ম্যান ইউতে ফিরলেন রোনালদো

আগের সংবাদ

চেনা উইকেটে অচেনা নিউজিল্যান্ড

পরের সংবাদ

সচিব উপসচিবের স্বাক্ষরে তৈরি হচ্ছে জাল সনদ : ভর্তি, সিজিপিএ বাড়ানোসহ সবই হচ্ছে হ মূলহোতাসহ চক্রের ৭ সদস্য গ্রেপ্তার

প্রকাশিত: আগস্ট ২৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইমরান রহমান : মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে শিক্ষাবোর্ডের মাধ্যমেই মিলছে জেএসসি থেকে ¯œাতক পর্যন্ত বিভিন্ন পরীক্ষার সনদপত্র। পছন্দ মতো সিজিপিএ অনুযায়ী পরিবর্তন করা হচ্ছে পরীক্ষার ফলাফল। আবার কেউ যদি কোনো নির্দিষ্ট কলেজে ভর্তি হতে চায়, সেটিও করে দেয়া হচ্ছে সূ²ভাবে। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে কিংবা কোনোদিন স্কুল কলেজের গণ্ডি না মাড়ালেও মিলে যাচ্ছে এসব সনদ। এক্ষেত্রে পাস করা শিক্ষার্থীদের সনদপত্র সংশোধনীর সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে প্রতারকরা। কোনো জাল সনদপ্রার্থী প্রতারকচক্রের সদস্যদের টাকা দিলেই চাহিদামতো সনদ পেয়ে যাচ্ছেন। তবে নিজের নাম, বাবা-মার নাম ও জন্ম তারিখ পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়ছেন প্রকৃত কৃতকার্য শিক্ষার্থীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাল সনদপ্রার্থীর নামের সঙ্গে মিল আছে এমন কৃতকার্য শিক্ষার্থীর সনদপত্র সংশোধনের নামে ১০ বছর ধরে কাজটি করে আসছে শিক্ষাবোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা চক্রটি। সনদ সংশোধনের কোনো নিয়মকে তোয়াক্কা না করে নির্দিষ্ট ফরমেটে আবেদন করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের সচিব প্রফেসর তপন কুমার সরকার ও উপসচিব (বৃত্তি শাখা) মীর আশরাফ আলীর স্বাক্ষর নিয়েই তৈরি করা হচ্ছে এসব সনদপত্র। যদিও স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারণার বিষয়টি তারা অবগত নন। তবে সচিব ও উপসচিব স্বাক্ষরিত একটি সংশোধনী আবেদনের কপি ভোরের কাগজের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তাদের স্বাক্ষরিত আবেদনপত্রে জাল সনদপত্র অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
গত শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর, রমনা ও চকবাজার এলাকা থেকে এ চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- চক্রটির মূলহোতা এ কে এম মোস্তফা কামাল, মো. মারুফ, ফারুক আহম্মেদ স্বপন, মাহির আলমা, আবেদ আলী, নূর রিমতি ও জামাল হোসেন। গতকাল শনিবার বেলা ১২টার দিকে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পরে ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে তাদের আদালতে পাঠানো হলে আদালত প্রত্যেকের ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
ডিবি সূত্র জানায়, কেউ জাল সনদপত্র বানাতে চাইলে মারুফের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মারুফ ৩ লাখ টাকায় চুক্তি করে সনদপ্রার্থীর সব ধরনের তথ্য নেন। এরপর যোগাযোগ করা হয় মূলহোতা মোস্তফা কামালের সঙ্গে। এরপর তারা জাল সনদপ্রার্থীর নামের সঙ্গে মিল আছে এমন সনদপত্র খুঁজতে থাকেন। এক্ষেত্রে সহায়তা নেয়া হয় শিক্ষাবোর্ডের ইবোর্ডরেজাল্ট.কম ওয়েবসাইটের। সেখানে রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়াই শুধু রোল নম্বর দিয়েই সনদ দেখতে পারা যাওয়ায়, চক্রের সদস্যরা রোল নম্বরের ডিজিট পরিবর্তন করে জাল সনদপ্রার্থীর নামের সঙ্গে মিল আছে এমন সনদপত্র খুঁজতে থাকে। কাছাকাছি নামের কারো সনদপত্র পেয়ে গেলে শুরু হয় জাল সনদপত্র বানানোর প্রক্রিয়া।
ওই সনদপত্রে নিজের নাম, বাবা-মার নাম ভুল আছে, সংশোধন করা প্রয়োজন জানিয়ে অনলাইনে আবেদন করা হয়। এক্ষেত্রে অনলাইনে জাল সনদপ্রার্থীর যে জন্ম নিবন্ধন তথ্য ও তার বাবা-মায়ের যে ভোটার আইডি কার্ড সরবরাহ করা হয়, তার সবই থাকে ভুয়া। এরপর নিয়ম অনুযায়ী সনদপ্রার্থীকে সংশোধন বোর্ডের মুখোমুখি হওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা এ চক্রে জড়িত থাকায় সেটির দরকার হয় না। এভাবে প্রথমধাপে প্রকৃত কৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীর অগোচরে নামগুলো সংশোধন করে ফেলা হয়। পরে একই উপায়ে পাল্টে ফেলা হয় জন্ম তারিখও। তখন শিক্ষাবোর্ডের ওয়েবসাইটে জাল সনদকারী হয়ে যান প্রকৃত সনদকারী। পরে ওই সনদপত্র ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করেন জাল সনদকারী। আর বিপাকে পড়েন প্রকৃত কৃতকার্য শিক্ষার্থী।
এভাবে অসংখ্য জেএসসি ও এসএসসি সনদপত্র পরিবর্তন করেছে চক্রটি। শুধু সনদপত্রই নয়, জালিয়াতি করে শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সিজিপিএও পরিবর্তন করে দিত তারা। এক্ষেত্রে কত পয়েন্ট করে দিতে হবে তার ওপর নির্ভর করে টাকার অঙ্ক। এ কাজগুলোর বাইরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্রও বানিয়ে দিত তারা।
সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, নূর তাবাসসুম নামের এক শিক্ষার্থীর সনদপত্র পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় ধানমণ্ডি থানায় একটি মামলা করা হয়। এই মামলার তদন্তে নেমে চক্রটির ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রতারণা সম্পর্কে হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেপ্তারকৃত নূর রিমতি ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় রাজধানীর সিটি মডেল কলেজ থেকে অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। কিন্তু তার ইতালি যাওয়ার জন্য এসএসসি পাসের সার্টিফিকেট প্রয়োজন। জাল সনদ তৈরির জন্য তিনি মামা জামাল হোসেনের মাধ্যমে এ কে এম মোস্তফা কামালের সঙ্গে তিন লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তি অনুযায়ী মোস্তফা কামাল শিক্ষাবোর্ডের দালাল চক্র গ্রেপ্তারকৃত মারুফ, মাহবুব আলম, ফারুক আহম্মেদ স্বপন ও আবেদ আজাদের সঙ্গে সমন্বয় করে নূর তাবাসসুম নামে এক শিক্ষার্থীর সনদপত্র সংক্রান্ত জেএসসি এবং এসএসসি পাসের সব তথ্য সংগ্রহ করেন।
এরপর তারা প্রথমে শিক্ষার্থীর বাবার নাম, মায়ের নাম সংশোধনের জন্য শিক্ষাবোর্ডের নির্ধারিত ফরমেটে আবেদন করেন। পরে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী টাকার বিনিময়ে শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটের রেজাল্ট আর্কাইভে নির্ধারিত ফরমেটে সংরক্ষিত কৃতকার্য প্রকৃত শিক্ষার্থী নূর তাবাসসুমের তথ্য পরিবর্তন করে অকৃতকার্য শিক্ষার্থী নূর রিমতির তথ্যসমূহ আপলোডের মাধ্যমে জাল সনদ তৈরি করেন। পরবর্তীতে জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে নেয়া হয়। এমনকি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটেও পরিবর্তিত শিক্ষার্থীর সংযোজিত তথ্য দেখায়। তিনি আরো বলেন, এই প্রতারক চক্র ঢাকা শিক্ষাবোর্ডসহ অন্যান্য শিক্ষাবোর্ডের বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, জন্ম তারিখসহ অন্যান্য তথ্য পরিবর্তন করে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের তথ্য সংযোজন করে জাল সনদ তৈরির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তাদের চক্রের সঙ্গে যারাই জড়িত, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি প্রকৃত কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের সনদ যাতে পরিবর্তন হয়ে না যায়, সেজন্য শিক্ষাবোর্ডের ওয়েবসাইটে ঢুকে যার যার সনদপত্র দেখার পরামর্শ দেন ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের (ঢাকা) সচিব প্রফেসর তপন কুমার সরকার ভোরের কাগজকে বলেন, যে কোনো সনদ সংশোধনের বেলায় একটি বোর্ড করা আছে। আবেদনকারী বা সংশোধন প্রার্থীকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ওই বোর্ডের মুখোমুখি হতে হয়। পরে ওই বোর্ড সংশোধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের কাছে আবেদন পাঠায়। পুরো প্রক্রিয়া বিভিন্ন যাচাইবাছাই শেষে করা হয়। যেহেতু এ কাজে অনিয়মের একটি বিষয় এসেছে, অবশ্যই আমরা তদন্ত করে দেখব। আগামীকাল (আজ রবিবার) আমার অফিসে লোক পাঠান, খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত জানাতে পারব।
জাল সনদ আপনার স্বাক্ষরেই তৈরি করা হচ্ছে কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমনটি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত কিনা আমরা খতিয়ে দেখব। আবেদনপত্রে আরেকজনের উপসচিবের স্বাক্ষর রয়েছে, কিন্তু ওয়েবসাইটে তার নাম নেই। তিনি কি শিক্ষাবোর্ডেই কর্মরত? জানতে চাইলে সচিব বলেন, ওই কর্মকর্তা তার অধীনেরই উপসচিব। ওই কর্মকর্তার ফোন নম্বর চাইলে বলেন, তাকে আলাদাভাবে ফোন দেয়ার দরকার নেই। যেহেতু আমি সচিব, সেহেতু আমার কথা আর তার কথা একই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়