ভাঙাড়ির দোকানে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, মালিকসহ দগ্ধ ৫

আগের সংবাদ

যুদ্ধের বাজারেও সিন্ডিকেট! রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে অসাধু চক্র > বাজারে সরকারের মনিটরিং দুর্বল

পরের সংবাদ

‘বিয়ে করলেও তুমি শেষ না করলেও তুমি শেষ’ : আলাপচারিতায় রুবাইয়াত হোসেন

প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক এবং গবেষক রুবাইয়াত হোসেন। সমাজে নারীর জীবনের জটিলতা, বৈষম্য ও সংগ্রামকে ফুটিয়ে তুলেছেন তার চলচ্চিত্রে। মূলত নারীপ্রধান চলচ্চিত্র নির্মাতা রুবাইয়াত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে নির্মিত মেহেরজান চলচ্চিত্র পরিচালনার মাধ্যমে ২০১১ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০১৫ সালে সিয়াটল চলচ্চিত্র উৎসবে মুক্তি পায় তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র আন্ডার কনস্ট্রাকশন। যা কিনা সমকালীন ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত এক নারীর আত্ম-অনুসন্ধানের চিত্র। আর ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ হয়ে বিদেশ ঘুরে ‘শিমু’ হয়ে নারী দিবসকে সামনে রেখে দেশের সিনেমা হলে ১১ মার্চ মুক্তি পাচ্ছে রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত চলচ্চিত্র। এছাড়া তার তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছে সুলতানা’স ড্রিমের প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ কর্মশালা
কেন চলচ্চিত্র ‘শিমু’
প্রতিকূলতাকে জয় করে সামনে এগিয়ে চলা প্রতিটি সংগ্রামী মানুষের গল্পই ‘শিমু’। সমতার প্রশ্নে ‘শিমু’ একজন সম্মুখযোদ্ধা। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে পোশাকশিল্পের যে ভূমিকা আছে তার আলোকে দৃঢ়চেতা নারী পোশাকশ্রমিকদের সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প বলা হয়েছে ‘শিমু’ চলচ্চিত্রে। আর আমার পাশাপাশি ছবিটির মূল কুশলীদের অধিকাংশই ছিলেন নারী। যেমন চিত্রগ্রহণে ছিলেন সাবিন ল্যাঞ্চেলিন, শব্দগ্রহণে কাজ কেছেন এলিশা আলবার্ট এবং শিল্প নির্দেশনায় ছিলেন জোনাকি ভট্টাচার্য্য।

মেইড ইন বাংলাদেশ থেকে শিমু, কেন?
‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ বা ‘শিমু’-এর কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে ওপেন ডোরস ল্যাবের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। শুরুতে আমাদের সিনেমার নাম ‘শিমু’ ছিল। পারমিশন ও কাগজপত্র করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রথম প্রদর্শিত হয় সিনেমাটি। তখন নামটা পরিবর্তন হয়ে যায়। এখন আবার দেশের রিলিজ করতে আসলাম, তখন মনে করলাম শিমু নামটা দেশের দর্শকদের জন্য মানানসই। তাই আগের নামটাই রাখলাম।

গল্পটি কীভাবে খুঁজে পেলেন?
আমি সবসময়ই নারীদের জীবন ও সামাজিক অবস্থাগুলো নিয়ে পর্দায় এক্সপেরিমেন্ট করতে চাইতাম। নিজের এরকম পরিবেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকায় তিন বছর আগে আমি একটি গবেষণায় অংশ নিয়ে প্রচুর ফ্যাক্টরি কর্মীদের সঙ্গে দেখা করি। পরে সেখানে ডালিয়া নামের এক নারীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়। সে ছিল একটি সংঘের নেত্রী। আমার মনে হয়েছিল সে যথেষ্ট সাহসী, কর্মঠ ও স্পষ্টভাষী। সে তার নিজের বৈবাহিক জীবনে অত্যাচারের শিকার হয়েও একটু সম্মানের জন্য আকাক্সক্ষা ধরে রেখেছিল। তো, এখান থেকেই আমি আমার গল্পটা লেখা শুরু করি, যা ছিল ডালিয়ার জীবনেরই নানান সত্যি ঘটনায় অনুপ্রেরণা।

এই গবেষণাটি করতে গিয়ে কোন দিকটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়?
গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির নারী কর্মীরা খুবই অল্পবয়সি। প্রায় সবারই বয়স ১৮ থেকে ৩০-এর মধ্যে। এখানে একটু বয়স্ক নারী কর্মী খুঁজে পাওয়াই যায় না। কারণ মাসে ১০০ ইউরোর বিনিময়ে সপ্তাহে ৬ দিন সেলাই মেশিনে ১০ ঘণ্টা কাজ করে সবাইকেই শারীরিক জটিলতায় ভুগতে হয়।
কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এত কম টাকা, কঠিন কাজের পরিবেশ, বাড়িতে পুরুষতান্ত্রিকতা এসবের সঙ্গে লড়ায় করেও তারা আত্মনির্ভরশীল। মাত্র একশ বছর আগেও নারীদের বাসার বাইরে কোনো কাজ করার সুযোগ ছিল না, গৃহবন্দি নিগৃহীতের জীবন ছিল তাদের। তবে আজ তারা কাজ করছে, নিজের ও পরিবারের জন্য উপার্জন করছে, একই সঙ্গে বাড়িতে ও কর্মক্ষেত্রে অধিকার আদায়ে চলছে তাদের সংগ্রাম।

ডালিয়ার কোন বিষয়টি শিমুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যাবে?
ডালিয়া ১২ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা আসে। এটা মফস্বলে খুবই নিয়মিত একটি ঘটনা। যাইহোক, বাবা-মায়ের ঠিক করা বিয়ে থেকে বাঁচতে এত অল্প বয়সে তার পালিয়ে যাওয়াটা সাহসেরই একটি প্রমাণ। এই বয়সি অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়ে যায়। ডালিয়ারও তাই হতে পারত যদি সে গ্রামেই থেকে যেত। হয়তো ৩-৪টা বাচ্চার মা হয়ে যেত। কাজের সুযোগ তো দূরের কথা, যদিও সেটায় নারী ক্ষমতায়ন।
বিভিন্ন উৎসব ঘুরে এবার দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে সিনেমাটি। এটি ভালো লাগার মতো বিষয়। কেননা ছবিটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয় টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে। এরপর ছবিটি প্রদর্শিত হয় বিএফআই লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসবে। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সমাদৃত ও পুরস্কৃত হয়েছে ছবিটি। এছাড়া ২০১৯-এর ডিসেম্বরে ফ্রান্স, ডেনমার্ক, কানাডা ও পর্তুগালের বিভিন্ন সিনেমা হলে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পায় ছবিটি। এরপর ২০২০ সালে আমেরিকার বিভিন্ন হলে প্রদর্শনের পর ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে দেখানো হয় ম্যাক্সিকো, চীন, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক ও জার্মানির সিনেমা হলে। আর বাংলাদেশে মুক্তির পরপরই আগামী এপ্রিলে ছবিটি মুক্তি পেতে যাচ্ছে জাপানের বিভিন্ন সিনেমা হলে।

ছবি দেখে বিদেশের দর্শকদের মতামত কেমন ছিল?
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ছবিটি যখন নিউইয়র্কে প্রদর্শিত হয়, তখন একজন আফ্রিকান-আমেরিকান নারী যিনি পেশায় শিক্ষক, প্রদর্শনী শেষে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, শিমুর সংগ্রামকে তার নিজের মধ্যে দেখতে পেলেন। এরপর যখন ছবিটি ফ্রান্সে মুক্তি পেল, তখন সেখানে শ্রমিকদের আন্দোলন চলছিল। শ্রমিকরা দলবেঁধে সিনেমাটি দেখেছে এবং শিমুর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছে। তবে আমার মনে হয় শ্রমজীবী নারী না হয়েও এ গল্পের সঙ্গে নিজেকে খুঁজে পাবেন নারীরা। চলচ্চিত্রে শিমু তার ব্যক্তিগত জীবনে স্বামীর কাছ থেকে যেসব বিষয়ের মুখোমুখি হয়েছে, শ্রেণি নির্বিশেষে দেশের মেয়েদের সে বিষয়টির মুখোমুখি হতে হয়।

কাজটির পেছনে আপনার ব্যক্তিগত অনুপ্রেরণা কী?
আমাকে অনুপ্রেরণা ছিল ‘রোসেটা’র মতো ফিল্ম। এমনকি ‘নরমা রে’ যেটা আমি শিমুর মধ্যেও দেখিয়েছি। এছাড়াও আমাকে রঙ-বেরঙের রিকশা চিত্র বিশেষভাবে টানত। এটা ঢাকাতে খুবই জনপ্রিয় ছিল এমন একটি সময় যখন শহরটি প্রায়ই অন্ধকার থাকত বিদ্যুৎ-স্বল্পতায়। তবে রঙের ছড়াছড়ি ছিল সবখানে। এজন্যই আমি আমার প্রডাকশন ডিজাইনারদের সঙ্গে এই রঙের ব্যবহার ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। অন্ধকার ও রঙের ব্যবহারের সমান্তরাল উপস্থাপনা। উদ্দেশ্য ছিল রঙ ও শব্দের ব্যবহার দিয়ে একটি বিশেষ অনুভূতিতে সাড়া দেয়ার।
সিনেমায় দেখা যাবে হিজাব থেকে খোলা চুলের শিমুকে। ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু তার চুল আস্তে আস্তে আবরণ খুলতে থাকে। প্রথমে সে হিজাব পরত যখন তার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয় সে ওটা খুলে ফেলে। শেষ সিনে আমরা তাকে খোলা চুলে এমনভাবে দেখি যে, তাকে কখনোই দেখা যায়নি। শিমু অনেক কিছুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। অনেক ফোর্সের বিরুদ্ধে, তাও সে নিরাশ হয় না। শিমু চেষ্টা চালিয়ে যায়, যতক্ষণ না সে সফল হচ্ছে। আর ছবিতে শিমুর একটি লাইন খুব সাড়া দেয়, ‘বিয়ে করলেও তুমি শেষ, না করলেও তুমি শেষ’।

শেষ করব আপনার নতুন উদ্যোগ সুলতানা’স ড্রিম নিয়ে, কেন এ আয়োজন?
চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় একযুগ। আমি দেখেছি দেশে নারী নির্মাতা একেবারে হাতেগোনা। চলচ্চিত্র নির্মাণে তারা বৈষম্যের শিকার। আমার মনে হয়েছে বৈষম্যের এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে এবং দেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়নে বেশি করে নারী নির্মাতাদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আমরা যারা আছি, তাদের সঙ্গে আরো মেয়েদের চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু তার আগে দরকার মেয়েদের চলচ্চিত্র নির্মাণ শেখানো। সেই ভাবনা থেকেই আমাদের এই আয়োজন। এই কর্মশালায় ১৬ জন নারী নির্মাতা অংশগ্রহণ করেছেন যেখান থেকে সেরা দুইজন নির্মাণ করতে পারবেন ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স শিরোনামে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
:: মেলা প্রতিবেদক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়