খালেদা জিয়া হাসপাতালে ভর্তি

আগের সংবাদ

শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা উধাও

পরের সংবাদ

নৃ-তত্ত্ব, ভাষা জিজ্ঞাসা ও শিনোকান কবিতা

প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রফেসর বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রায়ই একটা কথা আমাকে বলতেন, ‘বিদেশে গিয়ে পড়ালেখা করে আসুন’। এ কথা কেন বলতেন তিনি, অমন করে এবং এতবার, এখন বুঝি। প্রফেসর জাহাঙ্গীর জানতেন আমি ভাবনা-চিন্তা করতে ভালোবাসতাম, এ-ও জানতেন বিদেশে গেলে আর কিছু না হলেও ভাবনার সাহস তৈরি হবে। দেশে আমরা ঔপনিবেশিক অতীতের কথা বলতাম এবং সেই অতীতের বিরোধিতা আমাদের লেখালেখির কাজের একটা প্রেরণা ছিল। ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের বিরোধিতার সূত্রে গড়ে ওঠা উত্তর-ঔপনিবেশিক আলোচনার ডাঙা কেন এবং কি করে খাঁটি কিংবা বিশুদ্ধ স্বদেশি হয়ে উঠতে পারে না, দীপেশ চক্রবর্তীর লেখা পড়ে তা বুঝবার সুযোগ হয়। দর্শনে রুচি থাকলে একথা বুঝতে কারোই অসুবিধে হবে না, ‘দ্ব›দ্ব’ কিংবা ‘পার্থক্য’ কখনোই একটা বিষয়ের সঙ্গে আরেকটা বিষয়ের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘোষণা করে না, কারণ ‘সম্পর্ক’ ছাড়া কোনো কিছুর ‘পার্থক্য’ নির্ণয় সম্ভব নয়। যখন আমরা কোনোকিছুর পার্থক্য দেখাই, তখন একটা-কোনো সম্পর্কের সূত্র নিশ্চয়ই প্রথমে ধরে নেই। ‘সম্পর্ক’ ছাড়া কোনো কিছুর সঙ্গে কোনো কিছুর ‘পার্থক্য’ ঘটে না। এ কথাটিই কিছুদিন আগে মার্শাল শাহলীনস আহারান্তে দেয়া একটি ছোট্ট বক্তৃতায় বলছিলেন এভাবে যে, আজকের সমাজ বিদ্যা ও নৃতাত্ত্বিক জ্ঞানে বৈপরীত্য, পার্থক্য, ভিন্নতা এসব খুব জোর দিয়ে তোলা হচ্ছে। তোলা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যান ও উপস্থাপনার অসম্ভবপরতা নির্দেশ করার জন্যে। জেমস ক্লিফোর্ডের ‘সংস্কৃতি লেখন’ (১৯৮৬) বইটির কথা আমাদের মনে পড়ার কথা, যার প্রভাবশালী ভূমিকায় ক্লিফোর্ড বলার চেষ্টা করছিলেন কেন নৃতাত্ত্বিকের এথনোগ্রাফি শেষাবধি সীমাবদ্ধ ও অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। প্রফেসর ক্লিফোর্ড বলতে চান নৃতাত্ত্বিক মাঠকর্মের ভিত্তিতে দূর জনপদের যে বৃত্তান্ত লেখেন- অন্যভাবে বলতে পারি ধ্রæপদী নৃতাত্ত্বিকরা যেভাবে এক শতাব্দী ধরে এথনোগ্রাফি লিখে আসছেন- তার ভেতর প্রধান যে অন্বেষা অন্তঃশীল তা হলো বেগানা সংস্কৃতির সত্য উদঘাটন করা এবং সেই সংস্কৃতির কাঠামো ও ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করা। ক্লিফোর্ডের মতে সময়ের ব্যবধানে নৃতাত্ত্বিকদের সিদ্ধান্ত ও মীমাংসায় আমাদের অবিশ্বাস জন্মেছে এবং তা ক্রমশ ভারি হয়ে প্রগাঢ় হয়ে ঘনীভূত হয়ে এমন বিস্ফোরণোন্মুখ হয়েছে যে আজকের পশ্চিমে ‘নৃতত্ত্ব’ নামক আস্ত শাস্ত্রটাই হুমকির সম্মুখীন। ক্লিফোর্ডের মতে ‘এথনোগ্রাফি’ শেষ পর্যন্ত একটা গড়ে তোলা আখ্যানই, একটা নির্মাণ, একটা সাহিত্যকর্ম। একটা উপন্যাস যেভাবে তৈরি হয় তার সঙ্গে এথনোগ্রাফির আখ্যান-রচনার খুব তফাত নেই। এভাবে সত্য সন্ধান ও সংস্কৃতির সিস্টেম উদঘাটনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর এক ধরনের ‘কাব্যিক এথনোগ্রাফি’ লেখার রেওয়াজ মার্কিন মুলুকে গড়ে ওঠে এবং তার সফলতা-বিফলতা সম্পর্কে অনেক চিত্তাকর্ষক গসিপ এ দেশের একাডেমিক অঙ্গনে চালু আছে। মার্শাল শাহলীনস বলছিলেন প্রাক্তনদের ত্রæটি নির্দেশ, বৈপরীত্য-ভিন্নতা-অসংগতিতে উচ্ছ¡াস, শতবর্ষকালীন শাস্ত্রীয় সকল অর্জনে সন্দেহ- এসবের ফলে এক ধরনের গভীর মূঢ়তার পরিবেশও তৈরি হচ্ছে। তিনি বলছেন, একমাত্র কমিটেড নৃতাত্ত্বিকের পক্ষেই তার মাঠকর্মের অভিজ্ঞতার সূত্রে এ কথা বোঝা সম্ভব যে, ফিজিতে ‘দুটো পরস্পর বিপরীত বিবৃতি অনিবার্যভাবে কোনো এক বিরাট অসংলগ্নতার নির্দেশ করে না’। তথ্য প্রদানকারী যদি সামোয়ান প্রধানদের সম্পর্কে একেবারে ভিন্ন ও বিপরীত গল্প বর্ণনা করেন, তাকে ‘অসংলগ্ন’ মনে করার কারণ নেই; কারণ ফিজিতে দুটো বিবৃতি ও বর্ণনা একেবারে আলাদা হয়েও ‘অসংলগ্ন’ বলে বিবেচিত হয় না। কেন হয় না তা বুঝতে হলে ফিল্ডওয়ার্ক ছাড়া কি আর কোনো পথ আছে?
নৃ-তাত্ত্বিক জ্ঞানের সারবত্তা সম্পর্কে সংশয় তৈরি হয়েছে অরিয়েন্টালিজম, উত্তর-ঔপনিবেশিক বুদ্ধিবৃত্তি, উত্তর-আধুনিক ও উত্তর-অবয়ববাদী আলোচনা, বিতর্ক, জিজ্ঞাসা ও ভাবনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে। নতুন নৃ-বিজ্ঞানীরা বলছেন সাংগঠনিক নৃ-বিজ্ঞান যেসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তদন্ত করে এথনোগ্রাফি লিখেছেন, সেসব ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’-কে খাঁটি বা বিশুদ্ধ বলা কঠিন, কারণ অনেকাংশেই তা উদ্ভাবিত, নির্মিত, রূপান্তরিত। আশির দশকে এরিক হবসবাওমের ‘ঐতিহ্যের উদ্ভাবন’ নামক বইটির একটা প্রভাব বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে পড়ে এবং সেই সূত্রে নৃবিজ্ঞানীরা তাদের বৃত্তান্তমালায় ‘ঐতিহ্য’ বিষয়ক যেসব বিবরণ দিয়েছেন তার খাঁটিত্ব সম্পর্কে গভীর অশ্রদ্ধা তৈরি হয়। মার্শাল শাহলীনসের প্রশ্ন হলো ঐতিহ্যের উদ্ভাবন সম্পর্কে এত বিস্মিত হবার কি আছে যেখানে পশ্চিমের গোটা সভ্যতার ভিত্তি ঐতিহ্যের উদ্ভাবনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে! পনেরো এবং সতেরো শতকে ইউরোপে একগুচ্ছ দেশি বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী কি ‘প্রাচীন সংস্কৃতি’ পুনর্নির্মাণের অভিপ্রায় নিয়ে ‘ঐতিহ্যের উদ্ভাবন’ করে যাননি? যাকে আমরা ইউরোপীয় সভ্যতায় আধুনিকতার সূত্রপাত বলে জানি, যাকে বলা হয় রেনেসাঁস, তা কি ‘ঐতিহ্যের উদ্ভাবন’ নয়? শাহলীন বলেন, রেনেসাঁসের শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা যতই বলুন তারা প্রাচীনতম খাঁটি বিশুদ্ধ উত্তরাধিকারকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন, তা খুব বিশ্বাস করার দরকার নেই। ‘তুলে আনার’ কথা বলে তারা ‘বানিয়ে তুলেছেন’ অনেক বেশি। কারণ যে ‘সংস্কৃতি’ তুলে আনার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন তারা, সে সংস্কৃতি অতদিনে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং যে-ভাষা ঐ ‘প্রাচীন সংস্কৃতির’ বাহক ছিল- ল্যাটিন ও গ্রিক- তা ততদিনে নানারকম ত্রæটি ও গোঁজামিলে পরিপূর্ণ, বিস্মৃত ও লুপ্তপ্রায়। এসব ইউরোপীয় বহু শতাব্দী ধরে খ্রিস্টান, কিন্তু তারপরও প্যাগান ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারকর্মে তাদের উদ্যম অদম্য। তারা প্যাগান দেব-দেবীকে অভ্যর্থনা জানায়, ধ্রæপদী মূল্যবোধের অনুশীলন শুরু করে। এভাবে এসব ইউরোপীয় পনেরো-ষোলো-সতেরো শতকে অত্যন্ত সচেতনভাবে ‘ঐতিহ্য উদ্ভাবন’ করে এবং সেই ‘উদ্ভাবিত ঐতিহ্য’-কে ‘খাঁটি প্রাচীন ঐতিহ্য’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তার লেভির ধরনে ইতিহাস লেখে, লাতিনের ঢঙে কাব্য লেখে, সেনেকার মতো করে ট্র্যাজেডি লেখে, টেরেন্সের ধরনে কমেডি- প্যাগান মন্দিরের আদলে গড়ে তোলে খ্রিস্টীয় গির্জা। একে বলা হলো ইউরোপীয় রেনেসাঁস, কারণ এ থেকে জন্ম হয়েছে আধুনিক সভ্যতা। মার্শাল শাহলীনস বলেন, রেনেসাঁসের নামে কৃতিত্বের মুকুট যারা পরলেন তাদের ‘ঐতিহাসিক ভাগ্য’ ছিল, এ কথা বলতেই হবে। যখন ইউরোপীয়রা ঐতিহ্য উদ্ভাবন করে ও বানায় তাকে আমরা বলি ‘খাঁটি সাংস্কৃতিক পুনর্জন্ম’, একটা প্রগতিশীল ভবিষ্যতের সূচনা। যখন ইউরোপের বাইরের লোকেরা তা করে তাকে বলি সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। এখানে যে জিনিসটি বুঝবার দরকার আছে তা হলো ইউরোপীয় জ্ঞানবৃত্তি-উদ্যমের একটা অধিবিচার মার্শাল শাহলীনসও করছেন কিন্তু বেশ ভিন্নভাবে, তার সমালোচনা একালের বিশ্রæত উত্তরাধুনিকদের মতো নয়, তিনি তারচেয়ে বড় ও মৌলিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। উত্তর-আধুনিক ও উত্তর-অবয়ববাদী লেখালেখি বহির্তলে বিচরণ করেছে বেশি, অর্থাৎ অধিবিচারের ক্ষেত্রে তারা গুরুত্ব দিয়েছেন ‘ভাষা-পরিসর’ ও ডিসকোর্সের রেটরিক ও অলংকারিকতাকে। শাহলীনসের ধরন স্ট্রাকচারাল, গভীর কাঠামোগত, নিগূঢ়।
মার্শাল শাহলীনস বলেন, একালের নৃতাত্ত্বিকদের বক্তব্য হলো ‘সুশৃঙ্খল এথনোগ্রাফি’ এখনকার দিনে আর লেখা যাবে না, কারণ যাকে আমরা সংস্কৃতি বলি এবং যার বৃত্তান্ত লেখা নৃতাত্ত্বিকদের বহুকাল-আচরিত পেশাকর্ম সেই সংস্কৃতি ‘সঙ্গতিপূর্ণ’ নয়- অর্থাৎ সুবিখ্যাত সেই দর্শনের নদীর মতো সংস্কৃতিও অনবরত বদলায়। একই নদীতে দুবার প্লান যেমন সম্ভব নয়, একই সংস্কৃতিতে দুবার পদক্ষেপ কাল্পনিক ঘটনা। সারকথা এই, নৃতাত্ত্বিকের বয়ান ও বৃত্তান্ত থেকে এবং সেই বয়ান-বৃত্তান্তে আচরিত পদ্ধতি থেকে মানবসমাজের সংস্কৃতি ও বাস্তবতা অনুধাবনের চেষ্টা খণ্ডিত হতে বাধ্য। নৃতাত্ত্বিকের বর্ণনায় সংস্কৃতির যে বিন্যাস ও বাস্তবতার যে উদঘাটন মেলে, তা নেহাতই আরোপিত, নৃতাত্ত্বিকের নিজস্ব উদ্ভাবন ও নির্মাণ।
এসব আরগুমেন্টের জবাব মার্শাল শাহলীনস ও সমমনস্ক অবয়ববাদী শাস্ত্রজ্ঞগণ দিয়েছেন, কিন্তু মীমাংসা খুব একটা হয়নি। বিপরীত মেরুর সা¤প্রতিক বিদ্বৎসমাজ মানবিক বয়ানের সীমাবদ্ধতা ও অসম্ভবপরতার কথা অনবরত উচ্চারণ করেছেন বটে, কিন্তু তাই বলে বয়ান বা বিদ্যাচর্চা, নৃ-তত্ত্ব বা অন্যান্য শাস্ত্র স্তব্ধ হয়ে যায়নি। বরং প্রতিষ্ঠিত শাস্ত্রগুলোর প্রধান অনুজ্ঞাগুলো অমান্য করে কিংবা এড়িয়ে বিভিন্ন শাখাস্ত্রোত তৈরি হয়েছে; তার ফলে শাস্ত্রের কর্তৃত্ববাদ দুর্বল হয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে তার ব্যাপ্তিও ঘটেছে। ব্যাপ্তির ফলে বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের কেন্দ্র দুর্বল হয়েছে, তার প্রধান প্রতিজ্ঞাগুলো শিথিল ও ভঙ্গুর হয়েছে এবং শাস্ত্রীয় সীমা লঙ্ঘন সাধারণ রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। নৃতত্ত্বের সা¤প্রতিক একটা বই পড়ে বোঝা মুশকিল তা সাহিত্যের না দর্শনের না রাজনীতির, একইভাবে সাহিত্য বিষয়ক বইপত্র হয়ে উঠছে নৃতাত্ত্বিক-সমাজতাত্ত্বিক-রাজনৈতিক।
বিভিন্ন শাস্ত্রের এই স্বতঃস্ফূর্ত বিনিময় ও আন্তরক্রিয়ার ফলে যে পরিবর্তন লক্ষণীয় তাকে ইংরেজিতে বলা হচ্ছে ‘দি লিংগুইস্টিক টার্ন।’ বাংলায় বলতে পারি ‘ভাষার দিকে ফেরা’। অর্থাৎ আলোচনার বিষয় যে শাস্ত্রীয় ঘরানারই হোক না কেন, তার মধ্যে ভাষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ‘ভাষা’ হয়ে উঠছে বিশ্লেষণের কেন্দ্র, ভিত্তি ও মূল। বহির্কাঠামো হয়ে উঠেছে অন্তরকাঠামোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; ‘ভাষা’ হয়ে উঠছে ‘বাস্তবতা’, কারণ ‘ভাষা’র বাইরে কোনো ‘গভীর নিগূঢ় বাস্তবতা’ নেই এবং তার মানে হলো ‘বাস্তবতা’ বলে কিছু নেই। মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ। এসব উৎপ্রেক্ষা পুরনো ও বহু ব্যবহৃত, তবু এসব ‘প্রায় ধ্রæপদী হয়ে-ওঠা’ উৎপ্রেক্ষা আমাদের বুঝবার পথ সুগম করতে সহায়ক। কিন্তু বিভিন্ন শাস্ত্রের পরিসরে যে বিপজ্জনক ও বেশ বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছে, তা আমার প্রবন্ধের কয়েকটি অনুচ্ছেদ ও অলঙ্কার থেকে ঠিক বোঝা যাবে না। পালাবদল পর্বের বইগুলো হাতে থাকা দরকার।
নৃতত্ত্ব ও অন্যান্য শাস্ত্রের বিভিন্ন বাঁক আর পালাবদলের কথা তুলেছি ‘ঊঃযহড়ঢ়ড়বঃরপং’ সম্পর্কে কিছু বলার জন্য। নৃতত্ত্ব নামক শাস্ত্রের শাখা স্রোতের প্রসঙ্গ আগেভাগে বলে নিয়েছি ‘ঊঃযহড়ঢ়ড়বঃরপং’-এ ফেরার জন্য। আমি ভালো করেই জানি, চটজলদি এসব বিষয়-আশয় নিয়ে কথা বলার বিপদ আছে এবং ছোট্ট একটা লেখায় কতটুকু বা সম্ভব সেও একটা প্রশ্ন। ‘ঊঃযহড়ঢ়ড়বঃরপং’-এর বাংলা কি হবে তা নিয়ে ড. সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে ই-মেইল চালাচালি করি। দুজন মিলে যেসব শব্দ প্রাসঙ্গিক হবে ভেবে বাছাই করি তা শেষ পর্যন্ত আমাদের সুখী করেনি। আমেরিকায় ষাটের দশক থেকে ঊঃযহড় শব্দের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়, প্রফেসর গারফিনকেলের ঊঃযহড়সবঃযড়ফড়ষড়মু দিয়ে এর সূত্রপাত। শব্দটি সুন্দর, ফলে জনপ্রিয়ও হয়, এবং মূলত চবড়ঢ়ষব অর্থে ঊঃযহড় শব্দের অমন ব্যবহার দেখা দেয়। কিন্তু যেহেতু প্রত্যেকটি শব্দ ব্যবহারগত পটভূমিকায় আত্মচারিত্র্যিক ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সেজন্যে ঊঃযহড়-এর বদলে চবড়ঢ়ষব জুড়ে দিলে তার সব ওজন ও মাত্রা মুহূর্তে নুয়ে পড়তে বাধ্য। যাই হোক ষাটের দশকে জেরমি রথেনবার্গ সর্বপ্রথম ঊঃযহড়ঢ়ড়বঃরপং শব্দটি ব্যবহার করেন। বাংলায় একে আমরা দৈশিক কাব্যতত্ত্ব বলতে পারি।
ঊঃযহড়ঢ়ড়বঃরপং বা দৈশিক কাব্যতত্ত্বের গোড়া ‘ভাষা’ সম্পর্কিত নতুন জিজ্ঞাসার মধ্যে খুঁজতে হবে। এ ক্ষেত্রেও মহাগুরু সোসুরের উল্লেখ অনিবার্য। সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক ভাষাতত্ত্বের প্রস্তাবকারী সোসুর বলেছিলেন যে, ভাষা হলো ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট ফরমাল সিস্টেম’। আরো সংক্ষেপে বলতে পারি ভাষা হলো একটা ‘বিমূর্ত ব্যবস্থা’ এবং ভাষা বিজ্ঞানীর কাজ হলো সেই ‘বিমূর্ত ব্যবস্থা’-র সংগঠন বিশ্লেষণ করা। তার প্রস্তাবের পূর্বে ‘ভাষাবিজ্ঞান’ ছিল না, যা ছিল তা অন্যকিছু, যেমন ভাষার ইতিহাস, ভাষার তুলনা, ভাষার বিবর্তনের ইতিবৃত্ত। সোসুর যখন বলছেন ভাষা হলো একটা ‘সিস্টেম’ তখন তিনি আসলে একটা বিপ্লবের কথা বলছেন, যা ভাষা সম্পর্কিত এবং বহুদিন ধরে প্রচলিত- সমস্ত ধারণা বদলে দেয়। মানবভাষা নামক বিমূর্ত ব্যবস্থার শৃঙ্ঘলা উদঘাটন ভাষা বিজ্ঞানীর কাজ। টেবিল চেয়ারে ভালো করে বসে ভাষা সম্পর্কে মনের মতো করে একটা বই লেখার সুযোগ তিনি পাননি, গত শতাব্দীর শেষের দিকে এই সুইশ বিজ্ঞানী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার সময় যেসব বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাই একত্র করে তার ছাত্রেরা তার মৃত্যুর পর গ্রন্থাকারে ছেপে দেয়। সোসুরের যেসব জীবনী লেখা হয়েছে তা পড়ে জানা যায় ভাষা বিজ্ঞান সম্পর্কে মনের মতো করে একখানা বই লেখার পরিকল্পনা তার ছিল, যা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধে হয়নি, প্রকাশিত ক্লাস-বক্তৃতাগুলোর কোথাও কোথাও কিছু অসঙ্গতি আছে বটে কিন্তু আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। একটা স্বতন্ত্র শাস্ত্রের জন্মদাতা হিসেবে সোসুরের প্রধান সমস্যা ছিল ভাষা সম্পর্কে এতদিন পর্যন্ত যেসব ধারণা চালু ছিল, তা দূর করা। সে খুব কঠিন কাজ ছিল এবং তার বক্তৃতাগুলো পড়লে বোঝা যায় প্রচলিত ধারণাগুলোর নিরাকরণ করতে গিয়ে বেশিরভাগ কথা তাকে বলতে হয়েছে। ভাষার আলোচনাকে একটা ‘বিজ্ঞানে’ পরিণত করা তার প্রথম লক্ষ্য ছিল। তার আগে ভাষা সম্পর্কে অনেকগুলো জনপ্রিয় বিশ্বাস ও সংস্কার সবার মধ্যে বদ্ধমূল ছিল, যেমন ‘ভাষা’র সঙ্গে ‘ধারণা’-র সম্পর্ক। ধারণা বা আইডিয়া ‘ভাষা’র আগে না পরে, এ ছিল একটা তর্ক। প্রায় সবাই মনে করতেন, আইডিয়া আগে এবং ভাষা পরে এবং ভাষা হলো ‘ধারণা’ বহন করার একটা উপকরণ মাত্র। ছোটবেলায় আমরা যেসব ‘আধুনিক’ ব্যাকরণ বই পড়েছি, তার মধ্যে সর্বত্র ‘মনের ভাব প্রকাশ’ করার কথাটি নিশ্চয়ই অনেকের মনে পড়বে। ‘ভাষা মনের ভাব প্রকাশ করে’- ভাষা সম্পর্কে এখনো কি আমরা সবাই প্রায় কাছাকাছি ধারণা পোষণ করি না? এই জনপ্রিয় ও জনবাদী ধারণায় ‘ভাষা’-কে একটা নেহাত মাধ্যম মনে করা হয়। সোসুর বললেন, ভাষা হল একটা ‘ঝুংঃবস ড়ভ ঝরমহং’ এবং ‘ভাষা’ বাদ দিয়ে ‘চিন্তা’ বলে কিছু নেই। ‘আগে থেকে বিদ্যমান বলে কোনো ধারণা নেই’ এবং ভাষার আবির্ভাবের পূর্বে কোনোকিছু ‘নির্দি’ (ফরংঃরহপঃ) ছিল না যা যে-কোনো চিন্তার একমাত্র লক্ষণ। সোসুরের পূর্বে ‘ভাষা’ অধ্যয়নের অর্থ ছিল ‘ভাষার ইতিহাস’ বর্ণনা করা এবং তার পরিবর্তন ও বিবর্তনের বৃত্তান্ত তুলে ধরা। তারা মনে করতেন ‘ভাষা’ হলো একটা হধসরহম ঢ়ৎড়পবংং, ভাষা বিভিন্ন বস্তু ও বিষয়ের ‘নাম’ দেয়; যেমন, ‘বৃক্ষ’ হলো ‘বৃক্ষ’ নামক একটি বস্তুর নাম, ‘শিশির’ হলো ‘শিশির’ নামক একটি বস্তুর নাম, ‘পাথর’ হলো ‘পাথর’ নামক একটি বস্তুর নাম। ভাষা যেহেতু একা নামকরণের প্রক্রিয়া কাজেই ‘বৃক্ষ’ শব্দের সঙ্গে ‘বৃক্ষ’ নামক বস্তুর, ‘শিশির’ শব্দের সঙ্গে ‘শিশির’ নামক বস্তুর এবং ‘পাথর’ শব্দের সঙ্গে ‘পাথর’ নামক বস্তুর অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক আছে। তারা বললেন, কেন একটি ‘নাম’ একটি নির্দিষ্ট বস্তু বা বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলো তা ঐতিহাসিক এমনকি প্রাগৈতিহাসিকভাবে নির্ণয় করে দেখানো সম্ভব। ইতিহাস, প্রাগৈতিহাস এবং তারও পেছনে ফেরে ‘নাম’ ও ‘বস্তু’র পড়রহপরফবহপব-এর কাছাকাছি মুহূর্তে পৌঁছানো সম্ভব বলে তারা মনে করতেন। সোসুর বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ভাষা তত্ত্ব নয় বরং নামের তালিকা ও নামকরণের প্রক্রিয়া ও তার ইতিহাস এসবের লক্ষ্য।
সোসুরের মতে ‘ভাষা’ হলো ভাষিক চিহ্নমালার শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থা এবং ভাষা বিজ্ঞানের কাজ হলো ‘ভাষিক চিহ্নমালার শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থার কাঠামো’ বিশ্লেষণ করা। মানবভাষা সবসময় একটা বিশেষ ও নির্দিষ্ট নিয়মে সংগঠিত, কাজেই মানবভাষা হলো একটা ‘সিস্টেম’, একটা ‘স্ট্রাকচার’, যেখানে অই ব্যবস্থা ও কাঠামোর সীমানার বাইরে যে কোনো একক ভাষাগত উপাদান সম্পূর্ণ অর্থহীন। ভাষার কাঠামোর বাইরে ভাষার সব উপাদান কতিপয় ধ্বনির সমাবেশ ছাড়া কিছু নয়। ভাষার কাঠামোকে সোসুর তাই দাবার ঘুঁটির সঙ্গে তুলনা করেছেন। দাবার ছকের বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে দাবার ঘুঁটিগুলোর কোনো অর্থ যেমন নেই, ভাষার কাঠামোর বাইরে ভাষার শব্দ বর্ণ এককগুলোর কোনো মানে থাকতে পারে না।
সোসুরের ভাষাতত্ত্বের মূল কথা তাহলে এই যে ভাষা ‘একটি ‘চিহ্ন’ ব্যবস্থা, ধ ংুংঃবস ড়ভ ংরমহং। এখন কথা হল ভাষার ‘চিহ্ন’ বলতে তিনি কি বোঝাচ্ছেন? সোসুরের মতে, ভাষার চিহ্ন (ঞযব ষরহমঁরংঃরপ ংরমহ) ‘একটি নাম’ ও ‘একটি বস্তু’র মধ্যে সমন্বয় সাধন নয় (‘বৃক্ষ’ একটি ‘নাম’ এবং ‘বৃক্ষ’ একটি ‘বস্তু’), ভাষার ‘চিহ্ন’ হলো একটি ‘ধ্বনি-প্রতিমা’ ও একটি ‘ধারণা’-র সমন্বয় (‘বৃক্ষ’ একটি ‘নাম’ এবং ‘বৃক্ষ’ একটি ‘বস্তু’), ভাষার ‘চিহ্ন’ হলো একটি ‘ধ্বনি-প্রতিমা’ ও একটি ‘ধারণা’-র সমন্বয় (‘বৃক্ষ’ হলো কতগুলো ধ্বনির প্রতীক বা প্রতিমা এবং ‘বৃক্ষ’ হলো বৃক্ষের একটি ধারণা)। সোসুর ভাষিক চিহ্নকে এক পৃষ্ঠার একটি সাদা কাগজের সঙ্গে তুলনা করেছেন যার এক পিঠে রয়েছে ‘ধ্বনি’ অন্য পিঠে ‘ধারণা’-এই ‘ধ্বনি’ ও ‘ধারণা’ মিলে তৈরি হয় ‘চিহ্ন’, ভাষার চিহ্ন। ভাষার চিহ্নকে তাহলে বলতে পারি ‘ধ্বনি’ ও ‘ধারণা’র সম্পর্ক বা সমন্বয়, সোসুরের মতে ভাষিক ‘চিহ্নে’র ‘ধ্বনি’ ও ‘ধারণা’ অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, ওতপ্রোত, পরস্পরসাপেক্ষ। তাহলে ভাষিক ‘চিহ্ন’ শুধুমাত্র ‘ধ্বনি’ নয়, বরং এমন ‘ধ্বনি’ যা ‘ধারণা’র নির্দেশক। পাঠক আশা করি খেয়াল করবেন, ভাষিক চিহ্নকে ‘অর্থপূর্ণ ধ্বনি’ না বলে আমি ‘ধারণার নির্দেশক ধ্বনি’ বলেছি। যাই হোক, সোসুরের ভাষিক চিহ্ন বিষয়ক কথাটি বুঝতে পারলেই তার ভাষাতত্ত্ব আমরা বুঝতে পারব। তার কথা এই যে, যখন আমরা ‘বৃক্ষ’ বলছি, তখন এখানে তিনটি জিনিস আছে :
(এক) বৃক্ষ- একটি ভাষিক চিহ্ন (ংরমহ);
(দুই) বৃক্ষ- কতগুলো ধ্বনি, ধ্বনি প্রতিমা, (ংরমহরভরবৎ);
(তিন) বৃক্ষ- বৃক্ষের একটি ধারণা (ংরমহরভরবফ);
পাঠক খেয়াল করবেন, এর মধ্যে ‘বৃক্ষ’ নামক ‘বস্তু’র উল্লেখ নেই। সোসুরের তত্ত্বীয় বিপ্লবের উল্লেখ করেছিলাম, বিপ্লবটা এখানেই। ‘বৃক্ষ’ একটি ‘চিহ্ন’’, যা কতগুলো ‘ধ্বনির প্রতিমা’ এবং যা বৃক্ষের একটি ‘ধারণা’র নির্দেশক। কাজেই ‘বৃক্ষ’ নামক চিহ্নের সঙ্গে ‘বৃক্ষে’র ধারণার সম্পর্ক আছে, কিন্তু ‘বৃক্ষ’ নামক ‘বস্তু’র কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা হয়তো বলব সে কি কথা! সম্পর্ক তো আছে- আস্ত একটা বৃক্ষ তো আমার চোখের সামনেই আছে। সোসুরের মত হলো, যে সম্পর্ক আমরা দেখি এবং তার আগেকার ভাষার আলোচকরা দেখেছেন তা হলো ধরে নেয়া চলে আসা সম্পর্ক অথবা সম্পর্কের একটি কল্পনা, যার সঙ্গে ‘বৃক্ষ’ নামক ভাষিক চিহ্নের কোনো সম্পর্ক নেই এবং সেজন্য তা ভাষাতত্ত্বের বিষয় নয়।
দৈশিক কাব্যতত্ত্বের কথা বলতে গিয়ে সোসুরের প্রসঙ্গ অনেকখানি জুড়ে থাকছে এজন্য যে, ষাটের দশকে এই নতুন কাব্যতত্ত্বের প্রস্থানভূমি জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত সোসুরের বক্তৃতাগুলো। দৈশিক কাব্যতত্ত্বের গোড়ায় আছে এক ধরনের নতুন ভাষা জিজ্ঞাসা। মনে রাখা দরকার, সোসুরের বক্তব্য ছিল ‘ভাষাতত্ত্বে’র বিষয় কি, আর দৈশিক কাব্যতত্ত্বেব প্রধান বিষয় হচ্ছে সোসুরের মূল ধারণা মেনে নিয়ে মানব ভাষার দিগন্তগুলো বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে বিস্তৃত করা সম্ভব কিনা। সোমুরের বক্তব্য ছিল ভাষার দুটো দিক (ক) লঁগ (খ) প্যারোল- ‘লঁগ’ হচ্ছে ভাষার মূল কাঠামো, বা ব্যাকরণ, যা স্থির, অপরিবর্তিত ও অপরিবর্তনীয়। মনে রাখা দরকার সোসুর, ডুর্খেইমের (ফ্রয়েডেরও) সমকালীন ছিলেন এবং ‘ভাষা’র মূল কাঠামো যে একটা সামাজিক সত্য, তাই ছিল তার বিশ্বাস। ভাষাতত্ত্বের বিষয় ‘লগঁ’, অর্থাৎ ‘ভাষা’র অপরিবর্তিত কাঠামো যা সামাজিকভাবে উদ্ভূত ও বিকশিত এবং যা অপরিবর্তিত এবং যার ওপর ব্যক্তির কোনো হাত নেই এবং ব্যক্তি যা পরিবর্তন করতে পারে না। ইংরেজি বাক্যে কেন ‘বিশেষ্যপদ’ আগে এবং ‘ক্রিয়াপদ’ পরে আসে তার কারণ আমরা জানি না, কিন্তু আসে এই জানি এবং তার উল্টা হলে ‘বাক্য’ হয়তো হবে কিন্তু তা ইংরেজি বাক্য হবে না। ইংরেজির এই যে ‘বিশেষ্যপদ’ ও ‘ক্রিয়াপদে’র কাঠামো এটি হলো ‘লগ’, এ ভাষার মূল কাঠামো এবং এর কোনো পরিবর্তন নেই। এই ‘লগঁ’-এর ওপর নির্ভর করে অগুণিত বাক্য আমরা তৈরি করতে পারি, করি, কিন্তু এই কাঠামো পরিবর্তন করতে পারি না। সোসুর তাই বলেন, ‘লগঁ’ নামক ভাষার মূল কাঠামো ব্যক্তির ইচ্ছার ফল নয় এবং ব্যক্তির ইচ্ছায় এর পরিবর্তন ঘটেনা। ‘লগঁ’ হচ্ছে একটা ভাষিক সত্য যা উৎসে আছে সমাজ, ব্যক্তি নয়। ‘লগঁ’ যদি হয় ভাষার কাঠামো, ‘প্যারোল’ হচ্ছে ভাষার ব্যবহার যা সতত পরিবর্তনীয়, যা ব্যক্তিভেদে বিচিত্র, অস্থির। ‘লগঁ’ সামাজিক রূপ, ‘প্যারোল’ ব্যক্তিগত; ‘লগঁ’ অনিবার্য ও অবধারিত, ‘প্যারোল’ আকস্মিক ও পরিবর্তনীয়। সোসুরের কথা হচ্ছে, ‘প্যারোল’ বা ভাষার ব্যবহারগত রূপ- বাংলায় বলতে পারি বচন- অবশ্যই গবেষণার বিষয় হতে পারে কিন্তু তা ‘ভাষা বিজ্ঞানে’র বেশ বাইরের ব্যাপার। যা অস্থির, পরিবর্তনশীল, ব্যক্তিভেদে বিচিত্র, যার উপাত্ত কারো পক্ষে বিজ্ঞানসম্মতভাবে একত্র করা ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়, তা ‘ভাষাতত্ত্বের’ বিষয় হতে পারে না। ভাষাতত্ত্বের বিষয় না হলেও সোসুরে মতে, তা অন্য তত্ত্বের বিষয় হতে পারে এবং বিস্ময়কর হলেও সত্য যে তিনি সেই তত্ত্বের নামকরণও করে গেছেন। তা হলো সেমিওলজি। সোসুর মনে করতেন, সেমিওলজি নামে একটা ব্যাপক শাস্ত্রের গোড়াপত্তন জরুরি, যার বিষয় হবে সামাজিক জীবনে ‘চিহ্নে’র ভূমিকা ব্যাখ্যা করা। সেমিওলজি চিহ্নের স্বভাব পরীক্ষা করবে এবং যেসব নিয়ম চিহ্নের স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করে তা ব্যাখ্যা করবে। চিহ্নবিজ্ঞান-সম্পর্কিত সোসুরের অত্যন্ত অল্প কয়েকটি অনুচ্ছেদের ইঙ্গিত অনুসরণ করে বিংশ শতাব্দীতে রোমান ইয়াকবস্ন, লেভি-স্ত্রোস ও অন্যান্য সেমিওলজির বিস্ময়কর বিকাশ ঘটান। সোসুর সেজন্য শুধু আধুনিক ভাষাতত্ত্বের নয়, আধুনিক চিহ্ন বিজ্ঞানেরও জনয়িতা।
সোসুরের বক্তৃতাগুচ্ছের পর (১৯১৬) আধুনিক ভাষা জিজ্ঞাসার সূচনা হয় এবং সোসুরের চিন্তার প্রভাব সুইজারল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, ফ্রান্স ও ডেনমার্কে ছড়িয়ে পড়ে। গড়ে ওঠে বিভিন্ন স্কুল, এর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী হলো ‘প্রাগ ভাষাতাত্ত্বিক স্কুল’ (১৯২৬)। গড়ে ওঠে বৈজ্ঞানিক ধ্বনিতত্ত্বের যুগান্তকারী ধারণামালা। ব্যাকরণ ও শৈলী সম্পর্কে কাজ হয় ব্যাপক। বিংশ শতাব্দীতে ভাষাতত্ত্ব ও ভাষাতাত্ত্বিক নন্দনতত্ত্বের যুগান্তকারী কাজ হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৪১ সালে রোমান ইয়াকবসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য চলে আসেন। নিউইয়র্কে রোমান ইয়াকবসনকে স্বাগত জানান নৃবিজ্ঞানী ফ্রানৎস বোয়াস। বোয়াসের বাড়িতেই ছিলেন ইয়াকবসন কিছুদিন, তারপর তিনি সরাসরি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর নিযুক্ত হন। (বাকি অংশ আগামী সপ্তাহে পড়–ন)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়