১৪ মাস পর ঢাবি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন

আগের সংবাদ

চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারক বাঁধন

পরের সংবাদ

একুশের সাংবাদিকতা আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৫৩ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকতায় একটি নতুন ধারার সূচনা করে। এ ধারায় সাহসের সঙ্গে সত্য উচ্চারণ আর মাথা নত না করার অঙ্গীকার ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান হয়ে ওঠে একুশের সাংবাদিকতার নব উপাদান। আর এই আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় বাঙালি সফল হলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটায়। অনেকেই বললেন বাঙালির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘটল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব সংবাদপত্র দিনটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া শুরু করে আন্দোলনের পরের বছর থেকেই। ’৫২ সালেই ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ঘটনার কথা পরদিনই সংবাদপত্রে প্রধান শিরোনাম হয়। পরের বছর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শিরোনামে আসে সব সংবাদপত্রে। পরদিন বিবরণ ছাপা হয় দিবসটি পালনের জন্য আয়োজিত নানা ঘটনার। ভাষা আন্দোলনের খবরাখবর যথাযথ গুরুত্বসহ পরিবেশন করে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয় দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, দৈনিক ইনসাফ, সাপ্তাহিক সৈনিক, সাপ্তাহিক নও-বেলাল, দৈনিক মিল্লাত, সাপ্তাহিক নতুন দিন, সাপ্তাহিক নতুন খবর, সাপ্তাহিক পূর্ব বাংলা (মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ, সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ্, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, পৃ ৫১৮)। ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণার পর সংবাদপত্র বন্ধ থাকায় বিবরণ ছাপানো হতো ২৩ ফেব্রুয়ারি। এখন অবশ্য সংবাদপত্রে ছুটি থাকলেও বিশেষ ব্যবস্থায় পরদিন পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
শুরুর দিকের শিরোনাম ছিল ‘আজ একুশে ফেব্রুয়ারি’ বা ‘আজ অমর একুশে’। এখনো এ শিরোনামটা ব্যবহৃত হয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট অক্ষরে। এর পরিবর্তে বাংলা ভাষা বা ভাষা-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ’৬০-এর শেষ দিকে পর পর কয়েক বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক পাকিস্তান ৮ কলামে ব্যানার শিরোনাম করে ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সে সবার কীবা রীতি নির্ণয় ন জানি’। এ সময় বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা শুরু হয়। এর আগে নিয়মিত সংখ্যায় ছাপানো হতো বিশেষ প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ। ভাষা আন্দোলনের নানা ঐতিহাসিক তথ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার আঙ্গিকে প্রকাশের ধারাবাহিকতা আজো অব্যাহত রয়েছে। কর্মসূচি ও উদযাপনের খবরের বাইরে ইতিহাস নির্ভর রিপোর্ট ও ফিচার প্রকাশের মাধ্যমে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসকে একুশের সাংবাদিকতায় নিয়ে আসে দৈনিক পাকিস্তান ’৬০-এর শেষ দিকে। তখন এর বার্তা সম্পাদক তোয়াব খানের পরিকল্পনায় ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘আমরা বরকতের ভাই আমরা সালামের ভাই’ শিরোনামে প্রথম পাতায় এক কলামের রিপোর্ট প্রকাশ শুরু হয়। এটি ছিল পাঠকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। ভূঁইয়া ইকবাল এ রিপোর্ট লেখেন প্রথমে, পরে লিখেছেন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। শেষের পাতায় ক্রমান্বয়ে ছাপানো হয়েছে নানা আঙ্গিকের ফিচার। স্বাধীনতার পর সিঙ্গেল কলামের এ রিপোর্টের ধরনটি অন্য পত্রিকা অনুসরণ করে। এখনো এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। ভাষা শহীদদের নামে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে সিঙ্গেল কলাম রিপোর্ট এখন প্রায় সব দৈনিকের স্থায়ী পরিবেশনা। বাংলা একাডেমির বইমেলা শুরুর পর থেকে মেলার খবর একুশের সাংবাদিকতায় ক্রমেই প্রধান একটি বিষয়ে রূপ নিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভাষণ প্রকাশের ব্যাপারটি আমাদের মিডিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য প্রক্রিয়া। সে হিসেবে একুশে পদক বিতরণের খবরটি এখন ২১ ফেব্রুয়ারির একটি প্রধান খবর হিসেবে স্থান পেয়েছে বিশেষ করে সরকার প্রধানের ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে। বাংলা একাডেমির বইমেলার উদ্বোধনের খবরটিও একই কারণে ২ ফেব্রুয়ারি মিডিয়ায় গুরুত্ব পায়।

একুশের প্রথম সংকলন নতুন তথ্য
একুশের প্রথম সংকলন হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত ছিল হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। অনেক পরে জানা গেল প্রথম স্মরণিকা আসলে ‘ওরা প্রাণ দিল’। সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপানো হয় ‘সহকর্মী’। এটি ছিল ছদ্মনাম। তার আসল নাম প্রমথ নন্দী। ভাষা সৈনিক ফজলুল করিম তার স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে (বায়ান্ন’র কারাগার) সে কথা বলেছেন, যা সংবাদপত্র বৃহত্তর পাঠক সমাজকে অবহিত করেছে (সাজ্জাদ আরেফিন/একুশের প্রথম স্মরণিকা ‘ওরা প্রাণ দিল’, প্রথম আলো, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ. ১২)।
নতুন নতুন বিষয়-ভাবনা
সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনার আলোকে বা জাতিগত পরিচয়ের বিতর্কে কিংবা ভাষা চর্চার সংকটে একুশকে অবলম্বন করে নতুন নতুন বিষয়-ভাবনা স্থান করে নিয়েছে একুশের সাংবাদিকতায়। একুশের বিশেষ সংখ্যা এখন সকল সংবাদপত্রের একটি নিয়মিত প্রকাশনা, টেলিভিশন এবং অনলাইন মাধ্যমেরও নিয়মিত কর্মসূচি ‘একুশে’।

একুশের সাংবাদিকতা সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের প্রক্রিয়া দ্রুততর করার চাপ দিয়ে যায় বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মাসে। ’৬০-এর শেষদিকে আইয়ুব-মোনায়েমবিরোধী আন্দোলনে ঊনসত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের দৃপ্ত শপথ নেয়ার মহান অনুপ্রেরণা। এ দিন আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। আবার দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরাচারি শাসনের অবসানে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর নির্বাচিত সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলে, ওই বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রায় সব দৈনিক সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে স্বাগত জানিয়ে। এ অভিযাত্রার মূল প্রেরণা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি স্থান করে নিয়েছে একুশের সাংবাদিকতায়। গণতন্ত্র আর একুশে আরো একবার সমার্থক হয়ে ওঠে ১৯৯১-এর একুশ-পরবর্তী বছরগুলোতেও একুশের সাংবাদিকতা গণতন্ত্রের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে সামগ্রিকভাবে। ভাষা অন্দোলনের ৬০তম বছরে (২০১২) সংবাদপত্রগুলো দেশের রাজনৈতিক সংঘাত ও অনিশ্চয়তার চাপের মধ্য দিয়ে গেলেও একুশে ফেব্রুয়ারি বরাবরের মতো ছিল তাদের উল্লেখযোগ্য বিষয়। এ সময় তরুণদের দায়িত্বসচেতন করার প্রয়াস লক্ষ করা যায় মিডিয়ায়। ভাষাসৈনিকরাও সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার সফল করে তোলার ব্যাপারে তরুণদের ওপর তাদের ভরসার কথা বলেন জোর দিয়ে। নবীন ভাষাপ্রেমীরাও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবি তোলেন। এ বছর বায়ান্নর ভাষাসৈনিকদের হাত ধরে, মশাল জে¦লে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষার বিকৃতি রোধের শপথ নেন নতুন প্রজন্মের ভাষাপ্রেমীরা। একুশের চেতনা পরিষদের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবিতে ৩১ জুলাই ২০১০ ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক-এর নেতৃত্বে এ শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এখানে একটি প্রশ্ন বড় করেই উচ্চারিত হয় ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে বাধা কোথায়?’ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন বলবৎ থাকলেও জাতীয় জীবনের কোথাও এর প্রয়োগ নেই। দেশের প্রায় ৮০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতেও অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে বিষয় হিসেবে বাংলা পড়ানো হয় না। নতুন শতকের প্রথম দিকে প্রাইভেট এফ এম চ্যানেলগুলোতে বিকৃত বাংলা উচ্চারণ ও অহেতুক ইংরেজির ব্যবহার এতটাই বেড়ে যায় যে শেষ পর্যন্ত সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। অবশ্য এটি সরকারের কাজ নয় বলে কেউ কেউ মন্তব্য করলেও সরকারের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। শুধু এফ এম চ্যানেলে উচ্চারণ ঠিক করে বা স্যাটেলাইট টেলিভিশনে অনুষ্ঠানের নাম ইংরেজিতে না রাখা হলেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে স্যাটেলাইট টিভি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলব বাংলাদেশের টিভি অনুষ্ঠানের নাম ইংরেজিতে রাখার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। এতে ভাষার দীনতা প্রকাশ পায়। আলাদা করে ইংরেজি ভাষায় অনুষ্ঠান হতে পারে। বাংলা অনুষ্ঠানের নামকরণ ইংরেজিতে কম হওয়াটাই শোভনীয়। তবে এটা ঠিক, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের খবরদারিতে এর সমাধান হবে না। এখানে মিডিয়ারও দায়বোধ রয়েছে। তবে নাগরিক সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে দৃঢ়তার সঙ্গে। কারণ ব্যাপারটি মানুষের জীবনযাপনের অংশ। একুশের সাংবাদিকতায় এ বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই স্থান পায়।
একুশে নিয়ে বাণিজ্যায়নের যে প্রয়াস লক্ষ করা যায়, তাতেও আমরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুসন্ধান করতে পারি। বর্ণমালায় সাজানো পোশাক, বিভিন্ন ব্যবহার সামগ্রী, উপহার দ্রব্য আসলে একুশের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। একদিনের উদযাপন থেকে সারা মাস একুশ বিস্তৃত হয়েছে বইমেলাকে কেন্দ্র করে। এ মাসটি গ্রন্থপ্রকাশের প্রধান সময় হয়ে উঠেছে। প্রকাশকদের জন্য এটি বাণিজ্যের মাস। মিডিয়া বিষয়টিকে সে রকম ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছে। সর্বস্তরে বাংলার প্রচলনের ক্ষেত্রে এ বাণিজ্যায়ন সামাজিক প্রভাব ফেলছে।
২১ তারিখে গণমাধ্যম বরাবরই সরব। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন- সব ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সমসাময়িক জীবনধারার দিকগুলো তুলে ধরেছেন।
একুশ মানে মাথা নত না করা। এ আদর্শকে ধারণ করেই ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৯০-এর গণতন্ত্রের সংগ্রামে আমরা সফল হয়েছি। মিডিয়া বরাবর জনগণের সঙ্গে অবস্থান নিয়েছে, গণমুক্তির আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সহযোগী হয়েছে। শত রক্তচক্ষু মিডিয়াকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। দেশে গণতন্ত্রের অর্থবহ ভিত মজবুত করার লক্ষ্যে, মানুষের কথা বলা ও স্বাধীন চিন্তার অধিকার রক্ষায়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে আজকের গণমাধ্যম একুশের সাংবাদিকতার ঐতিহ্য রক্ষা করবে, স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে কখনো মাথা নত করবে না- এ বিশ্বাস আমাদের অটুট।

একুশে সংবাদপত্রের পাতায়
একুশে ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে প্রভাব ফেলেছে শুরু থেকেই। মাতৃভাষা বাংলার কথা, আন্দোলনের কথা, ত্যাগের কথা, সালাম, রফিক, জব্বারসহ সব সংগ্রামী মানুষের কথা গণমাধ্যম তুলে ধরেছে গুরুত্ব দিয়ে। প্রতি বছর ক্রমাগত এর অবয়ব বেড়েছে, কৌশল পরিবর্তন হয়েছে, উপস্থাপনার আঙ্গিক নতুন রূপ নিয়েছে। মূল পত্রিকার সঙ্গে এ দিন থাকে একটি বিশেষ সংখ্যা। মাসজুড়ে পত্রিকাগুলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্রগুলোতেও একুশে ফেব্রুয়ারি স্থান করে নিয়েছে। পুরো মাস ধরে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের এ দিনটি এখন একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

সম্পাদকীয় ও সম্পাদকীয় পাতার লেখা
মাতৃভাষা ও একাধিক বিদেশি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব, গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে সুসংহত করা, মাতৃভাষার উন্নতিই একুশের শিক্ষা, মাতৃভাষার উন্নতিই একুশের শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
সম্পাদকীয় পাতার বিভিন্ন কলামে যা পোস্ট এডিটরিয়াল বা অপ-এড নামে পরিচিত, লেখকদের নানামুখী মতামত পাওয়া যায়। এ দিন সব দৈনিকের প্রায় সব কলামের বিষয় একুশে ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ মাতৃভাষা, একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি। এসব লেখায় কেউ কেউ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ করেছেন। কেউ কেউ স্মৃতিচারণ করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ের সাহিত্য চর্চার প্রসঙ্গও এসেছে এসব লেখায়। শিক্ষার বিষয়টিও গুরুত্ব পায় অনেকের লেখায়।

প্রভাতফেরি নিয়ে প্রশ্ন
মধ্যরাতের একুশে উদযাপনের প্রেক্ষিতে প্রভাতফেরি প্রসঙ্গে বিতর্ক চলে কয়েক বছর। বদরুদ্দীন উমর ২০১৬ সালে দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন- প্রভাতফেরি কোথায় গেল। তার বক্তব্য ছিল, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাতারাতি প্রভাতফেরি উঠে গেল ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। কেউ আইন করে বা নির্দেশ দিয়ে তা উঠায়নি। সেটা উঠানো হলো বেশ কৌশলের সঙ্গে ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। … আগে ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রতিরোধের প্রতীক। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন শাসনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করা হলো শোক দিবস। … কাজেই এ দিবস থেকে হারিয়ে গেল প্রতিরোধ।’
পরের বছর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রভাতফেরি প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ১৯৭২ সালে রাত ১২টা ১ মিনিটে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো এবং প্রভাতফেরি শুরু করাটা সমর্থন করেই বলেন- একুশের প্রভাতফেরি কোথাও যায়নি (দৈনিক যুগান্তর ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)। ‘এ কথা সত্য, স্বাধীনতার পর সকালের পরিবর্তে মধ্যরাত ১২টায় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে একুশের উদ্বোধন করা শুরু হয়। আন্তর্জাতিক সময়ের সঙ্গে সংহতি রক্ষার জন্যই (রাত ১২টায় নতুন দিন শুরু) এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রভাতফেরি বন্ধ করার জন্য নয়। ইচ্ছা থাকলে প্রভাতফেরি মধ্যরাতেও করা যায়।’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর পাশাপাশি একই বছর কামাল লোহানী লিখলেন- প্রভাতফেরি ফিরিয়ে দিন। তিনি মধ্যরাতে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়টিকে ঔপনিবেশিক মানসিকতা বলেই উল্লেখ করেন। (ইত্তেফাক বিশেষ সংখ্যা এই একুশ সেই একুশ ২০১৭) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতামতের বিরোধিতা করে পরের বছর লিখলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারির উদযাপন এখনো হয়, আগের সময়ের চাইতে অধিক আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরের সঙ্গেই হয়, কিন্তু আগের সেই প্রভাতফেরি আর নেই। উদযাপন এখন প্রভাতে শুরু হয় না। শুরু হয় মধ্যরাতে, রাত ১২টা ১ মিনিটে। প্রভাতফেরি তো মধ্যরাতের ব্যাপার হতে পারে না, ব্যাপার সে প্রভাতেরই এবং আমাদের প্রভাত রাত ১২টা বেজে ১ মিনিটের মাহেন্দ্রক্ষণে আরম্ভ হয় না, শুরু হয় সূর্য ওঠার সময়ে, সকালবেলা, যখন পাখি জেগে ওঠে, প্রকৃতির ঘুম ভাঙে, মানুষ দিনের কাজ শুরু করে।’ (মধ্যরাতে প্রভাতফেরি, সংবাদ-অমর একুশে সংখ্যা ২০১৮ পৃ. ১)।

বিশেষ সংখ্যায় ও আয়োজনে নানা বিষয়
একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ সংখ্যা সাধারণত দৈনিক পত্রিকার সাইজে প্রকাশিত হয়। মাঝে মধ্যে দু’একটি ট্যাবলয়েড সাইজেও পাওয়া যায়। বিশেষ সংখ্যাজুড়েই একুশের ইতিহাস, ভাষা, শিক্ষা এবং সমসাময়িক সংকট নিয়ে লেখা থাকে। কখনো কখনো গল্প থাকে। কবিতা পাওয়া যায় নিয়মিত। কখনো কখনো সরকারের ক্রোড়পত্রটি বিশেষ সংখ্যায় সংযুক্ত করে নেয়া হয়। বিশিষ্ট লেখক এবং প্রবীণ ও নবীন লেখকদের পাওয়া যায় এখানে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সংকট নিয়ে একই সংখ্যায় সুচিন্তিত মতামত এসেছে একাধিক রচনায় যেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম; বিজ্ঞান চর্চা; পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়; বিজ্ঞাপন ও সাইনবোর্ড; আদালত; আদিবাসী ভাষার বিপন্নতা; (কালের কণ্ঠ ২০১৯ পৃ. ১-৪)। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি প্রসঙ্গে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নিজ মূল্যায়ন জানা যায় একটি সাক্ষাৎকারে (জনকণ্ঠ ২০১৯ পৃ. ২৪)।
প্রমিত বানান নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মত। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক দেখা যায় সংবাদপত্রে। মুস্তাফা জামান আব্বাসী প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কোন ভাষায় কথা বলব? প্রমিত’। তিনি জবাবে বলছেন কথা বলতে হবে প্রমিত ভাষায়। তার বক্তব্য হলো, ‘যখন আমরা বাইরে যাই, তখন বাড়ির ভাষাটা বাড়িতেই রেখে যাই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও যখন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে লক্ষ্য [লক্ষ] করি আঞ্চলিক ভাষার আধিক্য, তখন মনে হয় যে আমাদের শিক্ষার কোথাও গলদ আছে’ (ইনকিলাব ২০১৯ পৃ. ১৩)।
অবশ্য প্রমিত ভাষার চর্চায় বানান প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বিচলিত। ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এ প্রসঙ্গে তিনি দৈনিক সমকালে লিখেছেন, ‘… প্রমিত বানান নামে সংস্কার করা বানান পদ্ধতির যে ব্যবহার হচ্ছে, তাতে মনে হয় কিছুদিন পর শুদ্ধ বানান বলে আর কিছু থাকবে না…।’

ইতিহাসের উপাদান সংরক্ষণ
সরকারপ্রধান, রাজনীতিবিদ ও লেখকদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যকে প্রধান প্রতিবেদন করে বিচিত্রা একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যা ১৯৭৭ প্রকাশ করে। ‘৭৭-এর একুশের বক্তব্য’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনে যাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয় তারা হলেন- প্রেসিডেন্ট সায়েম, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা আবুল ফজল ও আকবর কবীর, সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ্ খান, নির্মল সেন ও শামসুর রাহমান, শিক্ষাবিদ ড. আহমদ শরীফ, বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদা, রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান, মোহাম্মদ তোয়াহা, কাজী জাফর ও সিরাজুল হোসেন খান। ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে শহীদ দিবস’ শিরোনামের লেখায় বিনোদ দাশগুপ্ত নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জনশক্তির ঐক্য ও শক্তি বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। আর এর ভিত্তি হিসেবে তিনি দেখেছেন পরিপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিকাশ।
১৯৭৬ সালের একুশে ছিল রাজনৈতিক সংকটের কাল। একুশে ফেব্রুয়ারি বিশেষ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হলো, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী উনিশশ বাহান্ন এখন শুধু একটি লাল তারিখ নয়- একুশ একটি চেতনার নাম, প্রতিরোধের নাম। আমাদের জাতীয় জীবনে, জাতীয় কার্যক্রমে সংকটে বিবেকের প্রহরী। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের মানুষ মুখোমুখি হয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জের। স্বাধীনতার শত্রæরা তৎপর হয়ে উঠেছে, চক্রান্ত চলছে। এই চক্রান্ত প্রতিহত করার জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ। চক্রান্ত প্রতিহত করতে হবে, দেশ ও জাতির শত্রæদের রুখতে হবে, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলতে হবে। এটাই হবে ছিয়াত্তরের একুশের নতুন শপথ।’ এই সংখ্যায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘ঐতিহাসিক, তবে কোন অর্থে?’ শিরোনামের লেখায় নিজের প্রশ্নের ব্যাখ্যা নিজেই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘… মুক্তির আন্দোলন নতুন ব্যাপ্তি, গভীরতা ও তীব্রতা প্রাপ্ত হয়েছে বায়ান্ন সালে, সে স্বচ্ছতর এবং অধিকতর গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে (পৃ. ৯ এই সংখ্যার একটি বড় সংযোজন মুনীর চৌধুরীর অপ্রকাশিত গল্প ‘ন্যাংটোর দেশে’।

আদালতে বাংলা ভাষা
জাতীয় জীবনে বাংলা ভাষা চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো আদালত। কিন্তু সেখানে এখনো ইংরেজি চর্চাই হয়ে থাকে মূলত। নিম্ন আদালতে রায় বাংলায় দেয়া হলেও উচ্চ আদালতে রায় দেয়া হয় ইংরেজিতে। তবে বাংলায় কয়েকটি মামলার রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্টের কয়েকজন বিচারপতি। বাংলায় রায় দেয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ সংখ্যায় এ নিয়ে অনেকবারই নিবন্ধ লিখেছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন, ‘দেশের রায় বাংলায় লিখতে হবে, যাতে নিরক্ষরও শুনলে কিছু বুঝতে পারে। বিদেশিদের অসুবিধা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। সব সন্দেহ নিরসনকল্পে সংসদের দ্ব্যর্থহীন উদ্যোগ নেয়া উচিত।’ (উচ্চ আদালতে রাষ্ট্রভাষার প্রবেশাধিকার, প্রথম আলো অমর একুশে ২০১৩ পৃ. ১, ৬;)। সাবেক বিচারপতি কাজী এবাদুল হক আদালতে বাংলা ব্যবহারের বাধা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। তিনি নিজে কয়েকটি মামলার রায় বাংলায় দিয়েছিলেন। তার মতে ‘বিচারপতিদের মধ্যে একমাত্র প্রয়াত আমিরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলা ভাষায় আদেশদান ও রায় লেখা শুরু করে পথিকৃত হয়েছেন।

বায়ান্নর কারাগারে
ভাষাসৈনিকদের অনেকেই সেই সময়ে কারাবরণ করেছেন। অনেকেই কারাগারের স্মৃতি লিখেছেন। সেই স্মৃতি নিয়ে লেখা একটি গ্রন্থ হলো বায়ান্নর কারাগারে। এই গ্রন্থ থেকে ‘রাজবন্দীর কারাস্মৃতি’ শিরোনামে প্রকাশিত অংশের শেষপ্যারায় লেখক ফজলুল করিম নস্টালজিক আবহে লিখেছেন, ‘…ঢাকা জেলে তখন ভাষা আন্দোলনের জন্য তখন আটক রয়েছেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, প্রখ্যাত নেতা ও দার্শনিক আবুল হাশিম, খয়রাত হোসেন, ওসমান দালাল, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক, খন্দকার মুশতাক আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, অধ্যাপক অজিত গুহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এবং বহু ছাত্র ও যুব নেতা। ….এভাবেই আমরা ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলে বসে উদযাপন করেছিলাম। ঢাকা জেলের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে সেদিন আমরা যে কয়েকজন বন্দি অমর একুশে পালন করেছিলাম তার মধ্যে আহাদ ভাই [অলি আহাদ], মতিন ভাই [আবদুল মতিন] আর আমি ছাড়া সবাই বিদায় নিয়েছেন। এই দিনটি এলে তাদের কথাই বেশি করে মনে পড়ে’ (রাজবন্দীর কারাস্মৃতি/ প্রথম আলো একুশে বিশেষ সংখ্যা ২০০৮, পৃ. ১-২, বায়ান্নর কারাগারে বই থেকে সংকলিত)। এখন আহাদ ভাই, মতিন ভাই ও করিম ভাই-ও নেই। করিম ভাই ২০০৭ সালের ২২ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেছেন।

জাতীয় পরিচয়ের নিয়ামক
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে নিয়ামক ধর্ম, ভূগোল না ভাষা এমন প্রশ্ন করেছেন (উধরষু ঝঁহ ২০১৮ ঢ়৬-৭), আফসান চৌধুরীও একই প্রসঙ্গে বলছেন, ‘ওফবহঃরঃরবংদধৎব সঁষঃরঢ়ষব, াধৎরড়ঁং, ঢ়ৎড়হব ঃড় ংযরভঃরহম ড়াবৎ ঃরসব রহ ৎবংঢ়ড়হংব ঃড় ঃযব ড়নলবপঃরাব পযধষষবহমবং ভধপবফ নু ঢ়বড়ঢ়ষব রহ ধ মরাবহ যরংঃড়ৎু. অ ঢ়বৎংড়হ যধং ড়হব ধহফ সধহু রফবহঃরঃরবং ধহফ রিষষ ধফলঁংঃ ধং যরংঃড়ৎু ফবসধহফং.’ (ঘবি অমব ২০১৮ ঢ় ঝ৩); সময়ের প্রয়োজনে মানুষের জাতীয় পরিচয়ের প্রেক্ষিত যে বদলে যেতে পারে, সেটা আমরা দেখেছি। ভারত বিভাগের আন্দোলনে এদেশের মানুষের প্রধান পরিচয়ের ভিত্তি হয়ে ওঠে ধর্ম। আবার ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে ভাষা এবং ভূগোল হয়ে ওঠে পরিচয়ের প্রধান উপাদান। রামেন্দু মজুমদার বলছেন, ‘একুশের চেতনা অসাম্প্রদায়িকতা’ (কালের কণ্ঠ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ পৃ. ১৪)। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও কয়েক বছরের মধ্যে নতুন পরিচয়ের প্রেক্ষিত তৈরি হয়। সকল সম্প্রদায়ের মিলিত কণ্ঠস্বর ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ আরো পরে ধর্ম নির্বিশেষে সেøাগান ওঠে, ‘পিন্ডি না ঢাকা-ঢাকা ঢাকা।’ অর্থাৎ ভূগোল হয়ে ওঠে পরিচয়ের ভিত্তি।

ভাষাসৈনিকদের তালিকা হয়নি
ভুলে যাওয়া পাঁচ ভাষা সংগ্রামীর কথা জানতে পারি। এরা হলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (কুমিল্লা), লোকমান হাকিম (খুলনা), খান জিয়াউল হক ও আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া (মাগুরা), কায়েসউদ্দিন (জামালপুর)। চারটি রিপোর্টে (উযধশধ ঞৎরনঁহব অসধৎ ঊশঁংযবু ২০১৮ ঢ় ঝ১.) এদের প্রশংসনীয় ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। লোকমান হাকিম কথা প্রসঙ্গে আরো কয়েকজনের নাম বলেছেন যারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুলিশের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এমন কয়েকজন হলেন আনোয়ার হোসেন, মালিক আতাহার, কমরেড নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান লিচু। একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তর বাড়িটি অবহেলায় আবর্জনার মধ্যে পড়ে আছে। ভাষা আন্দোলনকে বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই বলা হলেও ভাষা সৈনিকদের কোনো তালিকা হয়নি (যুগান্তর ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, পৃ. ১)।

বাংলা ভাষার বিকৃতি
বাংলা ভাষাও বিকৃতিতে ভরে গেছে। বিশেষজ্ঞরা তাগিদ দিয়েছেন সামাজিক আন্দোলনের। উচ্চারণে ত্রæটি, অশুদ্ধ বানান, বাংলা শব্দ থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার এই বিকৃতির প্রধান অনুষঙ্গ (যুগান্তর ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, পৃ. ১)। ঞযব ঁংব ড়ভ ইধহমষধ খধহমঁধমব রহ ধ ফরংঃড়ৎঃবফ ধিু ড়হ ঃযব ংড়পরধষ সবফরধ ধহফ ৎবমঁষধৎ ষরভবংঃুষব যধং পৎড়ংংবফ ধষষ হড়ৎসধষ ষরসরঃং. ঞযব ফরংঃড়ৎঃবফ ধিু ংববসং ঃড় যধাব নবপড়সব ঃযব হবি ংঃুষব. ….ঃযরং শরহফ ড়ভ ফরংঃড়ৎঃরড়হ রিষষ নব ঃযব নরমমবংঃ ড়নংঃধপষব ভড়ৎ ঁং ধং ধ পরারষরংবফ হধঃরড়হ.’ (ইধহমষধ ভধপরহম ফরংঃড়ৎঃরড়হ, ঝধঁমধঃড় ইড়ংঁ, ঃযব রহফবঢ়বহফবহঃ, ঋবনৎঁধৎু ২১, ২০১৮, ঢ়১)

গণমাধ্যমে বিকৃত বাংলা
রেডিওর বেসরকারি এফএম চ্যানেলগুলোয় ‘বিকৃত বাংলা ও অহেতুক ইংরেজির ব্যবহার’ করে বিশ্রীভাবে বাংলা-ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে কথা বলা শুরু হলে শেষ পর্যন্ত আদালত ও সরকারের হস্তক্ষেপে তা কিছুটা কমেছে। এই চ্যানেলগুলো সীমা লঙ্ঘন করেছিল বলা যায়। অনানুষ্ঠানিক ব্যক্তি-আড্ডা আর বেতারের অনুষ্ঠান এক কথা নয়। বেতার-টিভির একটা বড় ধরনের প্রভাব পড়ে শ্রোতাদের ওপর। আমাদের জীবনে কথা বলার সময় দুই-একটা ইংরেজি শব্দ এসে যায় অনেক সময়। তবে এর একটা সীমা আছে। এই লেখায় আমি ‘রেডিও/চ্যানেল’ বলছি। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা ভালো। বেসরকারি অনেক টিভি কেন্দ্রের নাম ইংরেজিতে। না হলে ভালো। তবু এটা হয়তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নেয়া যায়। কিন্তু বাংলা অনুষ্ঠানের নাম ইংরেজিতে হবে কেন? খবর হল বাংলায়, কিন্তু নাম দেখানো হচ্ছে ইংরেজিতে ঘবংি ঐড়ঁৎ. আরো অনেক বাংলা অনুষ্ঠানের নাম দেয়া হয়েছে ইংরেজিতে যেমন- ঝযড়নিরু ঃড়হরমযঃ (যমুনা টিভি)। বাংলা নামে একুশে, একাত্তর, দীপ্ত, সময়, দুরন্ত, মাছরাঙা, বৈশাখী এবং আরো কয়েকটি টিভি চ্যানেল রয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কী তারা যোগাযোগ করছে না?

বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ পুরোপুরি কার্যকর হলো না এখনো
২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ও ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের বিষয়ে এবং বেতার-টেলিভিশনে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ ও দূষণরোধে রুলসহ নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। যাতে বেতার ও টেলিভিশনে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ এবং ভাষা ব্যঙ্গ ও দূষণ করে অনুষ্ঠান প্রচার না করার নির্দেশনা ছিল। একইসঙ্গে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭’ অনুযায়ী সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু এই নির্দেশ সাতাশ বছরেও (২০২৪) যথাযথভাবে পালন করা হয় না। ভোরের কাগজের প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর আর বিজয়ের ৫০ বছর পরও ভাষানীতি না হওয়ায় …….হারিয়ে যাচ্ছে প্রমিত বাংলা। স্বপ্নই রয়ে গেছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর স্বপ্ন’ (ভাষা নীতি প্রণয়নের তাগিদ/প্রযুক্তিতে পিছিয়ে, উচ্চশিক্ষায় অবহেলিত বাংলা ভাষা, ভোরের কাগজ, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ পৃ. ১)। সরকারও এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহী বলে মনে হয় না। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার এবং পরবর্তী সরকারগুলোর আচরণে বুঝতে হয় ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭’ প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এটা ছিল আসলে স্বৈরশাসকের রাজনৈতিক চমকবাজি।
সাধারণ মানুষের জীবন-মান উন্নয়ন এবং দেশে স্থিতিশীল কল্যাণকামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু না হলে এ ধরনের আইন কার্যকর করা সম্ভব নয়। আর সেজন্য প্রয়োজন সৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ব্যক্তিগত শিক্ষা (শুধু ডিগ্রি নয়) ও উপলব্ধি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়