বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স

আগের সংবাদ

তালেবান আতঙ্কে বিশৃঙ্খলা > আফগানদের দেশ ছাড়ার হিড়িক : উড়ন্ত বিমান থেকে খসে পড়ল তিনজন

পরের সংবাদ

শূন্য অর্থনীতি থেকে উন্নয়নের রোল মডেল

প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৬, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : প্রায় শূন্য অর্থনীতির দেশকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের মানুষ যাতে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে সেজন্য তিনি সংবিধান রচনা করান চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও তিনি প্রাধান্য দেন সুষম একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে।
দারিদ্র্য জয় করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের রপ্তানি আয় গত অর্থবছর শেষে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এ মুহূর্তে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ। দেশের বাজেটের আকার, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ, রাজস্ব আয়, রেমিট্যান্স আহরণ, দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো তৈরি ও উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে সফলতা। বাংলাদেশের অর্থনীতির এমন অর্জনকে বিস্ময়কর বলেছেন পৃথিবী বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশের এ উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে এসেছে বিশ্বস্বীকৃতিও।
পাকিস্তানিরা বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাসহ এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কাঠামো এমনভাবে ধ্বংস করে যাতে বাঙালি আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন ফিরলেন তখন বাংলাদেশের সম্পদ বলতে কিছুই ছিল না। এমনই অবস্থায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু। পরে ১২ জানুয়ারি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রাথমিক সংকট কাটিয়ে উঠতে ভারতের কাছ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা পাওয়া যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রও বাংলাদেশের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত রাস্তাঘাট মেরামত শুরু হয়, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা খুলে দেয়া হয়, স্বাভাবিক হতে শুরু করে পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে সংকট কাটিয়ে ওঠে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার চার দশক পর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। আর এ স্বপ্ন পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে রপ্তানি খাত। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের রপ্তানি খাত কাঁচা চামড়া ও পাট নির্ভর হলেও সময়ের আবর্তনে সে তালিকায় যুক্ত হয়েছে তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণসহ হাল্কা ও মাঝারি শিল্পের নানা পণ্য। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের রপ্তানি আয় গত অর্থবছর শেষে প্রায় ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার দৌড়ে নতুন বাজার বাড়ানোর পাশাপাশি আগামী দিনের রপ্তানি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, আজকের অর্থনীতির যতটুকু উন্নয়ন, তার ভিত রচনা করে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিশেষ করে কৃষিতে ব্যাপক রূপান্তর ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পরে যখন কোষাগার ছিল শূন্য, কৃষিতে ছিা নাজুক অবস্থা ; সে সময়ই কৃষকের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা থেকে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন কৃষিপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেন।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি : যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুরু হয়েছিল ঋণাত্মক দিয়ে। ওই সময় দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাইনাস ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ দশমিক ১৭ ভাগ। আর ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭৫ ভাগ। সম্প্রতিক সময়ে করোনা ভাইরাসের প্রকোপে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে দাঁড়িয়েছে  ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশে। করোনা ভাইরাস মহামারির কঠিন সময়ে গত অর্থবছর ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে আশাব্যঞ্জক মনে করছেন বিবিএসের মহাপরিচালক (ডিজি) তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত অর্থবছরের পুরোটা সময় দেশ কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে ছিল। এর মধ্যেও ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খুবই ভালো অর্জন বলে আমি মনে করি।
মাথাপিছু আয় : ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় দাড়িয়েছে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার। আর সে হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ১৮ গুণ বেড়েছে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। সেই পর্যায় থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা বাংলাদেশ অর্জন করেছে। ২০২৪ সালের মধ্যে এই উত্তরণপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
রিজার্ভ : ১৯৭৩ সালে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৭৩ মিলিয়ন ডলার বা ১৭ কোটি ৩ লাখ ডলার। গত বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে এই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় সাড়ে ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
বাজেট : ১৯৭১ সালে মাত্র ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। এর পরের বছর প্রথম ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদ। পরের দুটি বাজেটও দিয়েছিলেন তিনি। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। সে হিসাবে দেশের ৫০তম বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৭৬৮ গুণের বেশি।
রেমিট্যান্স : স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় ছিল ১৬ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন) ডলার, টাকার অঙ্কে যা ২ লাখ ১০ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এই রেমিট্যান্স ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। এর আগে এক অর্থবছরে এত রেমিট্যান্স কখনই আসেনি।
বিনিয়োগ : স্বাধীনতার পর শুরুর দিকে বিদেশি বিনিয়োগ কেবলমাত্র সরকারি খাতের জন্যই প্রযোজ্য ছিল। স্বাধীনতার পর পাট ও বস্ত্রকলের মতো বৃহৎ শিল্পগুলো ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়। ক্রমান্বয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস তথা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদিও এসএমই’র মাধ্যমে উৎপাদিত হতে থাকে। এরপর যাত্রা শুরু করে পোশাক শিল্পের। দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বাড়তে থাকে বিদেশি বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরের বিভিন্ন খাতে সবমিলিয়ে ৩৫০ কোটি ১০ লাখ ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে।
রাজস্ব আয় : ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে জন্ম নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। স্বাধীনতার পর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৪২ কোটি টাকা। ৫০ বছর পর সেই রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১৩১৩ গুণ। প্রতিষ্ঠানটির গঠনের বছরে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয় ছিল মাত্র ১৬৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা, সেখানে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এনবিআর আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাত থেকে রাজস্ব আদায় করেছে ২ লাখ ১৮ হাজার ৪০৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়