বিআরটিএ চেয়ারম্যান : টিআইবির প্রতিবেদন উদ্দেশ্য প্রণোদিত

আগের সংবাদ

মুনাফার টার্গেট ইফতার পণ্য

পরের সংবাদ

নারীর রাজনৈতিক সমতা কি এখনো রূপকথা!

প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে। জননেত্রী শেখ হাসিনার এই বিজয় বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিজয়। সমগ্র দেশ যখন জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার করাল গ্রাসে ডুবে যেতে বসেছিল, ইতিহাস বিকৃতির খেলায় মেতে উঠে নারীকে ধর্মের নামে ফতোয়া জারি করে অন্ধকারে বন্দি করার কালো ক্ষণে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় নারীদের জন্য মুক্তির বার্তা বহন করে এনেছিল। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার নারী-পুরুষের সমতার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জেন্ডারগ্যাপ কমাতে বিভিন্ন নীতি ও কৌশল গ্রহণ করেছিল। যার ফলে বাংলাদেশে জেন্ডার গ্যাপ কমেছে। ডড়ৎষফ ঊপড়হড়সরপ ঋড়ৎঁস (ডঊঋ)-এর এবহফবৎ এধঢ় ওহফবী-এর ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী জেন্ডার সংবেদনশীল নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিক থেকে বিশ্বের ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এসেছে ৬৫তম যেখানে ২০০৬ সালে ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ৯১তম অবস্থানে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী জেন্ডার গ্যাপ কমানোতে দক্ষিণ এশিয়ার ৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে রয়েছে এবং বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ স্থান পেয়েছে। এই সাফল্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমকালীন বিশ্বে নারী ক্ষমতায়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। এই রিপোর্ট অনুসারে বিগত ৫০ বছরের মধ্যে বিশ্বে একমাত্র বাংলাদেশেই নারী সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সরকারপ্রধান হিসেবে ক্ষমতায় আছে। নারীর উন্নয়ন সংক্রান্ত বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে ও সে লক্ষ্যে কাজও করে যাচ্ছে। বর্তমানে এদেশে নারী শিক্ষার হার অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এখন বাংলাদেশের সব সেক্টরে নারীদের স্বগৌরবের অবস্থান চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে বিশ্বে গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে বাংলাদেশের যে গৌরবময় অবস্থান তৈরি হয়েছে তার মূলে রয়েছে নারীদের একচ্ছত্র অবদান। নারীর এহেন পদচারণায় আপাত দৃষ্টিতে নারীকে সমাজের শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করা হয়। তাছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে সরকার ও বিরোধী দলের শীর্ষে নারী নেতৃত্বের অবস্থানের কারণেও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে একটি ভ্রমবার্তা তৈরি হতে পারে সাধারণের মনে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তা নয়।
বাস্তবে রাষ্ট্র ও সমাজ উভয় পর্যায়েই নারী এখনো অধস্তন পর্যায়ে রয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে সমাজে প্রচলিত পিতৃতন্ত্র নারীকে যে প্রান্তিক অবস্থানের দিকে ঠেলে দিয়েছিল তাতে নারী ছিল অধস্তন। নারীর মনোজগতের ওপর পুরুষদের নিয়ন্ত্রণ তাদের করেছে অধীনস্ত। তাইতো একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারী শিক্ষায়, দক্ষতায় এগিয়ে গেলেও বিদ্যমান সমাজ কাঠামোকে অক্ষুণ্ন রেখে পুরুষদের মতো নারীর ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সমান অধিকার অর্জনের স্বপ্ন নারীর জন্য এখনো রূপকথার সোনার হরিণের মতো অধরা। কোনো সমাজে নারীরা সত্যিকার অর্থে কতটুকু ক্ষমতায়িত হয়েছে তা বোঝা যায় সেই সমাজের নারীদের সম্পদে সমানাধিকার অর্জন ও সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ওপর। অর্থাৎ সামাজিক ক্ষেত্রে ও রাজনীতিতে নারীদের যথাযথ ক্ষমতায়িত হওয়ার ওপর। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলেও জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ তার জন্য অপেক্ষাকৃত কম। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে এখানে সংরক্ষিত আসনবাদে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক কম। দেশের অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোতে নারীদের মনোনয়ন দেয়া হয় না। এই নিয়ে নারী নেতৃদের ভাষ্য হলো, পুরুষের অর্থ ও পেশিশক্তির দৌড়ে বিজয়ী হয়ে মনোনয়ন পাওয়া নারীর জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এবারের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ১৯ নারী প্রার্থী। যা ৩০০ জনের মধ্যে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ২০০৮-২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৮-২২ এর মধ্যেই রয়েছে সংসদে সরাসরি নির্বাচিত নারী সদস্যের সংখ্যা। অথচ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী রাজনৈতিক দলসমূহে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার যে বাধ্যবাধকতা তা ২০২০ সালের মধ্যে অর্জন করার কথা থাকলে তা কোনো দলই রক্ষা করেনি। এমনকি আওয়ামী লীগের মতো প্রগতিশীল দলও তা রক্ষার ব্যাপারে এখনো উদাসীন। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় বর্তমানে এ সময়সীমা ২০৩০ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের পর স্থানীয় নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি দিলেও একই দৃশ্য লক্ষণীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্থানীয় সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সিটি করপোরেশনে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে সরাসরি ভোটে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রতি তিনটি ওয়ার্ডেও জন্য একজন নারী কাউন্সিলর সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসার বিধান রাখা হলেও নির্বাচিত হওয়ার পর নারীরা পুরুষ কাউন্সিলরদের মতো ক্ষমতার চর্চা করতে পারেন না। কারণ বিদ্যমান আইনে (সিটি করপোরেশন আইন-২০০৯) সিটি করপোরেশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেবা জন্মনিবন্ধন সনদ, ওয়ারিশ সনদ প্রদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সনদগুলো প্রদানের অধিকার প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসা নারী কাউন্সিলরদের দেয়া হয়নি। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষ ভেদে নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নিষেধ করা হয়েছে। নারী ও পুরুষ-কাউন্সিলরের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে প্রকট করে। এ নিয়ে নারী কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বলে তাদের ক্ষোভ ও বঞ্চনার বিষয়টি জানা গেছে। আবার নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখাতে তারা সাধারণ কাউন্সিলরের আসনগুলো প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার সাহস ও অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে। তাইতো সাধারণ কাউন্সিলরের আসনে প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নারীদের আইনি কোনো বাধা না থাকলেও তাদের অংশগ্রহণের হার প্রায় শূন্যের কোটায়। নারী মেয়র এর সংখ্যাও নগণ্য। দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে নারী মেয়র শুধু দুজন। এভাবে নারী শিক্ষায় ও অভিজ্ঞতায় এগিয়ে গেলেও স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে নারী পিছিয়ে রয়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশে। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের দৃশ্যপটও অনেকটা এই রকম।
দেশের মোট অর্ধেক জনসংখ্যা নারী, তাদের রাজনৈতিক কাঠামো থেকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের সার্বিক অগ্রগতি অসম্ভব, কারণ নারীদের এই ক্ষমতাহীনতা ও রাষ্ট্রের উন্নয়নহীনতার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। নারীকে যদি রাষ্ট্র সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার, সমান সুযোগ ও সমান মযার্দা দিতে চায়, তবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ কেবলমাত্র ভোট প্রদানের মাধ্যমে হয় না। এর জন্য প্রয়োজন ক্ষমতা কাঠামোয় নারীদেরও সমান প্রতিনিধিত্ব লাভ এবং নির্বাচিত হওয়ার পর দায়িত্ব পালনে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যথাযথ পরিবেশ ও আইনগত সক্ষমতা।
জাতিসংঘের নারী নীতিমালা অনুযায়ী নারীর সমানভাবে জনপ্রতিনিধির ক্ষমতা কাঠামোয় অংশগ্রহণপূর্বক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পূর্ণ অংশগ্রহণ ও আইনগত-ক্ষমতা চর্চার পূর্ণ সুযোগ পাওয়া আবশ্যক। যার বাস্তবায়ন এদেশে এখনো পুরোপুরি হয়নি। চলমান লিঙ্গীয় বৈষম্যমূলক সমাজে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে পেশিশক্তির অবসান ঘটিয়ে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন কতটুকু বাস্তবায়ন হলো তার পরিমাপের ওপর নির্ভর করবে একটি সমাজ কতটুকু সমতার। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে পিতৃতন্ত্রের বিপরীতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় নারীবাদীদের উদ্ভব ঘটেছিল। তারই হাত ধরে ঘটনাবহুল পথ পাড়ি দিয়ে ৮ মার্চ বিশ্ব নারীদিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও বেশ জাঁকজমকভাবে এই দিবস পালিত হয়। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য হলো-
‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ
এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ।’
প্রতিপাদ্যে নারীর সমঅধিকার ও সমসুযোগকে নিশ্চিত করতে বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক প্রতিপাদ্য। কিন্তু নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগকে এগিয়ে নিতে হলে বিদ্যমান আইনেরও পবির্তন আবশ্যক। নারীর জন্য বিনিয়োগ হোক নারীকে রাজনৈতিকভাবে যথাযথ ক্ষমতায়িত করার লক্ষ্যে। বাংলাদেশর সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমানাধিকার লাভ নিশ্চিত করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলে ও নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এখনো রূপকথার সেই সোনার হরিণের মতো অধরাই থেকে গেল। এই অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে জেন্ডার সমতাভিত্তিক উন্নত সমৃদ্ধ বিশ্বে প্রবেশের স্বপ্নে যে জাতীয় নারী উন্নয়ন প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১) নিয়েছে, তা যেন কঠোর তদারকির মধ্য দিয়ে বাস্তব রূপ পায় সেই চেষ্টা সংশ্লিষ্ট মহলকে করতে হবে। সেই লক্ষ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চায় যথোপযোগী আইনের মাধ্যমে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা গেলে নারীর সমতা রূপকথার গল্প নয় বরং বাস্তব উপাখ্যানে পরিণত হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন অর্জিত হলেই নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা আইনগত মুক্তি দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়