শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাল মিসর ও ইতালি : নির্বাচনের প্রশংসা স্কটিশ এমপির, আরো কয়েক বিদেশি নেতার শুভেচ্ছা

আগের সংবাদ

অবশেষে পশ্চিমাদের ইউটার্ন : সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে রাজি যুক্তরাষ্ট্র > নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক

পরের সংবাদ

আলোকিত মানুষ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আফসানা আপাকে ছাত্রীরা ভীষণ পছন্দ করে। তাই তার ক্লাসে উপস্থিতি বেশির ভাগ দিনই প্রায় শতভাগ থাকে। বিনিময় প্রথা পড়াবেন বলে তিনি গত ক্লাসে ছাত্রীদের বলে দিয়েছিলেন ছোট ছোট তিনটা প্যাকেটে চাল, ডাল আর চিনি নিয়ে আসতে। সেইমতো বেশির ভাগ ছাত্রীই নিয়ে এসেছে। এবারে আপা পুরো ক্লাসকে তিনজন তিনজন করে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করলেন। তারপর বললেন, এবার তোমরা বিনিময় কর। ইকরার কাছে চাল আছে। তার ডাল দরকার। রথির কাছে আছে ডাল। ইকরা চালের পরিবর্তে রথির থেকে ডাল নিল। নোভার কাছে চিনি আছে। তার দরকার চাল। কিন্তু রথির চিনির দরকার নেই। ফলে নোভার আর চাল নেয়া হলো না। আবার এক প্যাকেট চালের বিনিময়ে এক প্যাকেট চিনি নিতে চাইলে সেটাই বা হয় কি করে। এক প্যাকেট চিনিতে অনেকদিন যায়। এক প্যাকেট চাল তো একবেলাতেই শেষ। এবারে আপা ব্যাখ্যা করলেন, কেন বিনিময় প্রথা টিকে থাকেনি এবং কখন থেকে শুরু হলো টাকার ব্যবহার। ছাত্রীরা নিজেরাই খাতায় লিখল বিনিময় প্রথার অসুবিধা। মজার ব্যাপার হলো- কাউকেই বই খুলে পড়তে হলো না। সবাই নিজের থেকেই লিখতে পারল।
আপা সব সময়ই ছাত্রীদের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক। একবার এক ছাত্রী গণিতে ফেল করেছিল। ক্লাসের সবাই সেটা জেনে গিয়েছিল বলে মেয়েটি লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকত। কারো সঙ্গে কথা বলত না। আপা সেটা জানতেন। একদিন তিনি ক্লাসে এসে বললেন, ছোটবেলায় আমি গণিতে অনেক দুর্বল ছিলাম। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় এত বেশি ভুল করেছিলাম যে গণিতে একশতে মাত্র পঁচিশ নম্বর পেয়েছিলাম। আমার ভাই তখন আমাকে খ্যাপানোর জন্য বলত, তোর মাথায় তো গোবর তাই তুই অঙ্ক পারিস না। এ কথা শুনে আমি খুব কেঁদেছিলাম। আমার বাবা তখন বলতেন, গোবর তো ভালো জিনিস। গোবর থেকে সার হয়। তাই তো কত ভালো ফসল ফলে। অঙ্ক তো হিসাব। ভালো করে বুঝলে ও বেশি বেশি চর্চা করলেই হিসাবে আর ভুল হবে না। এই যে দেখ আমি যে এখন তোমাদের গণিত শেখাই, আমার কি ভুল হয়? হয় না। কারণ আমি এক অঙ্ক অনেকবার করি। তোমরাও একটা নিয়ম শিখে সেটা বারবার করার চেষ্টা করবে। দেখবে আর ভুল হবে না।
আপা ছাত্রীদের কীভাবে হিসাব করতে শেখান তার একটা নমুনা এ রকম। তিনি একদিন ক্লাসে বলে দিলেন, আগামীদিন সবাই কাগজ কেটে টাকা বানিয়ে নিয়ে আসবে। একেকজনের কাছে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা থাকবে। ১০০, ৫০, ২০, ১০, ৫ আর ২ টাকা- এসব ধরনের নোট থাকতে হবে। সবাই সেইমতো টাকা বানিয়ে নিয়ে এলো। এবারে তিনি পুরো ক্লাসকে তিনটি দলে ভাগ করে তিন ধরনের পণ্য নিয়ে দোকান সাজাতে বললেন। শর্ত হলো- প্রত্যেক দলকে অন্য দোকান থেকে জিনিস কিনতে হবে। একটা দল দিল কলম-পেন্সিলের দোকান। পুরো ক্লাসের সবার পেন্সিল বক্স এনে জড়ো করল তারা। আরেকটা দল দিল বই-খাতার দোকান। তারাও সবার বইখাতা এনে জড়ো করল। শেষ দলটি দিল খাবারের দোকান। সবার টিফিনবক্স ভর্তি খাবার এনে রাখা হলো তাদের টেবিলে।
তমা অনেক দামাদামি করে একেকটা ৬ টাকা করে মোট তিন ডজন কলম কিনে ফেলল। দোকানদার রুনি হিসাব করে বলল, কলমের দাম হয়েছে মোট ২১৬ টাকা। তমা রুনিকে ১০০ টাকার তিনটা নোট দিল। রুনিও তমাকে ২০, ১০ আর ২ টাকার নোট মিলিয়ে খুচরা টাকাটা ফেরত দিল। কিন্তু তমা গোল পাকিয়ে ফেলেছে। সে কত টাকা ফেরত পাবে তা আর মিলাতে পারছে না। ম্যাডাম এবারে হিসাব করে বুঝিয়ে দিলেন, ৩০০ থেকে ২১৬ বাদ গেলে থাকবে ৮৪ টাকা। এবার তমাকে হাতের নোটগুলো গুনে দেখতে বললেন ৮৪ টাকা আছে কিনা। তমা গুনে দেখল তার হাতে তিনটা ২০, দুইটা ১০ আর দুইটা ২ টাকার নোট আছে। ঘটনাটায় ক্লাসের সবাই খুব মজা পেল।
এবার আপা জয়ীকে বললেন, তিনটি দোকান থেকেই তাকে তিন ধরনের জিনিস কিনতে হবে। জয়ী প্রথমে এক দোকান থেকে ৩৫ টাকার কলম কিনল। তারপর অন্য দোকান থেকে ১৭৫ টাকার খাতা কিনল। আর শেষ দোকান থেকে ৫০ টাকার কেক কিনল। এবারে আপা বীথিকে জিজ্ঞেস করলেন, জয়ীর কাছে এখন কত টাকা থাকবে। বীথি তখন কাগজ কলম নিয়ে হিসাব করতে বসল। ৩৫ যোগ ১৭৫ যোগ ৫০। সবমিলিয়ে ২৬০ টাকা। জয়ীর কাছে ছিল ৫০০ টাকা। তাহলে তার কাছে এখন থাকবে ৫০০ বিয়োগ ২৬০। অর্থাৎ ২৪০ টাকা। তখন আপা জয়ীকে তার টাকাগুলো গুনে দেখতে বললেন যে সত্যিই ২৪০ টাকা আছে কিনা। জয়ী গুনে বলল, হ্যাঁ ঠিক আছে। ব্যস কারো আর টাকা-পয়সা হিসাব করতে ভুল হলো না। তারা আরো কিছুক্ষণ কেনাবেচা করল এবং নানাভাবে হিসাব-নিকাশ করল। ভীষণ উৎসাহ পেয়ে গেল সবাই।
আরেকদিনের ঘটনা। আফসানা আপা ছাত্রীদের বললেন, কাল তোমাদের কোণ আঁকা শিখাব। সবাই চাঁদা নিয়ে আসবে। এ কথা শুনে অনেক ছাত্রীই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কয়েকদিন আগে বন্যা দুর্গতদের সাহায্যের জন্য চাঁদা দিতে হয়েছে। এখন আবার কোণের জন্য চাঁদা চাইতে গেলে তো মায়ের বকুনি শুনতে হবে। ফারিয়া এসে আপাকে জিজ্ঞেস করল, আপা কোণের জন্য কত টাকা চাঁদা আনতে হবে? আপা ফারিয়ার কথা প্রথমে বুঝতে পারলেন না। অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, টাকা কেন আনবে? ফারিয়া বলল, আপনি যে চাঁদা আনতে বললেন? চাঁদা মানে তো টাকা দেয়া। আপা এবারে হেসে ফেললেন। বললেন, আজ বাসায় গিয়ে জ্যামিতি বক্স খুলে দেখবে। তার মধ্যে অর্ধচন্দ্রাকৃতির একটা জিনিস দেখতে পাবে। ওটাকে চাঁদা বলে। কাল সেটা নিয়ে আসবে। ফারিয়া বলল, দুঃখিত আপা, আমি বুঝতে পারিনি। আপা বললেন, দুঃখিত হবে কেন ফারিয়া? বুঝতে না পারাটা দোষের কিছু নয়। তোমার মতো এ রকম অনেকেই আছে যারা বুঝতে পারেনি। আবার সাহস করে বলতেও পারেনি। তুমি জিজ্ঞেস করলে বলে অন্যরাও তোমার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টা বুঝে গেল। এতে ক্লাসের অনেকেরই উপকার হলো, তাই না? ফারিয়া তখন অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, বল তো সহপাঠীরা, তুমি কখন চাঁদা আনবে কিন্তু টাকা নয়? সবাই সমস্বরে বলল, কোণ আঁকার সময়। আপা মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।
কয়েকদিন আগে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। খাতা দেখা শেষ। ফলাফলও তৈরি হয়ে গেছে। আফসানা আপা দেখলেন এ বছর তার পাসের হার শতভাগ। আপার গত বছরের একটা ঘটনা খুব মনে পড়ছে। সেই বছর একটি ছাত্রী গণিতে ফেল করেছিল বলে প্রধান শিক্ষিকা মেয়েটিকে এই ক্লাসে উত্তীর্ণ করতে চাননি। আফসানা আপা তখন বলেছিলেন মেয়েটির একটি বছর নষ্ট না করতে। তারা এখন ছোট। বড় হলে ঠিক পেরে যাবে। তাকে একই ক্লাসে রেখে দিলে তার মন ভেঙে যাবে। প্রধান শিক্ষিকা সেকথা মানতে রাজি হননি। তিনি আপাকে অনেক অপমানজনক কথাবার্তা বলেছিলেন। আরো বলেছিলেন, আমার স্কুলে একটা শৃঙ্খলা আছে। এই স্কুলে মেধাবীরা পড়ে। এই স্কুলের ছাত্রীরা দেশে-বিদেশে বড় বড় পদে চাকরি করে। আমার স্কুল দেশের সেরা স্কুল। আপা তখন খুব বিনীত কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, বড়আপা আপনার অরণীর কথা মনে আছে? আজকের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুশিল্পী অরণী জামান। অরণী আমাদের ছাত্রী ছিল। নাচ, গান, অভিনয় সবকিছুতেই পারদর্শী ছিল। মঞ্চ-টেলিভিশনে বেশি সময় দিতে হতো বলে লেখাপড়ায় কিছুটা পিছিয়ে ছিল। অরণী বিদেশে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিল বলে বার্ষিকে একটা পরীক্ষা দিতে পারেনি। তাই তার পাস নম্বর হয়নি। তার অভিভাবকরা অনেক অনুরোধ করার পরও আপনি তাকে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ করেননি। বাধ্য হয়ে অরণীর বাবা-মা তাকে অন্য স্কুলে নিয়ে ভর্তি করেন। আজ কি তাকে দেখে আপনার একটুও অনুশোচনা হয় না? আজ এই ছাত্রীটির জন্য আপনি গর্ব করতে পারতেন। আফসানা আপার জন্য শেষ পর্যন্ত বড়আপা গণিতে ফেল করা মেয়েটিকে এই ক্লাসে উত্তীর্ণ করেছিলেন। আপা আজ ভীষণ খুশি। গত বছরের সেই মেয়েটি গণিতে আশির উপরে নম্বর পেয়ে তৃতীয় হয়েছে।
আজ পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়া হবে। আফসানা আপা ক্লাসে এসে বললেন, আজ আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। বল তো কেন? সবাই একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, কেন আপা? আপা বললেন, এবার তোমাদের ক্লাস থেকে কোন মেয়ে গণিতে ফেল করেনি। শুধু তাই নয়, গণিতে কারো নম্বরই ষাটের নিচে নেই। এবার একজন ছাত্রী একশতে একশ পেয়েছে। সবাই খুশিতে হাততালি দিল। জিমি বলল, কিন্তু আপা আমাদের সবার যে ভীষণ মনখারাপ লাগছে। আজকের পর আমরা যে আপনার ক্লাস আর পাব না। আপা হাসতে হাসতে বললেন, নতুন ক্লাসে নতুন শিক্ষকরা তোমাদের ভীষণ আদর করবে। তখন আমার কথা তোমাদের মনেই থাকবে না। সবাই চিৎকার করে বলল, না না, আপনাকে আমরা ভুলব না। আপা বললেন, তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। যখন যেই কাজটাই করবে সততার সঙ্গে করবে। শুধু লেখাপড়ায় ভালো হলেই হবে না। তোমার আচরণেও যেন ভালো মানুষের প্রকাশ ঘটে। তোমরাই হবে আগামীদিনের আলোকিত মানুষ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়