বিআরটিএ চেয়ারম্যান : টিআইবির প্রতিবেদন উদ্দেশ্য প্রণোদিত

আগের সংবাদ

মুনাফার টার্গেট ইফতার পণ্য

পরের সংবাদ

একাত্তরের দশ মাস

প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৮, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শ্রীজ্ঞান যতীন সরকার রচিত ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ বইটি সম্পর্কে পূর্বে আমি একটি অধ্যায় লিখেছি। ওই বইটি বলা যায়, এখন আমার নিত্যপাঠ্য। আত্মজীবনীর আদলে রচিত শ্রীজ্ঞানের গ্রন্থটি আমার ‘আত্মকথা ১৯৭১’ রচনায় খুবই সহায়ক হয়েছে। আমি যে সময় নিয়ে লিখছি, তিনি সেই সময় নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। অবস্থানগত কারণে আমার একাত্তরের অর্জিত অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার একাত্তরের অর্জিত অভিজ্ঞতার পার্থক্য যেমন আছে, তেমনি মিলও আছে অনেক। আমাদের গুরু-শিষ্যের মধ্যকার অনতিক্রম্য জন্মসূত্রটি আমাদের জীবনকে কতকগুলো অভিন্ন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছে। সে কারণে পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন গ্রন্থটি আমার জন্য আরো বিশেষভাবে সহায়ক হচ্ছে। আমি ওই গ্রন্থটি থেকে হয়তো খুব বেশি উপাত্ত বা তথ্য আমার রচনায় ব্যবহার করছি না, কিন্তু মহাসমুদ্রে পথ হারানো নাবিককে সমুদ্র তীরবর্তী বাতিঘর যেভাবে সাহায্য করে, আমার মুক্তিযুদ্ধের সমুদ্রযাত্রায় ওই গ্রন্থটি সেইরূপ বাতিঘরের মতোই আমাকে সাহায্য করে চলেছে। রাষ্ট্রবিপ্লবে একটি দেশের মানুষ হয়তো অনেক অভিন্ন অভিজ্ঞতাই অর্জন করে, কিন্তু সেটি হচ্ছে ঘটনার উপরিস্তরের আলেখ্য, তার ভেতর-স্তরে থাকে যোজন যোজন পার্থক্য। অভিন্ন ঘটনার মধ্যেও মানুষের আচরণে প্রচুর ভিন্নতা দৃষ্ট হয়। তাই দেখা যায়, কেউ হয়তো তার বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছে, আবার কেউ নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে বন্ধুকে নিধন করেছে। সেই কারণেই প্রতিটি আত্মজৈবনিক রচনাই বাইরে থেকে একরকম বলে মনে হলেও ভেতর থেকে সে বিচিত্ররূপে আলাদা। আত্মজীবনীমূলক রচনার মধ্যে আমরা অতিক্রান্ত সময়ের ইতিহাসটা যত অবিকৃতভাবে পাই, ইতিহাস-গ্রন্থে অনেক সময়ই সেভাবে পাই না। মনে হয় সেই বিবেচনা থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর আত্মজৈবনিক রচনার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মরহুম চার্চিলকে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল। আমার ধারণা, বাংলাদেশের কোনো লেখক যদি কখনো নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান- তবে তিনি তা পাবেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ আত্মজীবনীমূলক কোনো রচনার জন্য। সে ক্ষেত্রে শ্রীজ্ঞান যতীন সরকার রচিত ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ গ্রন্থটিকে আমি এগিয়ে রাখব। চার্চিল রচিত গ্রন্থের তুলনায় এই গ্রন্থটি আকারে ছোট হলেও প্রকারে, বিষয় গুরুত্বে, বর্ণনানৈপুণ্যে বা ভাষাশৈলী বিচারে মোটেও ‘ঊণ নয়’ বরং ইতিহাসনির্ভর গ্রন্থে উপন্যাস পাঠের আনন্দরসে সমৃদ্ধ ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ আরো বেশি হৃদয়সংবেদী।
আজ আমি মুক্তিযুদ্ধের বাতিঘরতুল্য আরো একটি সুসম্পাদিত গ্রন্থের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। বইটির নাম ‘একাত্তরের দশ মাস’। বইটির লেখক রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী। মোট পৃষ্ঠা ৮০০। প্রকাশক কাকলী প্রকাশনী। প্রকাশকাল ১৯৯৭-এর একুশের বইমেলা। যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে চান, বা ঐ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ বা ঐসব ঘটনার অভিঘাত থেকে জন্ম দেয়া তাদের নিজ-জীবনের অভিজ্ঞতার কথা দিনক্ষণ সহযোগে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করতে চান- তাদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সহায়ক দলিল-গ্রন্থ হচ্ছে এটি। এটি মুক্তিযুদ্ধের দশ মাসের একটি নির্ভরযোগ্য দিনপঞ্জি। সেখানে একাত্তরের ১ মার্চ থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দশ মাসের প্রতিটি দিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল-পত্র’-এর ভূমিকায় বলা হয়েছে- ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়সীমা হচ্ছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ‘একাত্তরের দশ মাস’ বলতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কে বোঝাননি। তিনি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্ত-বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কে তার বিপুলাকার গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এর ফলে বছর বা মাস বিচারে না হলেও সর্বমোট দিনের হিসেবে গ্রন্থের নামকরণের প্রতি সুবিচার করা হয়েছে বলেই আমি মনে করি। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নাটকীয় আনন্দ ও স্বস্তির মধ্য দিয়ে তার প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির সমাপ্তি টেনে ত্রিবেদী তার পাঠকদের এই ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছেন যে, বনবাস থেকে রামের প্রত্যাবর্তন পর্বটি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত রামায়ণ সম্পন্ন হয় না। গ্রন্থটিকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রলম্বিত করে ত্রিবেদী ‘একাত্তর সাল’ কথাটার একটা নতুন তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যাও দাঁড় করালেন আমাদের সামনে। তিনি যেন বলতে চাইছেন যে, আমাদের জীবনে এই একাত্তর একটা ভিন্ন অর্থ আছে। আমাদের এই একাত্তর খ্রিস্টবর্ষের সেই একাত্তর নয়। তারও বেশি কিছু। আলাদা কিছু। এটা হচ্ছে সেই মাতৃগর্ভকাল, যার ভেতর থেকে জন্মগ্রহণ করেছে বাংলাদেশ।
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী আমার বন্ধু। তিনি আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের কেউ নন। কর্মসূত্রে তিনি ছিলেন একজন আমলা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগরে প্রবাসী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামানের জনসংযোগ কর্মকর্তা। তা ছাড়াও কেন্দ্রীয় সাহায্য ও পুনর্বাসন কমিটির ওএসডি হিসেবে তিনি তখন শরণার্থী ও যুব প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোর দেখভাল করার গুরুদায়িত্বও পালন করেছিলেন, তখনই মুজিবনগরে রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এবং সে পরিচয় ক্রমশ বন্ধুতার পর্যায়ে উন্নীত হয়। বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে কিছুদিন আগে তিনি অবসর নিয়েছেন।
তার গ্রন্থের ভূমিকায় প্রাসঙ্গিক কারণেই ত্রিবেদী আমার কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে বইটির অন্যতম মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে আমার নিরলস পরিশ্রমের জন্য গ্রন্থকার আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তার সঙ্গত কারণ আছে। আমার ক্ষণস্থায়ী (১৯৮৭-১৯৯২) ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আজিমপুর সুপার মার্কেটস্থ শতাব্দী কম্পিউটারে তার বইটির অনেকখানি কম্পোজ হয়েছিল। আমার অনুজ নীহারেন্দু গুণ চৌধুরীই প্রধানত কম্পোজের কাজটা করত। আসল মুদ্রাক্ষরিক ছিল সে-ই। ত্রিবেদীর ভূমিকায় নীহারেন্দুর কথাও আছে। আমার দায়িত্ব ছিল প্রæফ দেখা। সেটা ১৯৯০ সালের কথা। ঐ বইয়ের কাজ করতে গিয়ে বাংলা-ইংরেজির মিশেল আর টিকা-টিপ্পনির অত্যাচারে আমাদের দুই ভাইয়ের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। আমার তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। ভাগ্যিস ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বীরদর্পে লড়াই করে আমি জামানত হারিয়ে সগৌরবে পরাজিত হয়েছিলাম। তাই ত্রিবেদীর গ্রন্থের পুরো কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই আমার প্রতিষ্ঠানটি লাল বাতি জ¦ালায়। আমার ঐ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটির আকাল মৃত্যু ঘটে। ফলে ঐ গ্রন্থের বাকি অংশ অন্যত্র (গতিধারা প্রকাশনী) কম্পোজ করা হয় এবং দীর্ঘ বিরতিতে শেষে কাকলী প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালের বইমেলায়। স্বীকার করতেই হবে, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণপুত্র শ্রীরবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর ধৈর্য তুলনাহীন। শ্রীশ্রীভগবান তার মঙ্গল করুন।
ভবিষ্যতে কখনো তার ঐ গ্রন্থটি আমার কাজে লাগবে, এমনটি তখন আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। তবে আমার কাজে না লাগলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-সন্ধানী সত্যনিষ্ঠ পাঠক ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচয়িতাদের যে খুব কাজে লাগবে, মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে আমার জন্য বিরক্তিকর হলেও তার এই বহু কষ্টরচিত গ্রন্থটি যে তাকে অমরত্ব দেবে, সে কথা তখন আমিই তাকে বলেছিলাম। ঐ গ্রন্থ সম্পর্কে আমার ভবিষ্যদ্বাণী অনেকটাই ফলেছে। ১৯৭১-এর ধারাবাহিক স্মৃতিবৃত্ত রচনা করতে এসে আমি বারবার হাত বাড়াচ্ছি ঐ গ্রন্থটির দিকে। ঐ গ্রন্থটি আমার হাতের কাছে না থাকলে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের ১৪ খণ্ড দলিলসমুদ্র আমাকে হাতড়ে বেড়াতে হতো। রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী শেষ পর্যন্ত অন্য কাউকে না হলেও আমাকে অন্তত সেই অভাবিত পণ্ডশ্রমের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছে। ফলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাটা আমার জন্য ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গ্রন্থটি দশ মাসে বিভক্ত। প্রতিটি মাসের জন্য একটি করে শিরোনাম রাখা হয়েছে গ্রন্থটিতে। ঐ শিরোনামগুলো গৃহীত হয়েছে বাংলা ভাষার কালোত্তীর্ণ কবিতা ও গানের চরণ থেকে। তার গ্রন্থের ভূমিকায় আমাকে সে মুদ্রাক্ষরিকের মর্যাদা দিলেও, শিরোনাম নির্বাচনে সে আমার কবিত্বের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করেছে, তাকে আমি বন্ধুকৃত্যের নিদর্শন হিসেবেই গ্রহণ করেছি। মুক্তিযুদ্ধে দশ মাস গ্রন্থে আমার জন্য বরাদ্দকৃত মাসটি হচ্ছে অক্টোবর মাস। ঐ মাসের শিরোনামে ব্যবহৃত আমার কাব্য পঙ্ক্তিটি হচ্ছে- ‘মানুষের মৃত হাড়ে সে এখন সশস্ত্র সন্ত্রাস…’
এই কাব্য-পঙ্ক্তিটি আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘না প্রেমিক না বিপ্লবী’র অন্তর্গত ‘মুখোমুখি’ কবিতায় আছে। পাঠকের খেয়াল থাকতে পারে যে ২৭ মার্চের দ্বিপ্রহরে ঢাকা থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে পালিয়ে যাবার সময় ঐ কবিতার প্রথম দুটি লাইন আমার মনে এসেছিল।
‘তাড়াতে তাড়াতে তুমি কতদূর নেবে?
এই তো আবার আমি ফিরে দাঁড়িয়েছি।’
পাকসেনাদের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে ঢাকা ছেড়ে নদীর ওপারে পালিয়ে যাওয়া ভয়ার্ত মানুষের মিছিলে দাঁড়িয়ে পাওয়া কবিতাটি নদীর ওপারে, শুভাড্যায় থাকাকালে ২৮ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল তারিখের মধ্যে কোনো এক সময় আমি লিখে শেষ করেছিলাম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার অব্যবহিত পরে রচিত আমার প্রথম কবিতা ছিল এটি। দ্বিতীয় কবিতা ‘আগ্নেয়াস্ত্র’। সেই কবিতা রচনার পটভূমি আমি পরে বলব। তার আগে বলব পাক সেনাবাহিনীর ‘জিঞ্জিরা আপারেশন’ সম্পর্কে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়