কুমিল্লায় ট্রাকচাপায় প্রাণ গেল দুই নারীর

আগের সংবাদ

শাড়িতেই এবার পকেট

পরের সংবাদ

চলচ্চিত্রের অগ্নিবীণা

প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী, প্রেম, দ্রোহ, মানবতার কবি কাজী নজরুলের গল্প উপন্যাস নিয়ে হয়েছে অনেক সিনেমা। অনেক সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে নজরুলের সৃষ্টি কালজয়ী গান। তিনি নিজেও অভিনয়ও করেছেন চলচ্চিত্রে।
নজরুলের জন্ম উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের সময়ে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি হয়েছিলেন চলচ্চিত্রের মানুষ। চলচ্চিত্রে অবদান রেখেছেন সুরভাণ্ডারি, পরিচালক, সংগীতকার, সুরকার, গীতিকার, অভিনেতা, গায়ক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার, পৃষ্ঠপোষক ও সংগঠক হিসেবে। কলকাতার চিত্রজগতে নজরুল সরাসরি জড়িত ছিলেন প্রায় ২০টি চলচ্চিত্রের সঙ্গে।
ত্রিশের দশকে নজরুল চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাডান থিয়েটার্স’র ‘সুর ভাণ্ডারি’ পদে নিযুক্ত হন। ১৯৩১ সালে প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’তে সুর ভাণ্ডারির কাজ করেন নজরুল। ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানির আরো যেসব চলচ্চিত্রের সঙ্গে নজরুল সম্পৃক্ত ছিলেন। সেগুলো হলো : ‘জ্যোৎস্নার রাত’, ‘প্রহ্লাদ’, ‘ঋষির প্রেম’, ‘বিষ্ণুমায়া’, ‘চিরকুমারী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘কলঙ্ক ভঞ্জন’, ‘রাধাকৃষ্ণ’ এবং ‘জয়দেব’।
১৯৩১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জলসা’ ছবিতে নজরুল তার নারী কবিতার আবৃত্তি ও একটি গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৩৩ সালে ‘কপালকুণ্ডলা’ ছবিতে গীতিকার হিসেবে যুক্ত হন এই সাম্যের কবি।
১৯৩৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে যৌথভাবে ‘ধ্রæব’ পরিচালনা করেন নজরুল। এতে তিনি নারদের চরিত্রে অভিনয় করেন। ওই ছবির গীতিকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন তিনি। সিনেমার ১৮টি গানের মধ্যে ১৭টি গান ছিল নজরুলের লেখা। ৩টি গানে কণ্ঠও দিয়েছিলেন তিনি।
১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাতালপুরী’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন নজরুল। পাতালপুরী’ সিনেমাটি কয়লাখনির শ্রমিক ও সেই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রাম নিয়ে নির্মিত হয়েছিল। এ ছবির জন্য গান রচনা করেন নজরুল।
১৯৩৭ সালে মুক্তি পায় রহস্য কাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘গ্রহেরফের’। এ ছবির সংগীত পরিচালক ও সুরকার ছিলেন নজরুল। একই বছর ‘বিদ্যাপতি’ সিনেমার গল্প সংলাপ ও চিত্রনাট্য যৌথভাবে নজরুল ও দেবকী বসু রচনা করেন। তবে মূল গল্প ভাবনা নজরুলের ছিল বলে জানা যায়। ‘বিদ্যাপতি’ লাহোর-মুম্বাই-কলকাতা হয়ে সিলেট-ঢাকা-বরিশাল এবং রেঙ্গুনের সিনেমা হল পর্যন্ত প্রদর্শিত হয়েছিল। এই সিনেমার সুরকারও ছিলেন তিনি।
১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন এতে রবীন্দ্রনাথের গানে সুরারোপ করেন নজরুল।
বেদে জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য নজরুল কিছুদিন বেদে দলের সঙ্গে ছিলেন। তারপর ‘সাপুড়ে’ সিনেমার কাহিনী রচনা করেন। ১৯৩৯ সালে মুক্তি পেয়ে ‘সাপুড়ে’ ছবিটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
‘চৌরঙ্গী’ (১৯৪২) ছবির গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। একই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দিলরুবা’ সিনেমার গীতিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল। চৌরঙ্গী হিন্দিতে নির্মিত হলে সে ছবির জন্য ৭টি হিন্দি গান লেখেন তিনি।
‘রজত জয়ন্তী’ (১৯৩৯), ‘নন্দিনী’ (১৯৪১), ‘অভিনয়’ (১৯৪১), ‘দিকশূল’ (১৯৪১) ইত্যাদি কয়েকটি চলচ্চিত্রের গান লিখেছিলেন নজরুল। তার গানগুলো সে সময় লোকের মুখে মুখে ফিরত।
১৯৪১-৪২ সালে ‘মদিনা’ নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। এ সিনেমার জন্য তিনি ১৫টি গান লেখেন। কিন্তু ১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়ায় সিনেমাটি আর মুক্তি পায়নি।
১৯৪১ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় নজরুল ‘বেঙ্গল টাইগার্স পিকচার্স’ নামে একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। তার সঙ্গে ছিলেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, হুমায়ূন কবীর, এস ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আজিজুল ইসলাম, সারওয়ার হোসেন, আজিজুল হক প্রমুখ। ১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। মস্তিষ্কের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ ৩৪ বছর বাকরুদ্ধ ছিলেন তিনি। সেই প্রতিষ্ঠানটির কাজ বেশিদূর এগোয়নি আর।
অসুস্থ হয়ে পড়ায় নতুন আর কোনো সিনেমায় তিনি সশরীরে যুক্ত না হতে পারলেও তার সৃষ্ট কর্ম ব্যবহৃত হতে থাকে নানা সময়ের চলচ্চিত্রে। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ থেকে শুরু করে হুমায়ূন আহমেদের ‘চন্দ্রকথা’সহ বাংলাদেশি অনেক চলচ্চিত্রে নজরুলের গান ব্যবহৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ এক ব্যতিক্রমী সংযোজন। পাকিস্তানি আমলে বিরাজমান রাজনৈতিক ঘটনাবলি জহির রায়হান পারিবারিক ঘটনার রূপকে তুলে ধরেন এই চিত্রে। এটি গণআন্দোলন ভিত্তিক চলচ্চিত্র। এ ছবিতে নজরুলের লেখা একটি বিপ্লবী গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ব্যবহৃত হয় রাজবন্দিদের ঠোঁটে সমবেত কণ্ঠে। গানটির ব্যবহার ও চিত্রায়ন ছবির সিচুয়েশন অনুযায়ী দারুণভাবে ফুটে উঠেছিল।
‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ সিনেমায় ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফেরে একা’ গান থেকে শুরু করে আধুনিক দারুচিনি দ্বীপ সিনেমার দূর দ্বীপবাসিনী গান দর্শক হৃদয়ে আলোড়ন তুলেছে। সিনেমায় প্রচুর গান ব্যবহার করা হলেও সে তুলনায় নজরুল সাহিত্য নিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কাজ হয়নি তেমন। ‘মেহের নেগার’ ‘রাক্ষুসী’ ‘মৃত্যুক্ষুধা’ এবং গল্প ‘ব্যথার দান’ ও ‘পদ্মগোখরা’ অবলম্বনেও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তবে নজরুলের গল্প নিয়ে ছোট পর্দায় প্রচুর নাটক টেলিছবি তৈরি হয়েছে।
নজরুলের ‘মেহের নেগার’ গল্প অবলম্বনে ২০০৬ সালে একটি সিনেমা নির্মিত হয়। সিনেমাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেন মুশফিকুর রহমান গুলজার ও মৌসুমী। প্রধান দুই চরিত্র কাশ্মীরের তরুণী মেহের নেগারের চরিত্রে মৌসুমী এবং আফগান যুবক ইউসুফের ভূমিকায় ফেরদৌস অভিনয় করেন। সিনেমাটি প্রযোজনা করে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। নজরুলের গল্প ‘রাক্ষুসী’ অবলম্বনে একই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের আরেকটি সিনেমা ‘রাক্ষুসী’। মতিন রহমানের পরিচালনায় তিনটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন রোজিনা, পূর্ণিমা ও ফেরদৌস।
এর আগে নজরুলের গল্প ‘জ্বিনের বাদশাহ’ অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন বাপ্পারাজ। নজরুলের উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ এবং গল্প ‘ব্যথার দান’ ও ‘পদ্মগোখরা’ অবলম্বনেও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার দুটি কবিতা ‘লিচুচোর’ এবং ‘খুকি ও কাঠবিড়ালি’ অবলম্বনে শিশুদের জন্য দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে।
২০০৫ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা মতিন রহমান নির্মাণ করেন ‘রাক্ষুসী’ সিনেমা। নির্মাতা বলেন, ‘আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে সেই অর্থে কোনো কাজই হচ্ছে না। কোন গল্পটি চলচ্চিত্রের জন্য উপযোগী, সেটা নিয়ে কারো কোনো ভাবনা নেই। তার সাহিত্য নিয়ে অনেক কাজ করার সুযোগ আছে। নজরুলসাহিত্য নিয়ে আরো সিনেমা হওয়া উচিত। জাতীয় কবির কাজের মূল্য যদি তারা বুঝত, হয়তো তাকে নিয়েও কাজ করত। বাঙালি নারীর ভালোবাসা নিয়ে প্রচুর সিনেমা হয়েছে। শাবানা, ববিতা অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ‘রাক্ষুসী’র গল্পে দেখলাম একটু ভিন্ন রকম ভাবনা। অন্য রকম ক্লাইমেক্স ছিল, সাধারণ বাংলাদেশের অন্য কোনো সিনেমায় এ রকম দেখিনি। তাই গল্পটা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল।’
:: মেলা প্রতিবেদক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়