দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম ও আদর্শ বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, আন্দোলন, আদর্শ, চেতনা ও প্রেরণার অংশ। এই মহান নেতা ও জাতির পিতার জীবন ও কর্মের প্রামাণ্য তথ্য ও নিদর্শন পাওয়া যায় সমকালীন সংবাদপত্র থেকে। বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট দুই খণ্ডে ‘সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশ করে ঐতিহাসিক জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে। এই দুই খণ্ডে সংকলিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট সংবাদ। প্রথম খণ্ডে সংকলিত হয়েছে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত সংবাদ। আর দ্বিতীয় খণ্ডে সংকলিত হয়েছে ১৯৬০ হতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ। মূলত: এসব সংবাদ সংকলন করা হয়েছে ওই সময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা হতে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম নিয়ে আমি দীর্ঘদিন ধরে প্রামাণ্যভাবে গবেষণা করছি। এই উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত তথ্য ও নিদর্শন সংগ্রহের জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকা পড়েছি। এই সূত্রে অনেক দুষ্প্রাপ্য তথ্য ও নিদর্শনের সন্ধান পেয়েছি। এসবের মধ্যে হতে ‘সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য নিচে দেয়া হলো:

(ক) ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বরে ‘দৈনিক নবযুগ’ এ প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত সংবাদ
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মালিকানায় কলকাতা থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ‘দৈনিক নবযুগ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম ও মজফফর আহমদ। নজরুলের জ্বালাময়ী লেখা ও অন্যান্য কারণে বৃটিশ সরকার ‘নবযুগ’ বন্ধ করে দেয় এবং এর জামানত বাজেয়াপ্ত করে। ‘দৈনিক নবযুগ’ আবার দ্বিতীয়বার প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালের ২০ হতে ২৪ অক্টোবরের মধ্যে। শেরে বাংলা তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। কাজী নজরুল ইসলাম নবপর্যায়ে ‘দৈনিক নবযুগ’ এর প্রধান সম্পাদক হন। এই পত্রিকায় ১৯৪১ সালের ২০ ডিসেম্বর (৫ পৌষ, শনিবার, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ১ম বর্ষ ৫৬ সংখ্যায় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলের তৎকালীন ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম পাওয়া যায় অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সঙ্গে। নজরুল গবেষক শেখ দরবার আলম এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি উদ্ধার করেছেন। তাঁর উদ্ধারকৃত ও পরিবেশিত তথ্য নি¤œরূপ:-
“১ম বর্ষ, ৫৬শ সংখ্যা। ৫-ই পৌষ, শনিবার ১৩৪৮ : ১লা ঈদোজ্জোহা, ১৩৬০ হিজরী : ২০শে ডিসেম্বর ১৯৪১” এর নবযুগের চতুর্থ পৃষ্ঠায় ষষ্ঠ কলমে একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর পরিবেশিত হয়েছে এইভাবে:

“ছাত্র-কর্মীদের বরিশাল যাত্রা
বরিশাল মুসলিম ছাত্র-কনফারেন্স
আগামী ২২শে ডিসেম্বর বরিশাল জেলা মোসলেম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেওয়ার জন্য কলিকাতা হইতে কারমাইকেল হোষ্টেলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট মিঃ আবদুল কাইউম এম-এ, বেকার হোস্টেল ইউনিয়নের ভূতপূর্ব্ব জেনারেল সেক্রেটারী মিঃ ফজলুল হক চৌধুরী বি.এ. কলিকাতা জেলা মোসলেম ছাত্র লীগের সেক্রেটারী মিঃ সিরাজুর রহমান, ইসলামিয়া কলেজের মিঃ আবদুল হক ও বেকার হোস্টেলের মিঃ মুজিবুর রহমান বরিশাল যাত্রা করিয়াছেন।
যাওয়ার পূর্ব্বে তাঁহারা নিখিল ভঙ্গ মোসলেম ছাত্রলীগের সেক্রেটারী নূরুল হুদা, ভূতপূর্ব্ব সেক্রেটারী মিঃ আবু সাইদ চৌধুরী ও ছাত্র নেতা মিঃ আবদুর রউফ ও মিঃ জহুর হোসেনের সাথে বাঙলার মোসলেম ছাত্র আন্দোলনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেকক্ষণ আলোচনা করেন।”
উল্লেখ থাকে যে, বাঙলার তৎকালীন মুসলিম ছাত্র সংগঠনের এই স্বনামধন্য নেতৃবৃন্দ তখন ছিলেন মুসলমানদের অর্থ-সাংস্কৃতিক দাবী-দাওয়ার, পাকিস্তান আন্দোলনের এবং কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দি ও স্যার খাজা নাজিমুদ্দীনের সমর্থক। কিন্তু সাতচল্লিশোত্তরকালে এঁদের মধ্যে অন্তত: দু’জন বাঙলাদেশ জন্ম দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তান বাঙলাদেশ হওয়ার পর একটা সময় আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।১

(খ) ১৯৫৩ সালের মে মাসে সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর করাচি যাত্রা ও নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে প্রবন্ধ রচনার সংবাদ
মাওলানা ভাসানীর সম্পাদকীয়তায় সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’ ১৯৪৯ সালের ১৫ আগষ্ট ঢাকার ৭৭ মালিটোলা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে ৯৪ নবাবপুর রোড এবং ৯ হাটখোলা রোড থেকে প্রকাশিত হয়। আরো পরে পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক হন তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) এবং এটি দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। যখন কোনো পত্রিকায় আওয়ামী লীগের খবর বেরোত না, তখন আওয়ামী লীগ প্রধান মাওলানা ভাসানী সবার সঙ্গে পরামর্শ করে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রকাশ করেন।২ এই সাপ্তাহিক পত্রিকায় আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত খবর নিয়মিতভাবে গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হতো। সাহিত্যিক, গবেষক, প্রকাশক, মফিদুল হক ১৯৫৩ সালের ইত্তেফাক থেকে বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ উদ্ধার করেছেন। নিচে তা তুলে ধরা হলো:
‘বর্তমান নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় অবশ্য পরের বছরের (১৯৫৩) রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠান। তৎকালীন ছাত্রলীগ বরেণ্য দুই বাঙালি কবির জন্মবার্ষিকী পালনের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। ৫ জ্যৈষ্ঠ সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছিল ছোট বিজ্ঞপ্তি, এর ভাষ্য ছিল নি¤œরূপ:
“নজরুল দিবস -আগামী ২৩ মে শুক্রবার বেলা পাঁচ ঘটিকায় পূর্ব্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর ১৫০ চক মোগলটুলীতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী আলোচনা করা হইবে। প্রদেশের বিভিন্ন শাখা কমিটিকে নজরুল জয়ন্তী পালন করিবার অনুরোধ জানাইতেছি।”
মোঃ কোমরুজ্জামান
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক।

একই দিনের পত্রিকায় আরেক সংবাদে প্রকাশ, “পূর্ব্ব পাক আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব মুজিবুর রহমান আগামীকল্য (মঙ্গলবার) করাচী অভিমুখে রওয়ানা হইবেন। তথায় তিনি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে পাকিস্তােেনর গভর্ণর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিবেন এবং পূর্ব্ববঙ্গে অবাধ, স্বাধীন নির্বাচন সম্পন্ন করিতে কতকগুলি দাবি পেশ করিবেন। ইহার মধ্যে বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের মুক্তির প্রশ্ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জনাব রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে কয়েকটি জনসভা ও সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করিবেন। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল তথাকার জনসাধারণের মনে যেসব ভুল ধারণার সৃষ্টি করিয়াছে,জনাব রহমান উহা দূর করিবার চেষ্টা করিবেন।”
১৮ জ্যৈষ্ঠ তারিখের সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার রিপোর্টে জানা যায় আরেক তাৎপর্যময় তথ্য। ছাত্রলীগের নজরুল দিবস অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে একটি বিশেষ প্রবন্ধ প্রণয়ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই প্রবন্ধটির আর কোন হদিস পাওয়া না গেলেও ইত্তেফাক পত্রিকায় ভাষ্য সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
সাপ্তাহিক ইত্তেফাক লিখেছিল :

“পূর্ব পাক মুসলিম লীগ কর্তৃক রবীন্দ্র-নজরুল জন্মবার্ষিকী উদযাপন”
পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর ১৫০নং মোগলটুলীতে ২৩ (শুক্রবার) বিকাল ৫ ঘটিকায় রবীন্দ্র-নজরুল জন্মবার্ষিকী উৎসব প্রতিপালিত হয়। ঝড়বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করিয়া সাহিত্যসেবী ও বহু উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ সম্মিলিত হন। তরুণ আইনজীবী জনাব আমিনুদ্দিন এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সভাপতির সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী বক্তৃতার পর সভার কাজ শুরু হয়।
পূর্ব্ব পাকিস্তানে – পূর্ব্ব পাকিস্তান মুসলীগ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠাতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমান এই সময় করাচী থাকায় তাঁহার প্রেরিত এক প্রবন্ধ জনাব মোশারফ হোসেন চৌধুরী পাঠ করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি কবি নজরুল ইসলামের বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিদ্রোহী জীবন যাত্রার এক নিখুঁত আলোচনারূপে প্রতিপন্ন হয়। প্রবন্ধের উপসংহারে বর্তমান শোণিতলোলুপ জগতের অত্যাচার ও অবিচারের বন্যারোধের জন্য কবির বৈপ্লবিক জীবনাদর্শ ছাত্র যুবক ও জনগণের কতখানি প্রয়োজন আছে তাহাই অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখা করা হয়।
অত:পর রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি স্বকীয় আবৃত্তি শোনান হয়। রেকর্ড বাজান শেষে জনাব মোশাররফ হোসেন চৌধুরী কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি মর্মস্পর্শী কণ্ঠে আবৃত্তি করেন। ফরিদপুর জেলা স্কুলের উদীয়মান জনৈক ছাত্র রবীন্দ্রনাথের ‘দরিদ্র’ কবিতা ও জগন্নাথ কলেজের ছাত্র জনাব আওলাদ হোসেন কবি নজরুলের ‘কুলি মজুর’ আবৃত্তি করেন। চট্টগ্রাম শাখার ছাত্র কর্মী জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী ‘সর্বহারা’ কবিতাটি পাঠ করেন।৩
বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত এধরনের আরো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। গবেষণা ও অনুসন্ধানের মাধমে তা সংগ্রহ ও সংকলন করে প্রকাশ করলে জাতি উপকৃত হবে।

অনুপম হায়াৎ
সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র গবেষক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়