৩১ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ল

আগের সংবাদ

ট্র্যাকে জ্যামাইকান সুন্দরীদের রাজত্ব

পরের সংবাদ

বায়োস্কোপওয়ালা হীরালাল সেন

প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৩১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভারতবর্ষের প্রথম দিককার চিত্রনির্মাতাদের একজন তিনি, অনেকের মতে তিনিই প্রথম! ভারতের সর্বপ্রথম বিজ্ঞাপন বিষয়ক চলচ্চিত্র তিনি বানিয়েছিলেন। এ অঞ্চলের প্রথম রাজনীতিক ছবিও তারই হাতে নির্মিত। তবে পরিতাপের বিষয় এই যে, ১৯১৭ সালের এক অগ্নিকাণ্ডে নষ্ট হয়ে যায় তার তৈরি সব চলচ্চিত্র। হীরালাল জন্ম নেন তৎকালীন ঢাকা (বর্তমান মানিকগঞ্জ) জেলার বগজুরি গ্রামে আনুমানিক ১৮৬৬ সালের (মতান্তরে ১৮৬৮) ২ আগস্ট। তার বাবার নাম চন্দ্রমোহন সেন যিনি ব্রাহ্ম সমাজের নেতা, পত্রিকা সম্পাদক ও আইনজীবী এবং মা’র নাম বিধুমুখী। তবে পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে আলোচ্য ব্যক্তি হলেন তার দাদা গোকুলকৃষ্ণ সেন মুন্সি যিনি ঢাকার জজ আদালতের নামকরা উকিল ছিলেন। গোকুল মুন্সির আভিজাত্যের গল্প লোকমুখে শোনা যায়। মুন্সি সাহেবের গোঁফের যতেœর জন্য দুজন ভৃত্যকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। সেই সময়ে তিনি যে চটিজুতো পরতেন তার দাম ছিল তখনকার হিসাবে ৪০-৪২ টাকা! গোকুল মুন্সির বাড়িটি ছিল প্রাসাদসম এক রাজবাড়ি যার ৪০ বিঘে জমিতে ৪-৫ বিঘে শুধু ফুলবাগানই ছিল, বাড়িতে ছিল একটি পশুশালা ও চিড়িয়াখানা। তার বাবা চন্দ্রমোহন সেনও ছিলেন ঢাকা শহরের নামজাদা উকিল। এই বিত্ত বৈভবের অনেকটাই শেষ হতে থাকে হীরালালের পিতার বেখেয়ালি জীবনযাপনের জন্য। বাবার দর্শন ছেলেরা তেমন পেত না, তবে মা বিধুমুখীর ভালোবাসা ষোলোআনা পেয়েছিলেন হীরালাল। ছোটবেলা থেকেই রোগা ও শান্ত স্বভাবের ছেলেটির শখ ছিল ছবি আকার ও প্রতিমা তৈরির। এন্ট্রান্সে প্রথমবার অকৃতকার্য হয়ে দ্বিতীয়বার পাস করে বের হন হীরালাল। পরবর্তীকালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলে ঝোক ওঠে ছবি তোলার। বোর্ন এন্ড শেফার্ডের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত ‘রাজ্যপাঠ থেকে হুগলিতে সূর্যাস্ত’ ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান নিয়ে সোনার মেডেল জেতেন তিনি। এই স্বর্ণপদক প্রাপ্তি তার জীবনের বড় অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায় এবং তিনি পেশাদার ফটোগ্রাফির ব্যবসা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘এইচ এল সেন এন্ড ব্রাদার্স। ১৮৮৭-১৮৯৮ পর্যন্ত সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় সাত সাতটিবার প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক জেতেন তিনি। ফটোগ্রাফি ছাড়াও তার ছিল ফটোগ্রাফ থেকে পোর্ট্রেট আকার নেশা যা তার শেষ বয়সের অবলম্বন হয়েছিল।
সে যুগে ফরাসি প্যাথে কোম্পানি ভারতবর্ষের রাজাদের হাতি, ঘোড়া, উট, বাঁদরের খেলা প্রভৃতির দৃশ্য ধারণ করে সেগুলো ইউরোপে প্রদর্শন করত। সেই প্যাথে কোম্পানির একজন সহযোগী হয়ে তাদের কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন তিনি। প্যাথে স্টুডিওর সদস্য অধ্যাপক স্টিভেনসনের থেকে ক্যামেরা চেয়ে নিয়ে হীরালাল নির্মাণ করেন তার প্রথম ছবি ‘A Dancing Scene From the Opera, The Flower of Persia’ যা নির্মিত হয় ওই অপেরার একটি নাচের দৃশ্য নিয়েই সেই ১৮৯৮ সালে! উল্লেখ্য, এক বিদেশি ফটোগ্রাফ পত্রিকায় বায়োস্কোপের বিজ্ঞাপন দেখে হীরালাল যন্ত্রপাতি কেনেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি। বিবাহসহ সে সময়ের ধনীদের নানা ধুমধাম সব আয়োজনে ডাক পড়ত এই বায়োস্কোপের। বায়োস্কোপকে সেসময়ে বলা হতো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। মঞ্চ নাটকের একজন নিয়মিত দর্শক হয়েই এই শিল্পমাধ্যমটির প্রতি তীব্র অনুরাগ জন্মে হীরালালের। তার পরিচয় ঘটে নাট্যজন অমরেন্দ্রনাথ দত্তেরসঙ্গে। এই অমরেন্দ্রনাথই প্রথম মঞ্চে আসল চেয়ার, টেবিল, সোফা ইত্যাদি সত্যিকারের সরঞ্জামের ব্যবহার শুরু করেন। এই দুই জুটি মিলে সৃষ্টি করেন ইতিহাসের। মঞ্চনাটক আলিবাবার চিত্রকে ভিডিও আকারে ধারণ করা হলো হীরালালেরই মাধ্যমেই। হীরালালের বায়োস্কোপ কোম্পানিতে যোগ দেন তার ভাগ্নে ভোলানাথ (যিনি চলচ্চিত্রে কুমার শংকর গুপ্ত নামে পরিচিত হয়েছিলেন) এবং তার মেঝভাই মতিলাল। তবে ভাগ্নে ভোলানাথের কুড়ি হাজার টাকা আত্মসাৎ করে চম্পট দেয়াটায় বেগতিক অবস্থায় পড়েছিলেন হীরালাল। ইতোমধ্যে আলিবাবার সাফল্যের পর অনেকে ব্যবসায়ীই এই শিল্পমাধ্যমে আগ্রহী হলেন যার মধ্যে অগ্রগণ্য জাহাঙ্গীর ফ্রামজি ম্যাডান। ১৯০৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের একটি প্রতিবাদ সভা হয়েছিল কলকাতার টাউন হলে। এ ছবিতে সেই ঘটনাকে ক্যামেরাবন্দি করেন হীরালাল। ছবির শেষে গাওয়া হয়েছিল স্বদেশি বন্দে মাতরম গান। হীরালালের তৈরি এ তথ্যছবি ‘Anti-Partition Demonstration and Swadeshi movement at the Town Hall, Calcutta on 22nd September1905’-কে ভারতের প্রথম রাজনীতিক চলচ্চিত্র বলা হয়। টকিং মেশিন দিয়ে শব্দধারণ করায় এই কাজটি সে সময়ে পেয়েছিল আলাদা শিল্পমাত্রা। এরপর তিনি চিত্রায়ন করেছিলেন ‘কেশভ গঙ্গাধার তিলকের’ কলকাতায় আগমনের ঘটনাবলি, ‘পঞ্চম জর্জ ও সম্রাজ্ঞী মেরীর’ ভারত আগমনের সংবাদচিত্রসহ নানা কিছু। জীবনের শেষদিকে ভাই হীরালালের সঙ্গে মতান্তরের ফলে ব্যবসায়ে আলাদা হয়ে গিয়ে এবং কণ্ঠে ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে জীবনটা কষ্টে কাটাতে হয়েছে তাকে। হীরালালের বিয়ে হয়েছিল হেমাঙ্গিনী দেবীর সঙ্গে। তাদের ছিল তিন মেয়ে ও এক ছেলে। তার তৃতীয় সন্তান মেয়ে প্রতিভা সেনের বিয়ে হয় নরনাথ সেনের সঙ্গে। নরনাথ সেনের ভাইপো দিবানাথ সেনের স্ত্রী ছিলেন কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন। ১৯১৭ সালে নবমীর এক সন্ধ্যায় অসুস্থ অবস্থায় তিনি জানতে পারেন তার ভাই মতিলালের বাসায় আগুন ধরে এবং তার ধারণকৃত সব উল্লেখযোগ্য কর্মগুলো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তার পরদিন সমগ্র শহর যখন প্রতিমা বিসর্জনে ব্যস্ত, ঠিক সে সময়েই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান হীরালাল। ১৯০০ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি আনুমানিক প্রায় ৪০টির অধিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বানিয়েছিলেন। অধিকাংশ ছবিতেই তিনি ক্যামেরাবদ্ধ করেন অমরেন্দ্রনাথ দত্তের কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ বিভিন্ন মঞ্চনাটকের দৃশ্যাবলি। ১৯০১ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে ক্লাসিক থিয়েটারের হয়ে তিনি বেশকিছু ছবি নির্মাণ করেন যার নাম ‘ভ্রমর’, ‘হরিরাজ’, ‘বুদ্ধদেব’ ইত্যাদি। ১৯০৩ এর দিকে তৈরি ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ তার কর্মগুলোর মধ্যে অধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ১৯০২-০৩ সালে বিদেশ থেকে উন্নত ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতি আনার পর হীরালাল ভিডিওবন্দি করেন এই ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’। ১৯০৪ সালের ২৩ জানুয়ারি ক্লাসিক থিয়েটারে তা দেখানো হয় এই পূর্ণদৈর্ঘ্যটি যা সৃষ্টি করে ইতিহাস। এছাড়া ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তার বায়োস্কোপ কোম্পানি থেকে প্রথম বাংলায় সিকে সেনের মাথার তেল ‘জবাকুসুম’, বটফেস্ট পালের ‘এডওয়ার্ড টনিক’ ও ডব্লিউ মেজর কোম্পানির ‘সার্সাপেরিলা’ ইত্যাদি বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মিত হয়। প্রামাণ্যচিত্র ও সংবাদচিত্রও রয়েছে তার কর্মের ঝুলিতে। সম্প্রতি হীরালালের জীবনী নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে যেখানে জামশেদজি ফ্রেমজি ম্যাডান এবং হীরালালের চরিত্রে রয়েছেন যথাক্রমে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এবং নবাগত কিঞ্জল নন্দ। হীরালাল শিরোনামের চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন ‘এগারো’, ‘চোলাই’-এর মতো নন্দিত ছবির নির্মাতা অরুণ রায়।
উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার হিসেবে দাদাসাহেব ফালকের নাম আসলেও সত্যিকারের ইতিহাস বলে সেটি আর কেউ নন স্বয়ং হীরালাল সেন। এমনকি হীরালাল যখন শারীরিক অসুস্থতার জন্য কর্মজীবনের শেষদিকে পৌঁছে গিয়েছিলেন তখনো দাদাসাহেব ফালকে তার কাজ শুরু করেননি। শুধু হীরালাল সেন নির্মিত কাজগুলো অগ্নিকাণ্ডে বিনষ্ট হয়েছে বলে তার এই অর্জন মøান হয়ে যাবে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। হীরালাল অবশ্যই থাকবেন বাঙালি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের হৃদয়ে, মননে।
:: মুহাম্মাদ আলতামিশ নাবিল

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়