ঢামেকে আগুন আতঙ্ক, রোগীর স্বজনদের ছুটাছুটি

আগের সংবাদ

কড়া নির্দেশনা কার্যকরে ঢিলেমি

পরের সংবাদ

সম্মোহনের অসাধারণ প্রতীক : বাঙালির মানস সুন্দরী সুচিত্রা সেন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সুচিত্রা সেন। প্রবাদপ্রতিম অভিনেত্রী। বাংলা ছবি এবং বাঙালি সিনেমা দর্শকদের কাছে আজো তিনি সেরা। তার সমান্তরাল অবস্থানে এখনো অন্য কোনো বাঙালি অভিনেত্রী পৌঁছতে পারেননি বললেও তেমন বেশি বলা হবে না। পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত সুচিত্রা ছিলেন বাংলা ছবির অন্যতম রোমান্টিক নায়িকা। যুবকদের কাছে স্বপ্নের নায়িকা। তার রোমান্টিক দৃষ্টির মধ্যে ছিল সম্মোহনী শক্তি, যার আকর্ষণে দর্শকরা হতেন মোহাবিষ্ট। বিশেষ করে তার মুখ, গভীর চোখের চাহনি, কথা বলার ভঙ্গি ও মোহময়ী হাসির মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক অসাধারণ স্ক্রিন পার্সোনালিটি অর্থাৎ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর আগে কয়েক দশক ধরে কোনো ছবিতে অভিনয় না করে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে দিন যাপন করেছেন। তিনি ছিলেন প্রায় গৃহবন্দি। কিন্তু কেন? সেটাই সুচিত্রা রহস্য।
সুচিত্রা সেন ধ্রæপদী বঙ্গসুন্দরী। তার অপরূপ সৌন্দর্যের মধ্যে রয়েছে একটা জোর, একটা তেজ, যেটা আর পাঁচজন সুন্দরীর মধ্য থেকে সুচিত্রাকে অনায়াসে আলাদা করে দিতে পারে। চোখ দুটো যেন উজ্জ্বল এক ভাষায় মুখর করে দিতে পারত একটা চরিত্রকে। আর তার কণ্ঠস্বর? সে এক আলাদা অভিব্যক্তির পরিবাহ সৃষ্টি করতে পারত। মোহিত করে তুলত নিমিষেই। এমনটা যার থাকে, সে অভিনয় না জানলেও কিছু যায়-আসে না। অথচ সুচিত্রা সেন ছিলেন অনিন্দ্যসুন্দরী অপরূপ ব্যক্তিত্বময়ী অসাধারণ এক অভিনেত্রী। তিনি শুধু বাংলা সিনেমায় রোমান্টিক নায়িকা হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং কিংবদন্তির পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন তাই নয়, উপরন্তু হিন্দি ছবিতে আত্মপ্রকাশ করেও একদা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলা ছবিতে সুচিত্রা সেনের আগমন তেমন মসৃণ ছিল না। তার নায়িকারূপে আত্মপ্রকাশ ঠিক ‘এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন’ তেমন ধরনের ছিল না, নিজেকে ধীরে ধীরে তৈরি করে নিতে হয়েছিল। এবং পায়ের তলার মাটি শক্ত করার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল পাক্কা দু-দুটি বছর। ১৯৫২ সালে সুচিত্রা প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান ‘শেষ কোথায়’ ছবির জন্য। এ ছবিতে নায়িকা চরিত্রে রূপদান করলেও তা শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। এর পরেই সুকুমার দাশগুপ্তের ‘সাত নম্বর কয়েদী’ ছবিটি তাকে কিছুটা পরিচিতি এনে দেয়।

সুচিত্রার আগে বাংলা ছবির তুমুল জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন কানন দেবী। ত্রিশ থেকে চল্লিশ দশক পর্যন্ত শুধু বাংলা নয়, সর্বভারতীয় ছবির জগতে তিনি ছিলেন গø্যামার কুইন। তার কালে তিনিই ছিলেন ড্রিমগার্ল। জনশ্রæতি আছে কানন দেবীর জন্য আত্মঘাতী হয়েছে তার বেশ ক’জন অন্ধভক্ত। কালে কালে কত অভিনেত্রী আসেন আবার চলে যান। কিন্তু কানন দেবীরা থেকে যান। তার পরের অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন উমাশশী, চন্দ্রাবতী, ভারতী দেবী, মলিনা দেবী, ছায়া দেবী, পদ্মা দেবী, সন্ধ্যারানী, মঞ্জু দে প্রমুখ। কানন দেবীর মতো রূপ, গুণ আর ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী হতে পেরেছেন সুচিত্রা সেন। কানন দেবী একসময় বলেও ছিলেন, সুচিত্রার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। আমাদের যুগ ছিল ডিকটেটরশিপের যুগ, মন সায় না দিলেও পরিচালক-প্রযোজকদের অনেক অন্যায় জুলুম আমাদের মানতে হয়েছে। কারণ সে অধ্যায় শিল্পীদের আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্র নয়। কর্তৃপক্ষের অহমিকার যুগ ছিল। কিন্তু সুচিত্রা সে যুগ উল্টে দিয়েছে। প্রথম যুগের সব অবিচার, অত্যাচার, অন্যায়ের প্রতিবাদ- এক কথায় একটা যুগের বিদ্রোহ ওর মধ্য দিয়ে কথা বলে উঠেছে। অনেক সময়ই ওর উগ্রতা হয়তো অনেককে অসহিষ্ণু করে তোলে, কিন্তু অনেক পর্বতের বাধা, খাদ, গহ্বর, অসমতল পথ অতিক্রম করে আসা নদীর বেগ দুর্বার দুর্দমনীয়। সুচিত্রাও তাই। প্রচলিত সংস্কার, প্রথার বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার বিদ্রোহী মনোভাবে তো উগ্রতা থাকবেই। পরে যখন ব্যালেন্সড হবে সবই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। যে প্রতিবাদ জানানো নানা কারণে আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, তা এসেছে ওরই মাঝ দিয়ে। এখানে সুচিত্রা অনন্যা অতুলনীয়া। এ সত্য মানতেই হবে।’ কানন দেবীর কথাগুলো খুবই সত্যি। সুচিত্রা সেনকে তার অভিনয় জীবনের শুরুতে অনেক বাধা-বিপত্তি, অপমান সহ্য করে নিজের অধিকার অর্জন করতে হয়েছে। নিজেকে উজ্জ্বল অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করার পর তিনি সেসব অন্যায়ের, অবিচারের প্রতিশোধ নিয়েছেন। পতন ঘটিয়েছেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ডিকটেটরশিপের।
বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে আত্মপ্রকাশ সুচিত্রা সেনের। ১৯৫২ সালে তিনি প্রথম অভিনয় করেন ‘শেষ কোথায়’ ছবিতে। দুঃখের বিষয়, ছবিটি মুক্তি পায়নি। পরের বছরই ১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় তার ‘সাত নম্বর কয়েদী’ ছবিটি। এ ছবির পরিচালক একসময়ে সুচিত্রার আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ১৯৫২ সাল, প্রস্তুতি চলছে ‘সাত নম্বর কয়েদী’ ছবির। একজন সুশ্রী অল্পবয়সি মেয়ে খুঁজছিলাম এ ছবির নায়িকার জন্য। সিনেমায় অভিনয় করার ইচ্ছে নিয়ে সদ্যযৌবনা গৃহবধূ রমা সেন আমার কাছে এলেন। সঙ্গে ছিলেন তার স্বামী দিবানাথ সেন। সুচিত্রার নাম তখন রমা। বয়স কতই বা হবে, সবে পার হয়েছে ‘টিন এজ’। দেখতে শুধু সুশ্রীই নয়, রীতিমতো ডাকসাইটে সুন্দরী। আটকালো শুধু এক জায়গায়। রমার উচ্চারণে পূর্ব বাংলার টিপিক্যাল টান। তবুও হাল ছাড়লাম না। বললাম, “তোমাকে কিছুদিন ডায়লগ রিহার্সাল করতে হবে। রিহার্সেলের জন্য ‘সাত নম্বর কয়েদী’র ডায়লগ না দিয়ে দিলাম শরৎচন্দ্রের ‘বিন্দুর ছেলে’ নাটকটি। আশ্চর্য নিষ্ঠা দেখলাম রমার, কয়েক দিনের মধ্যেই পশ্চিম বাংলার কথা বলার ধরন আয়ত্ত করে নিল অনেকটা। উচ্চারণ হলো অনেক পরিচ্ছন্ন এবং মিষ্টি। রমা যে পারবে তাতে কোনো সন্দেই রইল না, বিনা দ্বিধায় নায়িকার ভূমিকাটি তাকে দিলাম। ‘সাত নম্বর কয়েদী’র পর আমার আরো দুটি ছবির নায়িকা হয়েছে রমা। ছবিগুলো হলো ‘ওরা থাকে ওধারে’ এবং ‘সদানন্দের মেলা’। অভিনয়ের মধ্যে তার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখেছিলাম বলে তাকে বলেছিলাম, মুভমেন্ট আর ভাবের ব্যঞ্জনা হলো সিনেমার অভিনয়ের আসল জিনিস। যদি শিখতে চাও তো বিদেশি ছবির অভিনেত্রীদের কাজ দেখো। শুনেছি দারুণ আগ্রহ নিয়ে রমা বিদেশি ছবি দেখে নায়িকাদের চলাফেরা, আচার-আচরণ ও ভাবের ব্যঞ্জনা অভ্যেস করত।” সেই অসামান্য নিষ্ঠার গুণেই তিনি একদিন সুচিত্রা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
বাংলা ছবিতে দু’যুগেরও বেশি সময় ধরে যিনি রূপালি পর্দায় রোমান্টিক নায়িকার ভূমিকাটি দুর্দান্ত দাপটের সঙ্গে দখলে রেখেছিলেন এবং যিনি তাকে রোমান্টিক নায়কের সঙ্গদানে পরিপূর্ণ করে তুলেছিলেন, সেই মহানায়ক উত্তম কুমারের নামটি এক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সেই সুচিত্রা-উত্তম কিংবা উত্তম- সুচিত্রা রোমান্টিক জুটি পৃথিবীর চলচ্চিত্রের মানচিত্রে বোধ করি শ্রেষ্ঠ একটি জুটির বিরলতম উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হবে অনন্তকাল ধরে। যদিও হিন্দি ছবিতে নার্গিস-রাজকাপুর কিংবা দিলীপ কুমার-মধুবালা অথবা দেব আনন্দ-সুরইয়াকে নিয়ে রোমান্টিক জুটি বাঁধতেও দেখা গেছে। কিন্তু দায়িত্বের নিরিখে বিচার করতে গেলে সুচিত্রা-উত্তম জুটির কাছে সেগুলো খুবই স্বল্পায়ু কিংবা বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। ১৯৫৩ সালে সুচিত্রা অভিনীত পরপর তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ছবিগুলো হলো- ‘কাজরী’, ‘শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ ও ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। এর মধ্যে ‘শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ তাকে খ্যাতি এনে দিলেও ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিটিই ছিল উত্তম কুমারের বিপরীতে সুচিত্রার প্রথম অভিনয়। ১৯৫৩-এর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ থেকে শুরু করে পরবর্তী দু’দশকে সুচিত্রা-উত্তম জুটির হাসি-কান্না, চাওয়া-পাওয়া, রাগ-অনুরাগই রোমান্সের শেষ কথা হয়ে উঠেছিল। আজো তারা তেমনই উজ্জ্বল, তেমনই চিরসবুজ। ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে সুচিত্রা-উত্তম জুটি আরেক দফা ঝড় তোলেন। তাদের এ রোমান্টিক জুটির ব্যাপক সাফল্যের শুরু বলতে গেলে এ ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবি থেকেই। এরপর সুচিত্রাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে একের পর এক ছবি করেছেন। সেই সঙ্গে বাংলা সিনেমার রোমান্টিক জুটির ইতিহাসের ভিতটা একটু একটু করে শক্ত হয়েছে। ‘অগ্নিপরীক্ষা’র পর অর্থাৎ ১৯৫৪ থেকে ১৯৬১-এর মধ্যে সুচিত্রা-উত্তম জুটির প্রায় ষোলটি ছবি মুক্তি পায়। প্রত্যেকটি ছবিই যেন সুচিত্রা সেনের সাফল্যের ধারাবাহিক পথে এক-একটি মাইলস্টোন। এ ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পথে এক-একটি মাইলস্টোন। এ ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো ‘শাপমোচন’, ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’, ‘শিল্পী’, ‘হারানো সুর’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘চাওয়া পাওয়া’ এবং ‘সপ্তপদী’ ইত্যাদি।
উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে সুচিত্রা সেন সেদিন বিনোদনমূলক বাংলা ছবিতে যেন একটা নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিলেন। কুসংস্কারের জগদ্দল পাথরটাকে সরিয়ে দিয়ে বাঙালি দর্শকদের করে তুলেছিলেন আধুনিক। নর-নারীর প্রেমিবিষয়ক সম্পর্কটি নিয়েও নতুন করে ভাবনাচিন্তার দরজাটি খুলে দিয়েছিলেন। শুধু কি তাই? যদি প্রশ্ন করা হয়, সেই যুগে সুচিত্রা সেন কিংবা উত্তম কুমারের বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে কী অবদান ছিল? অবশ্যই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেই হবে, হিন্দি ছবিমুখী বাঙালি দর্শকদের সেদিন এই জুটি বাংলা ছবি দেখায় অভ্যস্ত করে তুলেছিল। এখানেই শেষ নয়। কিছুটা ভিন্ন ধারা, ভিন্ন রুচির ছবিতে অভিনয় করেও সুচিত্রা সেন দেখিয়ে দিয়েছিলেন অভিনয় ক্ষেত্রে তিনি কতটা পরিণত হয়েছেন। এরকমই একটি উজ্জ্বল উদাহরণ অজয় করের ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিটি। এ ছবিতে অভিনয় করেই সুচিত্রা মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সম্মান পেয়েছিলেন। অনেকেই বলে থাকেন অসামান্য সুন্দরী, রূপবতী সুচিত্রা সেন নাকি তার রূপ দিয়েই সিনেমায় রাজত্বটা অর্ধেক জয় করে নিয়েছিলেন। এ উক্তির মধ্যে ছিটেফোঁটা সত্য নিহিত আছে কি-না সন্দেহ। সুচিত্রা যে অসামান্য সুন্দরী ছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি দক্ষ অভিনেত্রীর পরিচয়ও রেখেছেন অসংখ্য ছবিতে। ‘সপ্তপদী’, ‘দ্বীপ জেলে যাই,’ ‘হারানো সুর’, ‘সাত পাকে বাঁধা এবং হিন্দি ‘দেবদাস’, ‘আঁধি’ ছবিগুলোই তো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। খুব অল্প সময়ের জন্যই তিনি হিন্দি ছবির জগতে প্রবেশ করেছিলেন। সেখানে তিনি অভিনয়ে কতটা অবদান রেখে গেছেন, সে কথা বিচার করবে ভবিষ্যৎ ইতিহাস। কিন্তু হিন্দি ছবিতে সুচিত্রার আত্মপ্রকাশ সেদিন যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ঘটনাও তো একটা ছোটখাটো ইতিহাস। অর্থাৎ সুচিত্রা যেখানে পা রেখেছেন সেখানেই তৈরি হয়েছে এক একটি নতুন ইতিহাস।
বাঙালি মানসসুন্দরী সুচিত্রা সেন কখনো গø্যামারাস নায়িকা কখনো স্নেহশীল মা, কখনো আটপৌরে বাঙালি বউ, কখনো আবার বুকে কাঁপন ধরানো সুন্দরী। কলকাতার বাংলা সিনেমা তো বটেই মুম্বাইয়ের হিন্দি সিনেমার নায়িকারাও একবাক্যে স্বীকার করে গেছেন সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিত্ব, স্মার্টনেস, তার হাঁটাচলা, তার বাচনভঙ্গি, চাউনি নকল করা অসম্ভব। অনেকেই নায়িকা হয়েছেন বা নায়িকা হতে পারেন, কিন্তু ক’জন অর্জন করতে পারে মহানায়িকার খেতাব। আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ তাকে এই শিরোপা তার মাথায় পরিয়ে দেয়নি। সবার স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসাই তাকে এই সম্মানে ভূষিত করেছে। যতদিন বাংলা ছবি বেঁচে থাকবে ততদিন অমর হয়ে থাকবেন সুচিত্রা। আগে ছবির টাইটেলে উত্তম- সুচিত্রা লেখা থাকত, পরে সেটা বদলে হয়েছিল সুচিত্রা-উত্তম। বাংলা সিনেমার অঙ্গনে সুচিত্রার পদার্পণের পর শুরু হয়েছিল নতুন এক অধ্যায়ের। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবারের তরুণী গৃহবধূর রমা পা রেখেছিলেন অভিনয়ের ভুবনে। এভাবেই বাঙালির স্বপ্নপূরণের নায়িকা সুচিত্রা সেনের রূপালি পর্দার স্বপ্নময় জগতে আত্মপ্রকাশ। বাঙালি জীবনের সেই হারিয়ে যাওয়া সুরই সেলুলয়েডে বেঁধেছিলেন সুচিত্রা-উত্তম জুটি। পাশের বাড়ির অতি চেনা-জানা ছেলে উত্তমের সঙ্গে স্বপ্নসুন্দরী সুচিত্রার ভালোবাসার গল্পে বাঙালি খুঁজে পেয়েছিল অপরূপ এক জাদুকাঠি। সেই স্বপ্নের প্রতিটি ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে কিছু না পাওয়া বাঙালির সব পাওয়ার স্বাদ। যে স্বপ্নের প্রতিটি ছত্রে রয়েছে সাদা-কালো জীবনের রঙিন হয়ে ওঠার কাহিনী। আরো লুকিয়ে আছে হাজার বছর হেঁটে বনলতা সেনকে হঠাৎ খুঁজে পাওয়ার অনাবিল আনন্দ। ওপার বাংলা-এপার বাংলার বাঙালির কাছে উত্তম কুমার মহানায়ক, সুচিত্রা সেন মহানায়িকা। সৌকর্য, সৌন্দর্য এবং সম্মোহনের অসাধারণ প্রতীক। প্রেমের আদর্শ উত্তম কুমারের সঙ্গে তার জুটি হয়ে উঠেছিল চিরন্তন প্রেমের প্রতীক। পর্দায় তাদের দু’জনের প্রেম ছিল বাঙালির গহিন অবচেতনে লুকিয়ে থাকা বৈষ্ণব গীতিকবিতার মতো। একটা সময় গেছে যখন উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত বিভিন্ন ছবির অনুকরণে নবদম্পতিরা ফটো স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলে আনন্দ পেতেন, পুলকবোধ করতেন।

দীর্ঘ ২৬ বছরের অভিনয় জীবনে মাত্র ৬১টি ছবিতে অভিনয় করেছেন বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ ছবিই দর্শকের হৃদয় বিপুলভাবে মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে রেখেছে। আজো বাঙালির ঘরে ঘরে সুচিত্রা জীবন্ত নায়িকা হিসেবে দর্শকদের নস্টালজিক করে রাখছেন। অগ্নিপরীক্ষা, হারানো সুর, দেবদাস, দীপ জ্বেলে যাই, সাত পাকে বাঁধা, সপ্তপদী, উত্তম ফ্লাগুনি, গৃহদাহ, আঁধি, দেবী চৌধুরানী, শাপমোচন, সবার উপরে, সাগরিকা, শিল্পী, পথে হলো দেরী প্রভৃতি ছবি দেখতে দেখতে দর্শক আজো হারিয়ে যান মুগ্ধতার আবেশে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ারের সব ছবিতেই তাকে নিত্যনতুন তরতাজা একেকটি অবয়বে দেখা গেছে। সুচিত্রা সেন নামটিতেই যে অনিন্দ্যসুন্দর অবয়ব ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে রূপকথার সেই রাজকন্যাকে। কোনো এক পরীর জাদুতেই হয়তো সুচিত্রা জয় করে নিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের মন। সুচিত্রার চিবুকের তিল, সুবিন্যস্ত দাঁত, টিকালো নাকেরা চেয়েও দর্শক ভালোবেসেছিলেন তার বাঙময় চোখ আর সেই চোখের ভাষা। থ্রি কোয়ার্টার হাতার কাজ করা ব্লাউজ, শাড়িতে লেস এমনকি শুধু বেণীবাঁধা চুলকে সামনে নিয়ে আসার স্টাইলে পঞ্চাশের দশকেও সুচিত্রা পুরোপুরি আধুনিক। শাপমোচন, চন্দ্রনাথ, ত্রিযামা, ইন্দ্রাণী, পথের দাবি- যে ছবিরই কথা বলা হোক না কেন তার স্টাইল, ফ্যাশন, সৌন্দর্য এক কথায় আইকনিক। আটপৌরে বাঙালি নারীও যে আবেদনময়ী আর অনন্য হয়ে উঠতে পারেন, সুচিত্রা সেন যেন তার প্রকৃত উদাহরণ। ১৯৩১-এ সুচিত্রার জন্ম বাংলাদেশেই। দেশ বিভাগের আগেই তার বাবা-মা বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেও এখানকার সোঁদা মাটির গন্ধ সবুজ-শ্যামল প্রান্তরের মায়াবী হাতছানি ভুলতে পারেননি তিনি। বারবার এখানকার প্রকৃতির কোলে ফিরে আসতে চেয়েছেন। তার শেষ ছবি ‘প্রণয় পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে। তারপর তাকে আর কোনো নতুন ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যায়নি। ১৭ জানুয়ারি ছিল বাঙালির মানসসুন্দরী, মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের মৃত্যু দিবস। মৃত্যু দিবস উপলক্ষে তার প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়