ঢাকা আইনজীবী সমিতি : সভাপতি-সম্পাদকসহ আওয়ামীপন্থিদের ২১ পদে জয়

আগের সংবাদ

অনুমোদনহীন রেস্তোরাঁই বেশি : ঢাকায় রেস্টুরেন্ট ২৫ হাজারের বেশি, ট্রেড লাইসেন্স মাত্র ২৮শর

পরের সংবাদ

টেলিপ্যাথি

প্রকাশিত: মার্চ ৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ৪, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাস চলছে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। সাভার থেকে শাহবাগ যাওয়ার এই রাস্তায় বরাবরই সময় বেশি লাগে। তবে হয়তো জীবনে এই প্রথমবার মন চাইছে এ যাত্রা আরো দীর্ঘ হোক। আগেও একসময় বিশেষ কারণে এই বিরক্তকর যাত্রা রোমাঞ্চকর লাগত, সে কথা পরে হবে। পাশের সিটে বসে আছে সদ্য তারুণ্য লাভ করা একটা মেয়ে, চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। বোধ হয় সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পা রেখেছে। এটাই সেই সময়- যখন বছরজুড়ে চলে বসন্তের মৌসুম। বাসের বেশির ভাগ মানুষকেই কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণের দল মনে হচ্ছে। এদের মাঝে নিজেকে সজীব ঘাসের মধ্যে এক টুকরো জরাজীর্ণতা বলে মনে হচ্ছে। বাস আবার ভয়ংকর জ্যামে পড়েছে, এখন বোধহয় আমাকেও বাকিদের মতো ফোনে চোখ রেখে অন্য দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে হবে, যেটা যাত্রাকালীন সময় আমার খুবই অপছন্দের। তবে রাস্তায় দীর্ঘ গাড়ির লাইন দেখার চেয়ে বোধহয় এটিই ভালো অপশন। মেসেঞ্জারে ঢুকতেই প্রথমে যার মেসেজ চোখে পড়ল সে আর কেউ না- আমার মেয়ে বিজয়া। আমার এই পাগল মেয়েটা সর্বক্ষণ আমাকে তার আপডেট দিতেই থাকে। আমি ভাবতেই পারছি না এই মেয়ে আমাকে এবার ঢাকায় একা আসতে দিয়েছে। বিজয়া তার বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে সিডনিতেই আছে। দেশে একটা জরুরি কাজ পড়ল বলেই আমাকে তাড়াহুড়ো করে আসতে হলো। দ্বিতীয় মেসেজ পেলাম সিডনিতে বাংলাদেশি কমিউনিটির একটা গ্রুপ থেকে, যেখানে আমাদের নেক্সট মিটআপের সিডিউল দেয়া হয়েছে। অনেকেই আসবে এই মিটআপে। তবে আমার মন বলছে, আগের বারের মতো সাহিল এবারো আসবে না, সে তার চিরাচরিত স্বভাবেই হুট করে গায়েব হয়ে যাবে।
সাহিল যে সিডনিতে থাকে, এটা আমি জানতাম না। সে হারিয়ে গেল ঠিক যেদিন আমাদের পথ চিরকালের মতো আলাদা হয়ে গেল, সেদিন থেকে। সেদিন যেদিন একটু সাহস করলে হয়তো আমরা আমাদের জীবনের গল্পগুলো অন্যরকমভাবে লিখতে পারতাম। সাহিল আর আমি এই বাসে করেই রোজ সাভার থেকে শাহবাগ যেতাম, বিশ্ববিদ্যালয় একসঙ্গে ক্লাস করা, ঘোরাঘুরি, আড্ডা আর হালকা খুনসুটি… কী সুন্দর ছিল দিনগুলো। সাহিল পাশে থাকলে এই দীর্ঘ বিরক্তিকর যাত্রা সহনীয় মনে হতো। সাভার আর শাহবাগের বাসে বারবার চলাচল করতে করতেই একদিন আমরা একে অপরের হৃদয় বিচরণ করতে শুরু করলাম, তারপর প্রণয়… আরো কত কিছু!
সাহিল আর আমার মধ্যে খুব অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল, যেটাকে সাহিল সহজ ভাষায় বলত টেলিপ্যাথি। এইতো একদিন বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবলাম- আজ সাহিল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে না, তার নিশ্চয়ই মন খারাপ। আমিও চললাম তার খোঁজ করতে। পরে জানতে পেলাম বাবা পছন্দের বাইক কিনে না দেয়ায় মহাশয়ের বড় অভিমান হয়েছে। তাই ক্লাসে না গিয়ে চায়ের দোকানে বসে দুঃখবিলাস করছে। আরেকবার সাহিল একদম লাপাত্তা, মনে হলো সাহিল ভালো নেই, ওর ভীষণ শরীর খারাপ। ওকে ফোন দিয়ে যখন জিজ্ঞেস করলাম- কিরে জ্বর কমেছে? স্যুপ বানিয়ে নিয়ে যাব? অপরপ্রান্ত থেকে হাসতে হাসতে সাহিল বলল- নিশ্চয়ই তুই আমার চারপাশে স্পাই লাগিয়ে রাখিস। না হলে আমি বারবার চেষ্টা করেও তোর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারি না কেন? তোর এই একটা স্বভাবের জন্যই তোর মতো প্রেমিকাকে একটু মিষ্টি জ্বালাতন করার সুযোগও আমি পাই না। আমি হাসলাম, তবে প্রত্যুত্তরে আমি যে গত রাতে স্বপ্নে ওকে অসুস্থ অবস্থায় বিলাপ করতে দেখেছি তা বলার প্রয়োজন মনে করলাম না। এমনই ছিল সাহিল। ওর সঙ্গে মান-অভিমান করে পারা যেত না, যতবার মান-অভিমান করে থাকতাম, ও ঠিক ধরে ফেলে মন ভালো করে দিতে চলে আসত।
তারপর একদিন ঠুনকো একটা কারণে অভিমান করে দূরে সরে গেল, আমিও গোঁ ধরে রইলাম। ভাবলাম সময় হলে ঠিক ফিরে আসবে। দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল তবে আর কোনোদিনও ফিরে এলো না। অনেকদিন আমি মানতে পারিনি- কী কারণে একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এভাবে সরে যাওয়া? তারপর সময়ের সঙ্গে বুঝতে পেরেছি- অনেক সময় হয়তো আমরা চাই আমাদের খুব ছোট্ট বিষয়গুলো নিয়ে কেউ ভীষণভাবে চিন্তিত হোক, আমাদের অভিমান ভাঙাতে আসুক, আমাদের একটু এক্সট্রা যতœ নিক।
যেই আমরা একসঙ্গে সম্পর্ক থেকে বিতর্ক সবকিছুর একটা বিশাল উত্থান-পতন, ঝুট-ঝামেলা মোকাবিলা করেছি; সেই আমরাই এভাবে একটা ঠুনকো অভিমানে আলাদা হয়ে গেলাম। ছোট্ট এক বিন্দু শিশির যেমন মলিন হয়ে যাওয়া কলাপাতাকে সজীব করে তোলে, ঠিক একই ঘটনা সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ঘটে। সেদিন আমরা দুজনেই বোধহয় একে অপরের জন্য একটু বেশিই নির্ভরশীলতা আর সহনশীলতার পরশ খুঁজেছিলাম। আমিও হয়তো চেয়েছিলাম- সেও আমার দিকটা বুঝুক। সেদিন একটু সাহস করতে পারলে বোধহয় জীবনটা অন্যরকম হতে পারত।
যাই হোক, সাহিল আগের বারের সেই অনুষ্ঠানে আসেনি। ভাবতে অদ্ভুত লাগে ৯ হাজার কিমি দূরেও আমার টেলিপ্যাথি কাজ করত! যখন আমি এবং আমার স্বামী ঢাকায় নিজেদের ছোট্ট সংসার গুছিয়ে নিচ্ছিলাম, ঠিক তখনই এক বিষণ্ন বিকালে আমার মনে হয়েছিল- নিশ্চয়ই সাহিল বাস্তবের এসব ঝুট-ঝামেলা থেকে বের হয়ে অপেরা হাউসের শহরে নিজের জীবনের নতুন অধ্যায়ের ভূমিকা খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞানের মতো কাঠখোট্টা একটা বিষয়ের গ্র্যাজুয়েশন আঁকড়ে ধরে নেই। হয়তো ফটোগ্রাফি করছে নতুবা সাহিত্যের সুরায় আচ্ছন্ন হয়ে জীবনে নতুন কোনো অবলম্বন খুঁজে বের করেছে।
এত বছরের জরাজীর্ণতায়, কমে যাওয়া উষ্ণতায়ও কিছুটা সংযোগ বোধ হয় এখনো থেকে গেছে, সম্পূর্ণ বিছিন্ন হতে পারেনি। তার প্রমাণ পেলাম আরো পাঁচ বছর পরে সিডনিতে তাকে দেখতে পেয়ে। আমাকে দেখে চমকে দিয়ে পথ বদলে ফেলেছিল। আমিও আর চাইনি কোনোদিন দেখা হোক। চেনা মানুষকে অচেনা খোলসে দেখা ভূত দেখার চেয়েও ভয়ংকর। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সেই প্রেমিক সাহিলকে আজকের ফেমাস কন্টেন্ট রাইটার গম্ভীর সাহিল হিসেবে দেখা আমার জন্য প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক। তাই আমি চাই, ওর সঙ্গে আমার আবার দেখা হওয়ার আগে পৃথিবীর সমস্ত রাস্তা যেন ফুরিয়ে যায়, যেসব প্রশ্নের উত্তর আজো মেলেনি সেসব প্রশ্ন পথ হারিয়ে যাক। হাজার বছর সাহিলকে দেখার আকুলতা থেকে যাক চোখের পাতাজুড়ে, তবুও চেনা সাহিল অচেনা হয়ে এ দুচোখে ধরা না দিক।
অনেক ভাবনার পর বাস শাহবাগে এসে থামল, আমার পাশে বসা মেয়েটি ফার্মগেটই নেমে গেছে। আমি শাহবাগে নামার পরেই এলো বৃষ্টি। ভিজতে ভিজতে ভার্সিটি এলাকায় পা দিতেই মনে হলো এ বৃষ্টি কিসের? এ বৃষ্টি কণা কি আমার অস্তিত্বজুড়ে ব্যঙ্গচিত্র এঁকে দিতে চায়? মনে করিয়ে দিতে চায় সেই সব দিনের কথা- যখন হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমি আর সাহিল সবসময় একে অপরের সঙ্গে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। অথচ সে প্রতিজ্ঞা আমরা রাখতে পারিনি। তাই আর কোনোদিনও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসা হয়নি। আজ বহু বছর পর একটা বিশেষ কাজে এলাম, আর এই বৃষ্টি রেখাও আমাকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়ল না। এত বছর পরে এই বৃষ্টি কি আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর পাঁয়তারা করছে? শেষবার বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আমাদের পথ আলাদা হয়ে যাওয়ার আগে যেসব প্রশ্ন জমা থেকে গিয়েছিল তার উত্তর পাওয়ার সময় কি এসে গেছে এই বৃষ্টিতে? না, এসব ভুল ভাবনা, কোনো টেলিপ্যাথি নেই আমাদের আর। বটতলা ধরে এগোতেই চোখে পড়ল মোটা ফ্রেমের চশমা পরা একজন গুটিশুটি দাঁড়িয়ে, ঠিক ১৫ বছর আগেকার সাহিলের মতো। এটা কে? আমার দিকেই আসছে কেন! কী সাংঘাতিক! সাহিল কেন এখানে? আমি তৎক্ষণাৎ পেছনে ফিরে চলে যেতে লাগলাম। এমন সময় একজন সুমধুর সুরে ডেকে উঠল- ‘নয়ন, কিছু কথা ছিল শুনবে কি?’ আর এতেই আমার যাওয়ার পথ ফুরিয়ে গেল। আমাদের সংযোগহীনতার সূচনা বোধহয় এজন্মে আর হবে না।

সাদিয়া সৌমিতা : শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়