জন্মদিন : প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যচিন্তা

আগের সংবাদ

বঙ্গবন্ধুর চোখে বঙ্গমাতা

পরের সংবাদ

৪০০ বছরের কাঁসা শিল্পে ধস

প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আতিক ইসলাম সিকো, শিবগঞ্জ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) থেকে : এক দশক আগেও কাঁসার থালা, বাটি ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হওয়ারই কথা, কারণ বাংলার প্রাচীনতম শিল্পের মধ্যে কাঁসা শিল্প একটি। তবে বর্তমানে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতির কারণে ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় স্টিল, মেলামাইন, অ্যালুমিনিয়ামের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে এ শিল্পক্রমে বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে।
এর অন্যতম উদাহরণ চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের কথা, যেখানে এ শিল্পের বয়স ৩০০ থেকে ৪০০ বছর অতিক্রম করেছে। ইতিহাস বলছে, কাঁসা ও পিতলের ব্যবহার জনপ্রিয়তা অর্জন করে মোঘল আমলে। এসব ধাতু দিয়ে তখন ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক, বন্দুক, কামান পর্যন্ত তৈরি করা হতো। এরপর ধীরে ধীরে কাঁসা দিয়ে বিভিন্ন দৈনন্দিন নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করা শুরু হয়। এ শিল্প ক্রমে বিস্তার লাভ করে। কিন্তু বর্তমানে আজাইপুর, আরামবাগ, নামোশংকরবাটি ও শান্তি মোড়ে আজ কার্যত অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে কাঁসা শিল্প। এক সময় এ শিল্প থেকেই এসব এলাকার কারিগররা তাদের সংসার চালাতেন। তবে বর্তমানে এর চাহিদা ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ায় কারিগর ও ব্যবসায়ীরা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তার ওপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতিতে ধস নেমেছে জেলার ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্পে। ভাংড়ির দাম করোনার আগে ছিল ৭০০ টাকা কেজি। কিন্তু এখন তা ১৪০০ টাকা কেজি। ১৮০০ টাকা কেজির রাং এখন ৩৬০০ টাকা। কাঁসার তৈরি থালার বর্তমান দাম কেজিপ্রতি ২০০০-২১০০ টাকা এবং গøাস, বাটির দাম ২৩০০-২৪০০ টাকা কেজি। যেগুলো কেজিপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা করে দাম বেড়েছে। কাঁসা ছাড়াও পিতলের তৈরি তৈজসপত্র প্রতি কেজির মূল্য ৭০০ টাকা। এছাড়া তামার তৈরি তৈজসপত্র প্রতি কেজির মূল্য ৬০০-১৫০০ টাকা। এখানের তৈরি তৈজসপত্র জেলা ছাড়াও রাজশাহী-নওগাঁ ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় আট হাজার কেজি কাঁসার বিভিন্ন সামগ্রী উৎপাদিত হচ্ছে। যার আনুমানিক মূল্য ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ২ হাজার কেজি পিতলের সামগ্রী উৎপাদিত হচ্ছে। যার আনুমানিক মূল্য ৩২ লাখ টাকা। এছাড়াও তামার তৈরি জিনিস উৎপাদন হয় প্রায় পাঁচশ কেজি, যার মূল্য সাড়ে তিন লাখ টাকা। করোনা পরিস্থিতিতে বিদেশ থেকে আমদানিনির্ভর কাঁচামাল না আসায় এর দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কাঁসা-পিতলের তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্রের দাম বেড়েছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে। দাম বাড়ায় এসব জিনিসপত্র ক্রয়ে আগ্রহ হারাচ্ছে ক্রেতা ও সারাদেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
কারিগর, কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাকালীন সময়ের আগে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্প। কিন্তু করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি শুরু হলে বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরির মূল উপাদান তামা ও রিং বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এতে দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে কাঁচামালের। তাই প্রস্তুতকৃত জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে দ্বিগুণ। একদিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম ও সিরামিক সামগ্রীর ব্যবহার বৃদ্ধি, অন্যদিকে দাম বাড়ার কারণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ক্রেতারা।
অন্যদিকে লকডাউনের কারণে কারখানা ও দোকানপাট বন্ধ থাকায় নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে তারা। সংসার চালাতে কয়েক দশকের পেশা ছেড়েছেন অনেকেই। গত কয়েক বছরের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ের ৩-৪ বছর ধরে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল কাঁসা-পিতলের সঙ্গে জড়িতরা। তবে করোনার সবকিছু ধ্বংস হয়েছে দাবি তাদের। জেলা শহরের আজাইপুর, আরামবাগ, নামোশংকরবাটি, শান্তিমোড় ও রামকৃষ্টপুর মহল্লার প্রতিটি অলিগলিতে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শোনা যেত খটখট শব্দ। তবে এখন হাতেগোনা কয়েকটি কারখানা রয়েছে। যারা ধরে রেখেছে বাপ-দাদার শত বছরের ঐতিহ্যবাহীর এই শিল্পকে।
৩৫ বছর ধরে কাঁসা-পিতলের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন রামকৃষ্টপুর এলাকার মেহের আলী। শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরির। তারা বলেন, আগে কাজ করে ভালো টাকাপয়সা পেতাম। দিন দিন তা কমছে। তবে করোনা এসে একেবারেই ধ্বংস হওয়ার মতো অবস্থা। কাজ না থাকায় সংসার চালার তাগিদে অনেকেই এই কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এখন তারা কাজ ছেড়ে কেউ রিকশা-ভ্যান চালায়, কেউ যোগ দিয়েছে রাজমিস্ত্রির কাজে, কেউ আবার পাড়ি দিয়েছে প্রবাসে। ৩ দশকের বেশি সময় ধরে কাঁসা-পিতলের ব্যবসা করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার রামকৃষ্টপুর এলাকার আবুল খায়ের। তিনি বলেন, প্রায় বছরখানেক বন্ধ থাকার পর কোনো রকমে আবার কারখানা চালু করেছি। কাঁচামালের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় খুব বিপদে আছি। সরকার বিদেশ থেকে এসব আমদানি করতে উদ্যোগ নিলে দুবেলা দুমুঠো ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারব। তা না হলে অন্যদের মতো আমাদেরকেও এই ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে।
এ ব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, এ জেলায় আম, কাঁসা, লাক্ষা, রেশম, নকশিকাঁথা ও সরু চালের জন্য বিখ্যাত। সবচেয়ে বেশি পরিচিতি আম ও কাঁসার জন্য। জেলার প্রায় ২৫-৩০ হাজার লোক কাঁসা শিল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে শিল্পটি ধ্বংসের মুখে। তিনি আরো বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আসতে না পারায় তৈরিকৃত জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে চাহিদা কমে যাওয়ায় কারিগররা পথে বসেছে। কাঁসাশিল্প বাঁচিয়ে রাখতে বিশেষ প্রণোদনা অথবা কাঁচামাল আমদানিতে বিভিন্ন সহযোগিতা দিয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রতি সরকারকে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়