প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
যখন গদ্য লেখার অআকখ-এর মধ্যে ছিলাম, তখন লেখা শুরু করতে সময় লাগত। শুরু হলে তরতর করে কলম এগিয়ে যেত। এখন আর এমনটা হয় না। এই বাস্তবতায় বিমল গুহকে নিয়ে এক-কলম বা সাতকাহন লিখতে পারাটা এমন কোনো শক্ত কাজ মনে হয় না, বিশেষত তিনি যখন সৃজনশীল এবং আমার পছন্দের একজন কুশীলব। বহুদিন থেকে চিনি তাকে নামে, তারপর সামনাসামনি। বন্ধুতা এবং আড্ডা-অনুশীলনে আমি দুটো কৌশলের চর্চা করি : এক- দোষগুণ মেনে নিয়ে কাউকে একেবারে নিজের ভেতরে ধারণ করা; দুই- পাছে দোষগুলো বিকট কামড়ে ধরে আমাকে ব্যথিত করে সেই ভেবে কিছুটা দূর থেকে দেখা, যেখান থেকে তার সৌন্দর্যগুলোকে মোটামুটিভাবে অবলোকন করা যায়। কিন্তু অসৌন্দর্যগুলো থেকে যায় দৃষ্টিসীমার বাইরে। মেধা-মনন-রুচি-প্রতিভার দিক দিয়ে এমন মানুষের সংখ্যাই আমার সংগ্রহে বেশি, যাদেরকে কিছুটা দূর থেকে দেখতে চাই বা দেখি। বিমল গুহ তার ওইসব বাচকতার প্রেক্ষিতে আমার চেতনায় ওই কিছুটা দূরে রাখারই প্রিয় মানুষ।
আমাদের সমাজ-বাস্তবতায় অনেক বড়ো মাঝারি লেখাপড়া জানা প্রতিভাধর মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখে আমার অভিজ্ঞতা হতাশাব্যাঞ্জক। বাহ্যদৃশ্যে বেশির ভাগ ভরাট মানুষই অন্তরখননে কেমন যেন ফাঁপা। হ্যাঁ মানছি যে জীবনের এই কৌশলের কারণে আমি নিজেকে বহু ও তথাকথিত ভরাট মানুষের অন্তঃশূন্যতা দেখা থেকে রক্ষা করাও ভাবছি বটে, সঙ্গে সঙ্গে এও তো সত্য যে, অনেক মানুষ, যারা বাইরে-ভেতরে দুই ক্ষেত্রেই ভরাট, তাদের মৌলিকত্ব দেখার সুখ থেকেই নিজেকে বঞ্চিত করছি। তো যে যা-ই বলুন, যিনি যেভাবেই নিন, আমি বহু লোককে প্রিয় ছবির ঝাপসা এড়ানোর জন্য কিছু যে দূর থেকে দেখতে চাই বিমলদা সেই দূরত্বে থিতুই একজন মানুষ।
বিমল গুহ যখন কবি, এই বিলু কবীর যখন তার একজন নাদান পাঠক। তখন তাকে নিয়ে একটা অগভীর গদ্য লিখতে হবে। যেহেতু বিমলদাও আমার প্রিয় বিলু কবীরও আমার ফেলনা নন, তখন তাকে নিয়ে লিখলে সেটা একচোখা ফরমায়েশি তো হওয়ার কথা নয়। বরং অধিকার রাখি তার প্রতিভার যথাযথ ব্যবচ্ছেদ করে দেখা এবং দেখানোর চেষ্টা করাও যে আমাদের কাব্যভুবনে বিমল গুহের অবস্থানটি কতটা ওপরে বা নিচে তিনি আমাদের কাছ থেকে একজন প্রতিভাবান হিসেবে কতটা মর্যাদা পাচ্ছেন এবং সেই পাওয়াটুকু তার প্রাপ্যের তুলনা কম না বেশি এবং কম হলে কতটা কম, কেন কম, বেশি হলেই বা কতটা বেশি, কেন বেশি! বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ দেয়ার বেলায় আমাদের কার্পণ্যের শেষ নেই, আর বেশি দেয়ার প্রশ্নে তো আমাদের বখিলতা আকাশছোঁয়া।
যাহোক, একটা লেখায় পুরো বিমল গুহকে ধরতে গেলে অনেক কিছুকেই আসলে ছাড়াও হবে। কারণ তার কাব্যজগতে অনেক অলিগলি, রাজকবি সড়ক। তার কবিতার বন-বনানী-প্রেম-পরিবেশ-মানুষ-প্রকৃতি-প্রতিবাদ-প্রত্যাশা-কটাক্ষ হাস্য ইত্যাদির সোজা এবং তির্যক চিত্র বক্তব্য বড়ো কম নয়। সেই কারণে একটিমাত্র লেখা তা তার কলেবর যাত্রাই প্রশস্ত হোক, তাও পুরো বিমল গুহকে ধরতে গেলে সেই রচনা অসম্পন্ন হতে বাধ্য। অতএব বিচক্ষণতা হয় তাকে খণ্ডিতভাবে মূল্যায়নের প্রয়াস পাওয়া। এই বোধে প্রাণিত হয়ে তার কবিতার নানা দিক নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তার বিষয় অধিক- মুক্তিযুদ্ধ চেতনা, উপমা উৎপেক্ষা, মিথ, অনুপ্রাস, প্রকৃতি, অধিবাস্তবতা, স্লোগানধর্মিতা, রূপকল্প, বিশ্বজনীনতা, জাতীয়তাবোধ, প্রভাবক-প্রভাবিত, নারী, ভালোবাসা রাজনীতি, লোকবিশ্বাস, পুরাণ, ধর্মবোধ, শিশুসাহিত্য, ফল-পাখি নানা বিষয় তার কাব্যজগতের সমৃদ্ধি তা দিয়েই। তা অস্বীকার করা যাবে না। বলছি না যে, আমার এই মতামতের সঙ্গে কাউকে বা সবাইকে পুরোটা একমত হতেই হবে। কিন্তু তার পেছনে চেতনাগত একটি কার্যকারণ তো অবশ্যই রয়েছে। সেটা হলো বিমল কাব্যের কী নিয়ে লিখে, কোন দিক নিয়ে লিখে, ভাবনার শুরুতেই কেন যেন ভেতরের আমি বাইরের আমাকে সায় বা সমর্থন দিল, তার ভালোবাসার কবিতাকে প্রতিপাদ্য করলে দোষ কী? সমর্থনটা আরেক ধাপ দৃঢ়তায় ধাক্কা দিল, দোষ তো নয়ই বরং মন্দ কী। তার পরই সিদ্ধান্ত থিতু হয়, মন্দের তো কোনো প্রশ্ন নেই, বরং ভালো ভালোই যথেষ্ট ভালো হয়।
এই কাজ করতে গিয়ে আকরগ্রন্থ হিসেবে বিমল গুহর বিবরের গান (২০১৫), প্রত্যেকেই পৃথক বিপ্লবী (২০১৫) এবং নির্বাচিত কবিতা (২০০১)-কে অবলম্বন করা গেল। শেষোক্ত বইটিকে প্রধান সহায় করলে খাটাখাটুনি ঢের কমে যায়। এই গ্রন্থে অবশ্যি এই বাছাইয়ের বাইরে আরো কবিতা আছে, যা যথার্থ প্রেমেরই কবিতা, কিন্তু মান বিচারে কবির বিবেচনা সেগুলো এগুলোর চাইতে বেশি উৎকৃষ্ট নয়। স্বীকার করে রাখলে নিজের দায় অনেকটাই হ্রাস হয়ে যায় যে, আলোচ্য ভালোবাসার কাব্য বাদেও তার যে অন্য কাব্যগুলো রয়েছে, অহংকার তোমার শব্দ (১৯৮২) সাঁকো পার হলে খোলাপথ (১৯৮৫) স্বপ্নে জ্বলে শর্তহীন ভোর (১৯৮৬), নষ্ট মানুষ ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯৫), প্রতিবাদী শব্দের মিছিল (২০০০), আমরা রয়েছি মাটি ছুঁয়ে (২০১১) কবিতাগুলো এবং প্রাগুক্ত বিবরের গান (২০১৫) ও প্রত্যেকেই পৃথক বিপ্লবী (২০১৫ সেখানেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভালোবাসার কবিতা রয়ে গেছে। সেইসব কবিতা-প্রেম পঙ্ক্তি হওয়া সত্ত্বেও এই লেখার আওতায় আনা হয়নি। অতএব বিমল গুহর কাব্যবিস্তৃতির প্রেমপরিধির পুরো চৌহদ্দিকে বীক্ষণের খনন প্রক্রিয়ায় আনা হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে এটি আলোচনা অসম্পন্ন হতে বাধ্য। তবে এ ক্ষেত্রে যিনি বা যারা পুরো বিমলকে খোঁড়াখুঁড়ি করবেন, তার বা তাদের জন্য কিছুটা কাজ অন্তত এগিয়ে রাখা গেল, সেই আত্মতুষ্টির একটা দাবি বোধ হয় এই তুচ্ছ রচনার পরিপ্রেক্ষিতে করা যায়।
ভালোবাসার কবিতায় স্বয়ং কবির যে বাছাই-উৎকৃষ্ট কবিতামালা, সেগুলো হলো : তুমি এলে প্রিয়তমাসু, চন্দ্রখচিত রাতে কাল, খসড়া, যখন তুমি অভিজ্ঞান, কী করে ফেরাতে পারো, সঙ্গতি, দ্ব›দ্ব, অন্যরকম, সহবাস, বিশালাক্ষী মনে পড়ে, ভুলভর্তি রাফখাতা, যৌথজীবন, আকাশে তখন পূর্ণচাঁদ, ৫ মার্চের গান, ভৌগোলিক কম্পনের মতো, এ কেমন ভালোবাসা, শান্তির পায়রা, অবজ্ঞা, এই কুড়িটি কবিতা। কবিতাগুলো সর্বাংশে উত্তীর্ণ? এই প্রশ্নের উত্তর সবার পক্ষ থেকে একই হবে না। কিন্তু আমার উত্তরটা কবির অনুকূলে যাবে। ভালো, যথেষ্ট ভালো। নইলে সেগুলোকে নিয়ে সাতকাহন লিখতেও বসা কেন।
যা-ই হোক এখন আমরা চুল না ভিজিয়ে বিমল গুহর ভালোবাসার কবিতায় অবগাহন করতে পারি। তাহলে নিজের মধ্যে কতটা দোলা বা ঢেউ জাগে, সেটা দিয়ে বিমল এবং তার কাব্যপ্রতিভাকে অনুভবের নিক্তিকে পরিমাপ বা অন্তরের বীক্ষণে নিরীক্ষা করা যাবে। তার গড় সম্পর্কটা তো সম্ভব নয়, আমরা ছিঁড়ে-ছিঁড়ে তার পঙ্ক্তি বিশেষকে আলোর সামনে একটুখানি মেলে ধরতে চেষ্টা করব। সেই সঙ্গে তার বাচিক শিল্প সংলাপ বিলাপ, রঙ-নকশার একটা মূল্যায়ন প্রয়াস। তার ‘চন্দ্রের শেষ আলো তখনো মোছেনি ভেজা চোখ’; কিংবা ‘প্রথম বয়সভাঙা বালিকার মতো’ খুবই শক্তিশালী হৃদয়স্পর্শী পঙ্ক্তি; বিশেষ করে- প্রথম বয়সভাঙা বালিকার মতো- এই উপমার কিন্তু তুলনা হয় না।
কবি যখন বলেন- ‘তোমাকে কী দিতে পারি বলো?/ এই নাও সংঘবদ্ধ আড়ই আঙুল’- প্রেম তখন কেমন হয়ে ওঠে। যখন সে মন হৃদয় ডিঙিয়ে শরীর হয়ে বসে। সংঘবদ্ধ আড়ষ্ট আঙুল মানে অনেক ক্ষুধা নিবৃত্তির রঙিন পরিণতি। এ ঠিক প্রেমের মধ্যে হাবুডুবু খাওয়া অবস্থায় এভাবে লেখা যায় না। বিমল গুহ সেই অভিধান খুব ভালোই তো বোঝেন। যেমন : তোমার ওভাবে শুয়ে থাকার মধ্যে/ ঘরময় পুলক শুয়ে আছে।/ পিঠের উপর আধাখোলা বেণী/ যেন মিহি-নীরবতা লজ্জা ছুঁয়ে যায়,/ উপুড় করা দুটি পায়ের পাতা/ যুগল পায় বা যেন আহার খুঁটছে আনমনে’। অসাধারণ। উপুড় করা দুটি পায়ের পাতা যুগল পায়রার আনমনে আহার খোঁটার রূপকল্প কবিত্ব বটে। মানব উপগত ছন্দোবদ্ধ দেহভক্ষণের এমন দৃশ্য অঙ্কনের জন্য এই কবি বাহ্বা পাওয়ার মতো ভাষাচিত্রী, যে-কথা বিস্ময়ের সঙ্গে স্বীকার করতে হয়। শেষ কথা এই যে, তার কবিতা একই সঙ্গে পথ ও পথিক। তাই তাতে ভর করে আমরা অনেক দূর যেতে পারি, আর তার সঙ্গেও যেতে পারি ঢের পথ।
শেয়ার করুন
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।