নৌপথ ও বন্দরগুলো ঠিক আছে কিনা তা লক্ষ্য রাখতে হবে : নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

গুরু পাপের লঘুদণ্ড!

পরের সংবাদ

একাত্তরে সেদিন সব এলোমেলো ছিল : গল্প

প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘পাকিস্তান মুরদাবাদ, মুরদাবাদ’।
‘সামরিক জান্তা নিপাত যাক, নিপাত যাক।’

১৯৬৮ সাল। ঊনসত্তর গণআন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়ানোর কিছুদিন আগের ঘটনা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট স্বৈরাচার ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের চট্টগ্রাম সফরে আয়োজিত জনসভায় কয়েকজন তরুণ সেøাগান দিতে দিতে সটকে পড়ে। গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে ওঠে। আকবর আলী সভায় গিয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে। সন্ধ্যায় বাড়ি না ফেরায় তার বন্ধুরা এবং বাড়ির সকলে চিন্তিত হয়ে পড়ে। সেদিন পুলিশ শনাক্ত করে ফেলে আকবরকে। গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তাই কেউ জানতে পারেনি। গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে নির্যাতন করে। দুদিন পর কোর্টে চালান দেয়।
আকবর কোর্টে অত্যাচারে বিবরণ দিতে এজলাসে দাঁড়ালে সরকার পক্ষের উকিল বাধা দেয়। বিচারক তাকে বিবরণ দেয়ার নির্দেশ দেয়। সে অত্যাচরের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা দেয়। গোয়েন্দা দপ্তরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখার ক্লান্তি আকবরের চোখে-মুখে স্পষ্ট। সারারাত ঘুমাতে দেয়নি। সোজা হয়ে এজলাসে দাঁড়াতে পারছে না সে। আকবর ভেঙে পড়া তরুণ নয়, উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে :
মাননীয় বিচারক, ক্ষমা করবেন, আমাকে আবার ঘৃণায়-ধিক্কারে উচ্চারণ করতে হচ্ছে, ‘পাকিস্তান মুরদাবাদ’। আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী মামলার আয়োজন হয়েছে। আমার সঙ্গে পুলিশের আচরণের কথা বলে শেষ করা যাবে না।
গোয়েন্দা দপ্তরে ঢুকেই শুনি পাশের টর্চার রুম থেকে চিৎকার। হাউমাউ কান্নার আহাজারি, ‘ওরে বাপরে, ওরে মারে, আমাকে মেরে লাভ কী, আমি কিছু জানি না, কিছু জানি না।’ এলাকার মেম্বার তাকে জনসভায় ট্রাকে করে নিয়ে যায়। দিনমজুর সে। জনসভায় লোক না হলে যে মেম্বারের ইজ্জত থাকবে না।
‘তুই দেশের শত্রæ, ভারতের চর, মেম্বারের কথা বলে বাঁচতে পারবি না, প্যাঁদানি খেলে বুঝবি’।
গ্রেপ্তার হওয়া থেকে গোয়েন্দারা এভাবেই তুই-তোকারী ব্যবহার করেছে। বাঙালি-বাঙালি বলে আমাকে গালি-গালাজ করছে। ওরাও কিন্তু বাঙালি। মুখে যা-ই আসছে, তাই বলছে।
টর্চার রুমে আমাকে নিয়ে গেলো।
‘দেখ তুই ওর কী অবস্থা করেছি।’
বয়সে আমার চেয়ে একটু বেশি হবে মনে হলো। এক লোকের দুই হাঁটুর নিচে লাঠি দিয়ে উপুড় করে নিচে শোয়ানো, পায়ের পাতা উপুড় করা, হাত-পা বাঁধা। দুই বাঙালি পুলিশ বেতের লাঠি দিয়ে ওর দুই পায়ের তালুতে আঘাত করছে।
‘কে তোকে সেøাগান দিতে বলেছে, আর রাজনীতি করবি’।
আবার মারতে শুরু করে। এক সময় লোকটা জ্ঞান হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। হুঁশ আসলে আবার শুরু করবে পিঠানো। স্বীকার না করে কোথায় যাবে বেটা।
আমার কাছে লোকটাকে নিরীহ মনে হয়েছে। কেউ খোঁজ-খবরও নিতে আসেনি।
মাননীয় বিচারক, আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি, আতঙ্কে বার বার শিউরে উঠি। সে মুহূর্তে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয় মনে হচ্ছিল।
এক বাঙালি অফিসার আমাকে দেখিয়ে বললো, ‘ওকে নিয়ে আসো, আমার রুমে’।
গোয়েন্দা অফিসে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথমে এই অফিসারই আমার সঙ্গে কথা বলে ছিল। শিক্ষা ও পরিবারিক হিস্টরি নিয়েছিল। পাশে বসে একজন লিপিবদ্ধ করে, আমাদের কথা-বার্তা। ওদের রাইটার বলে। তার থেকে লেখা কাগজটা নিয়ে, আরেকজন অফিসারকে দেয় বলে, জিজ্ঞেসাবাদ করেন।
অফিসার একের পর এক, প্রশ্ন করে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, আর বার বার পিঠানোর ভয় দেখায়। ধমকাতে থাকে। আমি দাঁড়িয়ে। পা ব্যথা করছে, খিদেই পেট চিন চিন করছে। এক সময় প্রশ্ন করা থামে। অল্প ডাল-মাছ-ভাত খেতে দেয়। ঘণ্টা খানেক পর আবার আরেকজন, এভাবেই আমার একদিন এক রাত কাটে। ঘুরে-ফিরে একই প্রশ্ন, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা জানতে চায়।
সেøাগানে আর কারা কারা দিয়েছিল, কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে এই কাজটি করেছি কি না এসব জানতে চায়। শুধুমাত্র স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দি দেয়ার জন্য এত অত্যাচার। নির্যাতন।
আমি নিজেই বাঙালি দালালদের মুখে স্বৈরশাসক আইয়ুবের গুণ-কীর্তন শুনে, উন্নয়নের বয়ান শুনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেøাগান দিয়েছি। আমার দেখাদেখিতে অন্যরা সেøাগান ধরে। আমি ওদের চিনি না, জানি না। বন্ধুরা সরে যেতে বলে আমাকে। আমি সটকে পড়ার প্রয়োজন বোধ করিনি।
মাননীয় বিচারক, জনসভায় আমাকে যখন সাধারণ মানুষের মতো একজন জিগ্যেস করে, সেøাগান দিয়েছি কি না। বললাম, ‘দিয়েছি, তো কী হয়েছে’।
সাথে সাথে আমাকে একদিকে টেনে নেয়। তারপর আরো কয়েকজনসহ জনসভার বাইরে নিয়ে টেক্সিতে তুলে নিয়ে যায়। পড়ে আরো দুই-একজনকে তুলেছে। তার মধ্যে অত্যাচারে অজ্ঞান হয়ে পড়া লোকটা ছিল না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার জানতে চেয়েছে, কারো প্ররোচনায় আমি সেøাগান দিয়েছি কি না।
মাননীয় বিচারক, আমার অপরাধ হলে শাস্তি দিন। রিমান্ডে দেবেন না।
আকবরের পক্ষের উকিলও রিমান্ডের বিরোধিতা করে।
অবশেষে বিচারক রিমান্ড মঞ্জুর না করে, জেলে হাজতে পাঠানোর নির্দেশ প্রদান করে।
দীর্ঘ তিন মাস বিচার কার্য চলার পর, আকবর জামিনে মুক্তি লাভ করে।

দুই.
আকবর আলী বাবার প্রথম সন্তান। দুই ভাই, তিন বোন। ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করা। ভালো ছাত্র। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কলেজে পড়ার সময় ছিলেন রাজনৈতিকভাবে মার্কস-লেলিন-মাওয়ের ভক্ত। বিভিন্ন মনীষীর প্রচুর বইপত্র পড়তেন ইংরেজি ভার্সনের। ইংরেজি মূল বইয়ে ডিটেলস পাওয়া যায়। পড়তে ভালো লাগে। বাংলা বইও পড়ত। কষ্ট করে। বাংলা পড়তে পড়তে, পরে ভালো পড়তে পারত। আকবর সেই পথেই এগোছিল শিক্ষা-দীক্ষায়।
আকবর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলত, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা।
আকবর যদি বলত, আমি সেøাগান দিই নাই, গ্রেপ্তার হতো না।
আকবরের ভাবনাটা ছিল, ওরা জানুক বাঙালি প্রতিবাদী। সাহসী। আমরা একদিন জেগে উঠবো।

তিন.
আকবর আলীকে নীরবে, সুনসান নীরবতায় শায়িত করা হলো। কিছুক্ষণ আগে। বাড়ির উঠোনে। গভীর রাত। নিñিদ্র অন্ধকার। সামরিক জান্তার ফ্লাশ-লাইট বারবার জ¦লে উঠছে। কারফিউ চলছে। ঘরে ঘরে ভয়ে-আতঙ্কে মানুষ দিশাহারা। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ। নিস্তব্ধতার ভেতর মাঝে মধ্যে সামরিক যান চলাচলের ভয় জাগানো শব্দ। বাড়ির উঠোনও কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্বজনহারা মানুষ কাঁদছে। নীরবে-নিভৃতে শব্দহীন। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে।
অন্ধকার রাত্রি। শুকনো পাতার শব্দ কেঁপে কেঁপে উঠছে। কণ্ঠস্বরহীন। মানবের অস্তিত্ব যে আছে তা, কেউ টের পাওয়ার সময় নয় এটা। তেমনই নীরবতা। ভয়-আতঙ্কে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চারজন কবর খুঁড়েছে। একজন বাড়ির পুরনো গৃহভৃত্য। একজন মৃত যুবকের চাচা। একজন চাচাতো ভাই। আরেকজন তার ছোট ভাই। কবরের জায়গাটি পুরনো তেরপাল দিয়ে ঢাকা। তেরপালে ঢাকা জায়গাটা দূর থেকে মনে হচ্ছে মাটির ছোট্ট ডিবি। কবরের ভেতরে একটি চেরাগ। তেরপালের নিচে হারিকেনের আলো। বারবার বাতাসে কাঁপছে।
কবর খোঁড়া হচ্ছে। একটি মাত্র শাবল আর কোদাল। কাঁপা কাঁপা হাতে কবর খোঁড়া চলছে। কবর খোঁড়ার অভিজ্ঞতাও কারোরই নাই। অনেকটা শব্দহীন প্রস্তুতি। শুধু ফিসফিসিয়ে প্রয়োজনীয় দু’একটি শব্দ। একজন আরেকজনকে শুধু বলছে আস্তে, আস্তে।
সাড়ে তিন হাত ভূমি, এক মাথা সমান উঁচু। ভেতরে বাঁশের ছাউনি। চাটাই দিয়ে মাটি ফেলে ভরাট করে ছোট ডিবির মতো মাঝখানে উঁচু টিলার ওপর এক কলসি পানি ঢেলে দেয়। কয়েকটি আগাছা গেড়ে দেয়া হয়। ভোরের আগে আগে কবর দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যেতে হবে। না, হলে নিশ্চিত মৃত্যু।
মারি ও মড়কে শূন্য গোয়াল ঘরের মতো পুরো বাড়ি শূন্য। এক বৃদ্ধা দোতলার ঘরের নিচের তলার সিঁড়ির প্রথম ধাপে বসে আছে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। হতভম্ব। বৃদ্ধার ছেলের ঘরের প্রথম নাতি, বংশের প্রথম প্রদীপ। পাকিস্তানি আর্মির গুলিতে নিভে গেল।
বাড়ি শূন্য। বাড়ির ষোলটি কক্ষ খালি। শূন্যতায় একটি হারিকেনের নিভু নিভু আলোয় আকবরের বৃদ্ধ দাদি এবং ছোট চাচা, ছোট ভাই, চাচা তো ভাই, পুরনো ভৃত্য বাড়িতে আছে। বাড়ির সবাই আকবর গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুর বাড়িতে উঠছে। ছোট ভাই আর চাচাতো ভাই, আলো ফুটে উঠলে গ্রামে বোনের বাড়িতে চলে যাবে।

চার.
পঁচিশে মার্চ, একাত্তর। রাতে পাকিস্তানি আর্মি পোড়া-মাটি নীতিতে গণহত্যা শুরু করে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাকিস্তানি আর্মি ও নৌসেনারা আকাশ কাঁপিয়ে বুলেট ও সেল ছুড়ছে। প্রচণ্ড শব্দ। সারারাত ধরে চলে। মানুষের মধ্যে ভীতি। পাকিস্তানি আর্মিরা জানে পথে ব্যারিকেড-প্রতিরোধ হবে। বাঙালরোখ সহজে ছাড়বে না। আকবর ২৭ মার্চ দুপুরের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে দূরের আকাশে আগুনের কুণ্ডলী দেখতে দেখতে নিজের বুকের ভেতরের ভয় তাড়িয়ে চলেছে। পাগলা কুকুরের মতো পাকিস্তানি সেনাদল তাড়িয়ে বেড়াছে বাঙালি লোকজনদের। আগুনের লেলিহান শিখা আরো বাড়ছে। মানুষ ছুটছে আর ছুটছে। শহরের চারদিকে আগুন জ¦লছে। এখন পাকিস্তানি সেনারা শহরের অলি-গলিতে ঢুকছে। গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগোচ্ছে। মানুষ অনেক আগে থেকেই শহরের ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে গ্রামের দিকে। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য।
সময় গড়াচ্ছে। যাচ্ছে দিন, সপ্তাহ মাস। কাটছে দুঃস্বপ্নের দিন। শহরে খবর আসছে গ্রামেও প্রবেশ করছে পাকিস্তানিরা। হাটের পর হাট জ¦ালিয়ে দিচ্ছে। দোকান-পাট-বাড়ির পর বাড়ি জ¦লছে। পাকিস্তানি সেনা একটা এলাকা দখলের পর, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দক্ষিণপন্থিরা রাজনৈতিক দলের কর্মীর ও হিন্দুদের বাড়ি-ঘর গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। মানুষ দেখলেই গুলি করছে। শুনেছে কালুরঘাট ব্রিজের প্রতিরোধ ভেঙে পটিয়ার দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যাচ্ছে।
কর্ণফুলীতে লাশ ভাসছে। নৌকা দিয়ে নদী পার হওয়ার সময়ও পাকিস্তানি আর্মি গুলি করছে। খাবার নেই। পানি নেই। পথ হারানো কোটি মানুষের এক অন্তহীন যাত্রা। আগে-পিছে মৃত্যু। মানুষ ছুটছে। সম্বলহীন। পুঁটলি-পাটলা নিয়ে ছুটছে। যেটুকু না হলে চলে না এমন জিনিসপত্র নিয়ে ছুটছে। পেছনে ফেলে আসা জীবনের সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আগুনের শিখায় জ্বলছে। বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়। মানুষের ভেতরের স্মৃতি তো সতত সত্য। বহমান। মুছে যায় না।
হাজার হাজার মানুষ গ্রামগঞ্জে রাস্তার ওপর। এই রাস্তা ক্রমশ অনেক পথ-ঘাট, পাহাড়, গ্রাম পেরিয়ে সীমান্তে গিয়ে মিশেছে। রাস্তার জনস্রোত দক্ষিণ থেকে উত্তরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ছুটন্ত মানুষেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে এইভাবে রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে হয়তো সহসা সীমানায় পৌঁছে যাবে। মুক্তিযুদ্ধকামী রাজনৈতিক কর্মী আর হিন্দুরা দলে দলে ছুটছে ভারত সীমান্তের দিকে। বাংলা চলেছে পশ্চিমে। মানুষগুলো তখনো বুঝতে পারেনি ওরা নিশ্চিন্ত বাসস্থান থেকে উদ্বাস্তু জীবনে পা রাখছে। তাদের আর ভাবা-ভাবির সময় নেই। আগে জীবনটা বাঁচুক। তারপর লড়াই। তারপর প্রতিরোধ।

দেশে ছত্রছান হয়ে পড়া লোকগুলোর শুধু মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণের কথা। সেøাগানে সেøাগানে উজ্জীবিত লাখ লাখ মানুষের কণ্ঠে একটিই সেøাগান ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো, স্বাধীন করো’। ভাষণ পাকিস্তান রেডিওতে সরাসরি প্রচার করার কথা থাকলেও প্রচার করতে দেয়া হয়নি। রেডিও পাকিস্তানের বাঙালি কর্মচারী ও কর্মকর্তারা রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা, বন্ধ করে রাস্তায় নেমে পড়ে। পূর্ব বাংলায় রেডিও পাকিস্তান স্তব্ধ হয়ে যায়। চাপে, পরের দিন রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা থেকে প্রচার করতে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ।
পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়েছিল। বাঙালির ভেতরের স্বাধীন বিদ্রোহী সত্তা জেগে ওঠে। পাড়ায় পাড়ায়, রাজপথ, অলি-গলি, ঘরে ঘরে একটি মাত্র সেøাগান, ‘এবারে সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। একমাত্র প্রেরণাদায়িনী, জীবনদায়িনী অনুষঙ্গ। বাঙালির মুক্তির সনদ। পূর্ব বাংলার মানচিত্র অঙ্কিত পতাকা পতপত করে উড়ছে। বাঙালির হৃদয়ের পতাকা। লাল-সবুজে উজ্জ্বল একটি পতাকা। সাহসের প্রতীক। ঘরে ঘরে, পথে-প্রান্তরে, দোকানে-বাজারে, গাছের ডালে ডালে।
আকবর সেই পতাকা হৃদয়ে ধারণ করে ছুটছিল। ছুটছে বিরামহীন। তখন পুরো পূর্ব পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলছে। বাঙালি তরুণ-তরুণী রাইফেল নিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে। কেউ কেউ স্কুল-কলেজের কাঠের গাদা বন্দুক নিয়েও ল্যাফট-রাইট করতে করতে, রাস্তায়, অলি-গলিতে প্রশিক্ষণ শুরু করে দেয়। আকবরও বন্দুকের গোডাউন থেকে লুট করা একটি বন্দুক নিয়ে রাস্তায় ল্যাফট-রাইট, ল্যাফট-রাইট করেছে। মনে পড়ছে জেলে যাওয়া। অত্যাচার। প্রতিবাদে মিছিলে মিছিলে মুষ্টিবদ্ধ হাত। এখন আকাশে বাংলার পতাকা তখন উড়ছে তো উড়ছে। এক একটি সেøাগানে, বারুদের গন্ধে গুলিবিদ্ধ রাজপথে ছাত্র-শ্রমিকের রক্তে ভেসে গেছে পাকিস্তানের অস্তিত্ব। অতঃপর প্রতিবাদের ভাষা ও সেøাগান পেয়েছে অস্ত্রের ভাষা। পূর্ব বাংলার মানুষ অস্ত্রে অস্ত্রে সশস্ত্র হয়েছে।
২৫ মার্চ। কালরাত্রি। আকবর দেখল, এবার ঠিকই বাংলা স্বাধীন হবে। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- বঙ্গবন্ধুর এই উচ্চারণ কবির ভাষার মতো। এ যেন এক অনন্য কবিতা। স্বাধীন সত্তার জাগরণের কবিতা।
পাঁচ.
আকবরের জন্ম সাতচল্লিশের মার্চে। সে বছর চৌদ্দই আগস্টে পাকিস্তান নামক দেশটি আবির্ভাব হয়। পাকিস্তানের জন্ম। পশ্চিম আর পূর্ব। এক একটি হাজার মাইল দূরত্বে। বন্ধন ধর্মের। মুসলমান ভাই ভাই। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দু। পূর্ব বাংলার ভাষা বাংলা। তাতে ধীরে ধীরে সম্পর্ক হয়ে পড়ে দ্ব›দ্ব-মুখর রাষ্ট্রভাষার দাবিতে। ভাইয়ে ভাইয়ে তখন অথচ এক পরিবারে বাস করতে পারে না ধর্মটা এক হলেও। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হয়ে পড়ে বালির বাঁধ। সম্পর্কে ধরে ফাটল। দেয়ালের ফাটল কখনো জোড়া লাগে না। ক্ষতের দাগ কখনো যায় না। মেরামতের পরও আঘাতের দাগ বুকের ভেতর মনের ভেতর থেকে যায়।
পূর্বে ও পশ্চিমে ভাষার প্রশ্নে তাই ফাটল ধরলো। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা নয় হবে উর্দু। পাকিস্তানের উর্দু ভাষী রাষ্ট্রপ্রধান মো. আলী জিন্নাহ ঘোষণা দিয়ে বসল, রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দুই। পূর্ব বাংলার মানুষ বিশ্বাস ভঙ্গে প্রতিবাদী ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির দাবি রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। ভাষার প্রশ্নে যখন প্রবল বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়, রক্ত ঝরে রাজপথে। বাঙালি তখন দেখে যুক্তির মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগোচ্ছে সময়ে সময়ে সংঘাতে। তিক্ততাও বাড়ছে।
পাকিস্তানের শাসকরা শুরু করল লুটপাট। বাংলার সম্পদ পাচার। বাজেটে বৈষম্য। অর্থনৈতিক শোষণ। বাংলার জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী। পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার মানুষের যুক্তির কাছে, দাবির কাছে বারবার হেরে যাচ্ছে। যুক্তির মুখ বন্ধ করার জন্য, নানা ফন্দি-ফিকির করেও যখন আর পারছে না তখন শুরু নির্যাতন। হত্যা। জেল। এসব ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানি শোষক শ্রেণি। শোষক শ্রেণির স্বার্থের ইতিহাস যুগে যুগে দেশে দেশে চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যে একই। মিথ্যে চূড়ান্ত লেবাসে নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখে। এক দেশ আরেক দেশের ওপর। মানুষ মানুষের ওপর। প্রতিবেশী প্রতিবেশীর ওপর। ধর্মে ধর্মে শুরু হয় দাঙ্গা লাগানো। উচ্চারিত হয় বাঙালির ছয় দফা। ছাত্রদের এগারো দফা দাবি। মওলানা ভাসানীর এক দফা। দমননীতি চালাতে দেয়া হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, সব মিলিয়ে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচনেও এলো অঘোষিতভাবে স্বাধীনতার পক্ষে রায়। পাকিস্তানের সামরিক সরকার নেয় সময়ক্ষেপণের রাজনীতি।
গণতন্ত্রের নামে ধনিক-ব্যবসায়ী শ্রেণির স্বার্থে পার্লামেন্টে স্বতঃস্ফূর্ত-উল্লাসে টেবিল চাপড়িয়ে বাজেট পাস করার গণতন্ত্রের যুগ শেষ হয়ে যায়, পুঁজির লাগামহীন লুটপাট বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সমাজতন্ত্রের সমবণ্টনের যুগও ক্রমশ প্রতিযোগিতায় চাপের মাঝে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ, সংঘাত। বিপরীতে ধনী রাষ্ট্র-পরাশক্তি। চলছে নিপীড়িত নিম্ন জাতিগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের শোষণ প্রক্রিয়ায় বন্দি করে রাখা। একনায়কতন্ত্র তাড়ানোর নামে আরেক একনায়ককে ক্ষমতায় বসানো রাষ্ট্রীয় জোট রক্ষা করছে পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ।
আকবর আলী বেঁচে থাকলে তার রাজনৈতিক চর্চার বিশ্লেষণের সত্যতা মিলতো। কিন্তু সে সাধারণের মুক্তির ইতিহাসের সূত্র দেখতে পেত না। ভোটার আর ক্ষমতার মাঝে দূরত্ব, পরিণতিতে দেখা যায়, সংসদ সদস্যরা পত্রিকার, নিউজ চ্যানেলের মালিক। প্রতিপত্তিশালী ব্যবসায়ী। আবার দানবীরও। শেয়ারবাজারেও তার কোম্পানির শেয়ার বেচাকেনা চলে। বেসরকারি হাসপাতালের মালিকও তারা।
আকবর আলীরা আজীবন আবেগে জেলে যাবে। অত্যাচারিত হবে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খেতাব নিয়ে কবরে-শ্মশানে ঘুমাবে। সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে জন্ম তারিখ, আর শহীদ হওয়ার দিন-তারিখ। চমৎকার, স্বীকৃতি পায় একজন মুক্তিযোদ্ধার। চিরকাল এটাই রীতি।
ছয়.
আকবর পাকিস্তানি আর্মির গতিবিধি দেখতে ছাদে উঠেছিল। তখনই রাস্তা থেকে আকবরকে গুলি করে পাকিস্তানি সেনা। চিৎকার দিয়ে সে ছাদে লুটিয়ে পড়ে। গুলি লেগেছে ডান পায়ের উরুতে। হাত দিয়ে ছেপে ধরে। ছাদ রক্তে ভিজে যায়।
আকবর আলী যেদিন গুলিবিদ্ধ হলো সেদিন ছিল আটাশে মার্চ। সকাল দশটার সময়। সেদিন পাকিস্তান আর্মি চারদিক থেকে শহরে প্রবেশের চেষ্টা করছে। ট্যাংক-বোমারু বিমানের সহায়তায়। মানুষ দেখলেই গুলি করছে নির্বিচারে। প্রতিরোধ দেখলে জেট বিমান থেকে বোমা ফেলছে। ঘর-বাড়িতে, বাজারে-দোকানে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। পোড়া-মাটি নীতিতে বিশ্বাস রেখে বাঙালি নিধনে নেমেছে পাকিস্তানি সরকার।
আকবরের বাড়িতে আছে ছোট ভাই জাবের আলী। আকবরের পরদিনই গ্রামে চলে যাওয়ার কথা। সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে ঘরে ছিল দুই ভাই, চাচা, চাচতো ভাই, দাদি আর একমাত্র পুরনো গৃহভৃত্য। আকবর আর জাবেরের নুরুদা।
জাবের নুরুদা নুরুদা বলে চিৎকার করতে থাকে। চাচাসহ তিনজনে ধরাধরি করে কোনোভাবে দোতলার ছাদ থেকে নিচে নামিয়ে আনে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পুরনো কাপড় বেঁধে দেয়। রক্ত পড়া কিছুটা কমে আসে। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিতে না পারলে নির্ঘাত মৃত্যু।
আকবরের চোখ বন্ধ। হুঁশ আছে। শুধু বলছে, ভাই আমাকে বাঁচা, হাসপাতালে নিয়ে চল। তাড়াতাড়ি কর। তাড়াতাড়ি। ব্যথায় কাতরাচ্ছে।
জাবেরের চোখে জল। ভাই তুমি বাঁচবে, যেভাবে হোক তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। রিকশা গ্যারেজে থেকে পরিচিত পাড়ার রিকশাওয়ালাকে ডেকে নিয়ে আসে। রিকশাচালক জব্বার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। রিকশায় ভাইকে ধরে বসে নুরুদা। পেছনে পেছনে ছুটছে জাবের। রিকশাচালক বারবার ভরসা দিচ্ছে ভাই বাঁচবেন। চিন্তা করিয়েন না। রিকশাচালক নিজের জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকির কথা ভাবছে না। জব্বারের ছিল মানবিকবোধ আর মানুষের জীবন রক্ষার সচেতনতা।
নুরু ছোট থেকে আকবরকে কোলে-পিঠে করে বড়ো করেছে। বাঁচানোর জন্য ছুটছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে চলা। একটি জীবনকে বাঁচানোর জন্য প্রকৃত মানুষ এভাবে যুদ্ধ করে। জীবনের বিনিময়ে জীবন বাঁচানোর লড়াই বাঙালির। একাত্তরে বারবার। প্রতি মুহূর্তে, প্রমাণ করেছে। আশ্রয় দিয়ে। খাওয়ার দিয়ে। এখন নানাভাবে বদলে যাওয়া পরিবেশে সেই চারিত্র্যিক মমত্ববোধ, মানবিকতা মুখের বুলি মনে হয় জাবেরের কাছে।
আকাশে ধোঁয়া। এদিক-ওদিক থেকে গুলির শব্দ। পথে-ঘাটে কোথাও কেউ নেই। জনশূন্য। প্রধান রাস্তাগুলো একেবারে ফাঁকা। কিছু কিছু মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে অলি-গলির ভেতর দিয়ে শহর ছাড়ছে। ওরা তখনো বুঝতে পারেনি ভয়াবহতা। সামনে উদ্বাস্তু জীবনের টানাপড়েন। বেঁচে থাকা। এক কাপড়ে ঘর ছাড়া। নদী-পাহাড় পেরিয়ে যাওয়ার জীবন বিপন্ন হওয়া কষ্ট। চোখে জল। পেটে খিদে। ছেলে-মেয়ে, বৃদ্ধ মা-বাবা নিয়ে ছুটে চলা। পথে-ঘাটে রাত্রি যাপন। এ সময়ে পর কখনো আপন, আপন কখনো পর হয়ে যায়। দুর্বিষহ জীবনের স্থিরচিত্র দেখা যায় ফটোগ্রাফিতে।
আজো সেদিনের কথা উঠলে। জাবেরের চোখে জল গড়িয়ে পড়ে। সে দিন, পথ যেন ফুরাতে চাইছিল না। রিকশাওয়ালা জব্বার মিয়া, ভাইজান আর বেশি সময় লাগবে না। হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকতেই মনে হলো আকবর এই যাত্রায় বেঁচে উঠল বুঝি। হাসপাতালে ডাক্তার দুয়েকজন আর টেকনিশিয়ান ক্ষতের জায়গাটা পরিষ্কার করছে। আকবরের চিৎকার। আকাশ-পাতাল, হাসপাতাল কেঁপে কেঁপে উঠছে।
জব্বার মিয়া বাড়ি এসে জানালো, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আর চিকিৎসা শুরু হওয়ার কথা। আকবরের চাচা আনসার আলীকে। ভাবলো, ভাইপো এ যাত্রায় বেঁচে গেল। আকবরের দাদিকে সে কথা জানিয়ে সান্ত¡না দিল ছেলে আনসার। উপরের দিকে হাত তুলে, নাতির জন্য মোনাজাত ধরল। বৃদ্ধা দাদির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
হাসপাতালে আসছে একের পর এক আহত। কেউ কেউ ইতোমধ্যে মারা গেছে। লাশ আর লাশ। প্রাণ আছে মনে করে অনেককে নিয়ে আসে। আর্তনাদে আর্তনাদে রক্তাক্ত বিকালের অস্তগামী সূর্যের আকাশ আজ আরো লাল হয়ে উঠলো সে আকাশ জাবেরের কাছে।
গুলিবিদ্ধ আকবরের উরু বেয়ে রক্ত ঝরেছিল, ভাইয়ের জীবন এভাবেই স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে অস্থির হয়েছিল জাবের। চিৎকার করেছে ডাক্তার ডাক্তার আমার ভাইকে বাঁচান। সামান্য গুলি লেখেছে। একটা ব্যান্ডেজ হলে চলবে। নুরুও দিশাহারা, ভাইয়া বাঁচবে, ভাইয়া বাঁচবে।
একজন ডাক্তার এলো ওয়ার্ডবয় নিয়ে, দেখে বলল, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্তের প্রয়োজন। এখনই এক বোতলের ব্যবস্থা করতে হবে। ডাক্তার খুব দ্রুত ব্যান্ডেজ করে দিল। সন্ধ্যা নেমে এলো। রক্তের ব্যবস্থা করতে পারল না। রাত বাড়তে বাড়তে হাসপাতালের আশপাশে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ।
শুয়ে পড়ো। শুয়ে পড়ো। ফিসফিসিয়ে একজন আরেকজনকে বলছে। দাঁড়ানো দেখলে পাকিস্তানি সেনা গুলি করছে, বেয়নেট দিয়ে খোঁচা মারছে। জাবের আর নুরু দুটি খালি সিটে রোগীর মতো পড়ে থাকল। হাসপাতালের ঘন অন্ধকারে টর্চ জ¦ালিয়ে পাকিস্তানি সেনারা টহল দিয়ে দ্রুত নেমে গেল।
ভোর হতে হতে অন্য অসুস্থ রোগীদের নিয়ে দ্রুত হাসপাতাল থেকে নিরাপদে আশ্রয়ে ছুটছে সবাই। আহতদের আর্তনাদে দিশাহারা স্বজনরা। কোথাও নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। আহত দেখলে পাকিস্তানি সেনা গুলি করছে। আকবরের চোখ বন্ধ। একটু নিশ্বাস ওঠা-নামা করছে। জরুরি বিভাগে ছুটে গিয়ে একজনকে ডেকে নিয়ে আসে। ডাক্তার না ইন্টার্ন বুঝার সময় নেই। টেনে নিয়ে আসল জাবের। রক্তের ব্যবস্থাও করা যায়নি। না। সম্ভবও না। মরা নদীর মতো জীবন নদী একসময় রক্ত শূন্য হয়ে আকব শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। নীরবে। শব্দহীন।

চোখের সামনে মৃত ভাইয়ের লাশ। এটাই এ মুহূর্তের সত্য। মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে আছে পুরো শহর। শোকে মুহ্যমান। সারা শহরে থেকে থেকে গোলাগুলির শব্দ। কোন পথে গেলে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাবে। ট্রলি নিয়ে হাসপাতালের নিচে এসে হাতে-পায়ে ধরে একজন ঠেলাওয়ালাকে রাজি করায়। ঠেলাওয়ালাও তাড়া দেয়, তাড়াতাড়ি ঠেলায় তোলেন, বেলা বাড়ছে। আর্মিরা নেমে পড়বে।
আকবর ঠেলা গাড়িতে লাশ হয়ে শুয়ে আছে। ঘর থেকে আনা একটি পুরনো চাদরের নিচে আকবর। জাবের আর পুরনো বিশ্বস্ত ভৃত্য নুরু ঠেলা গাড়ির পেছন পেছন দৌড়ে দৌড়ে দ্রুত বাড়ি পৌঁছার জন্য ঠেলা ঠেলছে। সোজা রাস্তা ধরে গোলপাহাড়, মেহদীবাগ, কাজীর দেউড়ি পার হয়ে লাভ লেনের কাছাকাছি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের দক্ষিণের দিকের পাকিস্তানি নৌবাহিনী আবাসিক এলাকা থেকে বেরিয়ে সৈন্যরা গোলাগুলি শুরু করে। লাভ লেনের মুখে আগে থেকে ছাত্র-জনতা একটি ব্যারিকেড তৈরি করে রেখেছিল। যাতে নৌ-সেনারা বেরুতে না পারে। প্রচণ্ড গোলাগুলির পর থামে। নৌ-সেনারা আবার ভেতরে ঢুকে পড়ে। এখানে কয়েকজন ছাত্র-জনতা শহীদ হয়।
জাবের, নুরু আর ঠেলাওয়ালা ঠেলার নিচে কোনোভাবে আশ্রয় নিয়েছিল। গোলাগুলি থেমে গেলে দ্রুত ঠেলাগাড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়। সন্ধ্যা নামার আগেই লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরে। বৃদ্ধ দাদি আর চাচা লাশ দেখে চিৎকার করে কাঁদতেও পারেনি। নিভৃতে চোখের জল ঝরছে।
দুঃখের মধ্যে সবার মনে এইটুকু সান্ত¡না, আকবরের লাশ শেষ পর্যন্ত কবরস্থ করা গেছে। হাজার হাজার লাশ পথে-প্রান্তে পড়ে আছে। দাফনহীন। আস্তে আস্তে হারিকেনের কেরোসিনও শেষ হয়ে আসে। এই হারিকেন প্রতিদিন ঘরের সামনের দরজায় জ্বালানো হতো, মাগরিবের আজানের সময় পরিবারের মঙ্গল কামনায়। সেই হারিকেনও নিভে গেছে শহরের হাজার হাজার লাশের জীবন প্রদীপের মতো। নিভে গেছে আকবর আলীরও।
আকবর আলী জীবন-মৃত্যুর রাজনৈতিক বিশ্লেষণে, তারুণ্যে-উজ্জীবিত প্রতিবাদে-প্রতিরোধে এক অগ্রবর্তী যোদ্ধা। যে মৃত্যু হতে পারতো যুদ্ধক্ষেত্রে, হতে পারতো পাকিস্তানি সৈন্যবহরে এমবুশ করে, ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে কিংবা বিজয়ীর বেশে মুক্তিযোদ্ধার হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে স্বপ্নের স্বাধীন দেশে প্রবেশ করতে পারত, সে তারুণ্য দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে ঘুমিয়ে রইল মাত্র চারজন স্বজনের চোখের জলে মাখামাখি হয়ে। একজন প্রতিবাদী বাঙালি তারুণ্যের এই বিদায়ও দেশের মাটির ভালোবাসা পায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়