নৌপথ ও বন্দরগুলো ঠিক আছে কিনা তা লক্ষ্য রাখতে হবে : নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

গুরু পাপের লঘুদণ্ড!

পরের সংবাদ

দোয়েল আর দেবলীনা : সমরেশ তর্পণে উপস্থিত শীর্ষেন্দু, সাক্ষী দুই কন্যা

প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত ১৮ মার্চ সোমবার আমরা সমবেত হয়েছিলাম আবিষ্কার প্রকাশনের কর্ণধার দেলোয়ার হাসানের আমন্ত্রণে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হুসেন চৌধুরী মিলনায়তনে কথাশিল্পী সমরেশ মজুমদার ফাউন্ডেশন ও আবিষ্কার প্রকাশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘সমরেশ মজুমদার সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪ প্রদান এবং সমরেশ মজুমদার স্মারকগ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে’। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাব সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন এমপি; পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট প্রকাশক ও লেখক ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, ভোরের কাগজ সম্পাদক, কবি ও গবেষক শ্যামল দত্ত, কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারকন্যা দোয়েল মজুমদার, কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কন্যা দেবলীনা মুখোপাধ্যায় এবং কবি ফরিদ আহমদ দুলাল; স্বাগত ভাষণ দেন দেলোয়ার হাসান। কবি হাসান হাফিজের সঞ্চালনায় সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আদ্যোপান্ত প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে অনুষ্ঠানটি। পুরস্কার প্রাপকের হাতে তুলে দেয়া হয় ক্রেস্ট, পুষ্পস্তবক, পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক এবং প্রশংসাপত্র। প্রথা মেনে অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সবাই বক্তব্য প্রদান করেন, সেলিনা হোসেন তার অনুভূতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন।
সমরেশ মজুমদার ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক। শহুরে জীবনের চালচিত্র বারবার বাক্সময় হয়েছে তার লেখায়। যে কারণে তাকে আপাদমস্তক ‘নাগরিক’ লেখক বলে বিভিন্ন স্থানে পরিচিত করা হয়েছে। তিনি ১৯৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বঙ্গবিভূষণসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
১৯৪২ সালের ১০ মার্চ সমরেশ মজুমদার পশ্চিমবঙ্গের গয়েরকাটায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কৃষ্ণদাস মজুমদার ও মাতা শ্যামলী দেবী। তার শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে; সেখানেই ভবানী মাস্টারের পাঠশালায় তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। ডুয়ার্স নিয়ে তার ছিল গভীর আবেগ। ডুয়ার্স থেকে যান জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে। তিনি কলকাতায় আসেন ১৯৬০ সালে। বাংলায় স্নাতকসম্পন্ন করেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিলাভ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
শেষ জীবনে তিনি সিওপিডিতে ভুগছিলেন, ২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ২০২৩ সালের ৮ মে তিনি সেখানেই প্রয়াত হন।
কর্মজীবনে তিনি আনন্দবাজার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তার প্রচণ্ড আসক্তি ছিল। তার প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ লেখাই হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসেবে, আর সেখান থেকেই তার লেখকজীবনের শুরু। অন্যমাত্রা ১৯৬৭ সালে দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সমরেশের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ১৯৭৫ সালে ছাপা হয় দেশ-এই। তিনি শুধু নিজেকে তার লেখা গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি থেকে গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাস সর্বত্রই তার জুড়ি মেলা ভার। তার প্রত্যেকটি উপন্যাসের বিষয় ভিন্ন, রচনার গতি এবং গল্প বলার ভঙ্গি পাঠকদের আন্দোলিত করে। চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নি¤œবিত্ত মানুষ তার কলমে যেন উঠে আসে রক্ত-মাংস অস্থি-মজ্জা নিয়ে। সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ’ বাংলা সাহিত্যে তাকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে।
সমরেশের এই বর্ণাঢ্য জীবনের নানান অনুষঙ্গ উঠে এসেছে অতিথিবৃন্দের আলোচনা ও স্মৃতিতর্পণে; উঠে এসেছে তার ব্যক্তিগত জীবনও। বিশেষ করে সমরেশকন্যা দোয়েল মজুমদার এবং শীর্ষেন্দুকন্যা দেবলীনা মুখোপাধ্যায়ের বয়ান কথাশিল্পীর জীবনের নানান ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এবং স্বপ্নবুনন আকাক্সক্ষার কথা উচ্চারিত হবার পর সমস্ত মিলনায়তন দুই রাজকন্যায় মনোযোগী হয়ে ওঠে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন বাংলাদেশের পাঠক সমাজে সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি ছিলেন সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ ও হুমায়ূন আহমেদ; যাদের তিনজনই অল্প কয়েক বছরে প্রয়াত হয়েছেন। চারজনের মধ্যে একমাত্র শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এখন জীবিত আছেন। দোয়েল মজুমদারের বক্তব্যে নিজের লেখার নিচের অংশ পাঠ-
‘সেদিন ৮ মে বিকেল ৫টা ৪৫-এ যখন আমি দাঁড়িয়ে আছি বাবার পাশে, মনিটরের লাইনটা ধীরে ধীরে সরলরেখা হয়ে যাচ্ছে, আমার একটা কথাই মনে হলো যে বাবা এখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, কোথাও? উত্তরবঙ্গে? বাংলাদেশে? নিশ্চয়ই কোথাও যাচ্ছে, কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। এখনো আমার খালি মনে হয়, যে বাবা তো আছেই। বাবা তো কোথাও যায়নি। যেমন ছোটবেলায় মাসখানেকের জন্য কোথাও চলে যেত, সেরকমই কোথাও গিয়েছে যেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই, নেটওয়ার্ক পেলেই আবার ফোন করবে, থাকি না এই বিশ্বাস নিয়ে।’
(বাবা \ দোয়েল মজুমদার \ সমরেশ মজুমদার স্মারকগ্রন্থ \ সম্পাদক : দেলোয়ার হাসান)। অনুকূল ঠাকুরের ভক্ত কথাশিল্পী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কন্যা দেবলীনা মুখোপাধ্যায়ের আবেগঘন বক্তৃতা বা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্তের বক্তৃতার-
‘সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসে ষাটের দশকের সেই নকশালবাড়ি আন্দোলন থেকে শুরু করে সেই সময়কার সংকট প্রকটভাবে উঠে এসেছে। তিনি একদিকে যেমন সিরিয়াস এবং জনপ্রিয়- দুধারার মধ্যে একটি অনন্য সমন্বয় ঘটিয়েছেন, মধ্যবিত্তের জীবনের সহজাত বিষয়গুলো উঠে এসেছে অনবদ্যভাবে। তার চরিত্রগুলোর মধ্যেও পাঠক অধিকাংশ সময় খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। তার উপন্যাসত্রয়ী উত্তরাধিকার, কালপুরুষ ও কালবেলার মধ্যে যে সময়কালের বর্ণনা, তার মধ্যে নিজেকে আত্মস্থ করেছে বাঙালি। তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন বাঙালি মানসের এক অপরূপ চিত্রায়নের জন্য।’
(বাঙালি সাহিত্যমানস ও সমরেশ মজুমদার \ শ্যামল দত্ত \ সমরেশ মজুমদার স্মারকগ্রন্থ \ সম্পাদক : দেলোয়ার হাসান) এবং আমি যখন অভিযোগ উচ্চারণ করে বললাম ঢাকা ক্লাবে শেষ আড্ডার স্মৃতি; সে আড্ডায় ছিলেন ফয়েজ ভাই, অশোক রায়নন্দী আর দেলোয়ার। আড্ডার শেষ প্রান্তে সবাই অবাক হলেন, কেন সমরেশদা আমায় ‘ওস্তাদ’ বলে সম্বোধন করলেন! সমরেশদা রহস্য করে বললেন, ‘আজকের আড্ডার আদ্যোপান্ত ভাবুন উত্তর পেয়ে যাবেন।’ কে কী উত্তর খুঁজে পেলেন জানি না; আমি মৃদু হেসে দাদাকে কার্তিকে ব্রহ্মপুত্রের চরে কাশফুল দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম ঢাকা ক্লাব থেকে। সমরেশ দা আমাদের শেষ সাক্ষাতে বলেছিলেন, ‘সামনে এসে অবশ্যই ময়মনসিংহে যাবো আপনার বাসায়!’ আর তার আসা হলো না, যাওয়া হলো না ময়মনসিংহে! বাংলাদেশের পাঠক, যারা সমরেশ মজুমদারকে নিজেদের স্বজন ভাবেন, তারা সবাই আবেগ তাড়িত হলেন। সব মিলিয়ে স্মৃতিকাতর মিলনায়তনে যেন দুই কিংবদন্তির নিঃশব্দ উপস্থিতি সবাইকে আবেগআপ্লæত করে তুলল। বাংলা কথাসাহিত্যের কিংবদন্তি সবাই ভালো থাকুন ও-পারে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আপনিও ভালো থাকুন, সৃজনমুখর থাকুন।
বাংলাদেশের পাঠক-লেখক-প্রকাশকরা সবাই মিলে সমরেশ-শীর্ষেন্দু, কথাসাহিত্যের দুই মহারাজার দুই রাজকন্যা দোয়েল-দেবলীনার সঙ্গে আনন্দ-বেদনার স্মৃতিরোমন্থনে বিকেলটাকে টেনে নিয়ে গেল সন্ধ্যার কাছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়