অশ্রুডানায় সূর্য খোঁজার পালা

আগের সংবাদ

শূন্য অর্থনীতি থেকে উন্নয়নের রোল মডেল

পরের সংবাদ

বিশ্ব পঞ্জিকায় ’৭১ থেকে ’৭৫ মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : খলনায়ক কিসিঞ্জার

প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ ডেস্ক : পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট আগে-পরে অভ্যুত্থানের নায়কদের সঙ্গে গভীর মার্কিন সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আজ সন্দেহাতীভাবে প্রমাণিত। ওই দিনগুলোতে বাংলাদেশে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি এবং এ দেশে মার্কিন দূতাবাসের দ্বিমুখী তৎপরতার দালিলিক নথিপত্র পরবর্তীকালে উন্মোচিত হওয়ার সুবাদে, এ নিয়ে নতুন করে একই প্রশ্ন উত্থাপনের কারণ নেই কোনো। ১৯৭২-৭৩ থেকেই বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলার অভাব, অসন্তোষ এবং সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব-গুঞ্জন ছিল ঢাকা, ইসলামাবাদ ও দিল্লির মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তাদের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়।
মার্কিন তথ্যসূত্রে প্রকাশ, ১৯৭২ সালেই মুজিব সরকারের অগোচরে (অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়ে কথা বলতে!) মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর শীর্ষ ঘাতক মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান। যদিও এর বছরখানেক পর ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই (একই উদ্দেশ্যে!) মার্কিন দূতাবাসে যান ফারুকের ভায়রা অপর শীর্ষ খুনি মেজর আবদুর রশিদ। তার ভাষ্যে, (তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার) জিয়া তাকে সেখানে পাঠান। এরপর ১৯৭৪ সালের ১৩ মে সৈয়দ ফারুক রহমান মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে সরাসরি জানান, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ স্তরের নির্দেশে শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের উৎখাতে’ মার্কিন সরকারের সহায়তা চাইতে এসেছেন তিনি। এ ঘটনার ১৫ মাসের মাথায় ১৫ আগস্ট রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের ঘটনাটি ঘটে।
ইতিহাস সাক্ষী, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রথম ও অন্যতম প্রধান ‘বেনিফিশিয়ারি’ খন্দকার মোশতাক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্রের সঙ্গে ‘অবৈধ’ যোগাযোগের চেষ্টা চালান এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে গিয়ে দৃশ্যত প্রথমবারের মতো ব্যর্থ হন। সম্পর্কে তিনি বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি আবদুর রশিদের ‘ঘনিষ্ঠ’ আত্মীয়।
এদিকে রশিদ আবার আত্মীয়তাসূত্রে আরেক খুনি সৈয়দ ফারুকের ভায়রাভাই। ফারুক-রশিদ-মোশতাক-জিয়া চক্রের এই মার্কিন যোগাযোগ ও ঘন ঘন দূতাবাস সফরের খতিয়ান থেকে পরিষ্কার, মুক্তিযুদ্ধের অবব্যহিত পরবর্তীকাল মুহূর্ত থেকে ১৫ আগস্ট হত্যাযজ্ঞের পূর্বকাল এবং পরবর্তীকালেও মার্কিন পরাশক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এই ঘাতক গংয়ের।
প্রথম কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাই চায়নি যুক্তরাষ্ট্র। শেখ মুজিবের পাকিস্তান বিরোধিতা ও গণমুখী বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিষয়ে চিরকাল আপত্তি করেছে দেশটি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে পরাশক্তির পক্ষে নেপথ্য ক্রীড়নক হিসেবে সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হেনরি কিসিঞ্জারের জবানিতে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল কে ঝায়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে উদ্যোগী হয় মার্কিন সরকার।’ এতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন ষাটের দশকে কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজী জহিরুল কাইউম। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি বাহিনীর ‘অধিনায়ক’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এই মোশতাক। মুজিব আমলে রুশ-ভারতের অক্ষশক্তিতে থাকা বাংলাদেশকে এভাবে মার্কিন ও ইসলামী অক্ষশক্তির আওতায় নিয়ে আসেন খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমান।
আজ থেকে প্রায় অর্ধশত বছর আগের ওই সময়টাই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর দুই পরাশক্তির মধ্যেকার ¯œায়ুযুদ্ধের যুগ। একদিকে আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র) অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া)। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে আনার লক্ষ্যে লড়াই চলছিল তাদের মধ্যে। বিশেষভাবে দক্ষিণ এশিয়া ছিল দুই পরাশক্তির টানাপড়েনের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে ভারত ঝুঁকে ছিল সোভিয়েত শিবিরের দিকে, পাকিস্তান ছিল মার্কিন ছত্রছায়ায়।
এ অবস্থায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন চাইছিলেন (ইয়াহিয়ার দৈত্যে) চীনের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক গড়ে তুলতে। পরিকল্পনা অনুসারে, নিক্সনের দূত হয়ে পাকিস্তান সফররত কিসিঞ্জার ‘অতি গোপনে’ ইসলামাবাদ থেকে অবকাশ যাপনের কথা বলে চীনসীমান্ত সংলগ্ন মারি শহরে পৌঁছেন। এখানে তিনি ‘অসুস্থ’ হয়ে এবং নিজের দূতাবাস কর্মীদেরও অন্ধকারে রেখে গোপনে চীন সফর করলেন। যুক্তরাষ্ট্রের এ ‘উপকারটুকু’ করে দেয়ার জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতার জায়গা থেকে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ ‘দেখেও না দেখার ভান’ করে থাকেন নিক্সন ও কিসিঞ্জার। সেদিক থেকে বাংলাদেশের জন্ম ও ইয়াহিয়ার পরাজয় বস্তুত ছিল নিক্সন ও কিসিঞ্জারের জন্যও একটি ‘অপমানজনক’ পরাজয়। যে ‘অপমান’ জীবনে কখনো ভুলতে পারেননি বিগত শতকের কূটনৈতিক বিশ্বের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ইহুদি ষড়যন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।
’৬০-’৭০-এর দশকগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির নিখুঁত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে দুনিয়াজুড়ে দাপিয়ে বেড়াত কুখ্যাত সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, বা সিআইএ। যেখানেই মার্কিন দূতাবাস ও দূত রয়েছে, সেখানেই ‘পলিটিক্যাল কমিশনার’ হিসেবে ঘাঁটি রয়েছে সিআইএর। সে যুগে তাদের মূল কাজ ছিল দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী বা জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী নেতৃত্বকে হটিয়ে কেবল মার্কিন স্বার্থরক্ষাকারী গোষ্ঠীকে গদিতে বসানো। কিসিঞ্জারের ইন্ধন ও নির্দেশনায় টাকা আর অস্ত্রের জোরে খুন-গুম-হত্যা আর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে সিআইএ তাদের প্রভাব বলয় বিস্তার করে চলেছিল ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য আফ্রিকা ও চিলিতে।
বাংলাদেশে ১৫ আগস্টের দিনগুলোয় ঢাকায় সিআইএর স্টেশন চিফ ছিলেন ফিলিপ চেরি। আর রাষ্ট্রদূত ছিলেন ইউজিন বুস্টার। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্বাভাবিক দেখা-সাক্ষাৎ ও সদ্ভাব ছিল বুস্টারের। মার্কিন নথির বরাতে, আড়ালে খুনি বাহিনীর সঙ্গে বরাবর সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ বজায় রাখছিলেন ‘রহস্যময়’ এই ফিলিপ চেরি। মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেন্স দৃঢ়ভাবে মনে করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিল সিআইএ। তার ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ বইয়ে কিসিঞ্জারকে তিনি অভিহিত করেন ‘অসাধারণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন’ একজন ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে, যার কারণে ‘হাজার হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। … যাদের মধ্যে আছেন সালভাদর আলেন্দে, আর্কবিশপ ম্যাকারিওস এবং শেখ মুজিবুর রহমান। একাত্তরের গণহত্যার জন্যও অভিযুক্ত হন কিসিঞ্জার। একই গ্রন্থের বরাতে ইয়াহিয়া তার তথ্যমন্ত্রী জি ডবলিউ চৌধুরীর কাছে একবার আস্ফালন করে বলেছিলেন, ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের সঙ্গে যে ব্যক্তিগত বোঝাপড়া আছে তার, সেটাই তার সুরক্ষা। ভারতবিদ্বেষী নিক্সনের মন জোগাতেই বস্তুত কিসিঞ্জার প্রতিজ্ঞা করেন, কিছুতেই তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় মানবেন না।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক যে হিমশীতল ছিল, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বন্দিদশা থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু ৪ এপ্রিল তারিখে ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে ১০ দিনের মধ্যে ঢাকায় মার্কিন কনস্যুলেট বন্ধ করে দেবেন তিনি। এর কয়েক ঘণ্টার ভেতর বাংলাদেশের প্রতি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করে ওয়াশিংটন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়