জাসদের পাল্টা প্রশ্ন : ১৫ আগস্ট সেলিম মার্কিন দূতাবাসে কী করছিলেন

আগের সংবাদ

কারা এই আইএস-কে? আফগানিস্তানে সক্রিয় নৃশংসতম জঙ্গিগোষ্ঠীর কাবুলে হামলার দায় স্বীকার

পরের সংবাদ

নজরুল সাহিত্যে কুরআন

প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চুরুলিয়া (চার আউলিয়ার) গ্রামে ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া কাজী নজরুল ইসলাম শৈশবেই কুরআন পড়তে শেখেন। শিশু নজরুলের মধুর তেলাওয়াতে মানুষ মুগ্ধ হতো। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’- বিকলাঙ্গ কুৎসিত এক মৌনী ফকিরকে নিয়ে; সেই ফকিরের বুকের ওপর দিয়ে যেদিন এক বোঝাই গরুর গাড়ি চলে যায় সেদিন মৌনতা ভঙ্গ করে মুমূর্ষু সেই ফকির ‘পড়ছে শুধু কুরআনের আয়াত’ আর ‘¯িœগ্ধ দীপ্তি সে কোন জ্যোতির আলোয়/ফেললে ছেয়ে বাইরের সব কুৎসিত আর কালোয়’। কুরআনের আয়াত পড়তে থাকায় কুৎসিত কালো ফকিরের দেহ থেকে ¯িœগ্ধ জ্যোতির বিচ্ছুরণ দেখলেন কবি। বিস্ময়কর বটে। কবি বলেন ‘ইহা সত্য ঘটনা’। সত্য হচ্ছে কুরআনের প্রতি কবির অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাস। এর পর তার ‘ব্যথার দান’ গল্পেও আছে কুরআনের আলোচনা। ‘অগ্নিগিরি’ গল্পের নায়ক সবুর মাদ্রাসার তালেবে এলেম-নামাজ পড়ে, কুরআন তেলাওয়াত করে। কুহেলিকা উপন্যাসে শহরের তরুণ বন্ধুদের জলসায় সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত হয়, নায়ক জাহাঙ্গীরের মা নিয়মিত কুরআন পড়েন। ‘ঝিলিমিলি’ নাটকে মির্জা সাহেব কুরআন তেলাওয়াত করেন। ‘জিনের বাদশা’ গল্পের নারদ আলীর বাড়িতে কুরআন খতম হয়। কুরআন পাঠের বহু অবতারণা নজরুলের রচনায়। কুরআনের আয়াত পড়তে গিয়ে, অবরোধ-বাসিনী কুলবালার ‘অশ্রæবাদল নামে আঁখিপাতে’। নজরুল গান বাঁধেন, ‘আমার মনের মসজিদে দেয়/আজান প্রেমের ‘মুয়াজ্জিন’,/প্রাণের ’পরে কুরআন লেখা/‘রুহ’ পড়ে তা রাত্রিদিন। কুরআন পড়ার জন্য তিনি সকলকেই আহ্বান জানান, ‘নীল আসমানের কোরআন/…তোরা পড় রে মুসলমান’। শুধু পড়াই নয়, তিনি বলেন, ‘পরানে রাখ কুরআন বেঁধে।’
তার পর্যবেক্ষণে, ‘ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র-পুঁজি ধনরতœ মণি-মাণিক্য সবকিছু- কুরআন মজিদের মণি-মঞ্জুষায় ভরা।’ ‘কুরআনের ঐ জাহাজ বোঝাই হীরা মুক্তা পান্নাতে’। নজরুলের প্রগাঢ় প্রতীতি ছিল যে তার প্রতিটি কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন আল্লাহ্। সেই আল্লাহ্কে দেখার এক অসম্ভব আকাক্সক্ষা কবি পোষণ করতেন- ‘রূপ আছে কিনা জানি না, কেবল মধুর পরশ পাই,/এই দুই আঁখি দিয়া সে অরূপে কেমনে দেখিতে চাই!’ তার বিশ্বাস, কুরআন শরীফ পড়লে আল্লাহ্কে দেখা সম্ভব- ‘খোদার দীদার চাস রে যদি/পড় এ কুরআন নিরবধি’। এবং সেই দিদার হবে ‘যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার তুমি হবে কাজী \’ শেষ বিচারে দোজখের আজাব থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়, ‘কুরআনের শিরিন শহদ’ (মিষ্টি মধু) পান।
কুরআনের আর্থসামাজিক অনুশাসনসমূহের প্রতি নজরুল অপার শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কুরআনের সুরা বাকারার ২১৫ ও ২১৯ নম্বর আয়াত থেকে অনুপ্রাণিত কবি তার বিখ্যাত ঈদের গানে লেখেন, ‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা নিত্য উপবাসী/সেই গরিব ইয়াতিম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ (উদ্বৃত্ত)’। বিশ্বের সম্পদে কোনো একক মানুষের একচেটিয়া অধিকার কুরআন স্বীকার করে না, ব্যক্তিবিশেষের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়াও কুরআন নিষেধ করে। বিত্তবানদের সম্পদ সম্পর্কে কুরআনের নির্দেশ কবি স্মরণ করিয়েছেন বহুবার, ‘ইহা কুরআন মজিদে আল্লার বাণী, তিনি ধনীদের যে উদ্বৃত্ত অন্ন দিয়েছেন, ক্ষুধাতুরের সেই উদ্বৃত্ত অন্নে হিসসা আছে।’ (কো: ৫১.১৯ ৭০.২৪-২৫)। কুরআনে ‘আল্লাহ্ আদেশ করেন সাম্যের’ (সুরা নহল আয়াত ৯০)। এ সকল প্রত্যাদেশের আলোকে কবি দাবি করেন, ‘ধনীর দৌলতে, জ্ঞানীর জ্ঞান ভান্ডারে সকল মানুষের সমান অধিকার রয়েছে। এই নীতি স্বীকার করেই ইসলাম জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম… সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্রবাদের উৎসমূল ইসলামেই নিহিত রয়েছে।’
কুরআন আমরা পড়ি বটে কিন্তু মানি না। মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে পিতৃহীন নিরন্ন শিশু মসজিদে যায় শিন্নির আশায়, মসজিদের ভিতর থেকে ভেসে আসে কুরআনের সেই অংশ যে, পিতৃহীনকে হাকাইয়া দেয়া নিষেধ, ভক্তরা চক্ষু বুজিয়া শোনে অথচ ক্ষুধাতুর শিশু ক্ষুধাতুর রয়ে যায় আর আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষায় কাল গোনে। ক্ষুব্ধ নজরুল আল্লাহর আদেশ মানতে মানুষ বাধ্য হওয়ার চিত্রও আঁকেন তার ‘ঈদুল ফিতর’ নাটকে- অভিশপ্ত জমিদার গরিবের হক স্বেচ্ছায় রাহে লিল্লা গরিবদের জন্য ওয়াকফ করে দিতে বাধ্য হন। সত্য বটে যে, কবিতা গল্প উপন্যাস কল্পনাপ্রসূত, কিন্তু এতে আছে কুরআনের শিক্ষা, আছে কুরআনের প্রতি কবির গভীর ভক্তি-অনুরাগের প্রকাশ। সুরা হুমাজাহ্’র মর্মকথা পাই তার কবিতায়, ‘কাঙালিনী মার বুকে ক্ষুধাতুর শিশু/তোমার দুয়ারে কাঁদে শোনো, ঐ শোনো/ভিক্ষা দাও না, রাশি রাশি হীরা মণি/তুলে রাখো আর গোনো।/এ টাকা তোমার রবে না, বন্ধু, জানি,/এ লোভ তোমারে নরকে লইবে টানি।’
কুরআনের দোহাই দিয়ে নজরুল বাংলার মুসলিম সমাজকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। সুরা কাহফের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন- বাঙালি মুসলিম ‘আসহাবে কাহফে’র মত ঘুমিয়ে আছে, জাগতে হবে। বলেছেন, ‘তরুণ বন্ধুরা কি মহাকুরআনের মহাবাণী ‘কুম’- ওঠো জাগো, এ বাণী ভুলে গিয়েছে?… তরুণদের মন-মন্দিরে তৌহিদের রুদ্রানল প্রজ্বলিত হউক!’ লেখেন, ‘মুসলিম জাগো! আল্লাহ্ তোমার একমাত্র উপাস্য, কুরআন তোমার সেই ধর্মের, সেই উপাসনার মহাবাণী’। কুরআনের মহাবাণীর দিকে ছাত্রদের তিনি আহ্বান জানান ‘তারা কি গ্রহণ করবেন না এই মহামন্ত্র- ‘ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাইয়াহইয়া ওয়া মা’মাতি লিল্লাহে রব্বিল আলামিন’ (কো: ৬. ১৬২)- আমার সব প্রার্থনা, নামাজ রোজা তপস্যা জীবন-মরণ সব কিছু বিশ্বের একমাত্র পরম প্রভু আল্লার পবিত্র নামে নিবেদিত… রাহে-লিল্লাহে আত্মনিবেদন কর।… এই আত্মনিবেদনেই তুমি তোমার আত্মীয়দের অভাবগ্রস্ত থেকে মুক্ত করতে পারবে।’ তিনি তাদের অভয় দিয়েছেন, ‘ভয় নাই তোর গলায় তাবিজ/বাঁধা যে রে তোর পাক কুরআন \’
তার সাহিত্যের পাঠক শুধু মুসলমান নয়, সকল ধর্মের সকল বাঙালি- এ কথা মাথায় রেখেও নজরুল তার রচনায় অসংখ্যবার কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়েছেন; সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব সমৃদ্ধ কুরআনের শিক্ষা তুলে ধরেছেন। সমগ্র বাঙালি জাতির প্রেক্ষাপটে অন্য কোনো সাহিত্যিক এমনটি করেননি- তার আগেও না পরেও না। বিশুদ্ধচিত্তে স্বীয় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করলেন, ‘আল্লা আমার প্রভু, রসুলের আমি উম্মত, আল-কুরআন আমার পথ প্রদর্শক’; “আমার মন্ত্র ‘ইয়া কানাবুদু ওয়া ইয়াকা নাস্তাঈন’ কেবল এক আল্লার আমি দাস… একমাত্র তারই কাছে শক্তি ভিক্ষা করি।” এ সময়ের কবির অবস্থা সম্পর্কে তার সুহৃদ বন্ধু খান মোহম্মদ মঈনুদ্দীন লিখেছেন, ১৯৪১ সালের পর খবর পেলাম… কুরআন শরীফের গূঢ়রহস্য উদ্ঘাটনে তিনি সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেছেন। এ সময় ঘরোয়া সাহিত্য সভায় কবি ভাষণ দেন, ‘যখন কুরআন শরিফে পড়ছিলাম সুরাহ নূর- তার অন্তর্নিহিত বাণী থেকে; আমার মনের আবরণ যেন খুলে গেল, আল্লাহ্র মহিমায়।’… (যারা আল্লার রহমে আল্লাহর সান্নিধ্য অনুভব করেন) ‘কুরআনে সুরা ইয়াসিন পড়ে বহু আনন্দ তারা উপভোগ করেন।… এই রসলোকের জন্য ছোটবেলা থেকেই আমার তৃষ্ণা ছিল।’ কলকাতা বেতারে তিনি কুরআন পাঠ ও কুরআন সম্পর্কে আলোচনা করেন, বলেন- সকল ধর্মের লোক কুরআনের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা শুনে উপকৃত হবেন।
পবিত্র কুরআনের শেষ পারা তিনি কবিতায় অনুবাদ ক’রে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন (১৯৩৫); বইয়ের নাম দেন- ‘কাব্য আমপারা’। অনুবাদক হিসেবে নিজের পরিচয় দেন- খাদেমুল ইসলাম (ইসলামের সেবক) হিসাবে। অনুবাদের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘আমার জীবনের সব চেয়ে বড় সাধ ছিল পবিত্র ‘কুরআন’ শরীফের বাংলা পদ্যানুবাদ করা।… বহু বৎসরের সাধনার পর খোদার অনুগ্রহে অন্তত পড়ে বুঝবার মতো আরবি-ফারসি ভাষা আয়ত্ত করতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করছি।… কুরআন পাকের একটি শব্দও এধার ওধার না করে তার ভাব অক্ষুণ্ন রেখে কবিতায় সঠিক অনুবাদ করার মতো দুরূহ কাজ আর দ্বিতীয় আছে কিনা জানিনে’। সেই দুরূহ কাজ তিনি সম্পন্ন করেন নিজের আরবির জ্ঞান এরং কুরআনের ধ্রæপদী ভাষ্য যথা তফসীরে কবীর, কাশশাফ, তফসীরে ইবনে কাছির এবং অন্য ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ বিশ্লেষণ করে। ’কাব্য-আমপারা’ প্রকাশের আগে তিনি একাধিক মজলিসে তার অনুবাদ কলকাতা আলেয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক ও অন্যান্য আলেমকে প’ড়ে শোনান ও পরিমার্জনা করেন। কবির কাব্য-আমপারায় কোনো অতিকথন নেই, নেই নিজের জুড়ে দেয়া কোন আবেগ-উচ্ছ¡াস। সব দিক বিবেচনা করলে তার ‘কাব্য-আমপারা’ এক অনন্য সৃষ্টি। সম্পূর্ণ কুরআনের কাব্যানুবাদ করার সাধ তার অপূর্ণই রয়ে গেছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়