দেয়ালচাপা পড়ে শ্রমিক নিহত

আগের সংবাদ

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

পরের সংবাদ

কৃত্যমূলক সংগীতসংস্কৃতি প্রসঙ্গে

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ বিচিত্র ধর্ম-মতের দেশ। এদেশে বসবাসরত মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বৈষ্ণব, নাথ প্রভৃতি ধর্মানুসারী মানুষের রয়েছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও সাংগীতিক ঐতিহ্য। এ ছাড়া এদেশের মানবদেহকেন্দ্রিক সাধকগোষ্ঠী বাউল-ফকির ও তান্ত্রিক উপাসকদেরও রয়েছে নিজস্ব সাংগীতিক পরিচয়।
বাংলাদেশের প্রাচীনতম সংগীত হলো- বৌদ্ধধর্মীয় সাধকসংগীত চর্যাগীতি বা চর্যাপদ। গবেষকের বিবেচনায়, ‘বৌদ্ধগান ও দোহা’ হিসেবে চর্যাগীতিগুলো ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্মীয় দেহ-সাধক সমাজে প্রচলিত ছিল। বাঙালি পণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে, এই ‘বৌদ্ধগানগুলোই পরবর্তী কালের বৈষ্ণব মহাজন পদাবলী ও মুসলমানি মারফতি গানের পূর্বরূপ (ঢ়ৎড়ঃড়-ঃুঢ়ব)। এক সময় নাথগণের চর্যাগীতি সমস্ত ভারতে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল।’ [শহীদুল্লাহ, ১৯৫৩ : ১৮] শুধু তাই নয়, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আরো বলেছেন যে, ‘এদেশের অধিকাংশ মুসলমান যে পূর্বে হিন্দু বা বৌদ্ধ ছিল, তাহা নিশ্চিত।’ [শহীদুল্লাহ্, ১৯৫৩ : ১৯] আসলে, আমরা যদি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র এ ধরনের সিদ্ধান্তকে আশ্রয় করি, তাহলে আমাদের পক্ষে বাংলাদেশের সংগীতের ইতিহাসের পূর্বাপর বিবেচনা সহজ হবে। কেননা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে, বাংলাদেশের ধর্মীয় সংগীতের কৃত্যের সাথে বাদ্যযন্ত্র ও পোশাক ব্যবহারের যেমন পূর্ববর্তী ঐতিহ্য রক্ষিত হয়; তেমনি বাণীর বিন্যাসে ও সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও পূর্ববর্তী মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
এই প্রবন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মাচারী মানুষ ও সাধকদের সাংগীতিক চর্চার ইতিহাস ও সাম্প্রতিক অবস্থার কিছু চিত্র উপস্থাপন করা হচ্ছে।

এক.
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। প্রায় এক হাজার বছর ধরে এদেশের মুসলমানরা নানা ধরনের সাংগীতিক ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত। ইতিহাসে প্রমাণ মিলেছে, এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মূলে সংগীতই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে নেত্রকোনার মদনে আগত হজরত শাহ সুলতান কমরুদ্দিন রুমী থেকে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুরে আগত বাবা আদম শহীদ, ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেটে আগত শাহ জালাল প্রমুখ সুফি-সাধক ও তাদের অনুসারীরা সংগীতের আশ্রয়ে বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা ও অবদান রাখেন।
পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণে নানা ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস, লৌকিক সংস্কার, লৌকিক মহাপুরুষের ধারণা প্রতিষ্ঠা পায় এবং সব কিছুর সঙ্গেই প্রায় সাংগীতিক ঐতিহ্যের প্রাণবন্তরূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। যেমন-
১. ইসলামের বাস্তব ইতিহাসের উপাদান তথা কারবালার ট্র্যাজেডির সাথে নানা ধরনের লৌকিক সংস্কার ও কল্পনার মিশ্রণে এদেশে জারি-মর্সিয়ার কৃত্যমূলক সংগীতরীতি সৃষ্টি হয়েছে। এই সংগীতরীতিতে মূলত কারবালার প্রান্তরের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারের সদস্যদের দুর্গতি ও মর্মান্তিকভাবে শহীদ হবার ঘটনাকে স্মরণ করে শরীরিক ও মানসিকভাবে শোক প্রকাশ করা হয়। সারা বাংলাদেশে নানারূপে জারি-মর্সিয়ার এই সংগীতরীতি চর্চিত হয়। প্রমাণ হিসেবে এখানে নেত্রকোনা অঞ্চলের বিষাদ-জারির একটি পরিবেশনার চিত্র দেখাতে পারি। উল্লেখ্য, নেত্রকোনা অঞ্চলের বিষাদ-জারিতে পুরুষের অংশগ্রহণ দেখা গেলেও বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে নারীও জারি-মর্সিয়া গান পরিবেশন করেন।
২. বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের মুসলমানরা হিন্দুদের দেব-দেবীর বন্দনামূলক সংগীত পরিবেশন করেন। যেমন-কুষ্টিয়া ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের মুসলমানরা লোকায়ত হিন্দুদের সর্পদেবী মনসার গান পরিবেশন করেন ‘পদ্মার নাচন’ ও ‘বেহুলার নাচাড়ি’ নামে। পাশাপাশি এদেশের মুসলমানরা বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণে হিন্দুদের দেব-দেবীর মতো অনেক লৌকিক পীরের আখ্যান রচনা করেছেন এবং তাদের মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য প্রায় তিন-চার শত বছর ধরে বিভিন্ন লৌকিক পীরের নামে সংগীত ঐতিহ্য রক্ষা করে আসছেন। যেমন- গাজির গান, মানিকপীরের গান, একদিল পীরের গান, মাদারপীরের গান, খোয়াজখিজিরের গান ইত্যাদি।
৩. বাংলাদেশের লোকায়ত জীবনে অত্যন্ত জনপ্রিয় সাংগীতিক ঐতিহ্য হলো- মারফতি-সুফি সংগীত। মুসলমানদের মারফতি সংগীতের এই ধারা যে প্রাচীন কালের বৌদ্ধগানের ক্রমবিকাশের ফল তা নানাভাবে প্রমাণিত।
বাংলাদেশের মুসলমানদের এই সাংগীতিক ঐতিহ্যের ধারা বিচিত্রভাবে চর্চিত ও বিকাশিত রয়েছে। এদেশের গ্রামীণ জীবনের মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-বৈষ্ণব প্রভৃতি ধর্মের সাধারণ মানুষ, এমনকি শহরকেন্দ্রিক নি¤œবর্গের মানুষ এখনো মনে করেন- গানই জ্ঞানচর্চার প্রধান বাহন।

দুই.
বাংলাদেশের হিন্দু ও বৈষ্ণবদের সংগীতের ধারার মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলো- কীর্তন। বাংলার সংগীতধারা হিসেবে কীর্তন শব্দটি সম্ভবত ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে রচিত গীতিকাব্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ থেকে আহরিত হয়েছে। এই গীতিকাব্যে ঈশ্বর উপাসনার অংশ হিসেবে মানব-মানবীর প্রেমলীলার প্রতীকে রাধাকৃষ্ণের প্রেম-কাহিনীর বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সব প্রকারের সংগীতে সেই প্রেম-কাহিনীর সাংগীতিক প্রভাব পড়েছে। সেই আদর্শে জন্ম লাভ করেছে-হিন্দু বিবাহের কৃত্যমূলক সাংগীতিক ঐতিহ্য ‘ধামাইল গান’। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্করা পর্যন্ত সেই গানের চর্চা অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশের হিন্দু সমাজে প্রচলিত শিশু-কিশোর থেকে শুরু সব বয়সের মানুষের এ ধরনের সংগীত পরিবেশনার নানা দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। যথা-অষ্টক গান, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি। এদেশের হিন্দু সমাজের পূজা-পার্বণ মানেই গানের অকৃত্রিম উৎসব। দুর্গাপূজা, মনসাপূজা, ল²ীপূজা, সরস্বতীপূজা, জগধাত্রীপূজা, কালীপূজা প্রভৃতিতে রামলীলা, কুশানগান, পদাবলীকীর্তন ইত্যাদির গানের আয়োজনে মুখর থাকে। যদিও এ ধরনের গানের আয়োজনে ধর্মীয় কৃত্য মুখ্য থাকে। কিন্তু এদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন যে, ধর্মাচার কেন্দ্রিক সংগীতমূলত মানুষের আধ্যাত্মিক জ্ঞান বৃদ্ধি ও মানবিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবদান রাখে।

তিন.
বাংলাদেশের মুসলমান ও হিন্দুদের মতো খ্রিস্টানদের নিজস্ব সাংগীতিক ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু পূর্ববর্তী গবেষকরা এ বিষয়ে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের খ্রিস্টীয় সংগীত সংগ্রহ, সম্পাদনা, গবেষণার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এদেশে খ্রিস্টীয় সংগীত চর্চার ইতিহাস প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান যশোরের (প্রাচীন ভূষণার) এক রাজপুত্র হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে আন্তইন দা রোজারিও নাম নিয়ে খ্রিস্টধর্র্ম গ্রহণ করেন। মূলত তিনিই প্রথম বাংলাদেশে খ্রিস্টীয় সংগীত প্রবর্তন করেন। প্রথম দিকে তিনি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে খ্রিস্টধর্র্ম প্রচারের লক্ষ্যে পতুগালে জন্ম নেয়া প্রখ্যাত খ্রিস্টধর্ম প্রচারক সাধু আন্তনির জীবন-কাহিনী নির্ভর যে আখ্যানগীতি পরিবেশন শুরু করেছিলেন। তারা ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আজো প্রচলিত। এদেশের ঢাকা, গাজীপুর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, নাটোর, পাবনাসহ প্রায় সব অঞ্চলের খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাধু আন্তনির আখ্যানগীতি প্রচলিত রয়েছে। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে গাজীপুরের মঠবাড়িয়াতে অবস্থিত খ্রিস্টীয় জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র নবজ্যোতি নিকেতনে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাধু আন্তনির পালাগানের গায়কদের সম্মিলনে প্রথম জাতীয় আন্তনির পালাগানের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রসিদ্ধ গায়করা সংগীত পরিবেশন করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের খ্রিস্টীয়মণ্ডলীর বিভিন্ন গায়ক আরো বিচিত্র ধরনের সংগীত পরিবেশন করেন।
মুসলমান-হিন্দু জনতার মতো খ্রিস্টানদের সংগীত পরিবেশনাতেও বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণ প্রত্যক্ষ করা যায়। পাশাপাশি, এদেশের খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেলের বিভিন্ন উপদেশমূলক অংশ নিয়ে সংগীত পরিবেশন করেন। খ্রিস্টধর্মীয় বিভিন্ন পর্ব স্টার সান ডে, বড়দিনসহ খ্রিস্টানরা তাদের রোগমুক্তির কামনায় বা কেউ মারা গেলে তার শ্রাদ্ধের অংশ হিসেবে সাধারণত খ্রিস্টীয় সংগীত পরিবেশিত হয়ে থাকে। খ্রিস্টীয় সংগীতের প্রাণবন্ত চিত্র একবার চোখে দেখলেই বাংলাদেশের খ্রিস্টীয় সংগীতের ঐতিহ্য সম্পর্ক স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
খ্রিস্টানরা তাদের সংগীত পরিবেশনের ভেতর দিয়ে ধর্মীয় চেতনার পাশাপাশি মানুষকে মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন।

চার.
বাংলাদেশ বৌদ্ধধর্ম অনুসারীদের একটি প্রাচীন ভূখণ্ড। এদেশের নওগাঁ জেলার সোমপুর (পাহাড়পুর) বৌদ্ধবিহার, কুমিল্লা জেলার ময়নামতি-লালমাই পাহাড় ও শালবন বৌদ্ধবিহার এবং বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের বৌদ্ধবিহার এদেশের প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের বিদ্যাপীঠ ও সাধনাক্ষেত্র হিসেবে প্রতœতাত্ত্বিক ভাষায় সাক্ষ্য দেয়। বৌদ্ধদের এসব তীর্থক্ষেত্র ও বিদ্যাপীঠে সাংগীতিক ঐতিহ্যের চর্চা ছিল।
সাম্প্রতিককালের বাংলাদেশে বসবাসরত বৌদ্ধরাও বিচিত্রভাবে সাংগীতিক ঐতিহ্য প্রবহমান রেখেছে। বাঙালি ও অবাঙালি বৌদ্ধরা বিভিন্নভাবে বৌদ্ধধর্মীয় সংগীত চর্চা করেন। অবাঙালি বৌদ্ধদের মধ্যে চাকমা, মারমা ইত্যাদি আদিবাসীরা ভিন্ন ভিন্নভাবে কৃত্যমূলক বৌদ্ধকীর্তন বা বৌদ্ধসংগীত পরিবেশন করেন। বিশেষ করে চাকমা আদিবাসীদের পরিবারের কারো মৃত্যু ঘটলে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বৌদ্ধকীর্তনের আয়োজন করে থাকেন। এ ধরনের কীর্তনে সাধারণত গৌতমবুদ্ধের গৃহত্যাগ বা সন্ন্যাস গ্রহণের বিষয়টি গীতিনাট্য রূপে উপস্থাপিত হয়ে থাকে। এতে প্রতীকীভাবে মানুষের দেহ-অবসানের পর পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলনের কথা সুর-বাণী-বাদ্য ও অভিনয়ের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়। বাংলাদেশের আদিবাসী বৌদ্ধদের মধ্যে সংগীতের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের বেশ স্বকীয়তা প্রত্যক্ষ করা যায়। কেননা, আদিবাসীরা নিজের উদ্ভাবিত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারেই স্বাচ্ছন্দ্য করেন। আর আদিবাসীদের বাদ্যযন্ত্র তৈরি উপকরণ সংগৃহীত হয়-সাধারণত তাঁদের নিজের ভৌগোলিক এলাকায় উৎপাদিত বাঁশ, লাউ, কাঠ বা বন্যপ্রাণির চামড়া থেকে। এ ক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্রের সুর, ছন্দ ও তালে নিজস্বতা রক্ষিত হয়।
বাংলাদেশের আদিবাসী বৌদ্ধদের তৈরি নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রের সুর-তাল ও ধ্বনির মাধুর্য প্রাকৃতিক পরিবেশের মতো যে কোনো মানুষকে মুগ্ধ করতে পারে। এক্ষেত্রে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের বাঙালি কবি আলাওলের ভাষায় প্রশ্ন হতে পারে-
শোনো শোনো গুণী ভাই শুন কহি সার
কোথা পাইলা বাদ্যযন্ত্র বসতি কাহার।
কোন গুরুর বচনে তুলি লইলা কান্ধে
ভেদ তত্ত্ব কহ ভাই বাহিবা কোন ছন্দে\
আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে বাঙালি কবি আলাওল দেহসাধনা ও আধ্যাত্মিক উপাসনার সাথে বাদ্যযন্ত্রের সম্পর্ক এবং বাদ্যযন্ত্রের গঠন প্রকৃতি সুরের অনুষঙ্গ বিচার মূলক এ ধরনের কাব্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু বাদ্যযন্ত্রের গঠনপ্রকৃতি, সুরধ্বনি ও তার সাথে সাধনার সম্পর্ক প্রথম বর্ণিত হয়েছিল বৌদ্ধদের গান চর্যাপদে। আগেই বলা হয়েছে যে, আজ থেকে প্রায় এক-দেড় হাজার বছর আগে বৌদ্ধধর্মীয় সাধনসংগীত চর্যাপদ রচিত ও গীত হয়েছিল।
সেই চর্যা-সংগীত চিন্তার দিক থেকে মূলত বৌদ্ধধর্মীয় দেহসাধনার কথা প্রকাশ করেছিল। পূর্ববর্তী গবেষক-পণ্ডিতদের কথা সূত্রে এবং আমাদের পর্যবেক্ষণ বলে-প্রাচীন বাংলার সেই সব সুরের ধারা ও বাদ্যযন্ত্র পরবর্তীতে বাংলাদেশে আগত ও জন্ম নেয়া অন্যান্য ধর্মের সাংগীতিক ঐতিহ্যের মধ্যে স্থান করে নেয়। তাই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালের নানা ধরনের সংগীতিক পরিবেশনায় প্রাচীন বাংলার সুর ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু নিজেদের সময় ও জীবনের সাথে প্রাচীন সুর ও বাদ্যযন্ত্রগুলো এতটাই নিবিড়ভাবে জড়িত যে, সেই সুর বা বাদ্যযন্ত্রগুলোর প্রাচীনত্বের কথা ভুলে যায়। যেমন-প্রাচীন বাংলার চর্যাগানের ধারা ও তার বাদ্যযন্ত্রগুলো ভিন্নভাবে, ভিন্ননামে মিলেমিশে রয়েছে বাংলাদেশের সাধুগুরু (বাউল-ফকির) ও বৈষ্ণবদের সাধনসংগীতের আসরে। বাউলের হাতের যে গুপীযন্ত্র বা একতারা বাদ্যযন্ত্র হিসেবে আজো বেজে যাচ্ছে সংগীতের আসরে, তা তো কোনো সাম্প্রতিক কালের সৃষ্টি নয়, তা অতি প্রাচীন কালের। আর এই সূত্র ধরেই বাংলাদেশের মাটিতে চর্যার পুনর্জাগরণ ঘটেছে- সঙ্গে লয়ে প্রাচীনকালের গুপীযন্ত্র, খঞ্জনি, প্রেমজুড়ি, করতাল, দোতারা ও আনন্দলহরি। আর সাধুর কণ্ঠে শুনি দেহ-সাধনার কথা : ‘শরীর গাছে পাঁচটি আছে ডাল, চঞ্চলা মনে পড়ছে ঢুকে কাল। দৃঢ় করে মন সুখ খুঁজে নাও। কেমনে পাবে গুরুকে শুধাও।’ চর্যার এই গানে বিস্তৃতভাবে দেহ-সাধনার কথা বলা হয়েছে।

পাঁচ.
মনে রাখা দরকার, আমাদের এই আলোচনার বাইরে বাংলাদেশে আরো বহু ধর্মমত ও ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছেন। যেমন- বিষ্ণুপ্রিয় ও মৈতৈ মনিপুরি জনগোষ্ঠী, এই দুটি গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র ভাষা-সংস্কৃতি ও সাংগীতিক ঐতিহ্য বিদ্যমান। এ ছাড়া, গারো, সাঁওতাল, হাজং, মান্দি, ওঁরাও, ত্রিপুরা প্রভৃতি নানা জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ধর্মীয় বা কৃত্যমূলক সংগীত রয়েছে। প্রতি বছর বিভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে তাদের সাংগীতিক প্রকাশ ঘটে।
অবশ্য, বাংলাদেশের সব স্থানের সব ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর কৃত্যমূলক সংগীতের সুর-তাল-বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে যত বৈচিত্র্যই থাক না কেন, তার গভীরের সঞ্চিত চেতনার ভেতর মানবদেহের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি এবং জীব প্রেম ও কর্ম-উদ্দীপনার প্রতি বাংলাদেশের সব ধর্মের কৃত্যমূলক সংগীতে আহ্বান থাকে।

উপসংহার
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের সংগীত কোনো না কোনোভাবে দেহ-সাধনা, আধ্যাত্মিক উপাসনা, লৌকিক সংস্কার, ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার বা কৃত্যের সাথে সম্পৃক্ত। তাই, এদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে বিনোদনমূলক গানের চেয়ে কৃত্যমূলক গানগুলোই অধিক প্রেম ও শ্রদ্ধার সামগ্রী। আমাদের বিশ্বাস, কৃত্যমূলক গানের সংগ্রহ, সম্পাদনা ও পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সাংগীতিক বৈচিত্র্যকে যথাযথভাবে উপলদ্ধি করা সম্ভব।

ড. সাইমন জাকারিয়া, গবেষক ও লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়