নৌপথ ও বন্দরগুলো ঠিক আছে কিনা তা লক্ষ্য রাখতে হবে : নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

গুরু পাপের লঘুদণ্ড!

পরের সংবাদ

একজন বীরাঙ্গনা মায়ের জীবন সংগ্রাম ত্যাগ ও প্রতিজ্ঞার আখ্যান

প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আনিসুল হক তার মা উপন্যাসের জন্য বাংলা সাহিত্যে একটি স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন। তার এই উপন্যাস শততম বারের মতো মুদ্রণ হয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার মায়ের সংগ্রাম, ত্যাগ ও প্রতিজ্ঞার কথা আমরা জানতে পাই সেই উপন্যাস পড়ে। এই লেখকের সম্প্রতি অমর একুশে বইমেলা ২০২৪- এ প্রকাশিত আরেকটি সাড়া জাগানো কাজ হলো কখনো আমার মাকে। এই শিরোনামে কবি শামসুর রাহমানের একটি কবিতা আছে বাংলা সাহিত্যে। যেখানে কবি তার মায়ের সাদামাটা জীবন ও সহজ সাধারণ স্বভাবের দিকটি তুলে ধরেছেন। সাহিত্যে মা নিয়ে আরো অনেক কবিতার সন্ধান আমরা পাই। এর মধ্যে একটা বিখ্যাত কবিতা হলো এডগার এলানপো রচিত ‘টু মাই মাদার’। প্রসঙ্গক্রমে এখানে কবিতাটি আমার অনুবাদে উদ্ধৃত করছি :
আমার মাকে
এডগার এলান পো

আমি বুঝতে পারি, আসমানের স্বর্গে,
ফেরেস্তারা কানাকানি করছে পরস্পর,
তাদের অমিয় ভালোবাসা খুঁজে পেয়ে
মায়ের ভালোবাসার মতো ত্যাগী আর কোনটাই নয়।
তারপর সেই প্রাণের নাম ধরে ডাক দেই তোমায়
তুমি আমার মায়ের চেয়েও বেশি,
এবং পূর্ণ করো অন্তরের অন্তস্থল, যেখানে মৃত্যু
তোমায় অধিষ্ঠিত করেছিল
ভার্জিনিয়ার ধকল কাটিয়ে উঠতে।
আমার মা- আমার নিজের মা, যে আগে মারা গিয়েছিল
আমার মা-ই ছিল, কিন্তু তুমি
মা ছিলে আমার প্রিয়ার
এভাবেই তুমি প্রিয়তর ছিলে আমার কাছে
সেই ভালোবাসা যার গুণে
আমার প্রিয়া আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছিল।
আমাদের আলোচ্য উপন্যাসে আমরা দুইজন মায়ের সন্ধান পাই। দুইজন বড় মা ও ছোট মা নামে তাদের সন্তানদের কাছে পরিচিত। তবে উপন্যাসের কেন্দ্র হলো তাদের ছোট মা। যিনি একজন সুশিক্ষিত, মুক্তিযোদ্ধা নারী। তার যুদ্ধ জীবন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী জীবনকে আবর্তন করে এই উপন্যাসের প্লট নির্মাণ করেছেন আনিসুল হক।
কখনো আমার মাকে উপন্যাসটাকে আমরা নানাভাবে মূল্যায়ন করতে পারি। এটাকে একদিক থেকে ইরষফঁহমংৎড়সধহ বলা যেতে পারে। আবার এটাকে আমরা একটি নিখাদ পারিবারিক উপন্যাস হিসেবেও সংজ্ঞায়িত করতে পারি। একইভাবে এটাকে কিশোরদের উপযোগী একটা যুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসও বলা যেতে পারে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আনিসুল হকের এই উপন্যাস দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সম্বোধন করে। এক. এটি একজন মুক্তিযোদ্ধা নারীকে সমাজে পুনর্বাসনে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সৎ সরকারি কর্মকর্তার উদারতার প্রতীক। দুই. একই পরিবারে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে একই ব্যক্তির দুইজন স্ত্রীর সুখে সংসার যাপনের এক অনন্য নজির হিসেবে স্থাপন করা যেতে পারে এই উপন্যাসকে। কারণ এই পরিবারের ঘটনাপ্রবাহগুলো নানা জটিল সমীকরণে বন্দি। তবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের উদারতা প্রদর্শনে সফলতার কারণে দিন শেষে এটি একটি নজির স্থাপন করা পারিবারিক উপন্যাস।
কখনো আমার মাকে উপন্যাসে পাঁচ ভাইবোনের বাবা মা এবং কে কার আপন ভাইবোন সেটা নিয়ে একটা ধাঁধা লেখক প্রায় শেষ পর্যন্ত জারি রেখেছেন। উপন্যাসে উল্লেখিত পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়জন আসলে যুদ্ধ সন্তান। বাবলুর মাকে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে। যুদ্ধ শেষে তিনি ক্যাম্প থেকে পরিবারের কাছে ফিরতে চাইলে তখন তার বাবা ফেরত নিতে অস্বীকার করেন। তখনই একজন মুক্তিযোদ্ধা ও সৎ সরকারি কর্মকর্তা তাকে ব্যাক ডেইটে বিয়ে করে সংসারে তোলেন। তবে তার ঘরে একজন স্ত্রী ছিলেন। তিনি সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম ছিলেন শুরুর দিকে। বিয়ে করে তিনি সেই সন্তানকে নিজের সন্তান হিসেবে কাগজে-কলমে নথিভুক্ত করে নেন। তবে এ কথা পরিবারের কোনো সদস্য তাদের মায়ের মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত জানত না। উপন্যাসে উল্লেখিত বড় মা ও ছোট মা এমনভাবে সন্তানদের বড়ো করেন বাচ্চাদের কোনোদিনই মনে হয়নি কে আপন মা আর কে বড় মা। একই ঘটনা ঘটে ছোটলুর ক্ষেত্রে। শেষ বয়সে বড় মার পেটে জন্ম নেয়া ছোটলু তার মাতৃবিয়োগের পরও ছোট মাকেই তার মা ভাবত। দুইজন মহিলার সমন্বিত প্রয়াস, উদারতা, সহনশীলতা এবং মানবিকতার কারণে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থেকে নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ছেলেমেয়েদের সবাইকে সফল হিসেবে বড় করতে পেরেছেন।
পরিবার সমাজ গঠনের অন্যতম ভীত। কখনো আমার মাকে উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই একটা মজবুত পারিবারিক ভীত বড় এই পরিবারকে সুখে, দুঃখে, শত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এক হয়ে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। একই বাবা-মার সন্তান না হওয়া সত্ত্বেও তারা অসম্ভব দৃঢ় একটা বন্ধনে আবদ্ধ থেকে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে সফলতার মুখ দেখেছে।
আমাদের যাদের বেড়ে ওঠা গ্রাম-মফস্বল মিলিয়ে তাদের জন্য কখনো আমার মাকে একটা স্মৃতি জাগানিয়া উপন্যাস। আত্মীয়, পরিবার-পরিজন ছেড়ে পড়ালেখার লক্ষ্যে শহরে আসা, ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হয়। প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগোতে থাকা ব্যক্তি মানুষের পক্ষে আর মূলে ফিরে আসা সম্ভব হয় না। সব পাখি নীড়ে ফিরলেও প্রফেশনাল ডায়াস্পোরা এসব মানুষের পক্ষে আর ঘরে ফিরে আসা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান দুর্নীতির চিত্রও ফুটে উঠেছে কখনো আমার মাকে উপন্যাসে। বাবলু-মাবলুদের বাবা সরকারি সার্কেল অফিসার ছিলেন। বিদ্যমান দুর্নীতির জালে নিজেকে না জড়ানোর অপরাধে তিনি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হন। বিনা অপরাধে শাস্তি পাওয়ার অপমান সহ্য করতে না পেরে ভদ্রলোক আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। আমরা পরবর্তী সময়ে মাবলুর মানসে সেটার প্রতি প্রতিশোধ নেয়ার স্পৃহা দেখতে পাই। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তিনি বিএসসি পড়েন। বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতেও জয়েন করেন। অবশ্যই চাকরিতে জয়েন করার আগেও তাকে বেগ পেতে হয়। বিনা অপরাধে অভিযুক্ত তার বাবার সেই মামলার সূত্র ধরে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে নিয়োগ থেমে গেলে মাবলুর ছাত্রীর বাবার হস্তক্ষেপে বিষয়টা সুরাহা হয়। এখানেও আমরা সরকারি চাকরি ও আমলাতন্ত্রের জটিলতার চিত্র দেখতে পাই।
হাবলু-মাবলুদের মায়ের প্রত্যাশা পূরণ হয় উপন্যাসে। মায়ের প্রত্যাশা নিয়ে পাকিস্তানের বিখ্যাত কবি আল্লামা ইকবালের মায়ের প্রত্যাশা কবিতাটা এখানে উদ্বৃত করছি :
‘মায়ের স্বপ্ন’
আল্লামা ইকবাল
এক রাতে ঘুমাতে গিয়ে এই স্বপ্নটা দেখেছিলাম
যা আমার বিরক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিল
স্বপ্নে আমি কোথাও যাচ্ছিলাম
নিকশ কালো আঁধার, পথ খুঁজে পাওয়া মুশকিল
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে
এক কদম এগোনো অনেকটা অসম্ভব

সাহস করে যখন এক কদম দুই কদম এগোলাম
দেখলাম কতক বালক সুন্দর লাইনে দাঁড়িয়ে
সবুজ কাপড় গায়ে
জ¦লন্ত বাতি হাতে নিয়ে

হেঁটে যাচ্ছিল নীরবে পরপর
কেউ জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে
এই চিন্তায় মগ্ন আমি
লাইনে যখন আমার ছেলেকে দেখলাম
পেছন দিকে হেঁটে যাচ্ছিল
জোরে নয়
তার হাতের বাতিটা জ¦ালানো হয়নি
চিনতে পেরে তাকে বললাম ‘বাবা!
কোথায় এসেছ আমায় ছেড়ে?
অস্থির আমি বেদনায়
অনন্তকাল কেঁদে যাওয়া আমি
তুমি একটু ও ভাবলে না আমার কথা
ছেড়ে এলে আমায়!’
ছেলেটা বেদনাহত আমায় দেখে
জবাব দিল, আমার দিকে ঘুরে
‘আমাকে হারিয়ে কাঁদছো তুমি
এটা আমার কোন মঙ্গল বয়ে আনছে না’
বলে কিছুক্ষণ চুপ রইল সে
বাতিটা দেখিয়ে মুখ খুলল

‘জানো কি হয়েছে এটার?
তোমার চোখের জল নিভিয়ে দিয়েছে এটার আলো’। (অনুবাদ : আলমগীর মোহাম্মদ)
বাবলু, ডাবলু, লাভলু, মাভলু ও লাভলীদের মা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আর কখনো গান করেনি। অত্যন্ত মেধাবী একজন কলেজ ছাত্রী পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত হন। পরবর্তী সময়ে জন্ম দেন একজন যুদ্ধ শিশুর। সংসারে এসে চিরদিনের জন্য সংগ্রামে লেগে পড়েন। ভুলে যান নিজের সাধ আহ্লাদের কথা। লেগে পড়েন সন্তানদের মানুষ করার কাজে। উপন্যাসের শেষের দিকে আমরা দেখতে পাই তার স্বপ্ন পূরণ হয়।
একজন বীরাঙ্গনা মায়ের জীবন সংগ্রাম, ত্যাগ ও প্রতিজ্ঞার আখ্যান কখনো আমার মাকে। হারানো শৈশব, দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন, মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠার সুন্দর অভিজ্ঞতা, হঠাৎ করে বাবার মৃত্যুতে খেই হারিয়ে ফেলা পরিবারে বড় সন্তানের হাল ধরা, ছোট ভাইবোনদের স্বার্থে নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দেয়া, সংসার গঠনে মায়েদের অনস্বীকার্য ত্যাগ এবং বড় পরিবারে একসাথে পাঁচ-ছয়জন ভাইবোন বেড়ে ওঠার বাস্তবিক বর্ণনা পাই আমরা এই উপন্যাসে। কখনো আমার মাকে পড়ে আমি ‘পাঠের আনন্দ’ পেয়েছি। একই সঙ্গে একটা সুন্দর গোছানো শৈশব না পাওয়ার আক্ষেপ পেয়ে বসেছে আমাকে। লেখক আনিসুল হককে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়