নীরব-মজনুসহ বিএনপির ৪৭ নেতাকর্মীর কারাদণ্ড : নাশকতার তিন মামলা

আগের সংবাদ

অপশক্তিকে রুখে দেয়ার অঙ্গীকার : বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ

পরের সংবাদ

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার বিকল্প নেই

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা নিয়ে আমাদের দুর্ভাবনার শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই বলে গেছেন, শিক্ষা আর জীবন আলাদা হতে পারে না। এ দুটি বিষয় গায়ে গায়ে লাগানো সত্ত্বা। তিনি বলতেন, ‘যেমন জীবন চাও, তেমন শিক্ষা নাও’। জীবনঘন এই শিক্ষার যেমন কারিগরি বা বিজ্ঞানভিত্তিক দিক আছে, তেমনি মূল্যবোধ বা নৈতিক দিকও আছে। মোদ্দা কথা, এর পেছনে সৃজনশীলতার দিকটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ উদ্ভাবন বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়ার অধিকার রাখা। রবীন্দ্রনাথ তার ‘লক্ষ্য ও শিক্ষা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘চিত্তের গতি অনুসারেই শিক্ষার পথনির্দেশ করিতে হয়। … নানা লোকের নানা চেষ্টার সমবায়ে আপনিই সহজ পথটি অঙ্কিত হইতে থাকে। এ জন্য সব জাতির পক্ষেই আপন পরীক্ষার পথ খোলা রাখাই সত্যপথ- আবিষ্কারের পথ।’ এ প্রসঙ্গে একটি প্রবন্ধে তিনি আরও লিখেছেন, ইংরেজরা তাদের সন্তানদের ঠিকই অক্সফোর্ড-ক্যামব্র্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন চিত্তের চাওয়ার আলোকে শিক্ষা নেয়ার জন্য। অথচ ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকরা ভারতবর্ষে চালু করেছিলেন জীবনবিমুখ কেরানিকুল তৈরির অপলক্ষ্য সামনে রেখে। সে কারণে তারা বাংলাসহ ভারতবর্ষে এমন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যা আমাদের ছাত্রছাত্রী ও সমাজের জন্য ছিল প্রতিকূল। ইংরেজ শাসন শেষ হলো। এলো পাকিস্তানি নয়া ঔপনিবেশিক শাসনকাল। সেই আমলেও শিক্ষা আবিষ্কারমুখী হলো না। বরং কেরানি তৈরির অভিপ্রায় পাকিস্তানি এলিটদের মনে পুরোপুরিই ছিল। সে কারণেই পাকিস্তান আমলে জীবনধর্মী শিক্ষার পক্ষে বারবার আন্দোলন গড়ে উঠেছে। ষাটের দশকে শিক্ষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্বে ব্যাপক হারে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে। শিক্ষকরাও শিক্ষা আন্দোলনকারীদের যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। সেই আন্দোলন যথেষ্ট উত্তাপ ছড়ালেও শেষ পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। শিক্ষা আন্দোলনকারীদের সেই ক্ষোভ পরবর্তী সময়ে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে প্রতিফলিত হতে আমরা দেখেছি। স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশলে তাই বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ে শিক্ষার বিনিয়োগ এবং পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে তার সেই অভিপ্রায়ের অনেকটাই প্রতিফলিত হয়। কিন্তু আমাদেরই দুর্ভাগ্য, তিনি তার সেই অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করার সুযোগই পেলেন না বিশ্বাসঘাতকদের আঘাতের কারণে। এরপর শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের সংস্কার প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ করেছি। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনবাদী প্রচেষ্টার বাস্তব সাফল্য এখনো দেখতে পাইনি। বরং প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের তরুণরা যে চাকরি-বাকরি জোগাড় করতে পারে না, তা বিভিন্ন জরিপে ফুটে উঠেছে। উদ্যোক্তা হওয়ার প্রয়োজনীয় শিক্ষাও তরুণদের আমরা দিতে পারছি না। সম্প্রতি এক জরিপে ৫ হাজার ৬০০-এর মতো তরুণ উত্তরদাতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। তাদের ৬৮.৬ শতাংশই জানিয়েছে, চলমান শিক্ষা তাদের কাক্সিক্ষত মানের কর্মসংস্থান প্রদানে উপযুক্ত নয়। অন্যদিকে ৬৯.৬ শতাংশ বলেছে, একজন উদ্যোক্তা হওয়ার মতো প্রস্তুতি নেয়ার শিক্ষাও তারা পাচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগের চাহিদা মেটাতে কী ধরনের সংস্কার দরকার- এমন প্রশ্নের উত্তরেও জরিপে অংশগ্রহণকারীরা যথেষ্ট সুচিন্তিত মতামত দিয়েছে। তাদের ৫৭.৭ শতাংশ মনে করে, শিক্ষার উন্নতি শিক্ষকের মান্নোয়নের ওপর নির্ভর করবে। ৪৪.৪ শতাংশ মনে করে নেতৃত্ব, যোগাযোগ এবং ‘সফট স্কিল’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। ৪১ শতাংশের ধারণা, ডিজিটাল স্বাক্ষরতা অর্জন এখনো বেশ চ্যালেঞ্জিং। আর ৩৫ শতাংশের ধারণা, ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ বা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে শিক্ষা ভাবনার মূলে আনা চাই। এই বাস্তবতাতেই বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণাটি সামনে নিয়ে এসেছেন। উল্লেখ্য, গত বছরের ডিসেম্বরে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস’-এর উদ্বোধনী বক্তৃতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন- ‘ডিজিটাল

বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা। স্মার্ট বাংলাদেশ ও স্মার্ট জাতি গঠনই আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য পূরণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। … কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট, ভার্চুয়াল বাস্তবতা, উদ্দীপিত বাস্তবতা, রোবোটিকস অ্যান্ড বিগ-ডাটা সমন্বিত ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে চায়।’ খুব সংক্ষেপে আমাদের আগামীর সামষ্টিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথনকশাটিই যেন তিনি তুলে ধরেছেন। সারা পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়েই তিনি এই নবযাত্রার সূচনার কথা বলেছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশের সমাজ এবং অর্থনীতিও বদলে গেছে। বদলে যাচ্ছে। অচিরেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। সামনে রয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জাতীয় লক্ষ্য। এ জন্য আসলেই আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করার বিকল্প নেই।
আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে অদক্ষ প্রবাসী শ্রমিক এবং গার্মেন্টস রপ্তানি এখনো অনবদ্য ভূমিকা রেখে চলেছে-এ কথা সত্য। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পরের পর্যায়ে প্রবেশ করতে আরো সৃজনশীল ও দক্ষ জনশক্তির যে প্রয়োজন সে কথাটি নিশ্চয় অস্বীকার করা যাবে না। এক্ষেত্রে আইসিটিভিত্তিক শিল্প/সেবা রপ্তানির প্রসার একটি যথাযথ পথ হতে পারে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (ব্যাসিস)-এর প্রক্ষেপণ অনুসারে ২০২৫ সাল নাগাদ তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে আমরা ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে পারব। আর ২০৩১ সাল নাগাদ এই পরিমাণ ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছানো খুবই সম্ভব। বলা বাহুল্য, এই সম্ভাবনাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলে ডলার আয় কিংবা রপ্তানি বহুমুখীকরণের পাশাপাশি বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো সামষ্টিক অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলো অর্জন করা অনেকখানি সহজ হয়ে আসবে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের যে অমিত সম্ভাবনা রয়েছে, তা সর্বজনবিদিত। সমতুল্য অন্য দেশগুলোর থেকে জনশক্তির গড় বয়সের বিচারে আমরা অনেকখানি এগিয়ে আছি। জাতিসংঘের হিসাব বলছে, ২০২১-এ আমাদের মোট জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ ‘ওয়ার্কিং এইজ পপুলেশন’(১৮-৬৪) তথা শ্রমবাজারে নিয়োজিত হওয়ার উপযোগী বয়সের মানুষ। তাদের প্রক্ষেপণ বলছে, ২০৩০ নাগাদ এই অনুপাত আরো ২ পয়েন্ট বেড়ে ৫৭ শতাংশ হবে। তবে এই জনসংখ্যাকে প্রকৃত অর্থেই জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে তাদের জন্য যুগোপযোগী বিজ্ঞান শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগী মানবসম্পদ তৈরির জন্য শিক্ষাদান পদ্ধতিরও ডিজিটালাইজেশন দরকার। বিশেষত করোনাকালে আমরা শিক্ষাদান পদ্ধতির ডিজিটালাইজেশনের প্রয়োজনীয়তাটুকু বেশি করে অনুভব করেছি। ওই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হওয়ায় যে ক্ষতি হচ্ছিল, তা পুষিয়ে নিতে সরকারি ও অসরকারি অংশীজনরা নানামুখী ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূরশিক্ষণের ব্যবস্থা করায় কিছুটা উপকার হয়েছিল। কিন্তু সবার পক্ষে দূরশিক্ষণের সুফল সমানভাবে ভোগ করা সম্ভব হয়নি। কেননা দেশের ৪০ শতাংশেরও কম মানুষের ইন্টারনেট অ্যাকসেস আছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরও মাত্র ৪৫ শতাংশের উপযোগী ইন্টারনেট কানেকশন ছিল বলে এক জরিপ থেকে জানা গেছে।
দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনে আমাদের এখনো অনেক উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে। তবে এরই মধ্যে নানামুখী সরকারি ও অসরকারি উদ্যোগগুলো থেকে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেগুলো বিশেষ সহায়ক হবে বলেই মনে হয়। টেলিকম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা একাধিক লার্নিং প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করছেন। এ ছাড়া ব্যক্তি খাতেও আমাদের একাধিক লার্নিং প্ল্যাটফর্ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে বলা যায়। কাজেই শিক্ষাদান পদ্ধতির ডিজিটালাইজেশনের গুরুত্ব আমাদের নীতিনির্ধারকরা ঠিকই উপলব্দি করতে শুরু করেছেন। তবে তাদের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে আমাদের তরুণ সমাজ। এরই মধ্যেই প্রায় ৮-১০ লাখ তরুণ ডিজিটাল কর্মী বা স্বউদ্যোক্তা নিজে নিজেই প্রযুক্তি রপ্ত করে ফ্রিল্যান্সিং কাজে যুক্ত হতে পেরেছে। তারা করে করে সেখার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অনুমান করুন, এরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যদি ভাষা ও প্রযুক্তি আরেকটু ভালোভাবে শিক্ষিত হতো, তাহলে তাদের এই দক্ষতা অর্জনের গতি কতটা ক্ষীপ্র হতে পারত। তবে করে শেখার গুরুত্বকে আমি খাটো করে দেখছি না। বঙ্গবন্ধু নিজেও ‘করে শেখা’র গুরুত্ব অনুভব করেছিলেন। ২১ জুলাই ১৯৭৫-এ বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন-‘কেউ করে শেখে, কেউ দেখে শেখে, আর কেউ বই পড়ে শেখে। আর সবচেয়ে যে বেশি শেখে সে করে শেখে।’ নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই এগিয়েছে আমাদের শিক্ষা খাত (বিশেষত গত ১৩-১৪ বছরে)। তাই এক্ষেত্রে আমাদের সংখ্যাবাচক অর্জন কিন্তু নিতান্ত কম নয়। প্রাথমিক শিক্ষায় নেট এনরোলমেন্ট ৯৮ শতাংশ, মাধ্যমিকে ৭০ শতাংশ এবং দুই স্তরেই নারী-পুরুষ ভর্তিতে সাম্য, কারগরিতে এনরোলমেন্ট স্বল্পতম সময় (৬ বছর)-এর মধ্যেই ৬ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশ করা গেছে। প্রতিবন্ধীসহ সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের নেয়া প্রণোদনা উদ্যোগগুলোর সাফল্য তো সারা বিশ্বেরই স্বীকৃত। তবে আমার মতে, ১৯৭৪-এর শিক্ষা কমিশনে যে পথনকশা দেয়া হয়েছিল তার সংখ্যাবাচক দিকগুলো অর্জনে আমরা যে সাফল্য দেখাতে পেরেছি, গুণবাচক দিকগুলো বাস্তবায়নে ততটা সফল হতে পারিনি। সবার জন্য শিক্ষায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কাজটি আমরা ভালোভাবেই সম্পন্ন করতে পেরেছি। তবে শিক্ষার গুণমান এবং কর্মমুখিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের আরো অনেক কাজ যে বাকি- তা মানতেই হবে। বিশেষ করে নির্মাণনির্ভর শিক্ষা অবকাঠামোর ওপর যতটা জোর দিচ্ছি, তার চেয়ে ঢের বেশি জোর উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ওপর দেয়ার দরকার ছিল। কারিগরি শিক্ষার হার নিঃসন্দেহে বেড়েছে। কিন্তু সেখানেও হাতে-কলমে শিক্ষার জন্য ল্যাব ও প্রশিক্ষণ সুযোগ বাডানো যে দরকার তা মানতেই হবে। বিশেষ করে এই কারিগরি শিক্ষাকে চলমান রূপান্তরমুখী শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত কি করে আরো জোরালোভাবে করা যায়, বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট ভাবার সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষার সংখ্যার পাশাপাশি তার গুণগত মানের বিষয়টি সমান গুরুত্বসহ ভাবা দরকার।
শিক্ষার গুণমান বৃদ্ধির জন্য তো কাজ করতেই হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার কর্মমুখিতা নিশ্চিত করার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া চাই। আর এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাথমেটিকস তথা স্টেম বিষয়ে শিক্ষার দিকে। আগেই বলেছি, কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্ট ৬ বছরের ব্যবধানে ৬ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশে নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা সফল হয়েছি। তবে মনে রাখতে হবে, এক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যারা কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি হচ্ছে তাদেরও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। কেবল টারশিয়ারি পর্যায় (অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়)-এ স্টেম বিষয়ে পড়ালেখা করছে এমন শিক্ষার্থীদের অনুপাত মোট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর তুলনায় ১১ শতাংশের সামান্য বেশি। বলা বাহুল্য, এই অনুপাতটি দরকারের তুলনায় অনেক কম। প্রতিবেশী ভারতে এই হার প্রায় ৩৪ শতাংশ এবং পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক পরাশক্তি মালয়েশিয়ায় এই হার আরো বেশি (৪৪ শতাংশ)।
জনশক্তির যথাযথ ব্যবহারে তুলনামূলক বেশি সফল হওয়া দেশগুলোর সঙ্গে তুলনায় করে বলা যায়, স্টেম শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের আরো অনেক উন্নতির সুযোগ রয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনের জন্যই এই উন্নতি করা দরকার। এক্ষেত্রেও আমরা ওই সব দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারি। ভবিষ্যতের কর্মশক্তিকে স্টেম শিক্ষায় শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার সরকারের মালয়েশিয়া এডুকেশন ব্লæ প্রিন্ট (এমইবি) ২০১৩-২০২৫ থেকে আমার শিখতে পারি। এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ইতোমধ্যেই সে দেশে স্টেম শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থীর অনুপাত ৪৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরুর প্রথম তিন বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের মধ্যেই সে দেশের উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্টেম শিক্ষায় ভর্তি নিশ্চিত করা হয়েছে এবং ২০২৫-এর মধ্যে এই হার ৬০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশেরও স্টেম শিক্ষার প্রসারে এমন একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দাঁড় করিয়ে তার ভিত্তিতে এগুনো দরকার। পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপেই সরকারের পাশাপাশি অসরকারি সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী এবং সর্বোপরি ব্যক্তি খাতের অংশীজনদের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই আমরা স্টেম শিক্ষার বিস্তারের নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করতে সক্ষম হবো, যা আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণেও সহায়ক হবে।
স্মার্ট বাংলাদেশের যে সময়োচিত লক্ষ্য আমাদের সামনে এসেছে, তা বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো জনশক্তিকে আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলা। এ জন্য শিক্ষাদান পদ্ধতির যেমন আধুনিকায়ন দরকার, তেমনি দরকার শিক্ষার বিষয়বস্তুর আধুনিকায়নও। এসব ক্ষেত্রেই আমরা ইতোমধ্যে কিছু কিছু সফলতার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। অন্য দেশের সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে যেমন শিক্ষা নিতে হবে, তেমনি নিজেদের সাফল্য-ব্যর্থতাগুলো থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। এভাবেই আমরা নিজেদের পথটি পেয়ে যাব এবং সেপথ ধরে এগুতে পারব। আগামীতে নির্বাচন-উত্তর যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন প্রযুক্তিনির্ভর এবং মানবিক শিক্ষার ওপর তাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে ঝুঁকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারেও তার প্রতিফলন নিশ্চয় দেখতে পাব। ক্ষমতাসীন দল আগেভাগেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মিশনের কথা বলতে শুরু করেছে। তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার পাশাপাশি সৃজনশীল উদ্ভাবনী মন ও মনন সৃষ্টির পক্ষে নীতিগুরুত্বের কথা আসবে বলেই অনুমান করা যায়। আশা করছি, অন্যান্য রাজনৈতিক দলও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার ওপর সমান গুরুত্ব দেবে তাদের নির্বাচনী এবং দলীয় অঙ্গীকারে।
সমকালীন বিশ্ব ও দেশীয় বাস্তবতায় শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সুদূরপ্রসারী কৌশল বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের গ্রহণ করতে হবে। চনমনে বাংলাদেশ চাইলে চনমনে শিক্ষার ও প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প যে নেই, সে কথাটি আমাদের মানতেই হবে। শুধু মানা নয়, করতেও হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়