জাসদের পাল্টা প্রশ্ন : ১৫ আগস্ট সেলিম মার্কিন দূতাবাসে কী করছিলেন

আগের সংবাদ

কারা এই আইএস-কে? আফগানিস্তানে সক্রিয় নৃশংসতম জঙ্গিগোষ্ঠীর কাবুলে হামলার দায় স্বীকার

পরের সংবাদ

বাঙালি জাতিসত্তার রূপকার

প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাজী নজরুল ইসলাম এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষেরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতে আগমন করে প্রথমে বিহার ও পরে পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় বসতি স্থাপন করেন, মোগল সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালে। মোগলামলে আসানসোলের চুরুলিয়ায় একটি বিচারালয় ছিল। নজরুলের পূর্বপুরুষেরা ঐ বিচারালয়ের বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। তাছাড়া ইসলাম প্রচারক বিশিষ্ট অলিয়ে কামেল হাজি পাহলোয়ানের মাজারের খেদমতের ভারও ঐ পরিবারের ওপর ন্যস্ত ছিল। বর্তমানের চুরুলিয়া এলাকা ঐ মহান তাপসের আধ্যাত্মিক কামেলিয়াতের বরকতে ইসলামের শান্ত-শীতল ছায়াতলে সমাগত ছিল। মোগল আমলে বিচারালয়ের বিচারকের দায়িত্ব পালন করায় কাজী উপাধিত ঐ পরিবার প্রচুর ‘আয়েমা সম্পত্তি’র মালিক হন এবং এলাকায় সম্ভ্রান্তজন হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
আরব দেশ থেকে আগমন করায় এবং মোগলামলে ভারতের রাজভাষা ফার্সি হওয়ায় কাজী পরিবারে বাংলার সাথে সাথে ফার্সিভাষার চর্চা ও অনুশীলন যে অব্যাহত ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এরই ধারাবাহিকতায় নজরুল তার পরিবারে ও মক্তবে আরবি-ফার্সি ভাষার দুই পণ্ডিত ব্যক্তিকে তার জন্মকালেই শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন। এদের একজন পিতৃব্য কাজী বজলে করিম এবং অন্যজন কাজী ফজলে আহমদ। কাজীবাড়ির সামনেই মক্তব। মক্তবেও আরবি, বাংলার সাথে ফার্সি শিক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক। ফলে পরিবারে ও মক্তবে অধ্যয়নকালেই নজরুল বাল্যবয়সেই বাংলার সাথে আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। ফলে এই ভাষাগুলো ছিল তার মজ্জাগত। বংশগত ও ঐতিহ্যগতভাবে নজরুল তা পেয়েছিলেন। প্রচণ্ড মেধাশক্তি এবং প্রখর স্মরণশক্তির অধিকারী নজরুল ইসলাম দশ বছর বয়সকালে কুরআন খতম, ফার্সি ও হাদিসে জ্ঞান লাভ করেছিলেন।
পিতার অকাল মৃত্যুতে অতি অল্পবয়সেই নজরুলকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল। মোগল সম্রাটদের দানকৃত লাখেরাজ সম্পত্তি ইংরেজ সরকারের আমলে অনেকটা খাস হয়ে যাওয়ায় এবং প্রয়োজনের তাগিদে ব্যয় বিক্রি হস্তান্তর করায় কাজী নজরুল ইসলামের পূর্বপুরুষরাও আর্থিক দৈন্যের শিকার হন। ফলে কবির পিতামহ ও পিতাকে মসজিদের ইমামতি, মাজারের খেদমতগারি এবং পীরের মাজারে আগত মুরিদ, ভক্তবৃন্দের দেয়া মানত ও অর্থ সাহায্যের ওপর ভিত্তি করে সংসার চালাতে হতো। এক কথায় মাজারের সেবা ও মসজিদের ইমামতির টাকার ওপর গোটা পরিবার নির্ভর ছিল। পিতার মৃত্যুর পর কবিকে এই দুই কাজ ছাড়াও আরো একটি বাড়তি কাজ করতে হতো। মক্তবে মাস্টারি।
উল্লেখ্য, নজরুল ইসলাম দশ বছর বয়সে মক্তবের পাঠ সাফল্যের সাথে শেষ করার পর অর্থাভাবে উচ্চতর শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারেননি। আল্লাহ প্রদত্ত অফুরান মেধাশক্তিতে বলীয়ান নজরুল সেই বয়সেই আরবি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক ও ফার্সিতে এতোখানি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে, তাকে উক্ত মক্তবে শিক্ষকতার কাজে নিয়োগ দিতে কর্তৃপক্ষ কুণ্ঠাবোধ করেননি। ঐ সময় নজরুল উর্দু, ফার্সির সাথে শুদ্ধভাবে ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারতেন। মক্তবে শিক্ষকতা ও পরিবারে পিতৃব্য বজলে করিমের কাছে ফার্সির পাঠ গ্রহণ, চর্চা অনুশীলনে মনে করার কারণ আছে যে তিনি অতি অল্প বয়সেই ফার্সি সাহিত্যের অমর কবি হাফিজ, সাদী, খৈয়াম, রুমী, জামী, রুদকী, কানী ও ফেরদোসির কাব্যের সাথে পরিচিত ছিলেন, যা করাচির সেনানিবাসে পরিপূর্ণতা লাভ করে।
আমরা কাজী নজরুল ইসলামের বাল্য ও কৈশোরের বারো-তেরো বছরের জীবনকালকে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। এক- জন্ম থেকে দশ বছর এবং দুই- দশ থেকে বারো/তেরো বছরকাল। প্রথম ভাগে কবি ছিলেন মক্তবের ছাত্র (১-৫ শ্রেণি)। নিদারুণ অর্থকষ্টে ভোগা অথচ দুরন্ত নজরুল। দারিদ্র্যের অসহনীয় কষ্ট, অনাহার, অর্ধাহার তিনি নিজে অনুভব করেছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। পরিণত বয়সে নজরুলের ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়, ‘হে দারিদ্র্য! তুমি মোরে করেছ মহান’ তার বাল্যের নিদারুণ দারিদ্র্যের কঠিন ছাপেরই প্রতিফলন। তার বহু কবিতা এর সাক্ষী।
সে অল্প বয়সে নজরুলের দুরন্তপনা এলাকাবাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। অন্যের গাছের ফল ছিঁড়ে আনা, পাখির ছানা ধরে আনা, ফুল চুরি করা, বন্ধুদের নিয়ে গান করা, দলবেঁধে সাঁতার কাটা, ছড়া কেটে টিটকারী করা ইত্যাদি ছিল নিত্যদিনের কর্ম। দ্বিতীয় ভাগে কবি যখন মক্তবে শিক্ষকতা, মাজারের খেতমতগারি ও মসজিদের ইমামতি করছিলেন তখনই ফার্সি সাহিত্যের প্রভাব ও পীর-মুরশিদদের সংস্পর্শে এসে তার কচিমনে আধ্যাত্মিকতার বীজ বপিত হয়ে অঙ্কুরোধগম শুরু হয়। সর্বোপরি আল কুরআন, হাদিস, ফার্সি সাহিত্য, হিন্দু-পৌরাণিক মিথের মর্মবাণী অনুধাবন করতে সক্ষম হওয়ায় কিশোর নজরুলের মধ্যে এক বিস্ফোরণোন্মুখ প্রতিভার আত্মপ্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। তার এই প্রতিভা লক্ষ্য করেই পিতৃব্য বজলে করিম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘আমার এই ভ্যাংগাছি বড় হলে সাপ হবে’। যা সত্যে পরিণত হয়েছিল। সংসার পরিচালনার জন্য বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে নজরুল লেটোগানের দলে যোগ দিলে তার ভেতরকার বহুমুখী প্রতিভা প্রকাশ পাওয়ার পথ খোঁজে পায়। তিন বৎসরকাল (১৯১০-১৯১৪) লেটোগানের দল পরিচালনার সময় তিনি অসংখ্য হামদ, নাত, গান, কমিকগানসহ বহু ‘পালা’ বা ‘নাটিকা’, ‘সঙ’ ও ‘প্রহসন’ রচনা করেছিলেন। গল্পে, প্রবন্ধে, কথকথায় কোন কোন কবির বারো/তেরো বছরের কাব্য প্রকাশের কথা বারবার শোনা যায়। অথচ একাধারে বহুমুখী প্রতীভার অধিকারী বালক নজরুলের তেরোখানি পালা রচনার কথা কী এক অজ্ঞাত কারণে আলোচিত হয় না। আলোচিত হয় না তার বাল্য প্রতিভার ইতিকথা। তার এসব রচনায় গানে, হাসি-ঠাট্টা, প্রহসনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ধর্মের জয়গান পরিণত বয়সে আল্লাহ-প্রেম, রাসুলের (দ.) প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আধ্যাত্মিকতা, হামদ, নাত পরবর্তীতে ইসলামী সংগীত, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতসহ ইসলামের সাম্য, সৌহার্দ, ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিতা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধসম্পন্ন কবিতা, গান রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে।
পরিণত বয়সের নজরুলের ইসলামী সংগীত, হামদ, নাত, গজল, ‘কাব্যে আমপারা’, সাত শতাধিক হিন্দুধর্ম-বিষয়ক সংগীত, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা থেকে শুরু করে ‘হিন্দু-পৌরাণিক মিথ’, আরবি, ফার্সি, উর্দু শব্দাবলির ব্যবহারে নজরুল যে পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করে বাংলাকাব্য সাহিত্যে, সংগীতে, গজলে, রাগ সৃষ্টিতে (আঠারোটি রাগ সৃষ্টি করে মিয়া তানসেনের মৃত্যুও চারশত বছুর পর কাজী নজরুল ইসলাম ভারতের অষ্টমতম রাগস্রষ্টা ব্যক্তিত্ব), অমরত্ব লাভ ও মহাকবি হওয়ার ক্ষেত্রভূমি, লীলাভূমি প্রধানত বর্ধমানের তার বাল্য-কৈশোরের চুরুলিয়া। অবশ্য আসানসোল, ময়মনসিংহের ত্রিশালও তার কৈশোরকেই ধারণ করে।
পারিবারিক সূত্রে পাওয়া আরবি, ফার্সি ভাষার সাথে পরিবারে ফার্সি-বিশেষক্ষ পিতৃব্য বজলে করিম এবং মক্তবে আরবি-ফার্সি পণ্ডিত ওস্তাদ কাজী ফজলে আহমদের কাছে শিক্ষাগ্রহণ, ফারসি সাহিত্য অধ্যয়ন, লেটো গানের প্রয়োজনে রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, পুরাণ পাঠ, লেটোগানের সুবাদে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের সাথে সম্পৃক্ততা তাকে গণমানুষের কবি, জাতীয়তাবাদী ও জাতীয় সাহিত্যের রচয়িতা হতে সাহায্য করেছে।
আবার স্বাধীন বাংলাদেশেরও সর্বপ্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা-কবি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী কবি। বাঙালির জয় হোক, বাংলার জয় হোক বাংলা বাঙালির হোক। “বাঙালি যেদিন একতাবদ্ধভাবে বলতে পারবে ‘বাঙালির বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে”। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে বলেছেন, ‘বাঙালি জাতিসত্তার সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক রূপকার’।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়