দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ : চট্টগ্রামে বিএনপির বিক্ষোভ

আগের সংবাদ

ঢিমেতালের ফাঁদে সোনালি ব্যাগ : সিলিং মেশিনে আটকে আছে উৎপাদন, বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ

পরের সংবাদ

আনতারা

প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আনতারা নামটির অর্থ বীরাঙ্গনা।
বীরাঙ্গনা শব্দটি শুনলেই সুধাংশু বিশ্বাসের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে হয়। সেই সময় তিনি ছিলেন এক দুরন্ত কিশোর। সুধাংশুর বাবা সুবল বিশ্বাস ১৯৭১ সালে সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য। বাবার মুখে যুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছে সে। গোলাগুলি, রক্ত আর প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর সেই দিনগুলো এত বছর পর এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে তার। চোখে ভাসে ভয়ানক দিনগুলোর ভুলে যেতে চাওয়া স্মৃতিগুলো। বাবাকে হারানোর স্মৃতি। যুদ্ধ মানেই তো হত্যা, নৃশংসতা, ক্ষত-বিক্ষত লাশের বহর। তবুও এসব না পেরুলে নিজের একটি স্বাধীন দেশ পাওয়া হতো না।
সুধাংশুর বড় মেয়েটি জন্মেছিল দেশ স্বাধীন হবার প্রায় বাইশ বছর পর। মেয়ের সাথে যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই, ছিল না। তবুও স্ত্রী মৃন্ময়ী দেবীর গর্ভের সন্তানটি যখন সময়ের আগেই পৃথিবীতে চলে এলো, তখন বাড়ির দাইটি বলেছিল, ‘তোর বেটি মস্ত বড় পালোয়ান বাহে। অঁই বাঁচি থাকপে। আগোত হইচে জন্যে মরণ উয়্যাক নিব্যার পাইরব্যান্নায়।’
দাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে সুধাংশুর আবারো মনে পড়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের কথা। তাই তিনি কন্যার নাম রাখলেন- আনতারা।
আনতারা ছোটবেলা থেকেই ভীষণ ছটফটে ও চঞ্চলা। বাবার আদর বেশি কাড়ে, নাকি মায়ের মমতায় বেশি আদৃত হয়, সঠিক করে মেপে বলা কঠিন। কিন্তু সে তার বাবা ও মায়ের দুই চোখে দুটি স্বপ্নের তারার মতন ভীষণ প্রিয়। আনতারার দুই বছরের ছোট ভাই প্রণব, সারাক্ষণ বোনের সাথে থাকে। আনন্দ, বেদনা হাসি কান্নায় মাতিয়ে রাখে এই দুটি তাদের সুখী গৃহকে।
যুদ্ধের সময় একবার শখ করে পাকিস্তানিদের দেখতে গিয়ে সুধাংশুর ডান পায়ে একটা গুলি এসে লেগেছিল। গুলিটি হাঁটুর ওপর মাংস পেশির ভেতরে হাড়ের খুব কাছ কেটে বেরিয়ে গিয়েছিল বলে বাঁচা। পা কেটে ফেলতে হয়নি। কিন্তু সুধাংশু দুই পায়ে সমান জোর পান না এখন আর। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পাদটি আরো অকেজো হয়ে পড়েছে। সংসার চালানোর জন্য সে এখন নদীতে মাছ ধরার কাজ করে। নিজের নৌকা নেই, তাই ভোলানাথ, শিবু, হারাধনের বড় নৌকায় যুগালি দিয়ে মাছ ধরতে যায় নদীতে। রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর কসবা হিন্দু জেলে পল্লীতে বাস করেন এরা সবাই। অনেক বছর ধরে পাশাপাশি থাকায় পরিবারগুলো আত্মীয় না হয়েও পরমাত্মীয়ের মতো সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে নিজেদের ভেতর।
আনতারা যুবতী হয়েছে। পণের টাকা জোগাড় হয়নি বলে মেয়ের বয়স ত্রিশ পার হয়ে যাবার পরও তাকে পাত্রস্থ করা যাচ্ছে না, এই নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা সুধাংশুর মনে। ছেলেটি তবু পীরগঞ্জ সদরে একটা মুদি দোকানে কাজ করে। সুধাংশু ভাবছেন ছেলেটিকে বিয়ে দিয়ে যদি কিছু টাকা পয়সা পাওয়া যেত মেয়ের পরিবার থেকে, তাহলে তিনি আদরের মেয়ে আনতারার জন্য একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারতেন।
চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষ, দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। সুধাংশুদের হিন্দুপল্লীতে ভীষণ খুশির আমেজ। সবার মন উৎফুল্ল। কিন্তু আনন্দ স্থায়ী হলো না। সপ্তমীর দিন জেলেপল্লীর সবার ভেতর খুব উৎকণ্ঠা দেখা গেল। পাশের ঘরের শিবু এসে প্রথম সংবাদটি দিলো, ‘দাদা শোনচেন? ফির বিপদ আইলো হামার।’
সুধাংশু বলে, ‘হ। শোনচোঁ। হাটখোলাত দোকানোত টিপিত খবর দ্যাখছোঁ। কুমিল্লাত বোলে মন্দিরোত কোরান শরিপ পাওয়া গেইছে। হামার ছিরি রামের সাঁতের হনুম্যানের পায়ের নেচোত কেবা মোসলমানের বইখ্যাঁন থুইচে।
মৃন্ময়ী ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। একটা পিঁড়ি টেনে নিয়ে বসল পাশে। বললো, ‘হায় রাম! মন্দিরোত কোরান ঢোকলে কি হয় বাহে? হুনম্যান ফির কোরান পড়ি দ্যাখফে নাকি? এইগল্যা কোন কথা হইলো বাহে?’
শিবু উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘বইন! এইগল্যা ইচ্চ্যা করি কচ্ছে কাঁইয়ো। এই দ্যাশোত হেন্দুর ঘরোক থাইকপ্যার দিব্যান্নায়। হামাক দ্যাশ থাকি ক্ষ্যাদে দিব্যার জন্যে ওরায় মন্দির, হেন্দু বেইচ্ছোইল, হেন্দুর ভূঁই সোগগুল্যাত অইত্যাচার কত্তুছে। দুই দিন পর পর নানান ভ্যাঁংতা ওমার।’
সুধাংশু শূন্য দৃষ্টিতে বসে থাকল অনেকক্ষণ। দুই গালে হাত রেখে বলে, ‘হামার দ্যাশ ছাড়ি হামরা কোনঠে যাঁমো বাহে? দ্যাশ শাদিন কইরব্যার যায়া হামার বাপ মরি গেইছে। হামরা ইতিম হছি। যোদ্ধের সমায় মুইও সাহাজ্য কচ্ছোঁ মুক্তিবাহিনিক। হামার বাপ দাদা চোদ্দ গুষ্টি এই ভিঁট্যাত হইচে। দ্যাশ ছাড়ি কোনঠে যামো হামরা?’
মৃন্ময়ী চোখের জল শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে ঘরের ভেতরে গেল। ফিরে আসে একটি বাটিতে কিছু মুড়ি আর কয়েকটি নারকেলের নাড়ু নিয়ে।
শুকনো মুড়ি চাবাতে চাবাতে শিবু বললো, ‘মুঁই শুননু কুমিল্লাত, চাঁদপুরের গোড়োত বোলে ভাঙ্গাভাঙ্গি হইচে। হেন্দুর মন্দিরোত মোসলমানের বই ঢোকলে ধর্মের ক্ষতি না হইলেও মোসলমানের ঘরে সর্বনাশ হয়া গেইছে। মোসলমানের চায়া জাতপাত বোলে হেন্দুরে বেশি? অ্যালা দেখতুছোঁ সোগ উল্ট্যাপাল্টা।’
মৃন্ময়ী রাগে ফুঁসে উঠে বলে, ‘জাত পাত মারাইছে। এইগল্যা খালি হামার খ্যাদে দেওয়ার বুদ্দি। অ্যাখে মাটির মানুষ। ওমার অক্ত নাল? হামার অক্ত কি ধলা?’
বুক ভেঙে কান্না আসতে চায় তাদের। হাহাকারের মতো শোনায় কথাগুলো। ভয়ে চিমসে আছে তাদের চোখ মুখ। শিবু ফিসফিস করে বলে, ‘অবস্তা ভালো নোয়ায় কিন্তু। মোসলমানেরা হেন্দুর বাড়িত ডাঙ্গাডাঙ্গি কত্তুছে। মানুষ মারি ফেলাইতুছে। সোগ জিনিস কাড়ি নিতুছে। সোগগুল্যা আক্ষইশ।’
কুমিল্লায় নানুয়ার দীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপের এই ঘটনাটি অমীমাংসিত থাকতেই ঘটে গেলো আরেকটি ভয়ানক ঘটনা। বিজয়ার দিন দশ বছরের একটি হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে মুসলমান ধর্মের কেউ। সিঁদুর খেলার আনন্দপূর্ণ বিজয়া পরিণত হলো রক্তাক্ত শারদে। অনলাইনে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানবতাবাদী মানুষ প্রতিবাদের ঝড় তুলে ফেললো।
এসব বিক্ষোভ গুঞ্জনের ভেতর কয়েকটি দিন কোনোরকমে পার করতেই এলো আরেক ভয়ংকর অধ্যায়। সুধাংশুদের জেলেপল্লীর বাসিন্দা প্রশান্ত কুমার। শোনা গেল, প্রশান্তের ১৬ বছরের ছেলে পরিতোষ নাকি ফেসবুকে একজনের পোস্টের কমেন্টে মুসলমানদের পবিত্র ঘর কাবা শরীফের ব্যঙ্গ ছবি পোস্ট করেছে। তাই রাত দশটার দিকে, কিছু উত্তেজিত মানুষ পল্লীতে এসে পরিতোষকে খুঁজছে। তারা জেলেপল্লীর চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। ভয় পেয়ে পরিতোষ এবং তার পরিবারের সবাই পালিয়ে গেল পল্লী থেকে। ক্ষিপ্ত লোকগুলো জেলেপল্লীর অর্ধশতাধিক বাড়িতে হামলা করে, আগুন লাগায় এবং লুটপাট করে। প্রাণ বাঁচাতে আর সবার মতো সুধাংশু নিজের স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েকে নিয়ে পাশের ক্ষেতে গিয়ে লুকালো। সবাই যথাসম্ভব পা টিপে টিপে হাঁটছে। কথা বলছে ফিসফিস করে। কানের কাছে মশা আর পোকার দল শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে, কামড়ে দিচ্ছে, কিন্তু কারো ভ্রæক্ষেপ নেই সেদিকে। একটু শব্দ করে মৃন্ময়ী বলে উঠলো, ‘আনাতারায় কি তোমার গোড়োত?’
মৃন্ময়ীকে চাপা ধমকে দিলো সুধাংশু, ‘চুপ করেক। কথা কইলে সবাখে মারি ফেলাইবে।’
মৃন্ময়ী অন্ধকারে স্বামীর হাত ধরে বললো, ‘আনু কোনঠে? আনুক দেখতুছোঁ না ক্যান?’
‘আনু ন্যা তোমার গোড়োত আছিল?’
‘আছিল তো। অ্যালা ক্যাম্বা দেখতুছোঁ না? হামার আনু কোনঠে হারে গেলো?’
সুধাংশু কেঁপে উঠেন। ক্ষেত থেকে বেরিয়ে গিয়ে খুঁজতে চান মেয়েকে। কিন্তু মৃন্ময়ী স্বামীর হাত ছাড়ে না, ‘না। তোরা অ্যালায় যাবান্নান। আনু বোদায় নুকি আছে কোনোঠে। থাউক। বিয়ানবেলা পাওয়া যাইবে।’
সারারাত জেলেপল্লীর অধিকাংশ মানুষ ক্ষেতের ভেতর লুকিয়ে থাকলো মুসলমানের হাতে ধরা পড়ার ভয় আর সাপের কামড়ের ভয় নিয়ে। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা জেলেপল্লীর আগুন নেভাতে আর লুটপাটের দাঙ্গা থামাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পৌঁছে গিয়েছে। পুলিশ অর্ধশতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কয়েক জনকে গ্রেপ্তারও করে নিয়ে গেল। ভোরের দিকে চারপাশ থেকে মাইকিং শোনা গেল। সরকারি লোকজন তাদের সবাইকে ক্ষেত থেকে বেরিয়ে আসতে বলছে, ‘তোমাক ভয় নাই বাহে? বারে আইসো। তোমাক কেউ মাইরব্যান্নায়।’
‘ক্ষেতের ভেতর থেকে বেরিয়ে মানুষগুলো প্রথমেই ছুটে গেল নিজের বাড়ির কাছে। বুক ভাঙা আর্তনাদে ফেটে পড়তে চাইলো জেলেপল্লীর পুরোটা আকাশ। আর্তনাদে আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে বাতাস। ‘হায় ভগবান! হামার ঘর কোনঠে? হামরা অ্যালা থাকমো কোনঠে?’ ঘর বলতে এখন পল্লীতে পড়ে আছে শুধু পোড়া ছাই-ভস্ম। অনেকগুলো দরিদ্র পরিবারের মাথা গোঁজার সামান্য ঠাঁইটুকুও চলে গেল অল্প কিছু মানুষের ক্রোধের দাবানলে পুড়ে।
সুধাংশু পোড়া ভিটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর আবার ক্ষেতের দিকে দৌড়ে গেল। যেতে যেতে মৃন্ময়ীকে বলল, ‘আনাতারাক উকটি আইসোঁ। চেংড়িট্যা যে কোনঠে গেল?’
স্বামীর পেছন পেছন মৃন্ময়ীও দৌড়ে যান ক্ষেতের কাছে। অল্প খুঁজতেই ক্ষেতের একপাশে পেয়ে গেলেন আনতারার রক্তাক্ত, বিবস্ত্র, ক্ষত-বিক্ষত লাশটি। মাটির উপর বসে পড়েন মৃন্ময়ী। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছেন। সুধাংশু তার গলার গামছাটি দিয়ে ঢেকে দিতে চেষ্টা করে মেয়ের লজ্জা। রাতে পালানোর সময় দানবেরা তার মেয়েটিকে মুখ চেপে ধরেছিল এইখানে। উপর্যুপুরি ধর্ষণ করে যাবার সময় মেয়েটির মাথা ইটের আঘাতে থেতলে দিয়ে গেছে। শুধু আলাদা ধর্ম বিশ্বাসের কারণে এত আক্রোশ হয় মানুষের ওপর মানুষের! মেয়ের পাশে সুধাংশু পাথর হয়ে বসে থাকেন। মৃন্ময়ীর মতো তার চোখ থেকে জলের ধারা নেমে আসে না। তার চোখ দুটিও যেন পাথরে পরিণত হয়েছে। একজন বীরাঙ্গনার বাবা সে, তাকে তো ভেঙে পড়লে হবে না। মেয়ের সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে যে তাকেই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়