নৌপথ ও বন্দরগুলো ঠিক আছে কিনা তা লক্ষ্য রাখতে হবে : নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

গুরু পাপের লঘুদণ্ড!

পরের সংবাদ

কবি সরোজ দেবের মনোজগৎ ভাবনা : জন্মদিন

প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেই আদিকাল থেকেই মানুষ চিন্তা ও কর্মের সঙ্গে যুক্ত, সমাজ সভ্যতার ইতিহাস সে সাক্ষ্য প্রমাণ দেয়। প্রাচীন সাহিত্য আর আজকের একুশ শতকের সাহিত্য একই সূত্রের আলোকেই পরিবর্তিত হয়েছে। দিন বদলের সঙ্গে যেমন বৃক্ষ-লতা প্রাণীকুলের অবয়বগত পরিবর্তন ঘটে, অবিকল শিল্প-সাহিত্য ও সংগীতেরও পরিবর্তন ঘটে। তাই চর্যাপদের কবি ভাষা আর একুশ শতকের কবি ও কবিতার ভাষাশৈলী এবং আঙ্গিক প্রকরণেরও পরিবর্তন ঘটেছে। কবি ভাবনা ও তার মানস প্রকৃতি সেই ধারাবাহিকতায় স্বাতন্ত্র্য হয়েছে। যেহেতু সময়ের পরিবর্তনে আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনি জীবনের প্রতি অসীম আকর্ষণ জগৎকে আবিষ্কারের অফুরন্ত আকাক্সক্ষাকে দিনের পর দিন বিস্তৃত করেছে। মানুষ এগিয়ে গেছে আরো অধিক স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায়। আর এমন প্রত্যাশা ও স্বপ্ন হৃদয়ে লালন করেন আমাদের উত্তরাঞ্চলের কবি সরোজ দেব। যিনি সাহিত্যাঙ্গনে মেধা, মনন আর আপন আলোয় উদ্ভাসিত। ‘শব্দ’ যার আপন ভুবন। যিনি ভালোবাসেন কবিতা, হৃদয়ে লালন করেন কবিতা, যিনি গভীরভাবে ভালোবাসেন তার দেশ, মা, মাটি ও মানুষকে। শব্দের দ্যোতনা ও ব্যঞ্জনায় বাক্সময় করে তোলেন কোনো বিষয় বৈভবকে। তিনি আমাদেরই কবি। ১৯৪৮ সালের ২৬ মার্চ কবি সরোজ দেব গাইবান্ধা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। আমরা আমাদের অতি কাছের কবিকে দেখতে পাই রাবীন্দ্রিক গড়নে-
এদেশের মাটি, মানুষ ও প্রকৃতি-
যার হৃদয় গহীনে,
আপন আলোয়
উদ্ভাসিত যিনি।

কবিতা ও শব্দ
যার আপন ভুবন,
হালকা-পাতলা ফর্সা মুখভর্তি লম্বা দাড়ি
গড়নে ঠিক যেন রবিরই মতন।

পড়নে পাজামা পাঞ্জাবি
কাঁধেতে ঝুলানো ব্যাগ
আমাদেরই কবি সরোজ দেব
দ্যাখ! দ্যাখ! ভালো করে দ্যাখ\

ষাটের দশক থেকে অদ্যাবধি তার পদচারণায় মুখরিত উত্তরাঞ্চলের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন। শব্দ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কবি সরোজ দেব নিয়মিতভাবে লিটল ম্যাগাজিন ‘শব্দ’ প্রকাশ করে আসছেন। শব্দ সম্পাদনায় তার নিষ্ঠা ও দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। বিভিন্ন কবি লেখকদের লেখাগুলোকে একত্রিত করে পাঠকের সামনে হাজির করে শব্দ।
‘শব্দে’ কবি সরোজ দেবের কতগুলো বাঁক বা গতি পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। শব্দ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত শব্দের বিভিন্ন সংখ্যা প্রকাশে নানা বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত রূপ, রসে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে চলেছেন কবি। তিনি প্রচ্ছদ, বর্ণসজ্জা, ভাষার বুনট, রূপ ও রঙে পূর্বের সংখ্যার আবেষ্টনীকে ভেঙে এক নবতর প্রকাশের মধ্য দিয়ে অবতরণ করে চলেছেন। সরোজ দেবের কবি মানসের এই পরিবর্তনশীল বৈচিত্র্যের প্রবণতাই তার সৃষ্টিশীলতাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। নিত্য নতুনের বৈচিত্র্যময় শিল্পবোধ ‘শব্দ’ পাঠক ও শ্রোতাচিত্তে স্পর্শ, অনভিজ্ঞ ও অপ্রত্যাশিত আনন্দ বেদনা মুখরিত অন্তর ধ্বনি সৃষ্টি করেছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। আমরা জানি সাহিত্য মানে সুসজ্জিত শব্দের বিন্যাস ও শব্দের খেলা। এটা এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত আর আবেগস্নাত অভিব্যক্তি যে যার মাধ্যমে অভিজ্ঞতার মূল নির্যাসটুকু শুধু পাঠক ও শ্রোতাচিত্তকে ছুঁয়ে যায় না, হৃদয় গহিন অরণ্যের অন্তরআত্মাকে আলোকিত ও আন্দেলিত করে তোলে। কবিতা, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও তার ধৈর্য, গভীর মনোযোগ, দৃষ্টির তীক্ষèতা লক্ষ করা যায়। তিনি নিজের চেয়ে অন্যের লেখাকে প্রাধান্য দেন বেশি। কবিতা বাছাইয়ে কবি সরোজ দেব ছন্দ, উপমা, অলংকার, চিত্রকল্প, রূপকল্প, শব্দচয়ন প্রভৃতিকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। আর ভাষা, ভাষার বুনট, রূপ, রস, অলংকার, পটভূমি, বিষয়বস্তু, রচনাশৈলী ও প্রকাশভঙ্গিতে পাঠকের চিত্তকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো আবেদন সৃষ্টি করতে পারে এমন লেখাকে তিনি গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করেন। জগৎ ও জীবনের গভীর ধ্যান ও অনিত্য জীবনে চিরন্তনের লীলাবৈচিত্র্যের অনির্বচনীয় রহস্য ও বিস্ময়কে কবি সরোজ দেব শব্দ ও সাহিত্যের ইন্দ্রজালে বন্দি করতে চান। বলা যায় কবি ও লেখকদের সম্মেলন মেলা ‘শব্দ’। দুই বাংলার অনেক প্রথিতযশা ও স্বনামধন্য লেখকদের পাশাপাশি তরুণ লেখকদের হাত পাকাবার এক অনন্য স্থান ‘শব্দ’। একজন কবি যেমন তার কবিতায় শব্দ, মাত্রা, উপমা, অলংকার গভীর চিন্তা আর বহুমুখী কল্পনার নানা রশ্মিছটায় স্বচ্ছন্দ ও সাবলীলভাবে কাব্যিক প্রবাহ সৃষ্টি করেন তেমনি শব্দ ও কবি সরোজ দেব সৃষ্টিশীল নতুন লেখিয়েদের উৎসাহ, উদ্দীপনা ও প্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন দিনের পর দিন। তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শব্দ ৪১ বছর ধরে সাহিত্যাঙ্গনে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছে। শব্দের বিভিন্ন সংখ্যায় চিত্রকল্প ও প্রচ্ছদ নির্বাচনে তিনি এক অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। কবি জীবনে দীর্ঘ সংগ্রাম ও ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। তিনি লেখা ও গবেষণার বিভিন্ন কাজে নানা সময়ে আমন্ত্রিত হয়ে ওপার বাংলায় যান। ‘শব্দ’ নামক তার আপন ভুবনে ‘শব্দহীন মিছিলে’ উচ্চারণ করেন-
‘অসংখ্য নৈসর্গিক চিন্তা সবখানে-
এমনকি ঘুমের রাজ্যেও মিছিল করে হেঁটে চলে
নৈতিকতার রক্তাক্ত প্রতিবাদে এই শব্দহীন মিছিল।

ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপ্তিতে প্রাত্যহিক দিনপুঞ্জ শুধুই রক্তঝরা
দার্শনিক প্রবচন পরাজয়ের ভূমিতেই উপ্ত হয় জয়ের সাম্রাজ্য
অথচ আপেক্ষিক চিন্তার স্রোতে সবাই-
ক্রমশ সংকীর্ণতার কেন্দ্রবিন্দুতে আবিষ্ট,
কিন্তু সময়ের শব্দহীন পদক্ষেপ ক্রমাগত বদলাতে থাকে-
চিন্তার জট শুধু জটিল থেকে জটিলতর হয়’…।
কবি হিসেবে তিনি সবার কাছে অতি পরিচিত। বাংলাদেশের উত্তর জনপদের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনি সবার প্রিয়ভাজন। কাব্যময় জীবনে হাস্যোজ্জ্বল তারুণ্যের প্রতীক। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এ মানুষটি এদেশের মাটি ও মানুষকে নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার। তাই তার কবিতায় একদিকে যেমন রয়েছে প্রেম প্রকৃতি তেমনি অন্যদিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রয়েছে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি ‘মানচিত্রে কালোছায়ায়’ দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন-

‘ফাগুনের প্রথম দিবসে যে ফুল ঝরে গ্যাছে
আমি তাদের জন্য কাঁদতে আসিনি;
ওরা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে অশোকের সিঁড়ি।

আমাদের পাঁজরে ঘা মেরে চলে গ্যাছে বুলেট
তা একদা ঠাঁই নেবে,
রক্তের দানা খুঁটে খাওয়া ইঁদুরের পাল
তোমাদের হৃদপিণ্ডে।
যে ফুল অকালে ঝরেছে তাদের জন্য আমি কাঁদতে আসিনি
যারা বেঁচে আছে, তাদেরই একজন আমি বলতে এসেছি
আমরা সালামের ভাই
আমরা রফিকের ভাই…।
এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেবো তোমাদের তাসের আবাস
মানচিত্রের ওপর থেকে ওই কালো ছায়াটা সরিয়ে নাও’।
হতাশ, ক্লান্তি, বিষাদ ও নিঃসঙ্গতা কবির চলার পথরুদ্ধ করতে পারেনি। সত্তরোর্ধ্ব কবি বয়সের ভারে ম্যুহমান হলেও কবিতার ভুবনে তার দ্যুতি বা স্বরূপ এখনো অনন্য। জীবনে এই চলার পথে তিনি বেশ কিছু মূল্যবান সম্মাননা পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুখ্যমন্ত্রী আবুল হোসেন সরকার পদক (১৯৪৭), স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী পদক (২০০০), বিন্দু বিসর্গ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৩), একুশের শহীদ স্মৃতি পদক (২০০৬), আদিবাসী সাহিত্য পদক, ময়মনসিংহ (২০০৭), দুই বাংলার কবিতা উৎসব পদক (২০০৭), ছান্দসিক পদক (২০০৮), আনোয়ার আহমেদ স্মৃতি পদক (২০০৯), অভিযাত্রিক, রংপুর পদক (২০০৯), শেরপুর লেখক চক্র পুরস্কার (২০১০), ছোট কাগজ পুরস্কার, ঢাকা (২০১১) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত বিভাগে প্রকাশিত লিটল ম্যাগ চিহ্ন সম্মাননা, লিটলম্যাগ মেলা-২০১১-তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার সম্পাদিত ‘শব্দ’ শ্রেষ্ঠ লিটলম্যাগ এবং তিনি শ্রেষ্ঠ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের (দার্জিলিং) বাংলা বিভাগের রজতজয়ন্তী উৎসবে কবিকে সংবর্ধিত ও সম্মাননা প্রদান করেছেন। সর্বশেষ ২০২১ সালে সমধারা সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করেন।
গভীর শিল্পবোধ, সজীব সজাগ দৃষ্টি, স্থির নির্ভুল বিষয় চেতনা এবং প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ সমস্তই কবি সরোজ দেবের মনোজগৎকে আলোকিত করেছে। কবির ভেতরে রয়েছে যেমনি শিল্পবোধ তেমনি আছে দায়বোধ। তাই কবিকে হতে হবে মানুষের পক্ষে শান্তি ও সম্প্রীতির সমর্থক। শিল্প-সাহিত্য স্বাধীন চিন্তার ফসল হলেও তা হবে যেমন নান্দনিক, তেমনি মানুষ, প্রকৃতি আর প্রেমময় সময়ের প্রতিচ্ছবি। কবিতা শুধু কবিদের জন্য নয়, মানুষের জন্য। কারণ মানুষ ও প্রকৃতি দুটিই কবিতা শিল্পের এক অন্যতম উপাত্ত। আর এটি একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়, যা কেবলই অন্তরআত্মা দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। তাই প্রিয়জন কিংবা দেশ, কাল ও জাতিকে চিনতে কবিতা হতে পারে উৎকৃষ্ট মাধ্যম।
কবি সরোজ দেব অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের বিছানায়। কবি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে দ্রুত ফিরে আসবেন এমন প্রত্যাশা রাখছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়