দেয়াল চাপায় শিশুর মৃত্যু : কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইনি নোটিস

আগের সংবাদ

বিজয়ী বিদ্রোহীদের ভাগ্যে কী আছে : সিদ্ধান্ত অমান্যকারীরা সাময়িক বহিষ্কার > ১৯ নভেম্বর আ.লীগের সভায় আসতে পারে নতুন সিদ্ধান্ত

পরের সংবাদ

ঢিমেতালের ফাঁদে সোনালি ব্যাগ : সিলিং মেশিনে আটকে আছে উৎপাদন, বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : শুধু বাংলাদেশ নয়, পলিথিন নিয়ে চিন্তিত সারা বিশ্ব। প্রতিদিন লাখ লাখ টন পলিব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ব্যাপক মাত্রায় ঘটাচ্ছে পরিবেশ দূষণ। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ হয় ২০০২ সালে। তারপরও দেশে পলিথিনের উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ হয়নি। সহজলভ্য বিকল্প না থাকায় বরং দিন দিন বাড়ছিল অপচনশীল ও ক্ষতিকর পলিথিনের বহুবিধ ব্যবহার। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে আশার আলো দেখিয়েছিলেন আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক মোবারক আহমদ খান। পাটের সেলুলোজ থেকে তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন পরিবেশবান্ধব ‘সোনালি ব্যাগ’, যাকে ভাবা হচ্ছিল ক্ষতিকর পলিথিনের নির্ভরযোগ্য বিকল্প। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছরেও এ ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসেনি। সরকারি তরফে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখানোর পরও ঢিমেতালে চলছে অতি গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি। প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) বলছে, এটি গবেষণাধর্মী একটি কাজ। তাই সময় একটু বেশি লাগছে। এদিকে নির্ভরযোগ্য বিকল্পের অভাবে বাজার সয়লাব হয়ে আছে নিষিদ্ধ পলিথিনে। এজন্য আন্তরিকতার সঙ্গে এ পণ্যটিকে দ্রুত বাজারে আনার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মোবারক আহমদ খান ২০১৬ সালে ‘সোনালি ব্যাগ’ উদ্ভাবন করেন। এরপর তাকে বিজেএমসির বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তার এ আবিষ্কার দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলায় ব্যাগটি বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনা যায়নি সোনালি ব্যাগ। বিজেএমসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাণিজ্যিকভাবে সোনালি ব্যাগ বাজারে আনার ক্ষেত্রে মূল জটিলতা এখন একটি স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটেড) ব্যাগ সিলিং মেশিন। এ বিষয়ে কাজ চলছে।
‘সোনালি ব্যাগ’ দেখতে প্রচলিত পলিথিনের মতোই। এটি হালকা-পাতলা ও টেকসই। পাটের সূ² সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে এ ব্যাগ তৈরি করা হয়। একটি ব্যাগ একাধিকবার ব্যবহার করা যায়। এটি সেলুলোজভিত্তিক বায়োডিগ্রেডেবল বায়োপ্লাস্টিক। পলিথিনের তুলনায় পাটের পলিমার দেড় গুণ বেশি ভার বহন করতে পারে। এটি পানি শোষণ না করলেও ফেলে দেয়ার কিছুদিনের মধ্যে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ফলে এটি পরিবেশ দূষিত করে না। এটিকে তাই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে ভাবা হচ্ছে।
এদিকে বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও পাখি ও জলজপ্রাণী। এ ছাড়া রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণও পলিথিন। শুধু ঢাকায়ই প্রতিদিন এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ জমা হয়। ২০০২ সালে দেশে আইন করে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাত ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়। দামে সস্তা ও অন্য কোনো বিকল্প না থাকায় নানা

সরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোবারক আহমেদ খান আবিষ্কৃত পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ উৎপাদনে ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল ‘অধিকতর গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ ও সম্পাদন’ শীর্ষক প্রকল্পে বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ৯ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও সেই অর্থ কাজে লাগানো যায়নি। এ অবস্থায় আগামী জুলাই মাস পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ওই টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্য কেনা হবে বলেও জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে ঢাকার ডেমরার শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে সরকারি পাটকল লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে প্রতিদিন হাজারখানেক সোনালি ব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে। শুধুমাত্র বিজেএমসির মতিঝিল কার্যালয় থেকে প্রতিটি ব্যাগ ১০ টাকা দামে কেনা যায়।
এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করতে না পারা এবং সময়ক্ষেপণে হতাশা ব্যক্ত করেছেন নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশের (এনসিসিবি) ব্যবস্থাপক (রিসার্চ এন্ড এডভোকেসি) ড. মুহাম্মদ ফররুখ রহমান। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিতে থাকা জনগণের স্বার্থে এ প্রকল্পগুলো নেয়া হলেও সেখানে মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ মনিটারিং ব্যবস্থাও অনেকক্ষেত্রে খুব দুর্বল। যে কারণে প্রকৃত সুফল জনগণ পায় না। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মনিটারিং ব্যবস্থা জোরদারের আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় পলিথিনের বিকল্প পচনশীল ‘সোনালি ব্যাগ’ বাণিজ্যিকভাবে দ্রুত বাজারে আনারও তাগিদ দেন ড. ফররুখ।
সোনালি ব্যাগের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রউফ ভোরের কাগজকে বলেন, সোনালি ব্যাগ তৈরির কার্যক্রম স্তিমিত হয়নি। আগের মতোই চলমান রয়েছে। পাইলট প্রজেক্টের আওতায় এখন আমাদের এক টন ব্যাগ তৈরির ক্যাপাসিটি হয়েছে। এখন প্রক্রিয়াটা আরো উন্নত করতে হবে। আমরা এখনো বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যেতে পারিনি। তবে আমাদের পাইলটিং প্রায় শেষের দিকে।
তিনি বলেন, এটি একটি গবেষণামূলক কাজ। সুতরাং গবেষণা করে কাজটা সম্পন্ন করতে সময় দরকার। জলবায়ু তহবিলের অর্থায়ণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জলবায়ু তহবিল থেকে যে অর্থায়ন করা হয়েছে আমরা তার মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছি। প্রথম কিস্তির টাকা আমাদের কাছে দীর্ঘদিন ছিল। কিন্তু মেয়াদভিত্তিক কাজ না করার কারণে আমরা তা খরচ করতে পারিনি। তিনি আরো বলেন, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের নিয়ম হচ্ছে, কোনো প্রকল্প যদি ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকে তাহলে ওই প্রকল্পের অর্থ পরবর্তী বছরের জানুয়ারির ১ তারিখে খরচ করতে পারব না। সুতরাং ওই টাকা থেকে কোনো লাভ হবে না। টাকাটা আমাদের তহবিলের অ্যাকাউন্টে ছিল, কিন্তু মেয়াদ না বাড়ানোর কারণে আমরা খরচ করতে পারছিলাম না। এজন্য মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ টাকা দিয়ে মেশিন কেনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
আবদুর রউফ বলেন, স্থানীয়ভাবে কিছু মেশিন দিয়ে সিলিংয়ের কাজ করা যাচ্ছে। বিজ্ঞানী মোবারক আহমেদ খান আমাদের এ বিষয়ে আস্বস্ত করেছেন। আমাদের দেশে যে মেশিনগুলো দিয়ে পলিথিনের ব্যাগ তৈরি হয়, সেটি তাপে কাজ করে। কিন্তু তাপে তো এটা কাজ করবে না। তাপ দিলে এটা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এডিটিং ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে হোক বা অন্য কোনো উপায়ে হোক এটাকে জোড়া লাগিয়ে ফাইনালি ব্যাগ তৈরি করতে হবে। এডিটিং ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে এবং আলট্রাসাউন্ড দিয়েও ব্যাগ জোড়া লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিজেএমসির চেয়ারম্যান আরো বলেন, আমরা একবার মেশিনপত্র কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী মেশিন পাওয়া যায়নি। আবারো দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এখন আমরা যে ৩০০-৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করব, তা কোথায় করব? গবেষক যদি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী এবারও মেশিনপত্র না পান তাহলে আরো পিছিয়ে যাবে বাণিজ্যিক উৎপাদন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সোনালি ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে এখনো একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত দেশে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে হলে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ এ ব্যাগ উৎপাদন করতে হবে। এ জন্য উচ্চতর প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া দামও সহজলভ্য হতে হবে। বর্তমানে একটি ব্যাগের দামই নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা, যা পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। যদি এ ব্যাগ খুবই কম দামের মধ্যে না আনা যায়, তাহলে তা কাগজের ব্যাগের মতো অভিজাত দোকানগুলোতেই বন্দি হয়ে থাকবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়