করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ে ফের স্কুল বন্ধ

আগের সংবাদ

রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৯ দফা নির্দেশনা : ঝুঁকি মোকাবিলায় নজরদারিতে চাকরিচ্যুত পুলিশরা

পরের সংবাদ

অনবগুণ্ঠিতা

প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমি উর্বশী। স্বর্গবেশ্যাদের একজন আমি। ধুম করে নিজেকে বেশ্যা বলে ফেললাম বলে কিছু মনে করবেন না। আসলে আমি একজন অপ্সরা। মেনকা, রম্ভা, ঘৃতাচী, বিশ্বাচীদের মতন একজন আমি। যাদের নাম বললাম, তাদের প্রত্যেকেই বিদ্যুল্লতা, রূপে অতুলনীয়া। প্রত্যেকে যৌনতার প্রতীক। আমরা কখনো দেবসঙ্গিনী, কখনো ধ্যানমগ্ন ঋষির কামনা পূরণের উপকরণ। আমাদের প্রধান কাজ স্বর্গ-নৃপতি ইন্দ্রের মনোরঞ্জন করা। সেই মনোরঞ্জনেরও আবার নিয়ম-পদ্ধতি আছে। আমরা কখনো নৃতগীত করে ইন্দ্রসহ অন্যান্য দেবতার মন তুষ্ট করি, আবার কখনো কখনো অঙ্কশায়িনী হয়ে ওঁদের কামাবেগ নির্বাপিত করি। এখন বলুন, যারা স্ত্রী নয় অথচ তাদের পরপুরুষের রিরংসা পূরণ করতে হয়, তাদের কী বলবেন আপনারা? গালভরা অপ্সরা, না গণিকা বলবেন? দ্ব›েদ্ব পড়ে গেলেন তো? আমি দ্ব›দ্ব-দ্বিধা থেকে মুক্ত করছি আপনাদের। আমরা প্রকৃতপক্ষে পরিশীলিত ‘অপ্সরা’ শব্দের মোড়কে রূপোপজীবিনী। আমি? বলেছি তো আগে, আমি অলম্বুষা, মিশ্রকেশী, বিদ্যুৎপর্ণা, তিলোত্তমা, অরুণা, মনোরমা, কেশিনী, সুরজাদের মতোই একজন—-স্বর্গের বারাঙ্গনা।
অন্যদের তুলনায় আমার নাম আপনারা বেশি শুনেছেন, জানি। আমার জীবনের নানা ঘটনা-উপঘটনা এর জন্য দায়ী আর দায়ী আপনাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কী একটা কবিতা লিখে আমাকে খ্যাতকীর্তি করে তুলেছেন! ওই যে ‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী/ হে নন্দনবাসিনী উর্বশী!’ ভেবে দেখুন, কবির মতে আমি মা নই, কন্যাও নই, আবার কারও স্ত্রীও না। তাহলে আমি কী! কবি বলতে দ্বিধা করলেও আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি—- আমি দেব-ঋষি মনোরঞ্জনী স্বর্গবেবুশ্যে ছাড়া আর কিছুই নই।

তবে এটা ঠিক যে আমি স্বর্গসুন্দরীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা। অন্যান্য অপ্সরার ভিড়ে আমার অবস্থান একটু পৃথক। আমার রূপের ঝলকে, আচার-আচরণে নাকি বিশেষ একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। আমি নাকি অন্য দশটা অপ্সরার মতো নই। আমি নাকি অন্যতমা, শ্রেষ্ঠতমা! আমার এই কথাগুলোর মধ্য আত্মশ্লাঘার ছোঁয়া পাচ্ছেন তো? পাওয়ারই কথা। নিজের কথা, বিশেষ করে গুণের কথা এ রকম করে কেউ বলে! বলে না তো। আমিও বলছি না। আমার সম্পর্কে এই কথাগুলো বলা হয়েছে বৈদিক যুগ থেকেই। কারা বলেছেন জানেন? বেদ রচয়িতারা, পুরাণ লিখিয়েরা আমার সম্পর্কে ওরকম মন্তব্য করে গেছেন। ও হ্যাঁ, মহাভারতেও আমার নামের উল্লেখ আছে কিন্তু! পিতামহ ভীষ্ম প্রাতঃস্মরণীয় নয়জন অপ্সরার নাম বলতে গিয়ে আমার নামটাই প্রথমে উল্লেখ করেছেন।
কোনো জননীর গর্ভে আমার জন্ম হয়নি। আমি অযোনীসম্ভবা। আমার জন্ম এক ঋষির উরু থেকে। তাই আমার নাম উর্বশী। ব্যাপারটা আপনাদের ধাঁধা লাগছে তো? লাগারই কথা। কোথায় নর-নারীর যুগল-মিলনে আমার জন্ম হবে! তা না, বলছি, একজন পুরুষের উরুজাত আমি। শুধু তা নয়, প্রচণ্ড এক চপেটাঘাত থেকেই জন্ম হয়েছে আমার। খুব একটা রহস্যপূর্ণ আর বিভ্রান্তকর মনে হচ্ছে না ঘটনাটা? খুলেই বলি।
পুরাকালে নর ও নারায়ণ নামে দুই ঋষি ছিলেন। একদিন অভীষ্ট সাধনের জন্য তাঁরা জোর-তপস্যা শুরু করলেন। তাঁদের কৃচ্ছ্রসাধনের কঠোরতা দেখে দেবরাজ ইন্দ্র ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এই বুঝি ঋষি নর ও নারায়ণ তাঁর চেয়ে অধিক ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলেন! আপনারা তো জানেন, ইন্দ্রের মতো আধিপত্য পরায়ণ দেবতা স্বর্গরাজ্যে আর দুটি নেই। তিনি ভাবলেন, এই বুঝি তাঁর সিংহাসন টলে যায়! নাহ্! যে করেই হোক ঋষি দুজনের তপস্যা ভাঙাতেই হবে। আর ভাঙাতে হবে কামরিপুদ্বারা তাড়িত করে। চিরাচরিত্র কৌশল অবলম্বন করলেন দেবরাজ। রূপময়ী নারী লেলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। তাঁর আজ্ঞাধীন দুই স্বর্গবেশ্যাকে ডেকে পাঠালেন। তিলোত্তমা আর রম্ভা সামনে এলে বললেন, ‘মর্ত্যধামে নর এবং নারায়ণ নামের দুই ঋষির বড় বাড় বেড়ে গেছে! ক্ষমতায় তারা আমাকে ডিঙাতে চায়। তা হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। তপস্যামার্গ থেকে তাদের বিচ্যুত করতে হবে। আর তা করতে হবে তোমাদের রূপ-যৌবনে বিভোর করে, তোমাদের দেহবল্লরীতে রতির ঢেউ তুলে।’ অনেকক্ষণ কথা বলে দম নেওয়ার জন্য থামলেন ইন্দ্র। তারপর আবার বললেন, ‘তোমরা বুঝতে পেরেছ তো তোমাদের ইতিকর্তব্য?’
তিলোত্তমা-রম্ভা সম্মতির মাথা নেড়েছিল।
এবং অচিরেই গন্ধমাদন পর্বতে উপস্থিত হলো তারা। ওখানকার এক তপোবনে নর-নারায়ণ তপস্যামগ্ন। স্বর্গসুন্দরীদের উপস্থিতির কারণে সেই তপোবনে অকালে ফুল ফুটল, কোকিল ডাকল। রম্ভা-তিলোত্তমা শরীরে মনোহরণ বিভঙ্গ তুলে ঋষি দু’জনের সামনে নাচতে শুরু করল। অপ্সরাদের নৃত্য-গীতে ঋষিদের ধ্যান ভেঙে গেল। চোখ খুলতেই তাঁদের নজর গিয়ে পড়ল তিলোত্তমা-রম্ভার ওপর। তাঁরা দেখলেন, কাঞ্চনবর্ণা বিদ্যুন্মালার মতো তাদের দেহসৌষ্ঠব। তাদের কটাক্ষ মনোহারী এবং কামোদ্দীপক।
এতসব দেখেও ঋষি দুজনের কোনোরূপ ভাবান্তর হলো না। তাঁরা বুঝলেন, এরা অপ্সরা, স্বর্গ-আগতা। ঋষিরা কাম-জর্জরিত তো হলেনই না, উপরন্তু তাঁরা অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসলেন।
নারায়ণ ঋষি অপ্সরা দুজনকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমরা আমাদের অতিথি। অনেক কষ্টে স্বর্গ থেকে এসেছ। তোমরা বস। আমরা যথাসাধ্য অতিথি-আপ্যায়ন করব।’ এই বলে অপ্সরা দুজনের দিকে পাদ্য-অর্ঘ্য এগিয়ে ধরতে শুরু করলেন। তিলোত্তমা-রম্ভা লজ্জায় মরে। এ কী কাণ্ড! কোথায় অভিশাপ দেবেন আমাদের, তা না করে পাদ্য-অর্ঘ্য! কী করবে, দিশা পেল না অপ্সরারা।
অতিথি-সৎকার শেষে ঋষি নারায়ণ বললেন, ‘জানি, মহারাজ ইন্দ্র শঙ্কিত হয়ে আমাদের তপস্যায় বিঘœ ঘটাবার জন্য তোমাদের মতো সুন্দরীদের পাঠিয়েছেন। কিন্তু তিনি জানেন না, সৌন্দর্য দিয়ে সবাইকে বিভোর করা যায় না। আমরা সেই ব্যতিক্রমীদের মধ্যে পড়ি। আর শোন মেয়েরা, যে সৌন্দর্যসম্ভার নিয়ে তোমরা আমাদের কাছে এসেছ, তার চেয়েও শত গুণ সুন্দরী ও গুণবতী অপ্সরা সৃষ্টি করতে পারি আমি।’
তারপর একটু থামলেন ঋষি নারায়ণ, রম্ভা-তিলোত্তমার দিকে তাকালেন। ওদের চোখে তখন অবিশ্বাসের কাঁপন।
হঠাৎ নিজ উরুতে চপেটাঘাত করে বসলেন নারায়ণ। অপ্সরারা স্তম্ভিত চোখে দেখল, ঋষি নারায়ণের উরুভেদ করে এক সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণী বেরিয়ে এলো। সেই রমনীটিই আমি—-উর্বশী।
আমার রূপ দেখে উপস্থিত অপ্সরারা চমৎকৃত হয়েছিল। লজ্জিতও হয়েছিল। লজ্জায় তারা ঋষি দুজনের সামনে মাথা নত করেছিল।
এই সময় নারায়ণ বলে উঠেছিলেন, ‘ভয় পেয়ো না তোমরা। তোমাদের ওপর আমাদের কোনো ক্ষোভ নেই। আমার এই উরু-সম্ভবা উর্বশীকে তোমাদের সঙ্গে স্বর্গে নিয়ে যাও। দেবরাজ ইন্দ্রকে বলবে, এ আমাদের উপহার, তাঁর সন্তুটির জন্য।’
সেই থেকে আজ অবধি আমি ইন্দ্রের সন্তুষ্টি বিধান করে আসছি। শুধু ইন্দ্রের কেন, তাঁর নির্দেশে অন্যদেরও।
স্বর্গলোকে বেশ ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিল আমার। দেবরাজ ইন্দ্রের দেওয়া বাসভবনে অলস-শৃঙ্গার রচনা করে, বৈজয়ন্ত প্রাসাদের স্ফটিক সভায় নৃত্যকৌশল প্রদর্শন করে বড় আয়েশেই সময় অতিক্রান্ত হচ্ছিল।
একদিন মহারাজ ইন্দ্র অন্যান্য অপ্সরার সঙ্গে আমাকেও তাঁর রাজসভায় ডেকে পাঠালেন।
আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমরা সবাই জান, ধনপতি কুবের আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ধনবান মানুষদের বাসনারও কমতি নেই। এক এক সময় এক এক ধরনের ইচ্ছা জাগে তাদের। কুবেরও তার ব্যতিক্রম নয়। তার মাথায় ঢুকেছে জৌলুশময় নৃত্যগীতের আসর বসাবে একটা। আর সে তো এও জানে, আমার সভার রাজনর্তকীরা সবার সেরা। আমার কাছে আবদার করেছে নৃত্যগীত পটিয়সীদের ওর রাজধানী অলকাপুরীতে যেন পাঠাই। আমি চাই, তোমরা সেখানে যাও। অলকাপুরী জয় কর। মনে রেখ, তোমাদের পারদর্শিতা মানে আমার বিজয়।’
দেবরাজ ইন্দ্রের কথার প্রতিবাদ করার সাহস কোনো অপ্সরার নেই। প্রতিবাদ করবেই-বা কেন? এ তো শুধু নাচ-গান নয়, এ যে বহু রাজরাজড়া, অমাত্য, মন্ত্রী, সমরনেতার হৃদয় জয় করার অভিযাত্রা! এই অভিযাত্রায় ছিল রম্ভা, মেনকা এবং আরো অনেক স্বর্গকন্যা। আর ছিলাম আমি। আমার সঙ্গে প্রিয়সখী চিত্রলেখা।
নানা অঙ্গভূষণে সজ্জিত হয়ে আমরা অলকাপুরীর রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়েছিলাম।
বড় সন্তুষ্ট হয়েছিলেন ধনাধিপতি কুবের। তাঁর পিঙ্গল চক্ষুটির ঝিকিমিকি দেখে তা বুঝতে পেরেছিলাম আমরা। আমাদের খুব খাতির যতœ করে রাজপ্রাসাদের সব চাইতে উজ্জ্বল দিকটিতে থাকতে দিয়েছিলেন। প্রাসাদ-প্রধানকে আমাদের সামনেই নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘এরা আমার প্রিয় অতিথি। আমার বন্ধু দেবরাজ ইন্দ্রের রাজসভার সবচাইতে মূল্যবান অলংকার। এদের কোনোরূপ যাতে অবহেলা না হয়। যে ক’দিন ওরা আমার প্রাসাদে থাকবে, ওদের যাতে কিছুতেই মনে না হয়, ওরা ইন্দ্রপ্রাসাদের বাইরে আছে।’ বলে তাঁর কুৎসিত দেহটিকে সিংহাসনে এলিয়ে দিয়েছিলেন।
যক্ষরাজ কুবের সম্পর্কে এখানে দু’একটি কথা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। সবচেয়ে বড় কথা তিনি লঙ্কাপতি রাবণের বৈমাত্রেয় ভাই। লঙ্কাতেই থাকতেন তিনি। রাবণ প্রবল হয়ে উঠলে লঙ্কা ত্যাগ করেন কুবের। মনের দুঃখে হিমালয়ে তপস্যা শুরু করেন। সেখানে দেবী রুন্দ্রাণীর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। রুদ্রাণীর তেজে কুবেরের ডান চোখ জ্বলে যায়, বাম চোখ ধুলিকলুষিত হয়। পরে দেবীর আশীর্বাদে ধনকুবের হন বটে, কিন্তু তিনি হয়ে যান এক চোখা। দেহটাও হয়ে যায় ঝলসানো, কদাকার। কুবেরের বাইরের চেহেরার সঙ্গে ভেতরের রূপের যোজন যোজন পার্থক্য। তাঁর অন্তর অত্যন্ত সুশোভিত, পরিশীলিত, সৌন্দর্যলগ্ন।
কুবেরের হৃদয়সৌন্দর্যের প্রতিফলন হয়েছিল সে রাতের নৃত্যগীতানুষ্ঠানে। বহু নৃপতি-আমাত্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন সেই প্রণয়সিক্ত অনুষ্ঠানে। ধন্য ধন্য রব উঠেছিল মুহুর্মুহু।
অনুষ্ঠান শেষে আরো দুটো দিন রেখে দিয়েছিলেন কুবের আমাদের। বিলাসে-ব্যসনে সেই দুটো দিন চোখের পলকে অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল।
এবার আমাদের ফেরার পালা। ফেরার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন যক্ষরাজ কুবের। ইন্দ্রপুরীতে পৌঁছা পর্যন্ত নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করেছিলেন। আমরা হৃষ্ট মনে আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম। স্বচ্ছন্দে অর্ধেক পথ অতিক্রমও করে ফেলেছিলাম আমরা। হঠাৎ দুর্ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল।
ওই সময় আমাদের রথগুলি হিরণ্যপুর অতিক্রম করছিল। হিরণ্যপুরের রাজা ছিল কেশী নামের এক দানব। দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে তার পূর্ব-শত্রæতা ছিল। আসলে কেশী ছিল ভীষণ অত্যাচারী। হঠাৎ হঠাৎ ইন্দ্ররাজ্য আক্রমণ করে বসত এই কেশী। তার এই আক্রমণের লক্ষ্য ছিল মনোমোহনী স্বর্গসুন্দরীরা। বিশেষ করে আমিই ছিলাম তার প্রধান লক্ষ্যবস্তু। কারণ আমি যে অপ্সরা শ্রেষ্ঠা সে জেনে গিয়েছিল। সে আরো জেনেছিল, আমার মতো রূপময়ী ইন্দ্রসভায় আর কেউ নেই। সুতরাং তার আমাকেই চাই। আমার এক রজনীর সান্নিধ্য তার কাছে স্বর্গপ্রাপ্তির বাড়া। আমার গতিবিধির সকল খবর রাখত এই দানবটি। আমরা যে অলকাপুরী থেকে ইন্দ্রসভায় ফিরছি, জানত সে। আর তার রাজ্যের পাশ দিয়েই যে আমরা ফিরব, গুপ্তচররা সেই সংবাদ এনে দিয়েছিল কেশীকে।
সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কেশী। সময়মতো কেশী স্বর্গসুন্দরীদের ছোট দলটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার সৈন্যদের প্রবল আক্রমণে আমাদের নিরাপত্তাবলয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কারও দিকে নজর দিল না এই দানবটি। আমার বাম হাতটি আঁকড়ে ধরল সে। এবং বল প্রয়োগে সে আমাকে তার রথে নিয়ে গিয়ে তুলল।
কেশী সারথিকে বলল, ‘দ্রুত স্থান ত্যাগ কর সারথি।’
সারথি সবেগে রথ চালিয়ে দিল।
পেছন থেকে মেনকা-রম্ভা-তিলোত্তমাদের ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পেলাম আমি। তারা সমস্বরে চিৎকার করতে লাগল, ‘বাঁচাও, ‘বাঁচাও। কে কোথায় আছ, আমাদের প্রাণসখী উর্বশীকে বাঁচাও।’
স্বর্গ-বাররামাদের সমবেত ক্রন্দনধ্বনি আর আর্তচিৎকার একজনের কানে গিয়ে পৌঁছাল। তিনি পুরূরবা।
পুরূরবা মর্ত্যরেই এক রাজ্যের রাজা। সেদিন সসৈন্যে অরণ্যমাঝে মৃগয়ায় এসেছিলেন তিনি। মনুষ্যলোকে যে সবাই দানব কেশীর মতন, তা নয়। পুরূরবার মতো মহৎ পুরুষও আছেন। তিনি কেশীর চলন্ত রথে আমার হা-হুতাশও শুনতে পেলেন।
প্রবল শক্তিতে কেশীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন পুরূরবা। তাঁর সামনে ক্ষণকালও টিকতে পারল না কেশী। আমাকে রেখে রথ নিয়ে পালিয়ে বাঁচল।
আমি আর পুরূরবা মুখোমুখি। জায়গাটা নির্জন। সখীরা বেশ দূরে। পাশেই বিশাল সরোবর। সেখানে শতসহস্র পদ্ম। হঠাৎ গোটা স্থান জুড়ে বসন্তবাতাস বয়ে গেল। আমি আর পুরূরবা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কারও চোখে পলক পড়ছে না। আমাদের উভয়ের বক্ষদেশ স্পন্দনরহিত। রাজা কী দেখছেন, জানি না। আমি কিন্তু পুরূরবাকে দেখে যেতে লাগলাম। পুরুষ এত সুন্দর হন! ইন্দ্রকে দেখা চোখ আমার। ইন্দ্রের রূপ স্বর্গে তুলনারহিত। আজ দেখলাম, তাঁর রূপকে ¤øান করে দেবার মতো রূপবান পুরুষও মর্ত্যে আছেন। আমি মর্ত্যপুরুষ পুরূরবাকে ভালোবেসে ফেলাম। আমি ভুলে গেলাম আমাদের মতো স্বর্গ-অপ্সরাদের ভালোবাসতে নেই। আমরা পুরুষদের দেহ দিই, মন দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই। স্বর্গনিয়ম ভুলে গেলাম আমি। আমি পুরূরবাকে মন দিয়ে বসলাম।
ওই সময় পুরূরবা বললেন, ‘কে তুমি রূপসী?’ আমি স্পষ্ট বুঝে গেলাম, রাজা আমাকে চেনেন না।
কৌতুকবোধ ছলকে উঠল আমার। ইচ্ছে জাগল, রাজাকে নিয়ে একটু খেলি। কিন্তু আমার মন শাসিয়ে উঠল, খবদ্দার, সবাইকে নিয়ে সবসময় কৌতুকে মাতিস না উর্বশী। রাজাকে নিজের পরিচয় দে।
নিজেকে দমন করলাম আমি।
বললাম, ‘আমার নাম উর্বশী।’
‘উর্বশী! স্বর্গসুন্দরী উর্বশী তুমি! অপ্সরা শ্রেষ্ঠা উর্বশী তুমি!’
পুরূরবার আবেগ দেখে চুপ করে থাকলাম আমি। নির্নিমেষ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
রাজার মুগ্ধতা কাটে না কিছুুতেই। দুচোখে অপার বিস্ময় ছড়িয়ে আমাকে অবলোকন করে যেতে লাগলেন তিনি। আমি বুঝে গেলাম, রাজা নিজের হৃদয়াসনে আমাকে স্থান দিয়ে ফেলেছেন।
এই সময় ওখানে অন্য অপ্সরারা এসে উপস্থিত হলো। আমাদের মগ্নভাব কেটে গেল।
রাজা বললেন, ‘চলুন, আপনাদের ইন্দ্রলোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’
মেনকা বলল, ‘তার আর দরকার হবে মহারাজা। আমরা এখন বিপদমুক্ত। আমরা নিজেরা চলে যেতে পারব। যদি প্রয়োজন বোধ করেন, কয়েকজন সৈন্য আমাদের সঙ্গে দিতে পারেন।’
পুরূরবা আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে মেনকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তা কী করে হয়! আপনারা নারী। কিছুক্ষণ আগে আক্রান্ত হয়েছেন। দানবটা যে বনান্তরালে ঘাপটি মেরে বসে নেই, কে বলবে! চলুন, আমি আপনাদের পৌঁছে দিই।’
রাজার আমাদের সঙ্গে যাওয়ার প্রধান কারণ যে আরো কিছু সময় আমার সান্নিধ্য পাওয়ার লোভ, বহু পুরুষদেখা আমি বুঝতে পারলাম।
আগ বাড়িয়ে মেনকাকে বললাম, ‘সখী, উনি সঙ্গে যেতে চাইছেন যখন, বাধা দিয়ো না। আমাদের অবমাননা দেখে বিচলিত হয়েছেন তিনি। তাঁকে অস্থিরতার মধ্যে রাখা ঠিক হবে না। তিনি আমাদের সঙ্গে যান না! তাতে তো আমাদেরই লাভ।’
বলতে চেয়েছিলাম আমারই লাভ, বললাম আমাদেরই লাভ। নারীসুলভ লজ্জাবনততা আমারও তো আছে!
আমার কথা শুনে পুরূরবা খুশি হলেন। মেনকারা আর আপত্তি করল না। আমাদের ইন্দ্রলোকে পৌঁছে দিয়ে পুরূরবা মর্ত্যে ফিরে এলেন। কিন্তু হৃদয়টা রেখে এলেন ইন্দ্রলোকে, উর্বশী নামের এক অপ্সরার কাছে।
আমারও উচাটনের কি অবধি আছে! আমার দেহটা ইন্দ্রলোকে পড়ে থাকল বটে, কিন্তু হৃদয়টা পুরূরবার পিছু পিছু মর্ত্যভূমিতে চলে এলো। আমি উ™£ান্ত, আমি বিভোর, আমি পুরূরবায় মগ্ন।
আমার এই বিচলিত মানসিক অবস্থার মধ্যে দেবরাজ ইন্দ্র এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন, রাজসভায় ল²ী-স্বয়ংবর নাটক অভিনীত হবে। স্বর্গসুন্দরীরা স্বমর্যাদায় অলকাপুরী থেকে ইন্দ্রলোকে ফিরে আসতে পেরেছে। এর চেয়ে বেশি আনন্দের সংবাদ আর কী হতে পারে? আনন্দ তো উদযাপন করতেই হবে! নাট্যাভিনয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।
নাট্যশাস্ত্রকার ভরত মুনির ওপর নাট্য পরিচালনার দায়িত্ব পড়ল। তিনি ল²ীর ভূমিকায় অভিনয় করবার জন্য আমাকে নির্বাচিত করলেন। কিন্তু আমি যে তখন পুরূরবায় বেপথু। উদাসীন আমি। অভিনয়ে মন বসাতে পারছি না। ক্ষণে ক্ষণে পুরূরবা-স্মৃতিতে শিহরিত হচ্ছি।
কিন্তু আমার এমন ক্ষমতা নেই যে ভরত মুনির নির্দেশকে উপেক্ষা করি!
মহড়া আমি দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু অভিনয়ে মন বসাতে পারছি না।
নাটক মঞ্চায়নের দিনে সাংঘতিক ভুলটা করলাম আমি। ল²ীর মুখে সংলাপটি ছিল এরকম, ‘পুরুষোত্তম বিষ্ণুর প্রতিই আমার একমাত্র নিষ্ঠা।’ কিন্তু আনমনা আমি বলে ফেলাম ‘পুরুষোত্তম পুরূরবার প্রতিই আমার একমাত্র নিষ্ঠা।’
আমার সংলাপ শুনে শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে নিন্দার ঝড় উঠল। রাজসভাজুড়ে তখন বিখ্যাত দেবতারা। তাঁরা বলাবলি করতে লাগলেন, উর্বশীর এ কী কথা! স্বর্গবাসিনী হয়ে সাধারণ একজন মানুষের প্রতি এত টান। ছি ছি ছি।
এই ছি ছি টা ভরত মুনি নিজের গায়ে মেখে নিলেন। তিনি ধরে নিলেন, দেবতারা এ ভর্ৎসনা- তিরস্কার তাঁর উদ্দেশেই করলেন। তিনি আমার দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে অভিশাপ দিলেন, ‘এতই যখন তোমার পুরূরবা প্রীতি, তাহলে যাও তুমি মর্ত্যভূমিতে। পুরূরবার কাছেই চলে যাও তুমি। আজ থেকে তুমি স্বর্গচ্যুত হলে।’
বিশ্বাস করুন, ভরত মুনির অভিশাপ-বাক্য শুনে একটুকুও বিচলিত হইনি আমি। বরং ভীষণ আনন্দিত হয়ে উঠেছি। আমি হৃষ্টমনে পুরূরবার কাছে চলে গেলাম।
আমাকে দেখেই আত্মহারা হলেন পুরূরবা। তিনি যেমন পূর্ণশশী হাতে পেলেন! আচমকা আমাকে প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, ‘তুমি রাজমহিষী হয়ে আমার রাজপ্রাসাদে অধিষ্ঠিত হও প্রেয়সী।’ আমি স্মিত হেসে বললাম, ‘আমাদের মিলনে কোনো বাধা নেই রাজা। কিন্তু…।’ বলে থেমে গেলাম।
অস্থির কণ্ঠে রাজা বলে উঠলেন, ‘কিন্তু কী উর্বশী?’

‘আমার দিক থেকে তিনটি শর্ত আছে। সেই শর্তগুলি যদি তুমি পালন কর, তাহলে আমি তোমার অঙ্কশায়িনী হব।’ আপনি থেকে তুমিতে নামলাম আমি।
পুরূরবার অবস্থা তখন এমন যে প্রাণ দিয়ে হলেও শর্তগুলি পূরণ করতে প্রস্তুত সে।
অস্থির কণ্ঠে বলল, ‘তোমার সেই শর্তগুলো কী বল উর্বশী। যে কোনো মূল্যে ওই শর্ত পালন করব আমি।’
আমি একে একে তিনটি শর্তের কথা উল্লেখ করলাম। বললাম, ‘প্রথম শর্ত, আমার দুটো মেষশিশু আছে। ওদের আমি সঙ্গে রাখব। ওদের আঘাত বা অযতœ করা যাবে না কখনো।’
‘দ্বিতীয় শর্ত?’ জানতে চাইল পুরূরবা।
‘আমি যাতে কখনো তোমাকে উলঙ্গ না দেখি।’
‘উলঙ্গ না দেখ! শয়নকক্ষে তোমার সঙ্গে যখন মিলিত হব আমি, তখন বিবস্ত্র হব না?’ বলতে গিয়ে থেমে গেল পুরূরবা।
মৃদু একটু হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘তৃতীয় শর্ত?’
বললাম, ‘আমি কামাতুরা হলেই তবে আমাকে সঙ্গম করতে পারবে তুমি। আমার সম্মতি ব্যতিরেকে আমাকে সঙ্গম করতে পারবে না।’
তিনটি শর্তই মেনে নিল রাজা। তখন সে কামাবেশে অস্থির।
আমরা পুরূরবার রাজপ্রাসাদে আমাদের যুগলজীবন শুরু করলাম। সুখৈশ্বর্যে এ জীবন ভেসে যেতে লাগল। স্বপ্নলোকের অভীষ্টতমা রমণীটিকে পেয়ে পুরূবরা তখন উম্মাতাল।
এইভাবে অনেকটা বছর কেটে গেল।
পুরূরবার সুখামোদী মিলন-চুম্বনে আমি স্বর্গকে ভুললাম। স্বর্গ কিন্তু আমাকে ভুলল না।
ওদিকে আমার অভাবে স্বর্গপুরী অন্ধকার। দেবরাজ দিনে দিনে বিষণ্ন হয়ে উঠছেন। উর্বশীর পদোছন্দ-নৃত্যগীত এখন আর ইন্দ্রসভায় ধ্বনিত হয় না যে!
ইন্দ্র গন্ধর্বকে ডেকে বললেন, ‘বহুত হয়েছে। আর নয়। উর্বশীকে স্বর্গে আনার ব্যবস্থা কর। উর্বশী ছাড়া দেবসভা অচল।’
গন্ধর্ব ষড়যন্ত্রে মাতল। পুরূবরাকে দিয়ে যে কোনো মূল্যে শর্ত ভঙ্গ করাতে হবে। তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে আমি পুরূরবাকে ত্যাগ করব। এই ছিল গন্ধর্বের ষড়যন্ত্র।
গন্ধর্বের প্রধান লক্ষ্য হলো মেষশিশু দুটি।
সে-রাতে আমি আর পুরূরবা আলিঙ্গনসুখে মত্ত। এ মত্ততা চরমে পৌঁছাল একসময়। আমি একে একে আমার অঙ্গ-আবরণ ত্যাগ করতে লাগলাম। সবশেষে ত্যাগ করলাম আমার যুগল কুচঢাকা উড়নিটি। স্তন দুটি পুরূরবার চোখের সামনে ঠোঁটের কিনারায় উদ্ধত ভঙ্গিতে স্ফীত হলো। কামাচ্ছন্ন পুরূরবা সকল কিছু ভুলল। কামতাড়িত হয়ে সে নিজের শরীরের সকল বস্ত্র খুলে ফেলল। কক্ষটি অন্ধকারে নিমজ্জিত। তার নগ্নদেহ আমি দেখতে পাচ্ছি না। পুরূরবার এ নগ্নতা আজকেই প্রথম নয়। এর আগেও বহু রাত্রিতে এ ধরনের ব্যাপার ঘটেছে। এতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। আমার শর্ত ছিল, কোনোভাবেই তার নগ্নশরীর যাতে আমি না দেখি। দেখিনি কখনো। ঘন অন্ধকার না দেখায় সহযোগিতা করেছে। আজও তাই হয়েছে। পূর্ববৎ নগ্ন হয়ে পুরূরবা রতিক্রীড়ায় মগ্ন হলো। আমিও মাতোয়ারা।
ঠিক ওই সময় আমার পালিত একটি মেষশিশুর ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পেলাম আমি, ‘ম্যা—-!’
আমার কানে ‘ম্যা’ ‘মা’ হয়ে ভেসে এলো।
আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম। শিশুটি কাঁদছে কেন? ওরা তো পাশের কক্ষেই সযতেœ রক্ষিত! তাহলে! কোনো বিপদ হলো না তো ওদের! ঠিক ওই মুহূর্তে দ্বিতীয় শাবকটির আর্তনাদ আমার কানে এসে বাজল। আমি অস্তির হয়ে উঠলাম। আমার শরীর থেকে পুরূরবাকে ঠেলে নামিয়ে দিলাম।
আমরা যখন রতিক্রীড়ায় সমর্পিত, ঠিক তখনই ইন্দ্রপ্রেরিত গন্ধর্বটি মেষশাবক দুটিকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিল। তাদের আর্তকণ্ঠস্বর আমার কানে এসে পৌঁছেছিল।
আমি হাহাকার করে বললাম, ‘প্রাণনাথ, আমার মেষশিশু দুটিকে বাঁচাও। ওরা আমার পুত্রস্নেহে লালিত।’
আমার করুণ আর্তিতে পুরূরবা বর্তমানকে ভুলল, বাস্তবতাকে বিস্মরিত হলো। দ্রুত হাতে ক্ষীণ দীপবর্তিকা জ্বালাল পুরূরবা। মেষশিশু খোঁজবার জন্য নগ্ন অবস্থাতেই বেরিয়ে পড়ল। অল্পক্ষণেই মেষশাবকরা উদ্ধার হলো। তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে দেখে অলিন্দে ওদের রেখেই পালিয়েছে গন্ধর্বটি।
রাজাকে বাহবা দেওয়া উচিত আমার। তা না করে আমি পুরূরবার ওপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলাম। আমি যে কক্ষের মৃদু আলোয় তার নগ্নদেহ দেখে ফেলেছি! ধিক্কার দিয়ে উঠলাম আমি, ‘তুমি শর্ত ভঙ্গ করেছ রাজা।’
রাজা আকুল হয়ে বলল, ‘এ তো তোমারই জন্য, তোমার প্রিয় মেষশিশুকে বাঁচাবার জন্য!’
‘সে আমি বুঝি না। বুঝি এটা যে, তুমি শর্তভঙ্গ করেছ।’ আমার কথা শুনে পুরূরবা একেবারে ভেঙে পড়ল। দুবাহু বাড়িয়ে আমাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতে চাইল।
আমি সরে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘আমাকে স্পর্শ করার অধিকার হারিয়েছ তুমি। এই মুহূর্তে অন্য কক্ষে চলে যাও তুমি। আগামীকাল প্রাতে ইন্দ্রলোকে প্রত্যাবর্তন করব আমি।’
পুরূরবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম আমি।
আমার এরকম ভাব-পরিবর্তনে রাজা দিশেহারা হয়ে পড়ল। বারবার বলতে লাগল, ‘ক্ষমা কর, আমায় ক্ষমা কর উর্বশী।’
আমি একটি কথাও বললাম না। দরজায় খিল তুলে দিলাম। দরজার ওপারে দাঁড়ানো রাজার আর্তনাদেও আমি আমার সংকল্প থেকে টললাম না।
পরদিন ফিরে এসেছিলাম আমি ইন্দ্রপুরে।
ফিরেই ইন্দ্রের ষড়যন্ত্রের কথা অবগত হয়েছিলাম। ইন্দ্রের প্রতি ঘৃণায় আমার সমস্ত শরীর রিরি করে উঠেছিল। ইচ্ছে হয়েছিল, দৌড়ে গিয়ে এক দলা থুতু তাঁর মুখে ছিটিয়ে আসি। কিন্তু তা করতে পারিনি আমি। আমি যে ইন্দ্রের হাতের পুতুল! তাঁর ইচ্ছাতেই যে আমাদের জীবন আর মরণ! পুরূরবার জন্য আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠল। দিবস রজনীতে তাঁর জন্য কেঁদে যেতে লাগলাম আমি।
ওদিকে মর্ত্যভূমির সর্বত্র পুরূরবা আমাকে খুঁজে ফিরতে লাগল। যেখানে যেখানে আমরা বিহারে গিয়েছিলাম, সেই নন্দনবন, চৈত্ররথ, অলকা, গন্ধমাদন—- সর্বত্র পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল রাজা। কিন্তু কোথাও আমাকে খুঁজে পেল না। তাই বলে আমাকে অনুসন্ধান করাও বন্ধ করল না পুরূররা।
একদিন পুরূরবার অনুসন্ধান সার্থক হলো। সেদিন আমরা কুরুক্ষেত্রের পদ্মসরোবরে স্নান করছিলাম। বহুদিন স্বর্গে থেকে থেকে আর ভালো লাগছিল না। মেনকাকে ডেকে বলেছিলাম, ‘মর্ত্যে যাব। সবাই মিলে মর্ত্যরে সবেরাবরে জলকেলি করব। তুমি ইন্দ্রের কাছ থেকে অনুমতি নাও।’
মেনকা অনুমতি নিয়েছিল। আমি এবং অন্য স্বর্গসুন্দরীরা মর্ত্যে নেমে এসেছিলাম।
স্নান করতে করতে আমি বিরহকাতর পুরূরবাকে দেখতে পেয়েছিলাম। আমি নিচু গলায় অপ্সরাদের বললাম, ‘ওই যে দেখছ, ও হলো পুরূরবা। যার সঙ্গে এতকাল সহবাস করেছি আমি।’
আমার কথা শুনে সবাই পুরূরবার দিকে তাকাল। মুগ্ধ হলো সবাই।
রম্ভা সকাতরে বলল, ‘ইচ্ছে হচ্ছে আমিও ওই রাজার সঙ্গে সহবাস করি।’
সবাই চাপা কণ্ঠে হেসে উঠল।
বহুদিন পর রাজাকে দেখে আমার ভেতরটায় তোলপাড়। আমি শুকনো বস্ত্র পরিধান করে রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পুরূরবা দুবাহু বাড়িয়ে পাগলের মতো আমাকে আলিঙ্গন করতে চাইল। আমি দু’কদম পেছনে সরে গেলাম।
অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল সে। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, ‘কত নিকটে ছিলে, কত দূরে চলে গেলে!’
তার অস্ফুট কথাগুলো শুনতে পেলাম আমি। বললাম, ‘তোমার আর আমার মধ্যে এখন যোজন যোজন ব্যবধান রাজা। মর্ত্যরে বন্ধন অনেক কঠিন রাজা। স্বর্গবন্ধন শিথিল। সহজে ছিন্ন করা যায়। মর্ত্যবন্ধন সহজে ছিন্ন করা যায় না। আমরা নির্মিত হয়েছি ছিন্ন করার জন্য, বন্ধনে জড়াবার জন্য নয়। আমরা পুতুল। ইন্দ্রের হাতের ইশারায় চলি আমরা। আমরা আনন্দসঙ্গী, নিত্যসঙ্গী নয়। আমরা ভোগে লাগার উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নই রাজা। আমাকে তুমি ক্ষমা কর।’ বলতে বলতে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করলাম আমি।
পুরূরবাও কেন জানি শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করল। তার এ কান্না যে ভালোবাসার, এ কান্না যে পেয়ে হারানোর, বুঝতে অসুবিধা হলো না আমার। তারপরও আমি নিরুপায়। আমাকে যে ফিরতে হবে! স্বর্গে ফিরে অন্য কোনো দেহলিপ্সুর বাসনা মিটাতে হবে আমায়। আমার কোনো আড়াল আবডাল নেই, নিজের বলে কিছুই নেই আমার। আমি যে অনবগুণ্ঠিতা!
পেছন ফিরলাম আমি। অদূরে রথের কাছে অন্য স্বর্গরূপসীরা একত্রিত হয়েছে। ফেরার সময় গড়িয়ে যাচ্ছে।
হাঁটা শুরু করলাম আমি। পেছন থেকে পুরূরবার আর্তকণ্ঠ কানে ভেসে এলো, ‘উর্বশী, তুমি এত নিষ্ঠুর হয়ো না। যেয়ো না তুমি উর্বশী। তোমার সঙ্গে যে আমার অনেক কথা বাকি!’
ডুকরে উঠলাম আমি। দুই হাতের তালু দিয়ে আমার দু’কান চেপে ধরলাম। দৌড়াতে শুরু করলাম আমি। আমি যে আর সইতে পারছি না! আমি যে বলতে পারছি না, ‘আমি কারও বধূ নই, নই কারও ভালোবাসার! আমি শুধু…।’
হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম আমি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়