জাসদের পাল্টা প্রশ্ন : ১৫ আগস্ট সেলিম মার্কিন দূতাবাসে কী করছিলেন

আগের সংবাদ

কারা এই আইএস-কে? আফগানিস্তানে সক্রিয় নৃশংসতম জঙ্গিগোষ্ঠীর কাবুলে হামলার দায় স্বীকার

পরের সংবাদ

‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’

প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

নজরুল বিশ শতকের প্রথমার্ধের কবি ও শিল্পী। প্রশ্ন উঠতে পারে বিশ শতকের প্রথমার্ধের এক সৃজনশীল প্রতিভার সৃষ্টিকর্ম একুশ শতকে কতটা প্রাসঙ্গিক? বস্তুত একুশ শতকে এসে বিশ শতকের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি একটা গ্রহণ বর্জন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিশ শতকের চিন্তা-চেতনা মন-মানসিকতার পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তথ্যপ্রযুক্তির অপরিসীম বিকাশ যা বিশ শতকের পরাশক্তিদ্বয়ের ¯œায়ুযুদ্ধের অবসানের পর থেকে সম্প্রসারিত হতে শুরু করেছে। যার রূপান্তর এক অপরিসীম সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করে চলেছে। বাতিল বা বর্জিত হয়ে চলেছে সভ্যতার অনেক উপাদান, সংযোজিত হচ্ছে নব নব প্রক্রিয়া। এমন এক ক্রান্তিলগ্নে অতীতের সব কিছুই আমরা হারিয়ে ফেলব কিনা সে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর ছোট ছোট দেশ ও জাতিগুলো তাদের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলতে বসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন জাতিসত্তা ও অসংখ্য ভাষা-সংস্কৃতি অস্তিত্বের হুমকির মুখে পড়েছে; মুক্তবাজার অর্থনীতি আজ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে দেউলিয়া ও পরনির্ভর করে তুলেছে, অবাধ তথ্য প্রবাহ একদিকে যেমন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে অপরদিকে তেমনি বহু প্রাচীন সভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এক নতুন পৃথিবীর উন্মেষ ঘটছে।
স্বদেশে নজরুলকে সবচেয়ে বিচলিত করেছিল ভারত তথা বাংলার সাম্প্রদায়িক সংঘাত। একটা সত্য তিনি চরমভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, সম্প্রদায়িকতা হচ্ছে ভারত তথা বাংলার সবচেয়ে বড় সমস্যা, তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে তাকে পাশ কাটিয়ে গেলে স্বরাজ বা স্বাধীনতা আন্দোলন কখনো প্রকৃত স্বাধীনতা বা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তথা জাতীয় মুক্তি আনয়ন করতে সক্ষম হবে না। ওই বোধ থেকে তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার জীবন ও সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে জেহাদ ঘোষণা করেন। সেদিন নজরুলের সতর্কবাণী উপেক্ষিত হয়েছিল। বিশ শতকের প্রথমার্ধে দুই দুইটি মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অবিভক্ত ভারত তথা বাংলায় সাম্রাজ্যবাদী বিভাজন এবং দেশীয় সামন্ততান্ত্রিক শাসন ও শোষণের ফলে মানুষ বিভক্ত হয়েছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, শ্রেণি এবং লিঙ্গবৈষম্যে। দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতার পর আরো যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্র তথা সরকারের আমলাতন্ত্রিক দুঃশাসনের প্রক্রিয়া। ফলে উপমহাদেশের মানুষ পাশ্চাত্যমুখী ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে ক্রমাগত। নজরুলে ভাষায়, ‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে সমুখপানে আমরা তখন বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকা ও হাদিস ঘেটে।’ নজরুলের বিশ্বাসের গভীরে ছিল ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’ আর সে কারণেই তিনি মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী দেয়ালগুলো ভাঙতে চেয়েছিলেন। যে দেয়ালগুলো হচ্ছে জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়, বর্ণ, শ্রেণি ও লিঙ্গ। মনুষ্য জাতির অবিভাজ্যতায় বিশ্বাসী নজরুল বিভেদের প্রাচীর ভাঙতে চেয়ে শাসক, শোষক ও সমাজপতিদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি নিজের বিবেকের সঙ্গে কখানো সন্ধি করেননি। তিনি তাঁর সুস্থ জীবনের শেষপর্যায় একটি ভাষণে বলেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, এর অভিযান সেনাদলের তূর্যবাদকের একজন, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। বিশ শতকের অভিযান, সেনাদলের আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল মানুষের মধ্যকার জাতি-ধর্ম, জাত-পাত, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো ও নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করা।
যুগ যুগ সঞ্চিত মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী ঐ উপাদানগুলো বিশ শতকে দূর করার চেষ্টা হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে, কিন্তু মানুষ সংস্কারের দাস, তাই তা থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন, তবুও বিশ শতকের অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে সে অসাধ্য সাধনে নজরুল অভিযান চালিয়েছিলেন। নজরুল হয়তো তাঁর অভিযানে সফল হননি কারণ পরাধীন দেশে যুগপৎ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয় কিন্তু তবুও নজরুলের সংগ্রামতো মিথ্যা ছিল না। বিশ শতক পেরিয়ে আমরা একুশ শতকে প্রবেশ করেছি, সাম্রাজ্যবাদের বদলে এসেছে বিশ্বায়ন, ঔপনিবেশিক শোষণের স্থান নিয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতি, জাতীয় সংস্কৃতিকে গ্রাস করে ফেলেছে আকাশ সংস্কৃতির বিকিরণে অপসংস্কৃতির বাতাবরণ। আজ তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে জটিল সমস্যা ঐ প্রভুত্ব থেকে স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রাখা আর সে জন্য প্রয়োজন একই সঙ্গে স্বদেশি ও আন্তর্জাতিক হওয়া। নিজের জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির প্রতি অবিচল থেকে আন্তর্জাতিক হওয়া। আজকের পৃথিবীতে কোনো দেশ জাতি নির্জন দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না, আজ তাকে নিজের মাটিতে আপন ঐতিহ্যের শেকড় গভীর থেকে গভীরে প্রেথিত করে অসীম আকাশের আলো হাওয়ার দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। নজরুলের মতো বলতে হবে, ‘বল বীর-/বল উন্নত মম শির!/শির নেহারি আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!’ এই আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় যদি মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয় তা হলেই মানুষের স্বাধীন চিত্ততার জাগরণ ঘটতে পারে। পরাধীন যুগের স্বাধীন কবি নজরুল বারবার স্বদেশের মানুষের মধ্যে স্বাধীন চিত্ততার জাগরণের আহ্বান জানিয়েছেন, তিনি প্রথমে মনের শিকল ভেঙে, পরে হাতের শিকল ভাঙার কথা বলেছিলেন, নজরুলের ভাষায়, ‘মনের শিকল ভেঙেছি এবার হাতের শিকলে পড়েছে টান’- এ কথা নজরুলের কিন্তু আমরা হাতের শিকল ভাঙলেও মনের শিকল ভাঙতে পারিনি। বিশ শতকের পরাধীন দেশে আমরা মনের শিকল যতটা ভাঙতে পেরেছিলাম একুশ শতকে এসে আমরা সে বাঁধনকে আবার শক্ত করে তুলছি, এই হলো আমাদের ট্র্যাজেডি। একুশ শতকে বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং আকাশ সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে আমরা ক্রমশ শামুকের মতো গুটিয়ে যাচ্ছি, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা যাচ্ছি। কিন্তু আরো বেশি কূপমণ্ডূক হয়ে পড়ছি, ধর্মের মর্ম অপেক্ষা আচার সর্বস্বতায় অধিক থেকে অধিকতর আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি। নজরুলের কথায় বলতে হয়, ‘আজাদ আত্মা, আজাদ অত্মা, সাড়া দাও, দাও সাড়া, এই গোলামীর জিঞ্জির ধরি ভীম বেগে দাও নাড়া।’ কিন্তু মানসিক গোলামী আমাদের মজ্জাগত।
একুশ শতকে পাশ্চাত্য শক্তিগুলো বিশ্বায়ন,
মুক্তবাজার অর্থনীতি ও আকাশ সংস্কৃতির বাতাবরণে দুনিয়াকে পদানত এবং তৃতীয় বিশ্বের সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য জঙ্গি ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রতিপক্ষরূপে দাঁড় করিয়েছে। সে মৌলবাদের উত্থানের পেছনে রয়েছে পরাশক্তির কূটকৌশল। প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে নজরুল যে সাম্প্রদায়িকতাকে মানবতার প্রধান শত্রæরূপে চিহ্নিত করেছিলেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ঠাণ্ডা লড়াইকালে সমাজতান্ত্রিক প্রভাব ঠেকানোর জন্য পুঁজিবাদী পরাশক্তি তৃতীয় বিশ্বের নব্য স্বাধীন দেশগুলোতে সেই সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই ইন্ধন জুগিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান রোধে। আফগানিস্তানকে সোভিয়েত দখলমুক্ত করার জন্য পাশ্চাত্য পরাশক্তি সৃষ্টি করেছিলেন তালেবান শক্তিকে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর সেই মৌলবাদী শক্তিই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর পাশ্চাত্য পরাশক্তি সৃষ্ট ধর্মীয় জঙ্গি মৌলবাদী শক্তিকেই তারা প্রতিপক্ষরূপে দাঁড় করায় তাদের সমরশিল্পকে চালু এবং তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোকে পদানত করার জন্য। নজরুল বিশ শতকে সাম্প্রদায়িকতাকে মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রæরূপে শনাক্ত করেছিলেন, একুশ শতকে সে সাম্প্রদায়িক শক্তি উগ্র ও জঙ্গিরূপ ধারণ করে জঙ্গি মৌলবাদরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু জঙ্গি মৌলবাদের অভ্যুত্থান কেবল আফগানিস্তান বা মুসলমানদের মধ্যেই ঘটেনি। আফগানিস্তানের অনেক আগে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে, পাশ্চাত্য শক্তি প্যালেস্টাইন বিভক্তির মাধ্যমে জঙ্গি গোঁড়া উহুদি মৌলবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলে সৃষ্টি করেছিল, তুলনায় নিজ দেশে পরবাসী ফিলিস্তিনিরা ছিল অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক এবং আলজিরিয়ায় পাশ্চাত্য মদদে জঙ্গি মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে। ইরানে পাশ্চাত্য সমর্থনপুষ্ট শাহের স্বেচ্ছাচারিতায় শিয়া মৌলবাদ শক্তিশালী হয়ে ক্ষমতা দখল করেছে। ধর্মনিরপেক্ষ ইরাককে ইরানের বিরুদ্ধে লেলিয়ে শিয়া ও কুর্দিদের উসকানি দিয়ে সাদ্দামকে অপসারণ আর ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। কার্যত ইরাককে শিয়া-সুন্নি-কুর্দি তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। পরিণতিতে ইরানের শিয়া মৌলবাদ সম্প্রসারিত হয়েছে ইরাকে। ইউরোপে যুগোস্লাভিয়াতে খ্রিস্টান মৌলবাদ মুসলমান প্রধান বসনিয়া ও কসভোতে যে ‘জেনোসাইড’ এবং ‘এথনিক ক্লেনসিঙ’ চালিয়েছে তা সম্ভবপর হয়েছে মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক যুগোস্লাভ রাষ্ট্রকে ভাঙার পাশ্চাত্য কূটকৌশলের ফলেই। উপমহাদেশের তিনটি দেশে মৌলবাদী শক্তির উত্থানের জন্য যেসব সাম্প্রদায়িক শক্তি দায়ী তাদের উন্মেষের পেছনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী ঠাণ্ডাযুদ্ধের আমলে পাশ্চাত্য শক্তির বিভিন্ন সামরিক চুক্তির প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। ভারতে হিন্দু মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটানো হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ রুদ্ধ এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনকে পর্যুদস্ত করার জন্য। জোটনিরপেক্ষ নেতা ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ণ, মিসরের জামাল আবদুল নাসের এবং ঘানার ড. নক্রুমা বিরোধিতার পাশ্চাত্য শক্তিগুলো মৌলবাদী এবং সামরিক শক্তিতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, পাকিস্তানে সামরিক স্বৈরাচারকে শক্তিশালী ও স্থায়ী করেছে। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে।
ঐ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেই একুশ শতকে জঙ্গি মৌলবাদকে মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রæরূপে অভিহিত করা হচ্ছে। উপমহাদেশে এই ধর্মীয় জঙ্গি মৌলবাদের বীজ রোপিত হয়েছিল বিশ শতকের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট সশস্ত্র বিপ্লববাদ এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মাধ্যমে। বিশ শতকের বিশের দশকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল; দেশে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কারণেই। অবিভক্ত বাংলায় ১৯২৬ সালে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বা ‘হিন্দু-মুসলিম চুক্তি’ বাতিল হয়ে গিয়েছিল; সাম্প্রদায়িক সংঘাতে রক্তাক্ত হয়েছিল একটানা ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ যার অনিবার্য পরিণতি। নজরুল ১৯২৬ সালে ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ বা ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’ গানে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।’ কিন্তু সেদিন ভারত তথা বাংলার কাণ্ডারিরা হুঁশিয়ার হননি। বিশ শতকে সাম্প্রদায়িকতা একুশ শতকে জঙ্গি ধর্মীয় মৌলবাদের বিষবৃক্ষে পরিণত। একুশ শতকে এই বিষবৃক্ষের উৎপাটনে নজরুলের মানবতার বাণী আমাদের শক্তির উৎস এবং ভবিষ্যতের পথ নির্দেশক আর এ সংগ্রামে নজরুলের আদর্শ আমাদের পাথেয়। একুশ শতকে এখানেই নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা।
একুশ শতকের পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক এবং পরিবর্তনশীল বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে আজ নজরুলের মতো দুঃসাহসী দেশপ্রেমিক মানব দরদী সাহিত্যিকের প্রয়োজন বড় বেশি। বাংলাদেশের মানুষ দেশ বিভাগের পূর্ব সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ছয় দশক যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক সংঘাতে যে দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছে সে যন্ত্রণা হৃদয়ে ধারণ করে লেখকেরা এ দেশের কোটি কোটি মানুষের দুঃখ-বেদনা ত্যাগ তিতিক্ষাকে তাদের লেখনীর মাধ্যমে কবে তুলে ধরতে পারবেন? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের মানুষের শৌর্য-বীর্য এবং অপরিমেয় রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সে কাহিনী এখনো আমাদের সাহিত্যে পূর্ণাঙ্গভাবে ফুটে ওঠেনি। বাংলার মানুষের বীরোচিত সংগ্রাম আর বিজয়গাথা আজো রচিত হয়নি বরং বারবার বিকৃত হয়েছে। আজ আমাদের প্রয়োজন নজরুলের মতো অকুতোভয় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি সাহিত্যিকের যিনি বাংলার সাহসী সন্তানদের সংগ্রামকে সাহিত্যে তুলে আনবেন, এ দেশের দুঃখী মানুষকে সাহস ও প্রেরণা জোগাবেন মানবতার জয়ের অনুপ্রেরণা দিয়ে। যাতে মানুষ আশাহত না হয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে জয়যাত্রার পথে এগিয়ে যেতে পারে। নজরুল যেমন তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে বিশ শতকের প্রথম চার দশকের পরাধীন দেশের মানুষের মর্মজ্বালাকে ছন্দে গানে তুলে ধরে ভীতি তুচ্ছ করে উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মানুষকে উদ্দীপিত করেছিলেন, আজকের বাংলাদেশে তেমন কবি ও শিল্পীর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়