রিমান্ডে পলকের ক্রাইম পার্টনারদের মুখোশ উন্মোচন
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪, ০৬:৪১ পিএম
সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক
কোটা বিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। অনেকেই সুযোগ বুঝে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তবে ৬ আগস্ট গোপনে দেশ ছাড়তে গিয়ে এয়ারপোর্টে আটক হন সদ্য সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। ১৫ আগস্ট পলককে ১০ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে হত্যাযজ্ঞ চালানোর মাস্টারমাইন্ড হিসেবে খ্যাত পলক রিমান্ডে গিয়ে কান্নাকাটি করছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে। রিমান্ডে পলকের সহযোগী ক্রাইম পার্টনার কারা ছিল তাদের তথ্য উন্মোচন করেছে স্বয়ং পলক।
রিমান্ডে পলকের জবানিতে বেরিয়ে আসছে দেশের সব প্রভাবশালীদের নাম। তবে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি আড়াল করে পুরো দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন একটি সিন্ডিকেটের ওপরে। জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত পলক স্বীকার করেছেন যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ রেহানা পুত্র রাদওয়ান সিদ্দিক ববি, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এবং সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং সিআরআই (সেন্টার ফর রিসার্চ এবং ইনফরমেশন) সিন্ডিকেট কীভাবে দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেছিলেন।
তদন্ত সূত্র বলছে, পলক এরই মধ্যে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা জয়ের সিগন্যাল ছাড়া তার মন্ত্রণালয়ে কোনো কাজই হতো না। তার সিলেক্টেড কোম্পানিগুলো থেকেই সরবরাহকারীরা সব ধরনের যন্ত্রপাতি এবং সফটওয়্যার কিনতেন। জয়ের হয়ে মাঝেমধ্যেই সিআরআইয়ের কিছু কর্তাব্যক্তি পলকের সঙ্গে মিটিংয়ে বসতেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পলকের সবচেয়ে কাছের সহযোগী সজীব ওয়াজেদ জয়ের বন্ধু এবং এটুআই-এর পলিসি অ্যাডভাইজার আনির চৌধুরী। জয়-আনির যুক্তরাষ্ট্রে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছে। আনির চৌধুরীকে এটুআই প্রোগ্রামের অনিয়মের কারিগর হিসেবে ধরা হয়। নিজ প্রকল্প এটুআই থেকে কয়েকটি অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বারবার কাজ দেয়ার মধ্যে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, কাজ পাইয়ে দেয়ার ব্যাপারে সহকর্মীদের সরাসরি নির্দেশনা দিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অসংখ্য অপকর্মের মূল হোতা আনির অবৈধভাবে বিদেশে শত শত কোটি টাকা পাচার করেছেন। কাজ দেয়া প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে একটিতে তার নিজের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এমন বহু বিতর্কিত কাজে আনির চৌধুরী জড়িত ছিল। এছাড়া সে প্রযুক্তিভিত্তিক ও তরুণদের বিপথে নেয়ার জন্য সিআরআই-এর সঙ্গেও আনির চৌধুরীর নিবিড় সংশ্লিষ্টতা ছিল।
তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বড় বাজেটের প্রকল্প হাইটেক পার্কের সাবেক এমডি ডা. বিকর্ন কুমার ঘোষ পলকের অন্যতম সহযোগী। তিনি ইনফো সরকার প্রকল্পের পিডি ছিলেন। তার প্রকল্প নিয়েই শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও সাবেক সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুলের ভাগাভাগির ফোনালাপ ভাইরাল হয়েছিল।
আরো পড়ুন- এটুআই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন
স্টার্টআপ বাংলাদেশের প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক পলকের বান্ধবী হিসেবে পরিচিত টিনা এফ জাবিনের নামও আছে এই তালিকায়। সবশেষ ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি স্টার্টআপ বাংলাদেশের এমডি হিসেবে যোগ দেন সামি আহমেদ। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এই খাতের কুমির হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের এলআইসিটি প্রকল্পের আইটি-আইটিইএস পলিসি এডভাইজার হিসেবে কাজ করছিলেন। সামি আহমেদ দায়িত্ব নেয়ার পর পছন্দমত প্রতিষ্ঠানে শত কোটি টাকা বিনিয়োগ দিয়েছে। তার পছন্দমত যেসব স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে সরকারি ফান্ড দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডে (বিডিসিসিএল) জনবল নিয়োগে সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ব্যাপক স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন পদে নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের চাকরি পাইয়ে দিতে সুপারিসসহ আবেদনের শর্ত শিথিল, পরীক্ষাকেন্দ্র পরিবর্তনসহ নানা অনিয়মের প্রমাণ এখন স্পষ্ট। নাটোর জেলার বিশেষ করে তার নির্বাচনী আসন সিংড়া উপজেলার অন্তত এক ডজন বাসিন্দাকে শুধু ডাটা সেন্টারেই চাকরি দিয়ে গেছেন টানা তিন মেয়াদের সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, কারিগরি ও সাধারণ-এ দুই ক্যাটাগরিতে ৪১ পদে নিয়োগের জন্য আগ্রহীদের থেকে অনলাইনে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে শুধু পাঁচটিতে আবেদনের যোগ্যতা শিথিল করা হয়। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রতিমন্ত্রীর তৎকালীন একান্ত সহকারী সচিব (এপিএস) রঞ্জিত কুমার নিয়োগ পান ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং) পদে। ফলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ২২ হাজার টাকা বেতন স্কেলের রনজিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে ৫৫ হাজার টাকা বেতন স্কেলে চাকরি পান। রঞ্জিতের চাকরি নিয়ে বিতর্ক ছিল আরও। চাকরিতে যোগদানের পরেও রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। ২০২২ সালের অক্টোবরে গঠিত নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিতে সহসভাপতি ছিলেন তিনি। এক সময় সভাপতির অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। জুতা সেলাইয়ের কাজ করা এই মুচির ছেলে রঞ্জিত কুমার এখন শত কোটি টাকার মালিক।
এ ছাড়া পলকের বর্তমান এপিএস রাকিবুল হাসান এবং পলকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সাদ্দামও এখন শত কোটি টাকার মালিক। ডাটা সেন্টার লিমিটেডের সচিব লতিফুল কবির। অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া এই কর্মকর্তা ডাটা সেন্টারে লুটপাটের প্রধান কারিগর। তিনিও পলকের ফাইন্যান্সার হিসেবেও পরিচিত। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর রঞ্জিত কুমার। তিনি হাইটেক পার্কের সাবেক এমডি বিকর্নর খুব কাছের বন্ধু হিসেবে পরিচিত। তাকে ডাকা হয় দুর্নীতির মহারাজা হিসেবে। এটুআই এর এইচডি মিডিয়ার পূরবী মতিন। আইসিটি আর পিএম কার্যালয়ের সব ইভেন্ট তিনি দেখতেন।
আরো পড়ুন- এটুআইয়ের ১৪ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ
পলকের সাবেক এপিএস ডাটা সেন্টারের প্রকিউরমেন্ট ম্যানেজার একরাম। যশোরের এই একরাম আঙ্গুলফুলে কলা গাছ হয়েছেন। এর আগে তিনি অন্য এক মন্ত্রীর এপিএস ছিলেন। এ ছাড়া বর্তমান পিএস মুশফিকুর রহমান, সাবেক পিএস বর্তমানে বগুড়ার ডিসি সাইফুল ইসলাম, এটুআইয়ের চিফ ইনোভেশন স্ট্রাটেজিক ফরহাদ জাহিদ শেখ, মানিক মাহমুদ, শাওন প্রমুখ। এই তালিকায় আরো আছেন আইসিটি অধিদপ্তরের ডিজি মোস্তফা কামাল, প্রোগ্রামার সৈয়দ মাহফু মাহমুদ ইশতিয়াক আহমেদ ও আব্দুল ওদুদ।
জুনাইদ আহমেদ পলকের রিমান্ড অফিসার জানিয়েছেন, আরো বেশ কিছুদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পাওয়া যাবে। আমরা আশা করছি, তার কাছ থেকে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাবে। কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি, এটুআই প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাইটেক পার্ক, আইটি পার্ক তৈরির নামে শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছে পলক সিন্ডিকেট। পলকের রিমান্ডে নাম আসা প্রতিটি মানুষকে তদন্তের আওতায় আনা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সামি আহমেদের প্রতিবাদ
স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি আহমেদ ভোরের কাগজে একটি প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে অভ্যন্তরীণ অনিয়ম ও দুর্নীতির উল্লেখপূর্বক কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড এর নাম যুক্ত করে মিথ্যা ও অসত্য তথ্য প্রকাশ এবং স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আমার সম্পর্কে অসত্য, মনগড়া ও আজগুবি তথ্য প্রকাশসহ আমাকে হেয় করে মানহানিকর সংবাদ প্রকাশ করায় আমি অত্যন্ত মর্মাহত, আশাহত ও সংক্ষুব্ধ হয়েছি এবং এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। উক্ত প্রতিবেদনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সামি আহমেদ দায়িত্ব নেয়ার পর পছন্দমত স্টার্টআপে শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেখানে ইনটেলিজেন্স মেশিন, ঢাকা কাস্ট, এডু হাইভ, মনের বন্ধু, সাজগোজ, জাহাজী, ডানা-ফিনটেক, হিসাব, বাড়ি কই, অন্য, লুজলি ক্যাপলড, এলিস ল্যাবস, উইগ্রো এবং ফ্যাব্রিক লাগবে স্টার্টআপের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অসত্য, ভিত্তিহীন ও মানহানিকর।
উল্লিখিত ১৪টি স্টার্টআপের মধ্যে ইনটেলিজেন্স মেশিন, ঢাকা কাস্ট, এডু হাইভ এবং মনের বন্ধু- এই ৪টি স্টার্টআপে বিনিয়োগ হয়েছে আমি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদানের পূর্বে। অন্যদিকে সাজগোজ, জাহাজী, ডানা-ফিনটেক, বাড়ি কই, অন্য, লুজলি ক্যাপলড, উইগ্রো এবং ফ্যাব্রিক লাগবে- এই ৮টি স্টার্টআপে স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড হতে কোন বিনিয়োগ করা হয়নি। উল্লিখিত ১৪টি স্টার্টআপের মধ্যে শুধুমাত্র ২টি স্টার্টআপে (হিসাব ও এলিস ল্যাবস) আমার দায়িত্বকালীন সময়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড হতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বোর্ড অব ডিরেক্টরস কর্তৃক অনুমোদিত গাইডলাইন অনুসরণ করে এক্সটার্নাল আইনী পরামর্শকের মাধ্যমে আইনগত মতামত ও ডিউ ডিলিজেন্স, ইনভেস্টমেন্ট এডভাইজরি কমিটি'র সুপারিশ এবং চূড়ান্তভাবে কোম্পানির বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন গ্রহণ সাপেক্ষে, প্রত্যেকটা সুনির্দিষ্ট ধাপসমূহ যাচাই পূর্বক অতিক্রম করার পরই শুধুমাত্র বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে। এখানে কোনো পছন্দমত প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করার কোন সুযোগ নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা এবং আমার মানহানি করার উদ্দেশ্যে এ ধরণের সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ ধরণের সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড অথবা ইকোসিস্টেমের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নিকট হতে সঠিক তথ্য না নিয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে যা কোন ধরণের পেশাদারিত্বের বাইরে বলে আমি মনে করি।
প্রতিবেদকের উত্তর
সামি আহমেদের প্রেরিত চিঠিতে স্বাক্ষর থাকলেও তিনি কবে এটি পাঠিয়েছেন সে তথ্য/তারিখ উল্লেখ করা নেই। সংশ্লিষ্ট সংবাদটি পর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই তৈরি করা হয়েছে। তবে যেসব স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের নাম ভোরের কাগজ প্রকাশ করেছিল সেগুলো বিনিয়োগ পাওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। সেসব তালিকা ইতিপূর্বে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশ হয়েছিল। তবে যেহেতু তাদের কাছে ফান্ড হস্তান্তর করা হয়নি সেহেতু ভোরের কাগজ এই চিঠি পাওয়ার আগেই নামগুলো সরিয়ে দিয়েছিল।