দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

সভ্যতার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার ভাষাসম্পদ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মাঝেমধ্যে ভাবনা হয়- ভাষার মতো এমন শক্তিশালী এবং আশ্চর্য দ্যুতিময় হাতিয়ার আর কী আছে মানুষের? আপন বুদ্ধি খাটিয়ে আপন অস্তিত্বের সম্প্রসারণ এবং অন্যের উপরে আধিপত্য বিস্তার ঘটানোর জন্য মানুষ এ নাগাদ কত কিছুই না করেছে। পুরাতন অস্ত্র বাতিল করে গবেষণালব্ধ নতুন অস্ত্রে শান দিয়েছে, বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধ্বংসস্তূপের উপরে স্থাপন করেছে উন্নততর মানবিক গুণসমৃদ্ধ নতুন বিধান ও ব্যবস্থার আলোকোজ্জ্বল সৌধ; কিন্তু মানুষের বুকের গভীরে স্থায়ী আসন পাতার জন্য ভাষার চাবি দিয়েই খুলতে হয়েছে রুদ্ধ দুয়ার। পৃথিবীর সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস সেই সত্যের পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়। তাই প্রশ্ন জাগে- মানুষ কবে কোথায় কেমন করে সন্ধান পেয়েছে ভাষাসম্পদের?
হ্যাঁ, ভাষাও এক প্রকার সম্পদ বৈ কি! দুনিয়ার সমুদয় বস্তুগত সম্পদের তুলনায় ভাষাসম্পদের মূল্য কম কিছু নয়। ভাষার জন্য প্রাণবাজি রাখা সংশপ্তক জাতি হিসেবে বাঙালি সেই ভাষাসম্পদের অন্তর্নিহিত মূল্য যথেষ্ট বোঝে, সত্যি বলতে কি অন্য অনেক জাতির চেয়ে খানিক বেশিই বোঝে। তাই পাকিস্তানি শাসনামলে বস্তুগত সম্পদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভে জ্বলে ওঠার অনেক আগেই, পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই সেই রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বাঙালি অগ্নিগিরির মতো উত্তাল বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে ভাষার প্রশ্নে, ভাষাসম্পদের উপরে অধিকার হারানোর উৎকণ্ঠায়। অবশ্য কেবল পাকিস্তানি জমানা বলে তো নয়, বাংলা ভাষার এ এক নির্মম নিয়তিই বটে, জন্ম থেকেই তাকে লড়তে হয়েছে প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে, নানাবিধ বৈরিতার কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়েই তাকে আসতে হয়েছে আজকের পর্যায়ে। তার অন্তর্নিহিত ভাবসম্পদই হয়তোবা তাকে শক্তি-সাহস প্রেরণা জুগিয়েছে। অনুমান করি, সে কারণেই বুঝি বা চর্যাপদের রচয়িতা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রাষ্ট্রীয় জুলুমের মুখে দেশ ত্যাগ করেছে, কিন্তু ভাষাসম্পদ কিছুতেই ছাড়েনি।
ভাবনা হয়- মানুষ কীভাবে পেল ভাষার নাগাল? বেশ তো চলছিল আকারে-ইঙ্গিতে, ইশারায়-ভঙ্গিতে! মানুষ কখন টের পেল যে-না, এই ইশারা-ইঙ্গিতে চলছে না, মন ভরছে না; তার আরো চাই, ‘কানের ভিতরে দিয়া মরমে পশিবার’ মতো ধ্বনি চাই, ধ্বনিপুঞ্জের গুঞ্জরণ চাই! বাগযন্ত্রের এমন নিপুণ ব্যবহার সে শিখল কোথায়! বটেই তো ভাষার মতো এমন বিস্ময়কর আবিষ্কার আর কীই বা আছে!
ভাষা কি তবে ঝরে পড়ে নক্ষত্রের মতো টুপটাপ খসে পড়ে আকাশ থেকে? আহা, আক্ষরিক অর্থে ভাষা না হোক, ভাষার শরীরে খচিত শব্দরাজি কিংবা শব্দের অভ্যন্তরস্থ ধ্বনিপুঞ্জ কি নক্ষত্রের চেয়ে কি কম কিছু উজ্জ্বল? জ্যোতিষ্কপ্রায় উজ্জ্বল ধ্বনিপুঞ্জ যদি আকাশ থেকে খসে নাই পড়ে, তাহলে ভাষার পুষ্পমঞ্জরি কি সবার অলক্ষে মাটি থেকে উত্থিত হয়? মাটি ফুঁড়ে নানাবিধ বীজকে অঙ্কুরিত হতে দেখেছি নানাবিধ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে, তাই বলে ভাষাবৃত্তও কি অঙ্কুরিত হবে মৃত্তিকার গভীর থেকে? ভাষাকে কেউবা তুলনা করেছেন নদীর সঙ্গে, কেউবা ফোটা ফুলের সঙ্গে। যুক্তি দুই পক্ষেই আছে, আবার তর্কও আছে। পাথর ছড়ানো বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে নদী চলে যায় দূর থেকে বহু দূরে। যেতে যেতে বাঁক বদল, গতি পরিবর্তন, আকার-আকৃতি এমনকি নদীর নাম বদলও ঘটে থাকে। সে কথা তো ভাষার বেলাতেও প্রযোজ্য। ভাষার ভূগোলও নদীর মতোই সম্প্রসারিত হয় (ক্ষেত্রবিশেষে সংকুচিতও হয় বটে), ডালপালা ছড়ায়, ঝরাপাতার মাঝেও আবার নবকিশলয় হয়ে জেগে ওঠে, পত্রপল্লবে ভরে ওঠে কানায় কানায়। হ্যাঁ, ফুল ফোটার সঙ্গেও ভাষা-বিকাশের তুলনা হতে পারে। সব ফুলের অভিন্ন বর্ণ গন্ধ নিশ্চয় থাকে না। বনে বনে ফুলের ভিন্নতা যেন বা দেশে দেশে ভাষার বৈচিত্র্যের সঙ্গেই তুলনীয়। ফুলের যেমন সৌন্দর্য সুষমা আছে, প্রত্যেক ভাষার অভ্যন্তরেও আছে তেমনই আয়োজন। ভাষার সৌন্দর্য তার ধ্বনিতে, শব্দে, অনুপ্রাসে; ছন্দ-অলঙ্কারে, প্রবাদ-প্রবচনে। সৃজনশীল শিল্পী সাহিত্যিকের সংস্পর্শে ও চর্চায় সে সৌন্দর্য আরো বিকশিত হয়, হতে পারে। এই যে সৌন্দর্যমণ্ডিত সুষমাপূর্ণ বিকশিত রূপ এটাই ভাষাকে সম্পদে রূপান্তরিত করে তোলে। এভাবেই ভাষা হয়ে ওঠে ঐশ্বর্যমণ্ডিত, সমৃদ্ধ। বিশ্বসভায় গুণী মানুষের মাঝে এভাবেই মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় ভাষা। অবশ্য যে কোনো ভাষার মান-সম্মান কেবল ওই ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপরেই নির্ভর করে না, এ আবার অন্য লড়াই, ভাষা-রাজনীতির ব্যাপার, ভাষা-ঔপনিবেশের বিষয়। থাক সে প্রসঙ্গ। এ আলোচনা ডালপালা মেলতে মেলতে বহুদূর বিস্তৃত হয়ে পড়তে পারে। বেরিয়ে আসতে পারে অন্ধকার কোনো অধ্যায়। মাতৃভাষার জন্য বাঙালির আত্মোৎসর্গের মহোত্তম ঘটনা ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভের পরও জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অনুমোদন আদায়ের দৌড়ে বাংলা ভাষার যথোপযুক্ত অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে আছে আন্তর্জাতিক ভাষা-রাজনীতির সক্রিয় উপস্থিতি। কিন্তু আমরা সে আলোচনায় যাব না।
ভাষা তো শুধু মানুষেরই নয়, পাখিসহ অন্যান্য প্রাণিকুলেরও আছে। তারা বাগযন্ত্রের উপরে সাধ্যানুযায়ী নানাবিধ কসরৎ করে কত না বিচিত্র ধ্বনি উৎপাদন করে, আমাদের শ্রবণেন্দ্রীয়ের কাছে কখনো তা কর্কশ, কখনো সুরেলা-মধুর বলে গণ্য হয়। আমরা, অর্থাৎ মানুষেরা তার বিচারক! কী যে অদ্ভুত পরিহাস- যে ভাষার আমি অর্থই বুঝিনে, তার সুর লালিত্য বিচারের অধিকার আমার আসে কোত্থেকে? কোনটা মধুর কোনটা কর্কশ, সে রায় ঘোষণার আমি কে? এ কি অনধিকার-চর্চার মধ্যে পড়ে না? মানুষ তা-ই করে। শক্তিমদমত্ত হলে যা হয় আর কী! সুযোগ পেলেই বাহাদুরি ফলানো! নিজের মতো ব্যাখ্যা করে নিয়ে অপরের উপরে চাপানোর অভব্য প্রয়াস! হঠাৎ একদিন পাখিরা থমকে দাঁড়িয়ে যদি শুধায়- তুমি আমার গানের মানে বোঝো মানুষ? অথবা সুন্দর বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার যদি কোনো ভাষাতাত্ত্বিককে দু’হাতে জাপটে ধরে বলে, আমরা কেবল গর্জনই করি কেমন? আমাদের আদর-সোহাগের ভাষা কি তোমরা বোঝো! ভালোবাসার ভাষা?
হায় অসহায় মানুষ! মানবেতর কার ভাষা বুঝবে সে? কী করে বুঝবে?
কী যে মানবিক সীমাবদ্ধতা। এক দেশের মানুষ অন্য দেশের মানুষের ভাষা বোঝে না। প্রত্যেক ভাষার দুয়ার তার নিজস্ব চাবিকাঠি দিয়ে খুলতে হয়। একই দেশে একাধিক ভাষাভাষী মানুষেরও বাস হতে পারে। খুব পাশাপাশি বাস, তবু ভিন্ন ভাষার ভেতরবাড়ির দরজা খুললে তো! মানুষ এত বড় চাবির গোছা পাবে কোথায়? আবার একই ভাষার ভিন্ন ভিন্ন ডালপালা থাকতে পারে, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে সেই ডালপালার মধ্যেও রচিত হতে পারে অচেনা দূরত্ব। উপভাষা, লোকভাষা কিংবা আঞ্চলিক ভাষা- যে নামেই ডাকি না কেন, পার্থক্য তাদের মধ্যে অবশ্যই আছে, দুর্বোধ্যতার দূরত্বও কিন্তু কম কিছু নয়। আমাদের এই ছোট্ট দেশেই চট্টগ্রামের আর বরিশালের কিংবা কুমিল্লার আর কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষা কি একই সমান্তরালে গড়িয়ে চলে? বোধগম্যতাই যদি যে কোনো ভাষার গ্রহণযোগ্যতার প্রধান শর্ত হয়, তাহলে এই যে আমাদের এই বাংলাদেশের পেটের ভেতরে বসে জন্মসূত্রে সবাই বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিচিত্র ধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে দাবি জানানো হচ্ছে আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা; মাতৃভাষার এ দাবি কতোটা যথার্থ? মাতৃভাষা যদি হয় মায়ের মুখের ভাষা এবং মায়ের মতো মমত্বময় মধুমাখা সহজবোধ্য ভাষা, তাহলে সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বরিশাল প্রভৃতি বিভিন্ন অঞ্চলের মায়েদের মুখে অনায়াসে প্রচলিত ভাষাভঙ্গিটির দিকে কান পাততে হয়, কী বলেন দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এইসব প্রান্তিক মায়েরা? কী ভাষায় আশীর্বাদ করেন তার সন্তানদের? সে ভাষার নাম কী? বাংলা ভাষা? বাংলা তো বটেই, কোনো আলংকারিক পরিচয়ে উপস্থাপন করব তাকে- মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা, নাকি জাতীয় ভাষা? মায়ের মুখে উচ্চারিত ভাষার সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত পরিচয় ‘মাতৃভাষা’, তা সারা দেশের সব অঞ্চলের লোকজন বুঝুক অথবা না-ই বুঝুক, সন্তান বুঝলেই হলো। রাষ্ট্রভাষা বা জাতীয় ভাষা খানিকটা আলাদা, অনেকটাই বড় মাপের বিষয়। আর আঞ্চলিক বা খণ্ডিত পরিচয় নয়, পরিচয় সারা দেশের, গোটা জাতির। দেশের নাম বাংলাদেশ। জাতির নাম বাঙালি জাতি (যদিও জাতিত্বের এই মীমাংসিত পরিচয়টুকুও রাজনৈতিক মতলববাজদের ঠেলায় ধাক্কায় বিতর্কিত হয়েছে), জাতীয় ভাষার নাম বাংলা ভাষা। হ্যাঁ, বৃহত্তর অর্থে মাতৃভাষাও বটে। কুমিল্লা, নোয়াখালী, বরিশাল, সিলেটে জন্মগ্রহণকারী মায়ের আদলে গোটা দেশের মানচিত্রের ছাপ বসিয়ে দেখলেই হলো। দেশকে মা বলে ডাকতে শিখেছি আমরা অনেক আগেই। রাষ্ট্র যখন দেশমাতা বা মাতৃভূমি, তখন তার ভাষা তো মাতৃভাষা হবেই। মাকে যেমন সর্বজনীন হতে হয়, সব সন্তানের প্রতি সমান যতœশীল ও মমত্বময় হয়ে উঠতে হয়, মাতৃভাষার ব্যাপারটাও সেই রকমই। সব আঞ্চলিকতার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বরং আঞ্চলিক লোকভাষার বিপুল বৈচিত্র্যের মধ্যে এবং তার অন্তর্নিহিত শক্তির মধ্যে ঐক্য স্থাপন করে সত্যিকারের মাতৃভাষা হয়ে উঠতে পারে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর।
যে কোনো ভাষার কৃতী সন্তান তার শিল্পী-সাহিত্যিকেরা মাতৃভাষার যথার্থ নাড়ির স্পন্দন ঠিকই ধরতে পারেন। তাদের হাতে যখন রচিত হয় মহৎ সাহিত্য, তখন সেই সাহিত্যে ব্যবহৃত লোকভাষাও আঞ্চলিকতার দোষ কাটিয়ে সর্বজনীন মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। তার প্রমাণ আমরা প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এ না পেলেও দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ থেকেই পেয়ে আসছি। নীলকর উড সাহেব যখন নীল চাষের জন্য শ্যামচাঁদের আঘাতে সাধুচরণকে জর্জরিত করে তোলে, তখন রাইচরণ সক্রোধে বলে- ‘ও দাদা, তুই চুপ দে। ঝা ন্যাকে নিতি চাচ্ছে ন্যাকে দে। ক্ষিদের চোটে নাড়ি ছিঁড়ে পড়লো, সারা দিনডা গ্যাল, নাতিও পালাম না, খাতিও পালাম না।’ অথবা ইজ্জত হারানোর ভয়ে তটস্থ ক্ষেত্রমণির আর্তনাদ কি কিছুতেই বিস্মরণযোগ্য- ‘ও সাহেব, তুমি মোর বাবা, মোরে ছেড়ে দাও। পদীপিসির সঙ্গে দিয়ে মোরে বাড়ি পেটয়ে দাও, আঁদার রাত, মুই একা যাতি পারবো না…।’ সংলাপের এই ভাষা কুষ্টিয়া-যশোরের (নদীয়ারও) আঞ্চলিক বা লোকভাষা হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় ভাষা বা প্রমিত বাংলা থেকে মোটেই দূরবর্তী নয়। আবার ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে নদীতীরে কুবেরের হাতে তামাক তুলে দেয়ার সময় কপিলা হাসিমুখে বলে, ‘তামুক ফেইল্যা আইছ মাঝি।’ তামাকের দলা গ্রহণ করে কুবের বলে, ‘খাটাসের মত হাসিস্ ক্যান কপিলা, আঁই?’ কপিলা বলে, ‘ডরাইছিলা, হ? আরে পুরুষ!’ তারপরই রহস্যময় প্রস্তাব- ‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’ এই সংলাপ শুনতে বা পড়তে গিয়ে পাঠক কি কখনোই পদ্মাপারের লোকভাষার কারণে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন? আঞ্চলিক উচ্চারণের শেকড়বাকড়ে পাঠককে কি আটকে পড়তেই হয়? অথবা যদি আরও সাম্প্রতিককালের অনবদ্য সৃষ্টি ‘নূরলদীনের সারাজীবন’-এর কথাই ধরি, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হকের কলমে যখন লেখা হয়- ‘জাগো বাহে কোন্ঠে সবাই’ তখন আর সেই কালজয়ী সংলাপ উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিকতার ফাঁদে আটকা থাকে না; হয়ে ওঠে সর্বজনীন। রংপুর-কুড়িগ্রামের জনসাধারণের মুখে মুখে প্রচলিত লোকভাষায় রচিত অমর কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ অথবা ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ এভাবেই আঞ্চলিক ভাষার সমস্ত সুষমা এবং প্রাণশক্তি বক্ষে ধারণ করে হয়ে ওঠে শ্রেষ্ঠ জাতীয় সাহিত্য। জাতীয় সাহিত্যে এই গ্রহণ ক্ষমতার উদ্বোধন ঘটে দক্ষ শিল্পীর হাত ধরে। যেমন মরমী শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠ ছুঁয়ে উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া হয়ে ওঠে সর্ববঙ্গের সম্পদ।
শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলের সাধারণ মানুষ জন্মসূত্রে প্রাপ্ত লোকভাষাতেই প্রাত্যহিক জীবনের সব কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে, এমনকি স্বপ্ন দেখা বা স্বপ্ন রচনার মতো কাজও অবলীলায় সম্পাদিত হয় ওই ভাষাতেই। একান্ত নিভৃতে লোকসংগীত ও লোকসাহিত্য সৃষ্টি হয় লোকভাষাতেই। প্রচলিত এ ভাষার ঐশ্বর্য প্রমিত তথা জাতীয় ভাষা ও সাহিত্যকে কীভাবে সমৃদ্ধ করে তোলে, সে উদাহরণও আমরা দেখেছি। বাংলা ভাষা তার জন্মলগ্নে প্রকৃতিলগ্ন প্রাকৃতজনের মুখের ভাষাকে উচ্চ মর্যাদায় গ্রহণ করেছে, কাজেই আজকের দিনে লোকভাষাকে অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু হাজার বছরের পরিচর্যা ও পথপরিক্রমায় বর্তমানে বাংলা ভাষার যে প্রমিত রূপ দাঁড়িয়েছে, কোনো শিক্ষিত বাঙালিকে যখন সেই প্রমিত বাংলা ভাষায় দু’চার মিনিট কথা বলতে কিংবা দু’চার পঙ্ক্তি গদ্য লিখতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠতে দেখি, তখন আর দুঃখের অবধি থাকে না। হয়তো তিনি ইংরেজিতে যথেষ্ট দক্ষ। ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকান উচ্চারণও অনেক সধানায় রপ্ত করেছেন। অথচ বাংলা লিখতে গিয়ে অসংখ্য বানান ভুলে আকীর্ণ, সাধু-চলিতের মিশ্রণদোষে দুষ্ট, ক্রিয়াপদের রূপ চেহারা ভেঙেচুরে একাকার করে বসেন। ভুল ধরিয়ে দিতে গেলেও নির্বিকার চিত্তে আকর্ণ বিস্তৃত হাসির মধ্যে জানান- আরে ভাই, ওই হলো, মাতৃভাষায় কথাটা বুঝানো গেলেই তো হলো। হায় মাতৃভাষাপ্রীতি! আর এই শ্রেণির শিক্ষিতজনের মুখের কথা শুনলে তো অবাক হতে হয়, ভেবে মেলে না- এমন ধোপদুরস্ত ভদ্রলোকের মুখ থেকে এ কী বেরুচ্ছে, প্রমিত বাংলা ভাষা নাকি, লোকভাষা! উচ্চারণের ক্ষেত্রে এমনই গ্রাম্যতায় আচ্ছন্ন যে, গোটা শিক্ষাজীবনে বুঝিবা প্রমিত উচ্চারণের প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগী হওয়ারও অবকাশ ঘটেনি। মাতৃভাষা যে! মনোযোগ-টনোযোগের আবার কী দরকার!
আমার তো মনে হয় একজন শিক্ষিত মানুষের পক্ষে নানান প্রেক্ষাপটে এবং নানাবিধ প্রয়োজনে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক এবং সংযমী হওয়া বেশ জরুরি। তিনি যে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন, যে ধুলোমাটি মেখে বড় হয়েছেন, সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় অবশ্যই তাকে গ্রহণ করতে হবে সেই এলাকায় প্রচলিত লোকজ ভাষাভঙ্গিটি; কেননা বাংলা ভাষার প্রমিত রূপটিও তাদের কাছে ভয়ানক দূরত্ববহ। কাজেই প্রাণের স্বজনকে তিনি দূরে ঠেলবেন কেন? পেশাগত জীবনে তিনি যদি স্কুল-কলেজের শিক্ষক হন, তাহলে ক্লাসরুমে ঢুকে ছাত্রছাত্রীর মাঝে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাকে অনেক বেশি দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। ছাত্রছাত্রীর কাছে শিক্ষক মানেই অনুকরণ এবং অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তাকে মনে রাখতে হবে ক্লাসরুমের মধ্যে তিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন সমগ্র শিক্ষক সমাজের। একই গ্রামের মানুষ হয়েও ক্লাসরুমে তিনি অন্য মানুষ, আলাদা মানুষ, তাকে অনুসরণ করার জন্য তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শত-সহস্র ছাত্র, অভিভাবক এবং আরো অনেকে; কাজেই ক্লাসরুমে ব্যবহারের ভাষাভঙ্গিটি তো প্রমিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। শিক্ষিত মানুষটি যদি হন কোনো অফিস-কর্তা, তাহলেও তাকে ভাষা-ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে সহকর্মীদের সঙ্গে বাক্যালাপ কিংবা ফাইলে নোট লেখার সময়। তিনি যদি হন রাজনীতিবিদ, তাহলে মাঠে-ময়দানের বক্তৃতা আর পার্লামেন্টের বক্তৃতার ভাষাভঙ্গি একাকার করে ফেললে চলবে না। অশুদ্ধ উচ্চারণ এবং অশুদ্ধ বানানের মধ্য দিয়ে যে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে, তা সবার কাছে শ্রদ্ধাপূর্ণ না হওয়ারই সম্ভাবনা অধিক।

বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ করছি, আমাদের রাজধানী শহরের ভাষা পাল্টে যাচ্ছে। না, একে আদি ও অকৃত্রিম ঢাকাইয়া ভাষা বলা যাবে না কিছুতেই। অদ্ভুত এক জগাখিচুড়ি ককটেল ভাষা। অদ্ভুত এর শব্দভাণ্ডার, বিচিত্র এর ক্রিয়াপদের ব্যবহার এবং বড়ই বিচিত্র এর উচ্চারণ ভঙ্গি। এই ভাষা কবে কবে, কোত্থেকে, কীভাবে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে তা নিয়ে উচ্চস্তরের গবেষণা চলতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো সে গবেষণা আলোর মুখ দেখবে। কিন্তু আমি কিছুতেই নির্ণয় করে উঠতে পারি না- বাংলা ভাষার এ কোন রূপ? জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস এবং টিভি সিরিয়ালে দোর্দণ্ড প্রতাপে উপস্থিত এই ভাষা। শেষ পর্যন্ত এই খিচুড়িভাষা যে কতো দূর হানা দেয়। তাও দেখার বিষয়। তবে এ ভাষার উত্তাপ প্রমিত বাংলার উপরেও যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, একই সঙ্গে তা এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকভাষাকেও প্রভাবিত করে চলেছে। অন্ধকারের এই হাতছানি থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষার উপায় উদ্ভাবনে ও করণীয় নির্ধারণে অচিরেই পণ্ডিতজনের দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক।
আমাদের ছোট্ট এই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলব্যাপী ছড়ানো লোকভাষার বৈচিত্র্য তার ঐশ্চর্য ও সম্ভাবনার ইঙ্গিতই বহন করে। এ ভাষা ব্যবহারের শৈল্পিক নৈপুণ্যই পারে কালোত্তীর্ণ মহৎ সৃষ্টির সঙ্গে তাকে যোগযুক্ত করে তুলতে। এভাবে লোকভাষার নির্যাস থেকেই পরিপুষ্টি সাধন ঘটতে পারে জাতীয় ভাষার। আজকের দিনে ঢাকাইয়া টেলিভিশনের নাটুকে ভাষার আগ্রাসন থেকে লোকভাষাসমূহের স্বকীয়তা ও বিশুদ্ধতা রক্ষা করাও যেমন জরুরি, তেমনি লোকভাষার সঙ্গে জাতীয় ভাষার শিল্প সুষমামণ্ডিত মেলবন্ধন রচনাও জাতীয় স্বার্থেই বিশেষ প্রয়োজন।

রফিকুর রশীদ, কথাসাহিত্যিক ও লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়