×

প্রবাস

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুইডেন প্রবাসীর খোলা চিঠি

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:৩৯ পিএম

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুইডেন প্রবাসীর খোলা চিঠি

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

আপনি কেমন আছেন? আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, অনুপ্রেরণা ও চেতনায় গড়ে উঠা ১৯৭১ সালের এক শিশু মুক্তিযোদ্ধা; যে তার বাবা এবং বড় তিন ভাইয়ের অবর্তমানে মায়ের দিক-নির্দেশনায় ছোট পাঁচ ভাইবোন নিয়ে দীর্ঘ নয় মাস নিজ দেশে শরণার্থী হয়ে জীবন-মরণের সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছি। দেশ স্বাধীনের ফেরিওয়ালা হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের, বাপ-চাচাদের বার্তাবাহক হয়ে কাজ করেছি ও সাহায্য করেছি। চোখের সামনে দেশ স্বাধীন হতে দেখেছি, বহু আত্মীয়স্বজনের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ পেয়েছি, সঙ্গে হারিয়েছিও অনেক কিছু। 

আমরা বর্তমান ৯ ভাইবোন, সবাই দেশের বাইরে শুধু একজন ছাড়া। নিজেকে, পরিবার এবং দেশকে সোনার বাংলা করে গড়ে তুলব বলে অল্প বয়সেই দেশ ছেড়েছি। বাবা-মার নির্দেশনা এবং অনুপ্রেরণায় দেশের জন্য সব করতে প্রস্তুত; এমনকি মানসিকভাবে এখনও দেশের জন্য কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। চল্লিশ বছর দূরপরবাসে বসবাস করলেও দেশের উন্নয়নে বদ্ধপরিকর হয়ে কাজ করে চলেছি। আমার গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলার (মাগুরা-২ আসন) নহাটা গ্রামে। আমরা অতি সহজেই পরনিন্দা এবং পরচর্চা করে থাকি অথচ নিজেদের মধ্যে যে একই সমস্যা রয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাও যে অপরিহার্য সেটা ভুলে যাই।

আমরা বাংলাদেশে ধর্ষণ, ঘুষ, মাদক, দুর্নীতি এসবের বিরুদ্ধে সব সময় লিখি, কথা বলি, সংগ্রাম করি। কিন্তু আমরা কখনো বলি না বা বলতে চাই না যে, এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তারা আর কেউ নয়, আমাদের সমাজেরই পরিচিত মুখ। আমার এই খোলা চিঠির মাধ্যমে আজ আমি আমার পারিবারিক সমস্যা তুলে ধরতে চাই সরাসরি আপনার কাছে। আমার পরিবার শিক্ষা এবং অর্থে দেশে-বিদেশে সুনামের সঙ্গে চললেও আমার পরিবারে রয়েছে ভাই-বোনদের বঞ্চনাকারী এক বা একাধিক সদস্য। আমার পারিবারিক সমস্যা আমি দুঃখের সঙ্গে তুলে ধরছি শুধুমাত্র পরিবর্তনের জন্য। কারণ যদি এমনভাবে চলতে থাকে তবে এসব কুৎসিত চরিত্রের মানুষের জন্য পুরো দেশ এক সময় অচল হয়ে যাবে। আর এ ধরনের কুৎসিত চরিত্রের মানুষ বর্তমানে বাংলাদেশে দ্রুত বর্ধনশীল।

বাংলাদেশের যৌথ পরিবারের সংখ্যা দিন দিন কমতে শুরু করেছে। পরিবারে বড় ভাই-বোনদের সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও বাবা-মা এবং ছোটদের ছেড়ে আলাদা হয়ে যাওয়া, খোঁজখবর না রাখা, এখন এসব ঘটনা সর্বত্র দেখা যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিয়ের আগে যে ভাইয়ের ওপর ছিল ভালোবাসা এবং মধুর স্মৃতি সে ভাই পরবর্তীতে মস্ত বড় অফিসার হয়ে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। সে পরিবার ছেড়ে নিজেকে লোভী করে ফেলেছে আর গড়েছে তার চারপাশে এক আত্মকেন্দ্রিক প্রাচীর। যে প্রাচীর বন্ধ করে রেখেছে তার মনুষ্যত্বকে, দিনের পর দিন আর বছরের পর বছর।

ছোট ভাই-বোনদের জন্য কিছু করে যদি কোনো বড় ভাই-বোন তা সুদে-আসলে তুলে নেয় এবং সারাক্ষণ কঠিনভাবে মানসিক অশান্তিতে রাখে তখন ভালোবাসার সম্পর্ক ঘৃণায় পরিণত হয়। অর্থনৈতিকভাবে ঋণগ্রস্ত ছোট ভাই-বোনের ওপর বড়দের জুলুমের পরিমাণ যখন সীমা লঙ্ঘন করে এবং তারা যখন ছোটদের প্রতি অত্যাচার এবং অবিচার করতে শুরু করে, তখন ঘৃণা ছাড়া ছোটদের আর কিছু করার থাকে না। সেক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় ভালোবাসা, সেইসঙ্গে সম্পর্কেরও অবনতি হয়। তখন সম্পর্ক আর ভাই-বোনের থাকে না।

সে সামান্যতম ত্রুটি-বিচ্যুতি বড় করে তুলে ধরে সবাইকে নিচু করতে দ্বিধা করে না। আবার অনেকে পরিবারের সবকিছু ভোগ-দখল করে আসছে বছরের পর বছর, তারপরও খুশি নয়। এরা সেই বর্ণচোরা মুখোশধারী মানুষ নামের দানব যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুরো ফ্যামিলিকে ঠকিয়ে চলছে বহু বছর ধরে। এরা যখন সবে চাকরিতে ঢুকেছে কিন্তু বিয়ে করেনি তখন যা করেছে, শুধু সেই ইতিহাস বলে বেড়ায়। অথচ অনেক বছর পার হয়ে যায়, কারো খোঁজখবর নেয় না। বাংলাদেশের লাখ লাখ পরিবারে প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এর একটা বিহিত করা প্রয়োজন। তবে পাছে লোকে কিছু বলে এই ভয়ে কেউ কিছু করছে না। সরাসরি কিছু করতে বা বলতে গেলে পরিবারের গুডউইল নষ্ট হবে।

আমরা সবাই দানবের নয়; মানবের সমাজ ফিরে পেতে চাই। কিন্তু এই দানবদের আলোর পথে না আনতে পারলে সমাজ এবং দেশে এদের সংখ্যা এত বাড়তে থাকবে যে, শেষ পর্যন্ত সৎ মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। যে চরিত্রহীন, অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত তাকে লজ্জা দেয়া যায় না। যে উলঙ্গ তাকে কে লজ্জা দেবে? কী করে সে দাবি করে সবার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা? একজন শিক্ষিত এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি যে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে, এমন স্বার্থপর আপনজন কেউ চায় না। সবাই সু-শিক্ষায় গড়া ভালোবাসার সমন্বয়ে ভরা সাধারণ পরিবার চায়।

দুর্নীতি হয় না এমন দেশ সারাবিশ্বে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখন প্রশ্ন কীভাবে দুর্নীতিবাজদেরকে সৎ চরিত্রে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? যদিও পরিবারের মধ্যে যে ক্ষতি হয়েছে সেটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না। তাহলে কীভাবে পরিবারে এ ধরণের মানুষদের চরিত্রের পরিবর্তন করা সম্ভব? পারবে কি এরা নতুন করে প্রমাণ করতে যে তারা পরিবার ও সমাজের সত্যিকার আপনজন? তাহলে তাদের প্রমাণ করে দেখাতে হবে, যে অন্যায় তারা করছে, তার জন্য তারা লজ্জিত ও অনুতপ্ত।

আমি সবকিছু বিচার বিবেচনা করে আজ আপনার কাছে আমার এই বার্তাটি তুলে ধরছি। কারণ বাংলাকে সোনার বাংলা করতে হলে আমাদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে এবং সে পরিবর্তন নিজ এবং নিজের পরিবারকে দিয়ে শুরু করতে হবে। সেক্ষেত্রে এগুলো পারিবারিকভাবে বসে মীমাংসা করতে চেষ্টা করার উদ্যোগ নিতে হবে এটাই সবাই বলবে। এতে সীমিত সময়ের জন্য হয়তো পরিবারের সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটা পরিবারের তথা সমাজের জন্য সুফল বয়ে আনবে। সুশিক্ষা এবং মানবতার ধ্বংস নয়, ধ্বংস হোক তার নিজের কুশিক্ষা।

জীবনে চলার পথে কিছু লক্ষ্য থাকা দরকার যা শিক্ষণীয় এবং যা সোনার বাংলায় আদর্শ মানুষ হতে সাহায্য করবে। আমি গত চল্লিশ বছর ধরে চেষ্টা করেছি একটি সুন্দর পরিবার তৈরি করতে। আমি চল্লিশ বছর প্রাক্টিস করেছি সৎ পথে চলতে, সত্য কথা বলতে, অন্যায় না করতে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। আমি পরিবারের ভালো-মন্দ সব কিছু জানি, জেনে শুনেও অনেক সময় চেষ্টা করেছি চুপ থাকতে, অনেক সময় সমাধানে ঢুকেছি, সমাধান করেছি। অনেকবার আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিবারিক সমস্যাগুলোর পুরো সমাধান করতে পারিনি। শেষে সকলের সাথে কথা বলে এবার ভেবেছিলাম বাবা-মা মারা গেছেন হয়তো আমরা পারব সব মিটাতে। 

কথা ছিল সবাই দরকারে একটু ছাড় দিবে। আমরা সকল ভাই-বোন যা কিছু করেছি দেশে তার সমস্ত দায়ভার আমাদের একমাত্র ভাই লে. কর্নেল (অব.) হান্নান মৃধার ওপর ন্যস্ত করি। কারণ সেই শুধু দেশে থাকে। আমরা তার ছেলেকে পর্যন্ত বিদেশে এনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। তারপরও সে আমাদের বিশ্বস্ততাকে ভঙ্গ করে আমাদের দেশের প্রায় সকল সম্পদ ভোগদখল করে চলছে। বয়স এবং সময়ের সাথে যখন আমরা সবাই দেশে ফিরে নিজেদের সম্পদের অংশবিশেষ ফেরত পেতে তাকে অনুরোধ করি ঠিক তখনই সে তার ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে আমাদের সকল ভাই-বোনকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা খেকে বঞ্চিত এবং ভয় দেখিয়ে সব কিছু ভোগ দখল করে চলছে। 

আমরা নানাভাবে বোঝাতে এবং তার পাওনার চেয়ে বহুগুণ বেশি দিয়েও তাকে সৎপথে আনতে ব্যর্থ হয়েছি। শেষে তাকে এও বলেছি দরকারে আপনার সাহায্য নিব তবুও দুর্নীতিকে পরিবার থেকে আজীবনের জন্য দূর করবো। লে. কর্নেল (অব.) হান্নান মৃধা কথা দিয়েও শেষে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, এটাই আমাকে কষ্ট দিয়েছে। সে তার চাকরি জীবনে ডিজিএফআই, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ নানা দায়িত্বে কাজ করেছে। সে নিজেই যখন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, আমার প্রশ্ন কোথায় আমরা সাধারণ মানুষ যাব? শেষে অন্য কোনো উপায় না পেয়ে আপনার এবং সমস্ত দেশবাসীর কাছে আমার এই লেখা। আশা করি আপনি আমাদের একটি ন্যায্যবিচার এবং অনীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেন। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দুর্নীতিমুক্ত পরিবার দরকার, আশা করি আপনি সেটা করতে পারবেন। আপনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করি।

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন থেকে, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App