প্রকাশিত: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মে ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
‘মহুয়া’ প্রসঙ্গে সামান্য
‘মহুয়া’ মৈমনসিং গীতিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পালা। ড. দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর কর্তৃক সংকলিত মৈমনসিং গীতিকার পালাগুলোর মধ্যে মহুয়া নানান কারণে তাৎপর্যমণ্ডিত। গীতিকারের অন্য পালাগুলো হলো- মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারামের পালা, রূপবতী, কঙ্ক ও লীলা, কাজলরেখা, দেওয়ানা মদিনা ইত্যাদি।
‘মহুয়া’ মূলত প্রেমোপাখ্যান। আমাদের নাটকে মূলত মৈমনসিং গীতিকার প্রেক্ষাপটকেই গ্রহণ করা হয়েছে এবং সংলাপ হিসেবেও মৈমনসিং গীতিকাকেই আশ্রয় করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন কিছু সংলাপও যোগ করা হয়েছে মূল উপাখ্যানকে মাথায় রেখেই। ‘মহুয়া’ পালায় যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, তার বাইরেও ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে মহুয়া পালার একধিক কাহিনী বর্ণিত হতে দেখা গেছে; যদিও সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের গ্রাম-গঞ্জে মৈমনসিং গীতিকার পালাগুলো সেভাবে আর গীত হতে দেখা যায় না; নগর সংস্কৃতিতে ‘মহুয়া’র পালাভিত্তিক যে সব পরিবেশনা হতে দেখা যায়, তার সবই গীতিকানির্ভর।
নাটকে যেসব গান ব্যবহার করা হয়েছে তার সবই প্রায় গীতিকা থেকে নেয়া, শুধুমাত্র সাপ খেলার গানটি ময়মনসিংহের লোকগান এবং নাট্যকারের সম্মিলিত রচনা।
মহুয়া ব্রাহ্মণকন্যা, যখন তার বয়স ছয় মাস, ডাকাত হোমরা তাকে রাতের অন্ধকারে চুরি করে নিয়ে যায়। মহুয়াকে চুরি করার পর হোমরা ডাকাতি ছেড়ে সাপুড়ের দল গঠন করে এবং দল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মহুয়া বড় হয়ে হোমরা বাইদ্যার দলের একজন হয়ে যায়। বেদের দল একসময় ‘বামুনকান্দা’ গ্রামে আস্তান গড়ে। সেখানেই জমিদার নদের চাঁদের সাথে মহুয়ার দেখা হয়, সাপ খেলা দেখাতে গিয়ে। প্রথম সাক্ষাতেই প্রেম, তাদের প্রেম একসময় তাদের দেশান্তরী করে; শেষপর্যন্ত মহুয়া ও নদের চাঁদের মৃত্যুতে কাহিনী সমাপ্তি ঘটে; যদিও নাটকে মহুয়া-নদের চাঁদের সাথে হোমরা বাইদ্যাও আত্মঘাতী হয়। হোমরা বাইদ্যার আত্মঘাতী হবার বিষয়টি মৈমনসিং গীতিকার পালায় নেই, এ অংশটুকু নাটকীয়তার প্রয়োজনে বৃহত্তর ময়মনসিংহের কোনো কোনো অঞ্চলে প্রচলিত পালা থেকে আহরিত হয়েছে।
চরিত্রলিপি
গায়েন
দোহার
হোমরা বাইদ্যা
নদের চাঁদ
ভৃত্য
ভৃত্য-২
মহুয়া
পালঙ
মানিক
সওদাগর
মাল্লা ৩ জন
সন্ন্যাসী
[আলো জ্বলার পর মঞ্চে আসে গায়েন এবং দোহার দল]
গায়েন :
পুবেতে বন্দনা করলাম পুবের ভানুশ্বর
একদিকে উদয়রে ভানু চৌদিকে পশর।
দক্ষিণে বন্দনা গো করলাম ক্ষীরনদী সাগর
যেখানে বাণিজ্যি করতো চান্দ সদাগর।
উত্তরে বন্দনা গো করলাম কৈলাশ পরবত
যেখানে পড়িয়া গো আছে আলীর মালামের পাত্থর।
পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা এন স্থান
উরদিশে বাড়ায় ছেলাম মমিন মুসলমান।
সভা কইরা বইছন ভাইরে ইন্দু মুসলমান
সভার চরণে আমি জানাইলাম ছেলাম।
চাইর কুনা পরথমে গো বাইন্ধ্যা মন করলাম স্থির
সুন্দরবন মুকামে বন্দলাম গাজী জিন্দাপীর।
কিবা গান গাইবাম আমি বন্দনা করলাম ইতি
উস্তাদের চরণ বন্দিলাম করিয়া মিনতি।
[মিউজিক এবং সুর পরিবর্তন]
ও মোর পাগলা ঘোড়ারে কই অতি কই লইয়া যাও।
দোহার :
ও মোর পাগলা ঘোড়ারে কই অতি কই লইয়া যাও।
গায়েন :
গারো পাহাড়ের বাঁয়ে হিমানী পর্বত
সে ঘোর জঙ্গলে ছিলো ডাকাইতের বসত
হোমরা নামে ডাকাইত ছিলো পেশা তার ডাকাতি
বামুনকন্যা কইরা চুরি বদলাইলো রাতারাতি
বামুনকন্যা বড় হইল সুন্দরী যুবতী
মহুয়া সুন্দরী সে আইজ রূপে বিভাবতী
বাইদ্যার দল লইয়া হোমরা ঘুরে দেশে দেশে
বামুন কন্যা মহুয়া ঘোরে বাইদ্যানির বেশে।
ও মোর পাগলা ঘোড়ারে কই অতি কই লইয়া যাও।
দোহার :
ও মোর পাগলা ঘোড়ারে কই অতি কই লইয়া যাও।
গায়েন :
ঘুরতে ঘুরতে বাইদ্যার দল বামুনকান্দা আইলো
বামুনকান্দা আইসা তারা আস্তানা বান্ধিলো
আস্তানা বান্ধিয়া তারা সাপের খেইল দেখায়
সাপ খেলা দেখাইয়া পৌঁছে নদের চাঁদের গাঁয়
সাপ খেলা দেখাইয়া পৌঁছে নদের চাঁদের গাঁয়।
ও মোর পাগলা ঘোড়ারে কই অতি কই লইয়া যাও।
দোহার :
ও মোর পাগলা ঘোড়ারে কই অতি কই লইয়া যাও।
[গায়েন তার দলবল নিয়ে বেরিয়ে যায়। জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণ। জমিদার নদের চাঁদ পায়চারি করছে। দৌড়ে প্রবেশ করে জমিদারের ভৃত্য।]
ভৃত্য : কর্তা! কর্তা! একখান কথা ছিল কইবার।
জমিদার : ধৈর্য নাই আমার তোমার অত্যাচার সইবার!
যা বলবার বল এখন বড়ই তরা
ফুর্তিতে পূর্ণ তোমার হৃদয়ের ঘড়া!
ভৃত্য : এলো সাপুড়ের দল দেখায় সাপের খেলা
অনুমোতি হয় যদি ডাকি এই বেলা?
জমিদার : সাপের খেলা! এই অবেলা।
ডাকো তাগরে কাইল, আজ তারা বিশ্রাম নিক।
ভৃত্য : কর্তা কী যে কন তার নাই ঠিক।
ওরা যাযাবর কখন কোথায় যায় রাজ্য ঘুরিয়া বেড়ায়
সময় সুযোগে তাগরে পাওয়া বড় দায়।
হাতের নাগালে আজ যদি কন পলকে উড়িয়া যাই
বাইদ্যার দল আইনা এখন সাপ খেলা দেখাই!
[ভৃত্য দৌড়ে বেরিয়ে যায়। জমিদার নদের চাঁদ পায়চারী করে। ভেতরের উদ্দেশে কথা বলে]
আমার চাদরটা দিয়ে যা তো কেউ।
[আবার পায়চারী করে। ভৃত্য আসে, সাথে হোমরা বাইদ্যা, মাইনকা, মহুয়া ও পালঙ। ওরা সবাই নদের চাঁদকে অভিবাদন জানায়।]
সর্দার, কোথায় থাকো তোমরা কোনখানে ঘর?
হোমরা : আমরা সাপুড়ের দল কর্তা জন্ম যাযাবর।
আমগর নিজস্ব ঠিকানা নাই। যখন যেথায় থাকি
সেখানেই ঠিকানা তখন, এ জীবন উড়ালপাখি।
এখন আপনার সীমায় বামুনকান্দায় আছি কয়েকদিন
সদাশয় কর্তার চরণে অধমের সহস্র ঋণ।
জমিদার : সাপের কী খেলা দেখাও তাই আগে শুনি?
হোমরা : সাপ নাচাই গান গাই দর্শক খুশি হইলে দুই পয়সা গুনি।
খুশি হয়ে যে যা দেয় তাই দিয়া দিন চলে যায়।
খুশি হয়ে কেউ কেউ বকশিশও দিতে চায়।
জমিদার : আচ্ছা। ভালো কথা। তুমি বুঝি গুরু?
হোমরা : কর্তা অনুমতি করলে এখন খেলা করি শুরু?
[নদের চাঁদ হাত তুলে খেলা শুরুর অনুমোতি দেয়। এ সময় একজন ভৃত্য এসে নদের চাঁদকে চাদর দিয়ে যায়। নদের চাঁদ চাদর কাঁধে রাখে। মহুয়া আর পালঙ গান গেয়ে সাপ খেলা শুরু করে।]
\ গান \
এ… খা…
সাপ খেলা মোর জাতি গো পেশা
সাপ দেখাইয়া খাই রে
স্বপন দেখি সাপেরে নিয়া
সাপরানী আমার সই রে \
এ… খা…
চিরল দাঁতে মিশি গো দিয়া
পাগল করলো দেশ রে
সাত ভাইরে কাটলো গো নাগে
আকুল বেউলা সুন্দরীরে
এ… খা…
কাল রাইতে হইলাম রাঢ়ি গো
ওরে স্বামী খাইলো কাল নাগে
কী সাপে দংশিল লখাই রে
লোহার বাসর ঘরে
ও … ও … দুখী বেউলা রে
এ… খা… খা খা খা কিরপিরে খা, খেলা দেইখা যে পয়সা না দেয় তার দিদারে খা!
জমিদার : তোমাদের গান শুনে খেলা দেখে আমি খুবই সন্তুষ্ট হয়েছি সর্দার। তোমাদের জন্য আমি কিছু লাখেরাজ জমি বন্দোবস্ত দিতে চাই। সেখানে তোমরা বাড়ি করে থাকবে, চাষাবাদও করবে।
[হোমরা তাকে অভিবাদন জানায়]
এই নাও তোমার উপহার।
[কাঁধ থেকে নিজের চাদরটা হোমরার গায়ে জড়িয়ে দেয়। হোমরা অভিবাদন জানায়। মহুয়ার উদ্দেশে বলে-]
তোমায় কী উপহার দিই বল তো কন্যা? তোমার গানের সুরে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আবার আমি তোমার গান শুনতে চাই।
[গলা থেকে মুক্তোর একটা মালা খুলে মহুয়াকে পরিয়ে দেয়। মানিক ক্রদ্ধ হয়।]
[মহুয়া মুচকি হেসে বিদায় নেয়। আলো নিভে যায়। মঞ্চে আসে গায়েন ও তার দল]
গায়েন :
কালো কোকিল তুই ডাকিস না তমালের ডালে।
দোহার :
কালো কোকিল তুই ডাকিস না তমালের ডালে।
গায়েন :
চোখে চোখে হইলে কথা আসমান দেখা হয়
বুকের ভিতর ঝড় বয়ে যায় চক্ষু কথা কয়
মহুয়ার মন হইলো উদাস নইদ্যার মুখ দেখিয়া
নদের চাঁদের তৃষ্ণা কখন আসবে ঘাটে প্রিয়া
চন্দ্র ওঠে বন-জনপদ চান্নিপশর হয়
ঘুম আসে না রাত্রে দুজন একাই কথা কয়
নয়া আবাস বাঁধে বাইদ্যা দীঘির উত্তর পাড়ে
আনন্দে দিন কাটে তাদের আবাদে-আচারে
এরই ফাঁকে নিরালাতে মহুয়া-নইদ্যার চাঁদ
অভিসারে মিলে তারা আনন্দ-আহ্লাদ!
দোহার :
কালো কোকিল তুই ডাকিস না তমালের ডালে
[গায়েন দল বেরিয়ে যায়। কথা বলতে মঞ্চে আসে মহুয়া আর পালঙ]
পালঙ : কথার উত্তর দেস না কেন সই?
মহুয়া : কী কথা তরে আমি দেই কোন উত্তর কই!
মনে আমার বাউলা বাতাস দিগি¦দিকে ছোটে
নিদ নাই দুই আঁখিপাতে আঁচল ধুলায় লুটে।
মন পড়েছে বান্ধা আমার নইদ্যার চাঁদের মনে
নীল ভ্রমরা উইড়া বেড়ায় একলা বনে বনে।
পালঙ : কী কথা কস সই মহুয়া বুকে কি ডর নাই
অমন কথা শুনলে সর্দার দেবে না রেহাই।
মহুয়া : জলের ঘাটে যাবো আমি দেখিতে সখারে
তার ডাক আমি শুনতে যে পাই বুকে বারে বারে।
আসমানের চাঁন নামে যদি মাটির পৃথিবীতে
মৃত্তিকা কি পারে তারে সহজে ফিরাতে?
রাজাধিরাজ নইদ্যার চাঁদ আমায় ভালোবাসে
নানান ছুতায় ভ্রমর হইয়া উইড়া কাছে আসে।
পালঙ : ভ্রমর হইয়া উড়বে কাছে মধু নিয়া শেষে
উড়বে ভ্রমর যাবে দূরে কোথায় নিরুদ্দেশে
শুন শুন বইন মহুয়া আমার মাথা খাও
একলা কেন সইন্ধ্যাবেলা জলের ঘাটে যাও
সারা নিশি কাইন্দ্যা পুয়াও চক্ষে ঝরে পানি
একটিবার মনের কথা কওনা কেনে শুনি
হাইম ফেলিয়া চাইয়া থাক ঠাকুরবাড়ির পানে
নদ্যাঠাকুর পাগল হইছে শুনছি তোমার গানে।
মহুয়া : চন্দ্রসূর্য সাক্ষী গো সই সাক্ষী হইও তুমি
নদ্যার ঠাকুর হইল আমার প্রাণের সোয়ামী
বাইদ্যার সঙ্গে আমি যে সই যথায় তথায় যাই
আমার মন বান্ধ্যা রাখে এমন স্থান আর নাই
বন্ধুরে লইয়া আমি অইবাম দেশান্তরী
বিষ খাইয়া মরবাম কিম্বা গলায় দিবাম দড়ি।
[মহুয়া বেরিয়ে যায়, পিছনে পালঙ সই। আলো নিভে যায়। আলো জ্বললে দেখা যাবে মহুয়া কলসি কাঁখে জলের ঘাটে যায়, পিছন থেকে নদের চাঁদ গান ধরে]
নইদ্যা : জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ মন
কাইল যে কইছিলাম কথা আছেনি স্মরণ
মহুয়া : হে নাগর ছাইড়া দে কলসি আমার যায় বেলা
শুন শুন ভিনদেশী কুমার বলি তোমার ঠাঁই
কাইল যে কইছিলা কথা আমার মনে নাই
হে নাগর ছাইড়া দে কলসি আমার যায় বেলা \
নইদ্যা : নবীন যইবন কইন্যা বেভুল তোমার মন
এক রাত্তিরে এই কথাটা হইলে বিস্মরণ।
মহুয়া : তুমি তো ভিনদেশী পুরুষ আমি ভিন্ন নারী
তোমার সঙ্গে কইতে কথা আমি লাজে মরি \
নইদ্যা : জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ ঢেউ
হাসিমুখে কও না কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ \
মহুয়া : কেমন তোমার মাতাপিতা কেমন তাদের হিয়া
এতো বড় যোয়ান হইছ না করাইছে বিয়া \
নইদ্যা : কঠিন আমার মাতাপিতা কঠিন তাদের হিয়া
তোমার মতো নারী পাইলে আমি করি বিয়া \
হোমরা : চিন্তায় কী ফল রে মানিক। চল এক কাম করি
এই আবাসের মায়া ছাইড়া চল ভিন আবাসের পথ ধরি!
মানিক : সঠিক চিন্তা সর্দার! কাইল বিয়ানের আগে চল ভিন বন্দরে চলি।
হোমরা : সবাইরে তৈরি হইতে কও!
বামুনকান্দা ছাইড়া যাইতে সবাই তৈরি হও!
[হোমরা ও মানিক বেরিয়ে যায়। মঞ্চে আসে মহুয়া আর পালঙ।]
পালঙ : এখন কী হবে সই?
মহুয়া : দুজনে আয় বুক ভাসায়ে আকুল হইয়া যাই।
যে করেই হোক নইদ্যা ঠাকুরকে বার্তা দেয়া চাই
কিছুতেই যেনো দুজনারে দুজন কখনো না হারাই!
সূর্যোদয়ের আগেই যদি ছাইড়া যাই গ্রাম
বিচ্ছেদের বার্তা তারে কেমনে পৌঁছাইতাম?
পালঙ : সবচেয়ে ভালো পলাইয়া যাও বাইদ্যার বহর ছাড়ি
যে যা বলুক হইবা তুমি পিড়িতের রেল গাড়ি।
মহুয়া : বাইদ্যার কুলে জন্ম আমার বাইদ্যার লগে ঘুরি
বাইদ্যার ইজ্জত ধুলায় লুটাইয়া কেমনে যামু ছাড়ি!
পালঙ : বাইদ্যার কুলে জন্ম তুমার নাও হইতে পারে
কিছু কথা শুনছি আমি একদিন আড়ে ঠারে।
বামুনের কন্যা ছিলা মায়ের আদরে
হোমরা ডাকাইত আনছে তোমায় রাইতে চুরি করে
মহুয়া : ব্রাহ্মণকন্যা ছিলাম, কী কথা শুনাও?
কোথায় আমার পিতা-মাতা সে কথা জানাও
কোথা পাবো কোন দেশে কোথায় নিবাস?
পালঙ : এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিলে বুকে জাগে দীর্ঘশ্বাস!
নইদ্যার ঠাকুর ভালোবাসে তার কাছে যাও
সব কথা সবিস্তারে তাহারে জানাও।
মহুয়া : থাকবো না আর বাইদ্যার লগে যাবো কাছেতে তাহার
কণ্ঠেতে পরাবো তারে প্রেম-পুষ্পহার।
[অট্টহাস্যে হোমরা ও মানিক আসে]
হোমরা : হা হা হা…
কই যাবে মহুয়া সুন্দরী হবে তুমি কার
তুমি গেলে আমার জীবন হবে অন্ধকার!
ফিরা চল ডেরায় আমার সময় হাতে কম
মাথার উপর খাড়া আমি সাক্ষাৎ তুমার জম!
নিয়া চলো মাইনক্যবাইদ্যা জবরদস্তি করে
দয়া মায়া নাই কো আমার পাষাণ এ অন্তরে!
[মহুয়াকে ধরে নিয়ে হোমরা বাইদ্যা ও মানিক বেরিয়ে যায়।]
পালঙ : কী যে করি, কার কাছে যাই ঘুচাতে আন্ধার
মহুয়ার জন্য কান্দে পরান হইয়া জারে জার!
[পালঙ বেরিয়ে যায়। গায়েন দল আসে]
গায়েন :
কালো কোকিল তুই ডাকিস না তমালের ডালে।
দোহার :
কালো কোকিল তুই ডাকিস না তমালের ডালে \
গায়েন :
যায় পলাইয়া বাইদ্যার দল রাইতের আন্ধারে
প্রাতঃকালে বন-বনানী কান্দে জারে জারে।
দিশাহারা নইদ্যার চাঁদ ঘোরে গ্রামময়
মহুয়ার সঙ্গে যদি একবার দেখা হয়!
কই মহুয়া কোত্থাও নাই বামুনকান্দা গাঁয়ে
গেহতে নাই মেঠোপথে কিম্বা বাইদ্যার নায়ে।
দোহার :
কালো কোকিল তুই ডাকিস না তমালের ডালে।
গায়েন :
মা-জননীর কাছে নইদ্যা মিনতি জানায়
মহুয়াকে আপন করে কাছে পাইতে চায়।
মায়ের কাছে কাইন্দা বলে-
বিদায় দেও গো মা-জননী বিদায় দেও আমারে
তীর্থ করতে আমি যাইবাম আজি দেশান্তরে
ভাত রাইন্ধো মা-জননী না ফালাইও ফেনা
আমি পুত্র বৈদেশ যাইতে না করিও মানা
বিদায় দেও গো মা-জননী বিদায় দেও আমারে
তীর্থ করতে আমি যাইবাম দূর দেশান্তরে।
কিসের গয়া কিসের কাশী কিসের বৃন্দাবন
বাইদ্যার কন্যা খুঁজতে ঠাকুর ভরমে ত্রিভুবন।
দোহার :
কালো কোকিল তুই ডাকিস না তমালের ডালে \
গায়েন :
এক মাস দুই মাস কইরা তিন মাস যায়
খুঁইজ্যা না পাইল দেখা ভরমিয়া বেড়ায়।
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ না মাস গেল বন্ধু এই মতে
কাইন্দা বেড়ায় নইদ্যার ঠাকুর উচা নিচা পথে।
আগুন মাসের অল্প শীতে কংসাই নদীর পাড়ি
লাগল পাইল নইদ্যারচান মহুয়া সুন্দরী
সাপে যেমন পাইল মনি পিয়াসী পাইল জল
পদ্মফুলের মধু খাইতে ভ্রমরা চঞ্চল।
দোহার :
কালো কোকিল তুই ডাকিস না তমালের ডালে \
[গায়েন দল বেরিয়ে যায়। মঞ্চে আসে ক্লান্ত নদের চাঁদ, মুখ ভরা দাঁড়ি। এমন সময় কলসি কাঁখে মহুয়া আসে।]
নইদ্যা : কে গো কইন্যা উদাস মনে জল ভরিয়া যাও
মায়া যদি থাকে বুকে ক্ষণেক দাঁড়াও।
এক আঁজলা জল যদি দাও পিপাসা মিটাই
বন্ধুর খোঁজে ঘুরি বৈদেশ মনে শান্তি নাই।
[মহুয়া কলসি থেকে জল ঢেলে দেয়, নদের চাঁদ আঁজলা ভরে পান করে।]
নইদ্যা : বামুনকান্দার কুমার আমি নদের চাঁদ নাম
বাইদ্যার দল খুঁজি আমি হারাইয়া সম্ভ্রম।
হোমরা বাইদ্যার দলে থাকে মহুয়া সুন্দরী
সেই কইন্যারে খুঁজতে আমি হইছি দেশান্তরী।
মহুয়া : কী কথা কও নইদ্যার ঠাকুর চোখ তুলিয়া চাও
আমিই মহুয়া তুমার পরানে তাকাও।
বছরকাইল্যা রোগী আমি মন দেয় না সাড়া
আচম্বিতে আইজ সকালে কেন যে হইলাম খাড়া!
ভাত-ব্যঞ্জন রন্ধন করি জল ভরিতে আসা
হিজলতলে আইসা দেখি আমার ভালোবাসা!
কেমন ছিলা গো বন্ধু তুমি সুধাই তোমায় কেমনে আইলা এই জংলা তরি?
নইদ্যা : মহুয়া! মহুয়া!
তোমায় ভরমিতে আমি হইছি দেশান্তরী!
পরিব্রাজক একলা একা একাকিত্বে সুখ
আমার বুকের মধ্যে জাগে প্রিয়ার হাসিমুখ।
মহুয়া : মুখটা শুকনা তোমার ক্ষুধায় মলিন
মনে হয় জোটে নাই অন্ন মুখে কতদিন!
এইখানেই থাকো তুমি কিছুটা সময়
আমি যাই আনি অন্ন-ব্যঞ্জন সুযোগ যদি হয়।
মহুয়া : কী কথা বল গো তুমি ওগো প্রাণেশ্বর
তুমি কষ্টে থাকলে আমার বুঝি কান্দে না অন্তর?
সাবধানে থাইকো তুমি খুব নিরাপদে
এই বন চারদিকে ভরা শিয়াল শ্বাপদে!
[মহুয়া বেরিয়ে যায় দ্রুত। নদের চাঁদ মঞ্চের একপাশে ফ্রিজ হয়। মঞ্চে আসে গায়েন ও তার দল।]
গায়েন :
কালো কোকিল তুই ডাকিস না তমালের ডালে।
দোহার :
কালো কোকিল তুই ডাকিস না তমালের ডালে \
গায়েন :
মহুয়া সুন্দরী ডেড়ায় ফিরে খাবার কিছু নিলো
খাবার নিয়া নইদ্যার দিকে রওনা হইলো।
পিছনে তার রওনা হইলো হোমরা আর মানিক
মহুয়া তা পাইলো না টের সামান্য খানিক।
দোহার :
কালো কোকিল তুই ডাকিস না তমালের ডালে \
[গাইতে গাইতে গায়েন ও তার দল বেরিয়ে যায়। নদের চাঁদ ফ্রিজ ভেঙে পায়চারী করে। মহুয়া আসে। নদের চাঁদকে নিয়ে খাওয়াতে বসে। এমন সময় আসে হোমরা বাইদ্যা ও মানিক।]
হোমরা : বাহ বা বা!
কারে অত যতœ কইরা খাওয়াছ মহুয়া সুন্দরী
আহ্লাদ দেইখ্যা আমরা সবাই আনন্দে যাই মরি!
এই ছুরি লইয়া তুমি যাও নদীর পাড়ে
বান্ধা আছে নইদ্যার ঠাকুর মাইরা আসো তারে!
মহুয়া : সর্দার আমায় কী কথা কও কেমনে তা পারি
সর্প নিয়া নাচাই বটে তবু আমি নারী
কোন পরাণে বধিব আমি নিষ্পাপ মানুষটারে
লুহা দিয়া বান্ধায়া দেও আমার পরাণডারে।
হোমরা : ষোল বছর পাললাম কন্যা কত দুঃখ করি
আমার কথা রাখ তুমি মহুয়া সুন্দরী।
ভিনদেশী দুশমন সে জাদুমন্ত্র জানে
বক্ষেতে হানিয়া ছুরি মারহ পরাণে
আমার মাথা খাওরে কন্যা আমার মাথা খাও
দুশমনরে মাইরা ছুরি সাওরে ভাসাও!
যাও! ধরো ছুরি! শিগগির কইরা যাও!
[গায়েন আসে একা সম্মুখমঞ্চে গান ধরে। গানের সাথে মহুয়া সর্দারের হাত থেকে ছুরি নিয়ে বেরিয়ে যায়। গানের মধ্যে সবাই মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায়।]
গায়েন :
ডুবিল আসমানের তারা চাঁন না যায় দেখা
সুনীল চান্নির রাইত আবে পড়ল ঢাকা
ভাবিয়া চিন্তিয়া কন্যা কি কাম করিল
বাপের হাতের ছুরি লইয়া ঠাকুরের কাছে গেল
পায়ে পড়ে মাথার চুল চক্ষে পড়ে পানি
উপায় চিন্তিয়া কন্যা হইল উন্মাদিনী।
[গান শেষে দেখা যায় হাত বাঁধা নদের চাঁদ পড়ে আছে। গান শেষে গায়েন বেরিয়ে যায়, মহুয়া আসে ছুরি হাতে।]
নইদ্যা : মাও ছাড়ছি বাপ ছাড়ছি ছাড়ছি জাতিকুল
ভ্রমর হইলাম আমি যদি তুমি বনের ফুল।
আমার আসমান মেঘে ঢাকা সামনে ভরা নদী
ভাসতে পারি অথৈ গাঙে তুমি ডিঙি হইতা যদি!
সুদূরের তারা তুমি বন্ধু দূর আসমানের পারে
ক্যামনে ছুঁইতে পারি আমি রূপসী তুমারে।
মহুয়া : দিশা আমি পাই না খুঁজে কী-যে আমি করি
আমার ছোরায় বিদ্ধ কর আমি আগে মরি!
নইদ্যা : বইসা থাকি নদীর কিনারে অকূল পাথার
তুমি ছাড়া ক্যামনে আমি হইগো নদী পার!
তুমি আমার বুকের মাঝে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ
বুকের বেদন তুমি ছাড়া বুঝে না তো কেউ।
পাষাণ তুমার পরাণ গো বন্ধু পাষাণ তুমার হিয়া
তুমি নদী পার হইয়া যাও ছুরি অঞ্চলে বান্ধিয়া।
যতক্ষণ তুমার বুকের মাঝে মিশে আমি থাকি
ততক্ষণ জীবন আমার বাকি সব ফাঁকি।
মহুয়া : চন্দ্রসূর্য সাক্ষী আছে তুমি ভালোবাসা
তোমার জীয়নকাঠি ছুঁব আমার বুকের আশা।
নইদ্যা : তোমায় যদি না পাই কন্যা আর যাব না বাড়ি
ঐ হাতে মার গো কন্যা আমার গলায় ছুরি!
যুদি পারো বিদ্ধ করো তোমার বিষলক্ষার ছুরি
তোমার হাতের ছুরিকাঘাতে মরতেও আমি পারি!
নইদ্যা : পইরা থাকুক বাপ মাও পইরা থাকুক ঘর
তোমারে লইয়া বন্ধু ফিবার যামু দেশান্তর
বাপের আছে তাজি ঘোড়া ঐ না নদীর পাড়ে
দুইজনেতে উঠ্যা চল যাইগো দেশান্তরে।
চন্দ্রসূর্য সাক্ষী কইরা ছাড়ব আমরা দেশ
কেউ জানব না কোথায় গেছি কোথায় নিরুদ্দেশ!
মহুয়া : তাই হোক তবে চল পলাই দুজনে
আমরা আছি কোন বনে তা জানবে না আসমানে!
[নদের চাঁদের বাঁধন কেটে দেয় মহুয়া, অতঃপর দুজন পালিয়ে যায়। গায়েন আসে দল নিয়ে।]
গায়েন :
আরে ঘোড়াতে চড়িয়া তারা রওনা হইলো
চলতে চলতে তারা বিস্তার নদীর তীরে গেল।
বিস্তার পাহাড়িয়া নদী ঢেউয়ে মারে বাড়ি
এমন তরঙ্গ নদীর কেমনে দিবে পাড়ি!
চর পইরা যাও রে নদী দুই চাইর দণ্ডের লাগি
পার হইয়া যাক দুইজনে এই না ভিক্ষা মাগি।
দোহার :
ও মোর পাগলা ঘোড়া রে কইঅতি কই লইয়া যাও।
গায়েন :
এমন সময় পাশ দিয়া যায় সাধুর বজরা-নাও
সুন্দরী মহুয়া বলে আমগরে পার কইরা দাও।
দোহার :
ও মোর পাগলা ঘোড়া রে কইঅতি কই লইয়া যাও।
[গান গাইতে গাইতে গায়েন তার দল নিয়ে বেরিয়ে যায়। মঞ্চে আসে মহুয়া আর নদের চাঁদ।]
মহুয়া : সওদাগর আমগরে পার কইরা দাও
আমরা বড় বিপদগ্রস্ত শুনিতে কি পাও, পার কইরা দাও!
মাঝি : বাণিজ্যের তাড়া এখন সময় নাই হাতে
[সাধু মহুয়াকে দেখে চোখে লালসার আগুন জ্বলে]
সওদাগর : তাড়া যতই থাকুক মাঝি ক্ষতি নাই তাতে!
বিপদগ্রস্ত মানুষ ওরা ওদের উদ্ধার করা চাই
মানুষকে বিপদে রাইখা আমি পালাইতে শিখি নাই।
কিস্তি ভিড়াও ভিড়াও কিস্তি আগে ঘাটে
দেখি আমার কী লেখা আছে কাঙাল ললাটে।
[বজরা পাড়ে ভিড়ে। সওদাগর মহুয়া এবং নদের চাঁদকে নৌকায় তোলে, নৌকা চলতে শুরু করে। মহুয়া একপাশে ক্লান্ত নদের চাঁদকে নিয়ে বসে থাকে। অন্যপাশে সওদাগর একজন মাল্লার সাথে কানে কানে কিছু বলে। মাল্লা এসে মহুয়াকে কিছু বলে। মহুয়া সওদাগরের কাছে যায়। এমন সময় দুজন মাল্লা এসে নদের চাঁদকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়! নদের চাঁদের চিৎকার, মহুয়ার চিৎকার।]
মহুয়া : যে ঢেউ ভাসাইয়া নিল আমার নইদ্যার চাঁন
সেই ঢেউয়ে পইরা আমি তেজিবাম পরাণ।
সওদাগর : আমি থাকতে তুমি মরবা কেন গো সুন্দরী
তোমায় আমি কিন্যা দিমু শাড়ি-বেলুয়ারি
ফুলে ভরা মধু কন্যা ফিরো একেশ্বরী
তোমারে পাইলে আমি বাঞ্ছা পূর্ণ করি
অন্দর ময়ালে আমার ফুলের বাগান
দুইজনে তুলিব ফুল সকাল-বিয়ান।
রাত্রিকালে শুইব দুয়ে জোর মন্দির ঘরে
শীতের রজনীতে কন্যা থাকবা আমার উরে।
[সওদাগর মহুয়াকে কাছে টানতে চায়, মহুয়া নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে মহুয়া মনে মনে ফন্দি আঁটে এবং সওদাগর আর মাল্লাদের খোঁপা থেকে তক্ষকের বিষ মিশিয়ে পান বানিয়ে খাওয়ায়। পান খেয়ে সবাই অজ্ঞান হয়ে গেলে মহুয়া নৌকা থেকে নেমে যায়। মঞ্চে যখন এ দৃশ্য অভিনীত হচ্ছে, গায়েন তখন একা মঞ্চের একপাশে এসে গান করে।]
গায়েন :
যখন মহুয়া বুঝে উপায় কিছু নাই
বুদ্ধি কইরা খাতির দিলো সওদাগরের ঠাঁই
সাধুর লাগিয়া কন্যা পান বানাইল
পাহাড়িয়া তক্ষকের বিষ পানেতে মিশাইল
হাসিয়া খেলিয়া সাধুরে পান দিল মুখে
রসের নাগর তখন পান খায় সুখে
পান খাইয়া মাঝিমাল্লা বিষে পড়ে ঢলি
নৌকার উপরে কন্যা হাসে খলখলি।
জলেতে দিল ঝাঁপ কন্যা সাহস ভীষণ
পিড়িতের কারণে কন্যা ডরে না মরণ।
স্রোতের নদী সাঁতার দিয়া কন্যা কূলেতে উঠিল
নইদ্যার চাঁনকে কন্যা তখন খুঁজিতে লাগিল।
খুঁজিতে খুঁজিতে তারে পাইল ভাটির টানে
কাহিল নইদ্যার ঠাকুর বাঁচে কিনা কে জানে!
এমন সময় সেথায় সন্ন্যাসী এক আসে
নইদ্যার ঠাকুর তবুও তো উইঠা না বসে।
[গায়েন ও সবাই বেরিয়ে যায়। মঞ্চে শায়িত নদের চাঁদ, মহুয়া তাকে নিয়ে আহাজারি করছে। এমন সময় আসে জটাধারী তান্ত্রিক সন্ন্যাসী।]
সন্ন্যাসী : কে বা তুমি বল কন্যা তুমার পরিচয়
কোথা হইতে বনে আইলা এমন সময়?
কে এই যুবক বল তাহার কি-বা পরিচয়?
বান্ধাইলা কী অঘটন আমার সাধন সময়!
মহুয়া : আমার পরাণী সে যে পরাণের স্বামী
সাইরা তুলো তারে আগে পরে কথা কই আমি!
সন্ন্যাসী : কন্যা তুমি আমার কথা শুন দিয়া মন
পায়ে ধরি মাগি কন্যা তোমার যইবন।
তোমার রূপেতে কন্যা যোগীর ভাঙে যুগ
এমন ফুলের মধু করাও মোরে ভোগ!
মহুয়া : স্বামীরে বাঁচাও আগে সত্য করি আমি
যাহা চাও তাহা দিব বাঁচাইলে পরাণী।
সন্ন্যাসী : দুই দিন সময় দিলাম ভাবিয়া স্থির কর
নিজে খাওইয়া বিষ পতিকে তুমি মার।
মহুয়া : বাপের সমান মানুষ হইয়া তুমি কী সব কও
কপট সন্ন্যাসী তুমি সিদ্ধ পুরুষ নও!
সন্ন্যাসী : আমার সঞ্চয়ে আছে গোলমরিচের চূর্ণ-থানকুনি পাতার জারক
বিশুদ্ধ গোদুগ্ধ সহযোগে খেলে হবে যৌবনবর্ধক
সুস্থ করে দেবো আমি যদি দাও যৌবনের ভাগ
তার আগে চাই সুন্দরী তোমার সোহাগোনুরাগ।
বোম বোম ভোলে জয় বাবা ভোলানাথ
আমার সিনার ’পরে সুন্দরী কাটাও দুটি রাত।
মহুয়া : পথে পথে যদি মানুষের কামের প্রকোপ থাকে
কাম কি দেবে না রেহাই কন্যাকে-মাকে?
মহুয়া : ক্ষমা কর-কৃপা করো করি অনুনয়
বিশ্বাসে বাঁচার পথে জাগিও না ভয়!
সন্ন্যাসী : পুণ্যস্নানে শুদ্ধ হবো সিদ্ধ হবো ধ্যানে
কামানলে পুড়ি যদি সিদ্ধ হই কেমনে?
সবার আগে কামানল নেভাই মুক্তি যজ্ঞানলে
তুমি আমার আগুন নেভাও সযতœ অঞ্চলে।
বলবর্ধক তরুর রসে দেহে জাগাবো আগুন
তোমায় সুধার মধু দেবো করে শতগুণ।
[সন্ন্যাসী বেরিয়ে যায়। মহুয়া ডেকে ডেকে নদের চাঁদকে বসায় তারপর তাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। গায়েন আসে দল সহ।।]
গায়েন :
পলাইয়া যায় মহুয়া সুন্দরী নইদ্যার চাঁনকে নিয়া
ভিন্ন এক জঙ্গলে তারা বসত করে গিয়া
সেই বনে আইসা তারা থাকে তিন মাস
তিন মাস গেলে ঘটে নতুন সর্বনাশ!
দোহার :
ও মোর পাগলা ঘোড়া রে কইঅতি কই লইয়া যাও।
গায়েন :
ঘুরিতে ঘুরিতে আসে হোমরা বাইদ্যার দল
মহুয়া আর নইদ্যার চাঁদকে ঘিরিল সকল!
দোহার :
ও মোর পাগলা ঘোড়া রে কইঅতি কই লইয়া যাও।
[গায়েন দলসহ বেরিয়ে যায়। মহুয়া আসে, পিছনে নদের চাঁদ। নদের চাঁদ মহুয়াকে খোঁপায় ফুল গুঁজে দেয়, মহুয়াকে সাপে কাটে, মহুয়া চিৎকার করে।]
হোমরা : মাইনকা ওরে ভাই আমার মুখ করিস না চুন
বিষলক্ষার ছুরিতে ঐ দুশমনরে কর খুন!
[মানিক নদের চাঁদকে ছুরিকাঘাত করে]
নইদ্যা : পাষণ্ড-পিশাচ! বামুন কন্যা চুরি কইরা করলিরে তুই পাপ
তর ঐ মুখে দেখতে যে পাই বিষাদের ছাপ।
অভিশাপ দেই তরে আমি ব্রাহ্মণ সন্তান
পাবি না তুই এই জীবনে কভু পরিত্রাণ!
[নদের চাঁদ পড়ে যায় মহুয়ার পাশে, দুইজনের মৃত্যু।]
হোমরা : [কান্নাজড়িত] ছয় মাসের শিশুকন্যা পাইল্যা করলাম বড়
কী লইয়া ফিরবাম দেশে আর যাবো না ঘর।
শুন শুন কন্যা আমার আঁখি মেইলা চাও
একটিবার কইয়া কথা আমার পরাণ জুড়াও!
আর ফিরবো না আমি কভু আপনার ভবনে
[দলের উদ্দেশে] তুমরা ফিরো কন্যার সাথে আমি থাকলাম বনে!
দুইয়ের জন্য কয়বর খুঁড়ো পাশে আমায় দিও
দুইয়ের লগে মরণরে বরি এইবার আমিও।
[নিজের বুকে ছুরিকাঘাত করে হোমরা! মহুয়ার পাশে ঢলে পড়ে। সবার আর্তচিৎকার! গায়েন আসে দল নিয়ে।]
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।