মির্জা ফখরুল : দলমত নির্বিশেষে ‘গণঐক্য’ গড়ার আহ্বান

আগের সংবাদ

পরিবেশবাদীদের ক্ষোভ প: সুনামগঞ্জে একসঙ্গে ৩ হাজার গাছ কাটার উদ্যোগ

পরের সংবাদ

বাংলা সিনেমায় দোলের গান

প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৩০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভারতীয় বাংলা ছবিতে দোলের গান চিরকাল আকর্ষণের বিষয়। আবার অনেক সময় পুরো ছবির ভেতর দোলের গানই হয়ে উঠেছে গল্পের ক্লাইম্যাক্স দৃশ্য। বাংলা ছবিতে প্রথম দোলের গান সচেতনভাবে কিন্তু আসেনি। ১৯৩৭ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘মুক্তি’ ছবিতে ব্যবহার হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান। নায়ক প্রমথেশকে সাজাতে সাজাতে নায়িকা কাননবালা নিজের গলায় গাইছেন ‘আজ সবার রঙে রং মিশাতে হবে’। দোলের গানের দৃশ্য নয় বরং বসন্তের গান, প্রেমের গান হিসেবেই ব্যবহার হয়েছিল এই গান। কিন্তু গানে আছে রঙের ছোঁয়া। রবীন্দ্রনাথের গানকে সর্বস্তরে পৌঁছে দিয়েছিল কাননবালার কণ্ঠের এই গান। সংগীত পরিচালনা করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। দেবকীকুমার বসুর পরিচালনায় ১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় ‘নবজন্ম’। এই ছবিতে সরাসরি দোল উৎসব না থাকলেও, অরুন্ধতী দেবীকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে বৈষ্ণব পদাবলীর রাধিকার রূপ বর্ণনার গান শুনিয়েছিলেন উত্তমকুমার। এই প্রথমবার উত্তমকুমারকে নিজের কণ্ঠে গাইতে শোনা যায়। গান শেষে অরুন্ধতী বলে ওঠেন, ‘উঠি ঠাকুরপো, সামনে দোল আসছে, ওইদিন সকালে তোমার দোলের গান শুনব’। ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় অসিত সেন পরিচালিত উত্তমকুমার প্রযোজিত সুচিত্রা সেন অভিনীত ঐতিহাসিক বাংলা ছবি ‘উত্তর-ফাল্গুনী’। এই ছবির শুরুতেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে পান্নাবাইয়ের ভূমিকায় সুচিত্রা সেন লিপ মেলালেন ‘কৌন তারাহ সে তুম খেলাত হরি’। গানের কথায় রয়েছে হোলির উল্লেখ। ১৯৬৯ সালে শ্যামল মিত্র ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ডুয়েট গাইলেন ‘সুন্দর নটবর খেলত হোলি’, ‘মা ও মেয়ে’ ছবিতে। প্রণব রায়ের কথায় ও সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে দুর্দান্ত ক্লাসিকাল আঙ্গিকে শ্যামল-মানবেন্দ্র জুটির এই গান। দোলের দৃশ্য নিয়ে গান তখনো কিন্তু বাংলা ছবিতে আসেনি। দোলের গান নিয়ে বিপ্লব ঘটালেন যিনি তিনি তরুণ মজুমদার। ১৯৬৭ সালে রিলিজ করল তরুণ মজুমদারের ‘বালিকা বধূ’। মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি। ‘লাগ লাগ লাগ লাগ রঙের ভেল্কি লাগ, পরাণে লেগেছে ফাগুয়া’ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এই গানটির গায়ক ও সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যে গানে দোলের দৃশ্যর প্রথম দেখা মিলল। ১৯৭০ সালে মুক্তি পেল অগ্রদূত পরিচালিত ‘মঞ্জরী অপেরা’। গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘আজ হোলি খেলবো শ্যাম তোমার সনে’ সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের লিপে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। হোলির গানে ক্লাসিকাল ছোঁয়া সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানে ফিরে এসেছে বারবার। ১৯৭৩ সালে রিলিজ করে চিরপ্রেমের ছবি ‘বসন্ত বিলাপ’। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ও সুধীন দাশগুপ্তর সুরে সাদাকালো এই ছবির আইকনিক রঙিন গানটি হলো- ‘ও শ্যাম যখন তখন, খেলো না খেলা এমন’। অপর্ণা সেন, কাজল গুপ্ত, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, শিবানী বসুরা ঠোঁট মিলিয়ে ছিলেন আর গানটি গেয়েছিলেন আরতি মুখোপাধ্যায় ও সুজাতা মুখোপাধ্যায়। ১৯৭৮ সালে আবার একটি সাদাকালো ছবি পরিচালনা করেন দীনেন গুপ্ত। ‘তিলোত্তমা’। অভিনয়ে রঞ্জিত মল্লিক, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, কল্যাণী মণ্ডল প্রমুখ। এই ছবির রঙের গানটি আজো ভীষণ জনপ্রিয় ‘রঙ শুধু দিয়েই গেলে আড়াল থেকে অগোচরে’। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সুরে গানটি গেয়েছিলেন মান্না দে ও অরুন্ধতী হোম চৌধুরী। লিপ দিয়েছেন রঞ্জিত মল্লিক ও কল্যাণী মণ্ডল। সত্তর দশকের শেষ থেকে বাংলা ছবিতে ঢুকে পড়ল বম্বের হাওয়া। রাহুল দেববর্মণ আর বাপ্পি লাহিড়ী হিন্দি ছবির ঢংয়ে বাংলাতে নিয়ে এলেন দমদার হোলির গান। বম্বে প্রভাব থেকে বাদ যাননি শ্যামল মিত্র। ১৯৭৮ সালে আলো সরকারের ‘বন্দি’ ছবিতে শ্যামল মিত্রর সুরে, আশা ভোঁসলে ও কিশোর কুমারের গাইলেন ‘মনে রং না লাগলে তবে, এ হোলি কেমন হোলি’, যে গানে লিপ দিয়েছিলেন সুলক্ষনা পণ্ডিত ও উত্তম কুমার। বলিউড ঘরানার ‘বন্দি’ ডবল ভার্সন ছবি হওয়াতে এই গানের হিন্দি ভার্সনও আছে। গান হিট ছবি ফ্লপ। উত্তমকুমারকে হিন্দি ঢংয়ে নেয়নি দর্শক। উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর ১৯৮০ সালের নভেম্বরে তরুণ মজুমদার আনলেন সবুজ প্রেমের তারুণ্যের ছবি ‘দাদার কীর্তি’। শিমুলতলার আউটডোরে প্রভাতফেরিতে হোলির গান গাইলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শক্তি ঠাকুর ও সহশিল্পীরা ‘হোলি আয়ি রে’, সংগীত পরিচালক হেমন্ত নিজেই কথা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও হৃদয়েশ পাণ্ডের। ‘ললিত-রঙ্গে রস-তরঙ্গে প্রাণের সঙ্গে হোলি খেলো, কুম কুম ফাগে রাঙা অনুরাগে অন্তর মন ভরে তোলো…’। দোলপূর্ণিমার আল্টিমেট গান হয়ে রইল ‘দাদার কীর্তি’। ১৯৮২ সালে পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘রাজবধূ’ ছবির ‘আজো রঙ্গ খেলত মেরে রঙ্গলাল’ গানটি বাঙালিয়ানা বজায় রেখে বোধহয় শেষ চলচ্চিত্র যেখানে দোল উদযাপন করা হয়। সুর অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের, গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। দৃশ্যে সুচিত্রা তনয়া মুনমুন সেন।
এবার শুরু হোলির গানে আর ডি বর্মণ যুগ। ১৯৮৭ সালে এল বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় অপর্ণা সেন-ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত ‘একান্ত আপন’। আর ডি ম্যাজিকে ‘খেলব হোলি রং দেবো না তাই কখনো হয়!’ আশা ভোঁসলের যে গান ছাড়া আজো হোলি জমে না। তবে অপর্ণা সেন ভিজে কাপড়ে মধ্যবয়সে এই গানে নাচানাচি করায় সমালোচিত হয়েছিলেন সে সময়ে। কিন্তু হিটের নিরিখে দোলের গানে এই গান থাকবেই। ১৯৮৭ সালেই এলো প্রভাত রায়ের ‘প্রতিকার’। দেবশ্রী রায় তুমুল নাচলেন ‘দোল দোল দোল’ গানে বস্তিতে হোলির উৎসবে। ছবির অ্যাকশন দৃশ্য শুরু হতো হোলির গানের ঠিক পরে। হোলির গানই ছবির ক্লাইম্যাক্স। বলিউড ঘরানায় টলিউডে বিশাল সাফল্য পায় ‘প্রতিকার’। ১৯৮৮ সালে রিলিজ করে বিশ্বজিৎ-ভারতভূষণ অভিনীত ‘কৃষ্ণ সুদামা’। এই ছবিতে নীতা সেনের সুরে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় দোলের দুর্দান্ত একটি বাংলা গান ছিল আরতি মুখোপাধ্যায় ও ঊষা মঙ্গেশকরের ডুয়েটে ‘ফাগুয়ায় কে কুমারী যায় বল কী জানা, লাল আবিরে সব সিঁথিতে সিঁদুর যে আজ টানা’। ১৯৮৯ সালে প্রভাত রায়ের ‘প্রণমি তোমায়’ ছবির কবিতা কৃষ্ণমূর্তির কণ্ঠে ‘সকাল হতে না হতে কেন এলে রং দিতে এখনো ঘরের কাজ সারিনি’ গানটিও বেশ হিট করেছিল বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে। অভিজিৎ সেনের ‘দেবতা’ ছবির ‘বছর ঘুরে এলো’ গানও উল্লেখ্য। ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়-দেবশ্রী রায়-ইন্দ্রানী হালদার-অর্জুন চক্রবর্তী নাচলেন হোলির ক্লাইম্যাক্স সিনে। আর ডি বর্মণের সুরে স্বপন চক্রবর্তীর কথায় গানেও চার মহারথী আশা ভোঁসলে, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, অমিত কুমার ও আর ডি বর্মণ নিজেই। রানি মুখোপাধ্যায়ের বাবা রাম মুখার্জি নব্বই দশকে বানিয়েছিলেন চিরঞ্জিত-দেবশ্রীকে নিয়ে ‘তোমার রক্তে আমার সোহাগ’। বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে ‘এসো এসো খেলি হোলি খেলা’ গাইলেন অভিজিৎ, সাব্বির কুমার, সুজাতা গোস্বামী ও বাপ্পি নিজে। ধীরেধীরে বাংলা ছবিতে দোলের গানের মান নেমে যাচ্ছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আর ডি বর্মণের মৃত্যু আর বাপ্পি লাহিড়ীর প্রস্থান বাংলা ছবিতে দোলের গানে শেষ পেরেক পুঁতে দিল। পরবর্তী সুরকার গীতিকাররা দোলের গান লিখলেও সেই আগের মতো সেসব গান আর শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরল না। লক্ষ্যভেদ, বদলা, জনতার আদালত ছবিতে হোলির গানে কোন বাঙালিয়ানাই থাকল না। শ্রæতিমধুর দোলের গানের সুর হারিয়ে গেল বাংলা ছবি থেকে। বাংলা ছবিতে দোলের গানে শেষ হিট শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের ‘গোত্র’ ছবির শ্রেয়া ঘোষালের কণ্ঠে ‘নীল দিগন্তে’। যদিও রবীন্দ্রসংগীতের প্রভাবে তৈরি। ‘বগলামামা’ ছবিতে একটি দোলের গানের দৃশ্য আছে। খরাজ মুখোপাধ্যায়ের লিপে ‘এলো রে এলো হোলি’, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর কণ্ঠে সুরে হোলির গানের দুর্বল উপস্থাপন। দোলের ভরপুর নতুন নতুন গান এখনো বাংলা ছবিতে চায় দর্শক।

: মেলা ডেস্ক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়