ডায়েট ভুলে জমিয়ে খান নুসরাত

আগের সংবাদ

অভিযানে কোণঠাসা কেএনএফ

পরের সংবাদ

ঘোর

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঘোরটা থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়ে আতিক। এমন ঘোরলাগা অনেকদিন কাজ করে না। শীতের দুপুরে তো ঘুমানোই হয় না; ঘোরটা লাগবে কীভাবে? একটা সময় নিয়মিত ভাতঘুম দেয়া হতো। শীতকালে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সন্ধ্যা নেমে আসত। শরীরের মধ্যে অন্যরকম একটা ঘোরলাগা ভাব কাজ করত। এভাবে হাঁটতে খুব ভালো লাগে। হাঁটতে হাঁটতে যখন ক্ষুধা চেপে ধরত তখন এক কাপ চায়ের সঙ্গে একটা সিঙ্গাড়া; ওতেই জীবনের সব সাধ মিটে যেত যেন। যেদিন বাবার হোটেল ছেড়ে শহুরে জীবিকাব্যস্ততায় নিজেকে জড়ালো, সেদিন থেকেই এই ভাতঘুমসহ আরো অনেক কিছুকেই ছেড়ে দিতে হয়েছে। ভাতঘুম তো দূরে থাক, বাল্যবন্ধুর মতো প্রিয় বিকেলটাও বেদখল হয়ে গিয়েছে কবে! কর্পোরেট অফিসে কাজ। অফিস সেরে যখন রাস্তায় বেরোতো; সারাদিন তাপ দিয়ে নগর পুড়িয়ে সূর্য ততক্ষণে ক্লান্ত-শ্রান্ত। কোনো কোনো দিন তো বিকেলের সূর্যের সঙ্গে দেখাই মিলতো না। সন্ধ্যা যখন বিকেলের গলা টিপে ধরে রেখেছে তখনো একগাঁদা ফাইল আতিকের ঘাঁড়ের ওপর চড়ে থাকত। কোনোমতে শেষ করে লোকাল বাসে চড়ে বাসায় ফিরতে রাত ১০টা পার। রান্না-বান্না করে রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় যেতেই রাত একটা। এরপর প্রযুক্তির দুনিয়ায় ঘোরাঘুরি। সকালে জ্যাম লাগার আগে পৌঁছানোর তাড়া। ছুটির দিনেও রাজ্যের কাজ। এভাবে দেখতে দেখতে কেটে যেত দিন-মাস-বছর। আধঘুমেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো তখন, ভাতঘুম ছিল কল্পনাতীত। জীবন তো এমনই। যখন যেমন। মানিয়েও নিয়েছে সে। হঠাৎই ছন্দপতন। হুট করে চাকরিটা চলে গেল। করোনার দোহাই দিয়ে লোকবল কমাতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অন্যসব প্রতিষ্ঠানেও একই অবস্থা। কোথাও কোনো চাকরি নেই। প্রথম ক’দিন ছোটাছুটি করেছে বেশ। সবাই কেবল আশ্বাসই দেয়। সম্ভাব্য সবখানে সব উপায়ে চেষ্টা করেছে। এখন মিরাকলের অপেক্ষা। বাবা বলতেন- ‘জীবনটা মিরাকলে ঠাসা। কোনো কাজই হিসাব মতো হয় না। হবে না। তুমি পরিকল্পনা করে যে কাজের সহজ সমাধান মিলিয়ে বসে থাকবে, দেখবে সেটাতেই কোনো না কোনো ঝামেলা তৈরি হয়েছে। যা ভেবেছ, হয়েছে তার উল্টো। অপরদিকে যে কাজের কোনো সমাধান তোমার মাথায় ধরবে না। কোনো কূলকিনারা পাবে না, দেখবে কোথা দিয়ে কীভাবে সে কাজটি ঠিকঠাক হয়ে গেছে। একইভাবে যে মানুষগুলোকে তুমি বিপদে পাশে পাবে বলে ধরে রাখবে, সে অনুযায়ী সম্পর্ক রাখবে; দেখবে সময়মতো কাউকেই পাশে পাবে না। পাশে পাবে এমনজনকে, যাকে দিয়ে তুমি চিন্তাই করোনি। অথবা হতে পারে তাকে আগে চিনতেও না। তাই বলা যায়, সমস্ত কিছু নির্ধারিত হলেও নিশ্চিত নয়।’ যখন বাবা কথাগুলো বলতেন, অনেকটা বিরক্ত নিয়েই শুনতো আতিক। তখন ধারণা ছিল, বৃদ্ধ হলে মানুষ এমনই বেশি কথা বলে। তাদের সঙ্গ দেবার মতো কেউ না থাকায় যাকে পায় ধরে জ্ঞান বিতরণে লিপ্ত হয়। এতে কিছু সময় তো খরচ করা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে আতিক বুঝেছে, জীবনের প্রয়োজনে, জগতে চলার প্রয়োজনে বাবা কথাগুলো জানিয়ে দিয়েছেন। এক জীবন খরচ করে বাবা যে শিক্ষা অর্জন করেছেন, তা-ই দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ছাত্রজীবন শেষ করে যখন চাকরির জন্য ঘোরাঘুরি করতে থাকে তখন থেকেই আতিক উপলব্ধি করতে পারে বাবার বলা চরম বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো। এলাকার যে বড়ভাই, পাড়াতো চাচা, কাছের-দূরের সব আত্মীয়; সবাই-ই বাড়িতে গেলে পড়াশোনার খোঁজ নিত। চাকরির আশ্বাস দিত, তাদের কাছে এসে কোনোরকমই সহযোগিতা পায়নি। স্কুলে পড়াকালীন অনেকেই বলেছেন- ‘পড়াশোনা শেষ করে যোগাযোগ করো, আমরাই চাকরির ব্যবস্থা করবো।’ তাদের কাউকেই তখন পাওয়া যায়নি। ফোন করলে প্রথমে আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বললেও চাকরির প্রসঙ্গ এলেই নানা ব্যস্ততা দেখিয়ে পরে ফোন করতে বলতেন। চাকরি পত্রিকা দেখে দেখে প্রতি সপ্তাহে গাঁদা গাঁদা অ্যাপ্লিকেশন পাঠাতে হতো। প্রতিটির পেছনে আবার পরীক্ষার ফি বাবদ ব্যাংক ড্রাফট করতে হতো। টুকটাক টিউশনি করে যা পেত তা দিয়ে নিজের চলাই সম্ভব হতো না। চাকরির অ্যাপ্লিকেশন করার টাকা বাড়তি চাপ। কী করবে, অ্যাপ্লিকেশন না করতে তো আর চাকরি হবে না। বাধ্য হয়েই একের পর অ্যাপ্লিকেশন পাঠাতে হতো। প্রথমে গণহারে পাঠালেও পরে খরচের লাগাম টানতে বেছে বেছে পাঠাতে হতো। পরীক্ষার কার্ড আসতো অধিকাংশেরই। পরীক্ষায় অংশ নিতে যেতে হতো শহরে। সেখানেও খরচ। সব মিলে যখন আর কুলিয়ে উঠতে পারছিল না তখন শহরে আসতে হয় বাধ্য হয়ে। প্রথমে ভেবেছিল খণ্ডকালীন কোনো কাজের ব্যবস্থা হলে পাশাপাশি চাকরির চেষ্টাটা চালিয়ে যাবে। অতটুকু সহযোগিতাও কেউ করেনি তখন। কারো কাছেই ধরনা দিতে বাদ রাখেনি। মনে পড়ল একদিন পশ্চিম পাড়ার মসলেম কাকার বড় ছেলে মফিজ বলেছিলেন- ‘যে কোনো প্রয়োজনে জানইস, আমি আছি তোর জন্য।’ শহরে অনেক বড় চাকরি করেন তিনি। সেবার তার মায়ের অসুখের খবর শুনে মধ্য রাতে ছুটে এসেছিলেন একা। আমাবশ্যার রাত। মেইনরোডে গাড়ি নামিয়ে দিবে। সেখান থেকে ৭/৮ কিলোমিটার ভেতরে তাদের গ্রাম। তখন চারদিকে ডাকাত-ছিনতাইকারীর ভয়। কে তাকে এগিয়ে আনবে? ফোন করেন আতিককে। আতিকই তখন একা গিয়ে এগিয়ে এনেছিল। শুধু সেবার কেন? সব সময়ই গ্রামে যে কোনো প্রয়োজনে আতিককেই ফোন করত। আতিকও করে দিত দায়িত্ব নিয়ে। সেবার আসতে আসতেই মফিজ ভাই যে কোনো প্রয়োজনে ফোন করার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন- ‘মন দিয়ে লেখাপড়াটা শেষ কর, চাকরির ব্যবস্থা আমিই করব। অনেক মন্ত্রী-আমলার সঙ্গে ওঠাবসা আমার। একটা চাকরি দেয়া কোনো ঘটনাই না।’ সেই মফিজ ভাইও ফোন করলেই ব্যস্ততা দেখাতে শুরু করল। দেশের পরিস্থিতি, বাস্তবতা বোঝানোর ছলে বুঝিয়ে দিল আসল বাস্তবতা। শেষে কোথাকার কোন বন্ধুর বন্ধু থাকার জায়গা দিল, চাকরি খুঁজে দিল। এরপর অবশ্য অনেকে যেচে সখ্যতা গড়তে এসেছেন। সেই ব্যস্ততা দেখানো মানুষগুলো অনেক অবসর গল্প করতে ডেকেছে আতিককে। দাওয়াত করেছে বাসায়। অভিমানী আতিক অবশ্য কৌশলে দূরেই থেকেছে। অভিমানের কথা না বললেও হৃদয় থেকে তাদের সঙ্গে আর মিশতে পারেনি। যে আপনজন বিপদে কাজে আসে না সেই আপনজনের চেয়ে একলা চলা ভালো। এতদিনে একলা চলা শিখে গেছে আতিক। চলছিল তো বেশ। হঠাৎ আবার চাকরিটা খুইয়ে বেকায়দায় পড়তে হলো। না, এখন আর তেমন দুঃখবোধ নেই। কোনোকিছুতেই তেমন খারাপ লাগে না। বুকের মধ্যে চাপ অনুভব হলে বড়জোর একটার জায়গায় আরেকটা সিগারেট ধরাতে হয়। রোডলাইটের নিয়ন আলোর সঙ্গে ধোঁয়ার কুণ্ডলির যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারলেই সব দুঃখ পালিয়ে যায়। সুখের বেলায়ও তাই। অত সহজে এখন আর আপ্লুত হয় না আতিক। উপরি পাতে মাংসের একটি বাড়তি টুকরা পেয়ে খুশিতে নেচে ওঠা আতিক ফাইভস্টারে খাওয়ার সময়ও কোনো বাড়তি আনন্দ পায় না এখন। একইভাবে আগে আশা-পাশের গ্রামের কারো মৃত্যুর সংবাদ শুনলেও হৃদয়টা ভার হয়ে থাকত। থোকা থোকা বেদনা টের পাওয়া যেত। এখন আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুতেও অতটা নাড়া দেয় না। মনে হয়- মৃত্যুই তো একটা

সমাধান। এই জটিল জীবনের সব হিসেবের সমাধান মেলে ওই মৃত্যুতে। দৈন্দিন ছোটখাটো বিষয় তো পাত্তাই দেয় না। আসলে এখন কোনোকিছুই হৃদয়ে সহজে নাড়া দিতে পারে না। মাঝেমধ্যে কেবল ভাবে- যান্ত্রিক জীবনে ক্রমে মানুষের অনুভূতিগুলো বুঝি এভাবেই হারিয়ে যায়। আবেগপ্রবণ আতিককে করে তোলে শহুরে যান্ত্রিক নাগরিক। যেন পাথরের মূর্তির মধ্যে কোনো যন্ত্র সেট করে দেয়া হয়েছে। অদৃশ্য কারো নির্দেশে কাজ করছে। জ্বালানি হিসেবে খাদ্য গ্রহণ করছে, বর্জ্য ত্যাগ করছে, খানিক বিরতি দিয়ে চলছে। নরম-কোমল সেই আতিক হারিয়ে গেছে অজানায়। যে আতিক স্কুল থেকে বিদায় নেয়ার সময় হাউমাউ করে কেঁদেছিল প্রতিটি বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে, সেই আতিক শেষ কবে চোখের জল ঝরিয়েছে মনে নেই। অনেক বাঁক, প্রতিবন্ধকতা ঠেলে হাঁপিয়ে উঠেছে ঠিকই; তবে কাঁদতে ভুলে গেছে। আতিক এখন বোঝে- ‘একটি মানুষ যখন কাঁদতে ভুলে যায় তখনই তার সমস্ত অনুভূতির মৃত্যু ঘটে। তখনই সে মানুষ থেকে যন্ত্র হয়ে যায়। আর মানুষকে এই যন্ত্র বানানোর কাজটি সূ²ভাবে করে চলছে এই নগর, এই সময়।’ আতিক এ-ও বোঝে এই যন্ত্রকে মানুষ করতে পারে কিছু বিশেষ ভালোবাসা। বিশেষ সম্পর্কের মানুষগুলো। আতিকের জীবনে অমন কেউও নেই। যে ছিল; মিলি এখন অনেক সংসার গোছাতে ব্যস্ত। তারই বা দোষ কী? কম তো অপেক্ষা করেনি। আতিক যেবছর কলেজে উঠলো সেবছর থেকেই তাদের প্রেম শুরু। মিলি সেবছর জেএসসি দিল। দেখতে শুনতে ভালো। দু’দিন পরপর সম্বন্ধ আসতো তখন থেকেই। মিলিই সেসব সামলেছে। বাবা-মাকে এটা-সেটা বুঝিয়ে এইচএসসি পাসও করেছে। যুদ্ধটা মিলি করেছে আতিকের পথচেয়ে। আতিকের অনার্স শেষ হলেই কিছু একটা হবে। বিসিএস না হোক একটা ব্যাংকে কিংবা সেকেন্ড ক্লাস কোনো চাকরিও যদি হয়। কিছু না হলেও কোনো কোম্পানির মোটামুটি লেভেলের চাকরি তো হবেই। কিন্তু অনার্স শেষ হয়ে আরো দু’বছর কেটে গেল। চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে মিলির দিকেও তেমন খেয়াল রাখতে পারেনি। আসলে নিজের দিকেই তো কোনো খেয়াল ছিল না সেসময়। হঠাৎই একদিন মিলির ফোন। সেদিন ছিল শুক্রবার। প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা দিতে জেলা শহরে গেছে আতিক। পরীক্ষার হলে থাকতেই মিলি কয়েকবার ফোন করেছে। সাইলেন্ট মুড অন করে বাইরে একজনের কাছে রেখে গিয়েছিল। বের হয়ে মিলির অতগুলো ফোনকল দেখেই বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে। মিলি তো জানে আজ পরীক্ষা আছে। রওনা করার সময়ও কথা হয়েছে। তাহলে এতবার ফোন কেন? ক্ষুদে বার্তা কক্ষে গিয়ে দেখে মিলি লিখেছে- ‘পারলে দ্রুত আমাদের বাড়িতে এসো। আর কখনো আসতে হবে না।’ এরপর কলব্যাক করে আতিক। কিন্তু মিলির মোবাইল বন্ধ। তাড়াহুড়া করে গাড়িতে ওঠে। বাড়িতে না গিয়ে মিলিদের বাড়ির সামনের রাস্তায় গিয়ে দেখে উঠোনে লাল লাল চেয়ায়ের ওপর সাদা সাদা পাঞ্জাবি আর টুপি পরা কয়েকজন বসে আছেন। কিছুই বুঝতে বাকি থাকে না আতিকের। শহরে আসার পর বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেছেন বিয়ে করাতে, আতিককে রাজি করাতে পারেননি। বাবা মারা যাওয়ার দুই বছরের মধ্যেই মা-ও মারা যান মারা যান। এখন আর আতিকের বিষয়ে ভাববার কেউ নেই। হয়তো আতিকের প্রয়োজনই নেই। অনেকদিন পর বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে আতিকের। বুক ফেটে কান্না আসে তার। পাথর ভেঙে ঝরনা আসার মতোই ঝরঝরিয়ে পড়তে থাকে জল। কোনোমতে নিজেকে সামলে নেয়। হাঁটতে হাঁটতে এরই মধ্যে অনেক দূর চলে এসেছে। ক্ষুধাও পেয়েছে বেশ। পকেট হাতড়ে কুড়ি টাকা পায়। কী খাওয়া যায় ভাবতে ভাবতে একজন ভিক্ষুক এসে হাত পাতে। তাকে কুড়ি টাকাই দিয়ে দেয় আতিক। এগিয়ে যায় সামনের দিকে। দূর থেকে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে আসছে একটি ট্রেন। শূন্য এ পৃথিবীতে আতিকের থেকে যখন সবাই দূরে সরছে তখন কেবল এই একটি ট্রেনকেই তার দিকে আসতে দেখা যায়। আতিকও আপন করে নেয়।

– রনি রেজা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়