয়ারে দরজাটা বন্ধ করলাম আবার। হাতমুখ ধুয়ে চেয়ারে বসতেই আমার ল্যান্ড ফোন বেজে উঠল। ফোনের হ্যান্ডসেট তুলে কানে লাগালাম। ওপাশ থেকে ভেসে এলো মুনিয়ার মোলায়েম স্বর, হ্যালো।
আমি একটু ইতস্তত, কীভাবে কথা শুরু করব? আমার নীরবতা দেখে মুনিয়াই বলল, খাওয়ার সময় ফোন করলাম।
আমি বললাম, ঠিক আছে, কথা চলতে পারে। কিন্তু আপনি খাবেন না?
মুনিয়া যেন নির্লিপ্ত গলায় বলল, খাব আর কি! কিন্তু এখন আবার ‘আপনি’ কেন? আমি তো ‘তুমি’ করে বলার অধিকার দিয়েছি।
ওহ্ আচ্ছা। -বলেই আমি ফোন ধরে বসে আছি। কী বলব ভাবছি। আর সত্য গোপন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু নিজেকে আড়াল করার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। আমার মনের অবস্থাকে অনুকরণ করে বললাম, মুনা, এই মুহূর্তে আমার কী বলা উচিত আমি জানি না। এখন আমার ভেতরটা খুব এলোমেলো ও বিক্ষিপ্ত। তবে আমার অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে।

মুনিয়া বলল, হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার উপায় ছিল না। প্রথমত আমি হালকা হতে পাছিলাম না। দ্বিতীয়ত তোমাকে ওসব কথা না জানালে আমি নিজের কাছে কিছুটা অপরাধী হয়ে থাকতাম। -এটুকু বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মুনিয়া। কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, তুমি ছাড়া এসব আর কাকে বলে হালকা হব আমি, কাকে আমি আমার এই কষ্টের কথা জানাব?
আমি এবার একেবারে অপ্রস্তুত। কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেব সহসা ভেবে পেলাম না। এটুকু বুঝতে পারলাম যে, এখন মুনিয়াকে সান্ত¡না দিতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। আগুনে ঘিয়ের ছিঁটা না দিয়ে এখন জল ঢালা জরুরি। আমি ঝটপট খুব নরম গলায় বললাম, মুনা, এমন করে না। এখন কথা বলার সময় নয়। তুমি একটু সয়ে ওঠো। আমরা পরে কথা বলব, এখন রাখি। প্লিজ, কিছু মনে করো না।
মুনিয়াকে জোর করে থামিয়ে দিয়ে আমি ফোনের রিসিভার রেখে দিলাম। কিন্তু আমি নিস্তার পেলাম না। মুনিয়ার না বলা কথাগুলো যেন তাড়া করে ফিরল আমাকে। আমি বসে থাকলাম চুপচাপ। বোঝার চেষ্টা করলাম, মুনিয়ার ভেতরে কত চাপা কষ্ট! এত অসামঞ্জস্য সম্পর্ক! এই কষ্ট নিশ্চয়ই অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়। বেচারি তা সয়ে উঠবে কী করে? মনের সাময়িক স্বস্তির জন্য মুনিয়া হয়তো ওর পাশে চাইছে আমাকে। এতদিনের পরিচয়ের সূত্রে হয়তো ভাবছে আমিই ওর একটা আশ্রয়। মুনিয়ার এই দুর্বলতা আমাকেও দিন দিন আরো দুর্বল করে তুলছে ওর প্রতি। ভেতরের ক্ষীণ চোরা ¯্রােত যেন গতিময় হয়ে উঠছে ক্রমে। এর নাম কি ভালোবাসা, অনুরাগ, নাকি ওর প্রতি আমার অনুকম্পা। মুনিয়ার ত্বকে যদি ওই রোগ-চিহ্ন না থাকত, তাহলে কি এমন পরিস্থিতি হতো? মুনিয়া কি ভেতরে ভেতরে আমাকে এমন কাছে টানত? আমিও কি ওর প্রতি এতটা আকর্ষণবোধ করতাম? হয়তো এর কোনোটাই নয়, হয়তো এটাই আমাদের নিয়তি।
মুনিয়া এই অফিসে আসার আগে থেকেই যেন ওর সঙ্গে জোড় বাঁধা হয়েছিল আমার। তা না হলে অফিসে ঢুকতেই সবার আগে কেন আমার সঙ্গে প্রথম দেখা হবে ওর। সেই দিনটার কথা এখনো পষ্ট মনে আছে আমার। অফিসে ঢুকে আমার সঙ্গেই প্রথম কথা বলেছিল ও। সেদিন কী কারণে যেন গেটের কাছে করিডোরের মুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। কম বয়সি একটি ছেলের সঙ্গে দ্বিধা থরোথরো পায়ে এগিয়ে এসেছিল একটি তরুণী মেয়ে। কাউকে কাছে না পেয়ে আমাকে বলেছিল, চাকরির দরখাস্ত কোথায় জমা দেবে? আমি পাশে পিএ-র রুমে রাখা চাকরির দরখাস্ত জমা দেয়ার বাক্সটা দেখিয়ে দিয়েছিলাম। সেই তরুণী মেয়েটিই মুনিয়া। পরে জেনেছিলাম, কম বয়সি ছেলেটি ওর ছোটো ভাই।
যা হোক, অফিসে মুনিয়াকে এড়িয়ে চললাম সারাদিন। কিন্তু সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে মনে হলো মুনিয়াই দখল করে আছে আমাকে। ওর কথা ভেবে মনটা আবেগে কেমন অধীর হয়ে উঠল আরো। দুপুরে টেলিফোনে ঠিকমতো কথা হলে দুজনেরই ভালো লাগত হয়তো। কিন্তু এখন কী করা? মনের অস্থিরতা দূর করার একটি উপায় খুঁজলাম রাতে। একটি চিঠি কি লেখা যায় মুনিয়াকে? ওর চিঠির উত্তরে কিছু কথা না বললে ভালো দেখায় না। লিলি দীপ্র দুজনই ঘুমোচ্ছে। আমি ড্রইংরুমে এসে কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম। চিঠিতে লিখলাম-

‘মুনা,
তোমার কথা যত ভাবি ততই অবাক হই। তুমি সব সময় দায়িত্বশীল ও বাস্তব সচেতন। জানি, তুমি নিজের সুখ- আনন্দের কথা কখনো বেশি ভাবো না। তোমার কাছে পরিবার সবার আগে। এবারো পরিবারের জয় হয়েছে। তুমি আক্ষেপ করে লিখেছ, ‘আমার আকাশ তো আগে থেকেই ছোটো হয়ে আছে।’ আসলে কি তাই? নিজের নিয়ন্ত্রণে যা নেই, তার জন্য আক্ষেপ করে কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী? আমরা বাইরের চাকচিক্যের কথা না ভেবে ভেতরের সৌন্দর্য ও শক্তির কথা কেন ভাবি না? আমি যখন এদিক থেকে তোমাকে দেখি, তখন বুঝতে পারি, তোমার আকাশ এখনো অসীম ও অবারিত। স্বপ্নের সঙ্গে জীবনের যোগ সবার একভাবে হয় না, একেকজনের একেকভাবে হয়। অনেকটা অভাবনীয়, অপ্রত্যাশিত পথে। এর কোনো নির্ধারিত সূত্র নেই। তাই জীবন থেমে যায় না। তুমি পরশ পাথর। আমার বিশ্বাস, তোমার স্পর্শে কয়লা সোনা হবে। সাধারণ হয়ে উঠবে অসাধারণ। জীবনের পথে তোমার চরণ-চিহ্ন বর্ণিল হোক। মনের রঙিন ডানা ছড়িয়ে ইচ্ছে-স্বাধীন ওড়ো এবং আনন্দ কুড়িয়ে নাও। দেখবে, নিজের অজান্তেই তোমার আকাশ বড়ো হয়ে গেছে। আমার কথা একটুও ভাববে না। ভালো থেকো।
নিরন্তর শুভ কামনা।
ইতি
তোমার শুভ।’

সকালে অফিসে ঢুকেই মুনিয়ার ঘরের দিকে তাকালাম। দরজা খোলা। মুনিয়া নিশ্চয়ই আছে। পর্দা সরিয়ে আমি উঁকি দিলাম। মুনিয়ার মেঘ-ছাওয়া মুখে আবছা হাসির ছটা। পকেট থেকে চিঠির খামটা বের করে এগিয়ে দিয়ে বললাম, আমাকে যিনি চিঠি লিখেছিলেন, তাকে এটি দিতে হবে।
মুনিয়া হাত বাড়িয়ে খামটা নিতে নিতে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল, একটু কি বসা যাবে না?
আমি ততক্ষণে দরজার বাইরে চলে এসেছি। পেছন ফিরে মৃদু হেসে আমার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে মনে হলো মুনিয়ার সঙ্গে একটু কথা বলি। সঙ্গে সঙ্গেই আবার ভেবে নিলাম, আজ এমনভাবে কথা বলব, যাতে মুনিয়া আবেগপ্রবণ হয়ে না ওঠে। ভাবতে ভাবতে ফোন নম্বর প্রেস করলাম। একবার রিং হতেই ওপাশে হ্যান্ডসেট তুলল মুনিয়া, যেন আমার ফোনের অপেক্ষায়ই ছিল। মুহূর্তেই ভেসে এলো মিহিন মিষ্টি কণ্ঠ, হ্যালো-
বললাম, হ্যাঁ আমি, খাওয়া হয়েছে?
মুনিয়া বলল, হ্যাঁ, খেয়ে বসলাম। তুমিও খেয়েছ নিশ্চয়ই। বলো, কেমন আছো?
-খেয়েছি, কিন্তু কেমন আছি, জানি না। আচ্ছা, লেখাটা কি তাকে দেয়া হয়েছে?
-হ্যাঁ, দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি তো চিঠির শেষ কথার সঙ্গে একমত না। শেষে লেখা হয়েছে, ‘আমার কথা একটুও ভাববে না।’ এটা তো পত্রপ্রাপকের ব্যাপার, তিনি যদি ভুলতে না পারেন!
আমি দেখলাম, মুনিয়ার গলা ভারী হয়ে উঠছে। না, আজ এটা হতে দেয়া যাবে না। আসলে আমার পক্ষেও কি মুনিয়ার কথা না ভেবে থাকা সম্ভব! সুতরাং এ প্রসঙ্গ থাক। আমি দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টালাম। ক্রিকেটের টেস্ট প্লেয়িং দেশগুলোকে নিয়ে অক্টোবরের শেষ দিকে বাংলাদেশে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নামে ইন্টারন্যাশনাল ওয়ানডে টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা। এরই মধ্যে টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে। খেলা হচ্ছে ঢাকার পল্টনে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। আমাদের আগে থেকেই নির্ধারণ করা ছিল ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে খেলাটা আমরা একসঙ্গে স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখব। একসঙ্গে বলতে মুনিয়াসহ অফিসের কয়েকজন মিলে। তখন কে জানত মুনিয়ার হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাবে। আগামীকাল ২৮ অক্টোবর ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ডে-নাইট খেলা। মুনিয়া কি আর খেলা দেখতে যাবে? আমি প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে এবার জানতে চাইলাম, আচ্ছা মুনা, স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখবার কথা কি মনে আছে? আগামীকাল ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার খেলা। অন্যরা যাবে বলেছে। তুমি কি যাবে?
ও আচ্ছা, কালকেই সেই খেলা, না?-বলেই মুনিয়া একটু সময় নিল। তারপর বলল, হ্যাঁ, যাওয়া যায়। আমরা তো অফিস থেকেই যাব, তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ, অফিস থেকে তো স্টেডিয়াম কাছেই। আমরা সকাল বেলাটা অফিস করব। দুইটা থেকে খেলা, বারোটা সাড়ে বারোটার দিকে আমরা বেরিয়ে যাব।-এটুকু বলেই আমি একটু আমতা আমতা করে আবার বলতে শুরু করলাম, কিন্তু আমি একটি কথা ভাবছি, তোমার ব্যাপারে কেউ আপত্তি করবে নাতো? এখন তো তুমি আগের মতো নও।
আমার কথা শেষ হতেই মুনিয়ার উত্তর, আমার আবার এখন আর তখন কী? আমি তো সব সময় একরকম। বাবা-মার সঙ্গে যেভাবে বাসায় ছিলাম, সেভাবেই আছি, সেভাবেই এ বাসাতেই থাকব। কাল অফিসে আসার সময় খেলা দেখার কথা আমি মাকে বলে আসব। অসুবিধা হবে না।-মুনিয়ার কণ্ঠ বেশ দৃঢ় শোনাল।

তিন.
পরদিন সকাল বেলা দেখা গেল, জসীম, শফিক, মান্নান কেউ অফিসে আসেনি। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পেরিয়ে গেল। সঙ্গীরা নেই, আমরা যাব কি যাব না? আমি আমার ঘরে বসে ভাবছি কী করব। এমন সময় মুনিয়া আমার ঘরে এসে বলল, একটু আগে জসীম ভাই ফোন করেছেন, বলেছেন ওনারা স্টেডিয়ামের ৯ নম্বর গেটে থাকবেন, আমরা যেন এদিক থেকে যাই, ওখানে সবার দেখা হবে।
আমি বললাম, তাহলে আমরা তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ি। বারোটা তো প্রায় বাজে। দেরি হলে গ্যালারিতে বসার জায়গা পাব না।
অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি, রাস্তায় খুব জ্যাম। তাছাড়া রিকশায় যেতে হলে ঘুরে যেতে হবে তোপখানা রোড হয়ে। আমরা সচিবালয়ের সামনে দিয়ে পায়ে হেঁটে সোজাপথ ধরলাম। জিপিওর মোড়ে আসতে আসতেই আমরা খেলার আমেজ টের পেলাম। বাইরে খেলার টিকেট বিক্রি হচ্ছে। দুটো টিকেট কিনে নিয়ে আমরা সামনে এগোলাম। কিন্তু ৯ নম্বর গেটে এসে দেখি, সঙ্গীরা কেউ নেই। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক খুঁজলাম সঙ্গীদের। জসীম, শফিক, মান্নান কারোরই দেখা নেই। এদিকে একটা বেজে গেছে। বাইরে এখনো উৎসুক জনতার যে ভিড় তাতে বোঝা যায়, ভেতরে গ্যালারি ভরে উঠেছে। গেট বন্ধ করে দিতে পারে যে কোনো সময়। আমরা অফিসের সঙ্গীদের খুঁজে পাওয়ার আশা বাদ দিলাম এবার। ভিড় ঠেলে আমি আর মুনিয়া কোনোমতে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। পশ্চিম দিকের গ্যালারির উপরে উঠে একটু জায়গা পেলাম বসার। পাশাপাশি বসলাম দুজন। বসে এদিক-ওদিক তাকালাম। অফিসের সঙ্গীদের যদি পেয়ে যাই। কিন্তু কাউকে খুঁজে পেলাম না। অচেনা লোকে গ্যালারি ভর্তি। নারী দর্শকের সংখ্যা খুব কম। তার মধ্যে মুনিয়া একজন। সবাই আড় চোখে দেখছে মুনিয়াকে। মুনিয়া সপ্রতিভ তাকিয়ে আছে মাঠের দিকে।

হেমন্তকাল। মাথার উপর ঝকঝকে নীল আকাশ। মধ্যগগনে তরুণ সূর্য। যেন অকৃপণ হাতে ঢেলে দিচ্ছে ঝাঁঝাঁ রোদ। মতিঝিলের হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো সূর্যের এই জয়যাত্রাকে উপেক্ষা করছে সগর্বে। পূর্ব দিকের গ্যালারি ঘেঁষে ছাব্বিশ তলা শিল্প ব্যাংক ভবন। এই ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে বিনা টিকেটে খেলা দেখবে বলে পশ্চিম দিকের জানালা খুলে বসে আছে অনেকে। রোদ থেকে বাঁচার জন্য গ্যালারিতে ছাতা খুলে বসেছে কেউ কেউ। পশ্চিম গ্যালারির উপরের দিকে বসে আছি আমরা। উপরের দিকের মানুষরাই ছাতা খুলেছে বেশি। এদের দেখাদেখি মুনিয়া বলল, আমার ছাতাটা খুলি?
আমি মুনিয়ার দিকে তাকাই। মুনিয়ার চোখেমুখে হাসির ঝিলিক। এই কয়দিন এমন প্রাণখুলে হাসতে দেখিনি মুনিয়াকে। যেন মেঘ ভেঙে রোদ উঠেছে আকাশে। আমার মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে গেল হঠাৎ। মুনিয়া ওর ব্যাগ থেকে ছাতা বের করতে করতে আবার বলল, আমার ছাতা না, মানে তোমার ছাতা।
আমি মুনিয়ার কথার মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করি। মুনিয়া ততক্ষণে ছাতা খুলে ধরেছে মাথার উপর। হলদে সাদা রঙের বিশেষ ধরনের এক ছাতা। ছাতাটা দেখে এবার আমিও হেসে উঠি।
এই ছাতাটা আমিই দিয়েছিলাম মুনিয়াকে। মুনিয়ার জন্যই জাপান থেকে এনেছি ছাতাটা। মাস দুই আগে অফিস থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য জাপান পাঠানো হয়েছিল আমাকে। প্রকাশনা ও সম্পাদনা বিষয়ে তিন সপ্তাহের ট্রেনিং। জাপানের রাজধানী টোকিওতেই ছিলাম। সেখান থেকে আশপাশের সবার জন্য কিছু না কিছু এনেছি। মুনিয়ার জন্য এনেছিলাম ছাতা আর একটি চুলের ক্লিপ। আমার এ সামান্য উপহার পেয়ে মুনিয়া কী খুশি! ভালোবেসে গ্রহণ করেছে উপহার দুটি। হাতে নিয়ে বলেছিল, এত সুন্দর! উপহারের জবাবে এমন কমপ্লিমেন্টস আর কেউ আমাকে দেয়নি। পরদিন থেকেই আমার উপহার দুটি নিত্যসঙ্গী করেছে মুনিয়া। ছাতাটা ওর অফিসের ব্যাগেই থাকে আর ক্লিপটা নিয়মিত পরে চুলে। আজও ক্লিপটা পরেছে মুনিয়া। ও বলে, ক্লিপটা পরতে কী যে আরাম! মুনিয়ার কথায় আমার বুকে তিরতির অনুভূতির ¯্রােত বয়ে যায়।
মুনিয়া ওর মাথার ওপর ছাতা ধরে বসেছিল। আমি আগের মতোই ছাতার বাইরে বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। মুনিয়া বলল, মাথায় রোদ লাগছে তো, এদিকে একটু সরে এসে ছাতার নিচে বসা যাবে।
আমারও ইচ্ছে করছে, কিন্তু আবার সংকোচও হচ্ছে। এতগুলো মানুষের মধ্যে একটি মেয়ের ছাতার নিচে বসব? আমি ব্যাপারটা সহজ করার জন্য বললাম, না, ঠিক আছে, রোদ এমন কিছু চড়া না।
মুনিয়া অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাল। ওর চোখেমুখে অনুুনয়মাখা শাসন। আমি ওর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দূরের গ্যালারির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই অধিনায়ককে সঙ্গে নিয়ে ম্যাচ রেফারি এসে দাঁড়ালেন মাঠের মাঝখানে। টস হবে। টস মুদ্রা নিক্ষেপণে জিতল অস্ট্রেলিয়া। টসে জিতেই ফিল্ডিং বেছে নিল ওরা। ভারতের পক্ষে ইনিংস উদ্বোধন করতে এলেন সৌরভ গাঙ্গুলি আর শচীন টেন্ডুলকার। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে মাত্র এক রান করেই আউট হয়ে গেলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। আমার খেলা দেখার মজাটাই নষ্ট হয়ে গেল। সৌরভের ডাউন দ্য ডান্সিং এসে চার ছক্কার মার আমার দারুণ লাগে। আহ! সামনা সামনি সৌরভের খেলা দেখতে পেলাম না। তাছাড়া ভারতের সমর্থক আমি। খেলার শুরুতেই উইকেট হারাল। এই ধাক্কা সয়ে উঠতে না উঠতে আরেক ধাক্কা। অধিনায়ক আজাহার উদ্দিনও আউট হয়ে গেলেন অল্প রানে। আমরা নড়েচড়ে বসলাম। জুটি না হলে রান হবে কী করে?
কিন্তু খেলার ঘোরের মধ্যে আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম, মুনিয়া নিজেই কখন আমার দিকে সরে এসে আমার মাথার উপর ছাতা ধরে রেখেছে। আমি অগত্যা ওর হাত থেকে ছাতার বাঁটটা তুলে নিলাম নিজের হাতে। শারীরিক দূরত্ব বাঁচিয়ে ছাতাটা ধরে রাখলাম ওর মাথার উপর।
এদিকে আস্তে আস্তে খেলার দৃশ্যপট পাল্টে গেল। শচীন টেন্ডুলকার মাঠের বাইরে চারদিকে বল পাঠিয়ে রানের ফুলঝুরি ছোটালেন। শচীনের সঙ্গে অজয় জাদেজা ও রাহুল দ্রাবিড়ের দুটি জুটি হলো। শচীন পঁয়তাল্লিশ ওভার পর্যন্ত খেলে একাই ১৪১ রান করলেন। জাদেজা করলেন ৭১। শেষ পর্যন্ত ভারত পঞ্চাশ ওভারে আট উইকেট হারিয়ে ৩০৭ রান সংগ্রহ করতে সক্ষম হলো। বেশ ভালো সংগ্রহ। সামনা সামনি শচীনের দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং দেখে আমরা আনন্দিত। মুনিয়া পাকিস্তানের সমর্থক হয়েও শচীনের ব্যাটিংশৈলীতে মুগ্ধ। ও সত্যিকারের ক্রিকেটপ্রেমী। তাই ওকে আমার এত ভালো লাগে!
স্টেডিয়ামে আসার আগে অফিস থেকেই আমরা হালকা খাওয়া-দাওয়া করে বেরিয়েছিলাম। খেলার মধ্যাহ্ন বিরতি হতে হতেই খিদে খিদে লাগল। গ্যালারিতে আমাদের আশপাশে নানা ভাজিপোড়া কাটা ফলমূল বিক্রি হচ্ছে দেদার। আমি কিছু খাবার কিনব বলে এদিক-ওদিক দেখছিলাম। মুনিয়া আমার কানের কাছে মাথা এলিয়ে মৃদু হাসল। -আমার সঙ্গে খাবার আছে তো। বাসা থেকে নিয়ে এসেছি।
আমি কিছু বলব বলে মুনিয়ার দিকে তাকিয়েছি। সে সুযোগ না দিয়ে মুনিয়া আমার প্যান্ট ধরে টেনে বসিয়ে দিল। বলল, এ বিষয়ে আবার বক্তৃতা শুরু করতে হবে না। খাও এবার।
মুনিয়া টিফিন বক্সের ঢাকনা খুলে বাড়িয়ে ধরেছে আমার সামনে। আমি তাকিয়ে দেখি টিফিন বক্সভর্তি বাসায় বানানো ডিম পরোটা। টুকরো টুকরো করে কাটা। মুনিয়া নিশ্চয়ই সব কলিগের কথা ভেবে বেশি করে খাবার এনেছে। কী অবাক করা চৌকস মেয়ে! কী বাস্তব বুদ্ধি! অথচ এই মেয়ের ভাগ্যটা এমন! মুনিয়ার জন্য এক অজানা মায়ায় আবার বুকটা ছেয়ে গেল আমার। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছি না। খেয়ে যেতে লাগলাম চুপচাপ।
মুনিয়া বলল, আমার পানি শেষ।
পানির বোতল আমার হাতেই ধরা ছিল। একটু আগে আমি পানি খেয়েছি। আমার হাত থেকে বোতলটা টেনে নিয়ে পরম তৃপ্তিতে পানি খেল মুনিয়া। আমি অবাক হয়ে দেখি। আগে কখনো এমন হয়নি। মুনিয়া কত আপন ভাবে আমাকে!
খেলা শুরু হলো আবার। ভারতের ৩০৭ রানের জবাবে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস। কিন্তু শুরুতেই হোঁচট খেল অস্ট্রেলিয়া। এরপর উইকেট পড়তে লাগল নিয়মিত বিরতিতে। মার্ক ওয়া ছাড়া কোনো ব্যাটসম্যান ব্যাটিংয়ে দৃঢ় নৈপুণ্য দেখাতে পারছেন না। বল হাতেও শচীন সাফল্য পেতে লাগলেন। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের যখন ৩০ ওভার তখন মুনিয়া নিচু স্বরে বলল, আমার জন্য তো তোমার কষ্ট করতে হবে। আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে।
মুনিয়ার সৌজন্য জ্ঞান বরাবরই আমাকে মুগ্ধ করে। কিন্তু আজ ওর কথাটা শুনে কেন যেন আমার একটু অভিমান হলো। আমি বললাম, এ আবার কেমন কথা, কষ্ট কেন হবে? তুমি কি ভেবেছ এত রাতে এত দূর থেকে তোমাকে আমি একলা ছেড়ে দেব? তুমি না বললেও তোমার সঙ্গে আমি যেতাম। তখন সেটাকে যদি তুমি মনে মনে আমার হ্যাংলাপনাও ভাবতে, তাতে আমার কিছু যায় আসত না, আমি যেতাম।
-হ্যাংলাপনা! এবার আমি রাগ করলাম। এত কিছুর পর তুমি নিজেকে এখনো সে পর্যায়ে ভাবো?-মুনিয়া গজগজ করতে করতে মাঠে চোখ ফেরাল।
আমি এবার সত্যি বেকায়দায় পড়ে গেলাম। কী করি, কী বলি ভাবতে ভাবতে বললাম, সরি সরি, আমার ভুল হয়েছে। কথাটা ফিরিয়ে নিলাম। এবার হলো?
মুনিয়া সবার অলক্ষ্যে আমার পেটে আলতো করে ঘুষি মেরে দিল একটি। কিন্তু ও তাকিয়ে আছে মাঠের খেলার দিকে। গম্ভীর অবয়বে মিষ্টি হাসির আভা। এ মুহূর্তে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে মুনিয়াকে। ওর মুখটাকে মনে হচ্ছে, পাতার আড়ালে ঠিক যেন একটি পুষ্ট গোল সিঁদুরে আম।
চল্লিশ ওভারের দিকে অস্ট্রেলিয়ার পরাজয় প্রায় নিশ্চিত। ৭৪ রান করে মার্ক ওয়া আউট হয়ে গেলেন। শচীন চার উইকেট পেয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্য এখন পরাজয়ের ব্যবধান কমানো। মুনিয়া বলল, আমরা একটু আগে আগে বেরিয়ে গেলে ভালো হয় না?
আমিও ভেবে রেখেছিলাম, আগেই বেরিয়ে পড়ব। সিএনজি বা ট্যাক্সিতে আমাদের তেজগাঁও যেতে হবে। খেলা শেষে বের হতে গেলে যেমন দেরি হবে, তেমনি সহজে ট্যাক্সিও পাওয়া যাবে না। আমরা সেই ঝুঁকি নিলাম না। আর দু’ওভার পরেই উঠে পড়লাম দুজন। ধীরে ধীরে গ্যালারির ভিড় এড়িয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে।
বায়তুল মোকাররমের সামনের মোড়েই পেয়ে গেলাম একটি ট্যাক্সি। পেছনের সিটে উঠে বসলাম আমরা দুজন। ট্যাক্সি ছুটল সচিবালয়ের সামনে দিয়ে। রাত প্রায় আটটা বাজে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি উপলক্ষে রাজধানীর এদিকটায় আলোকসজ্জা করা হয়েছে। চারপাশ ঝলমল করছে। ঝলমলে রাস্তা ছাড়িয়ে এবার আমাদের ট্যাক্সি চলেছে জাতীয় ঈদগাহ ছুঁয়ে মৎস্য ভবন হয়ে। এদিকের রাস্তা আবছা ছায়ামাখা। রমনার সুউচ্চ গাছগুলো যেন নিয়ন বাতির আলোর সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। গাড়ির ঝাঁকুনিতে আমরা দুজন কখন পরস্পরের কাছে এসে গেছি টেরই পাইনি। মুনিয়ার ডান বাহু লাগছে আমার বাম বাহুতে। মুনিয়ার নরম কানের হালকা ছোঁয়া লাগছে আমার কাঁধে। শরীরে কেমন এক শিহরণ বোধ করছি আমি। মুনিয়া কি কিছু টের পাচ্ছে? নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে না কেন ও? ও কি আরো কিছু

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়