মগবাজারে নিয়ন্ত্রণ হারানো বাসচাপায় নিহত এক

আগের সংবাদ

পাঁচ কৌশলে আওয়ামী লীগ : আজ কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক > গঠিত হবে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি

পরের সংবাদ

মিতুল ও ময়না পাখির ছা

প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৮, ২০২৩ , ১:০৩ পূর্বাহ্ণ

তুলদের বাড়ির পাশেই সবুজ বন। বনের পাশেই মাঠ। বিকেল হলে পাড়ার সব ছেলেমেয়ে ওই মাঠে এসে জড়ো হয়। মেতে ওঠে খেলায়। মিতুলও যায়। বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে পার করে প্রতিটি বিকেল। একদিন মাঠে না গেলে মনটা কেমন ছটফট করে!
মিতুল একদিন মাঠে খেলতে গিয়ে পেয়ে গেল একটা ময়না পাখির ছা। খুব সুন্দর। তুলতুলে। ঘাসের ওপর শুয়ে চিঁ চিঁ করছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ডানা দুটি এখনো ভালোভাবে গজায়নি। হয়তো বাতাসের ঝাপটায় ছিটকে পড়ে গেছে বাসা থেকে। আর উড়তে পারছে না। খুব ছোট তো, উড়াল শেখেনি। ছা-টা দেখে মিতুলের খুব মায়া হলো। এভাবে পড়ে থাকলে বনবিড়াল এসে খেয়ে ফেলতে পারে। তাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো বাড়িতে।
খাঁচায় ময়না পালন করার শখটা মিতুলের অনেক দিনের। কিন্তু একটা ময়নার ছা জোগাড় করা সহজ কথা নয়। কোথায় পাবে ময়নার ছা? বাবার কাছে অনেকবার বায়না ধরেও কাজ হয়নি। রাজি হয়নি কিনে দিতে। আর মা বলেছেন, খাঁচায় পাখি পোষা মস্ত বড় অন্যায়। পাখিদের ঘরবাড়ি বনে। ওরা ঘুমোবে গাছের শাখে, পাতায় ফাঁকে। খড়কুটোর ছোট্ট বাসায়। মায়ের ডানার তলে। যখন-তখন মুক্ত ডানায় উড়বে। ঘুরবে এ বন ও বন। সেই পাখি খাঁচায় বন্দি করে রাখলে দারুণ কষ্ট পাবে। মানুষকে কারাগারে বন্দি রাখলে যেমন কষ্ট পায়, ঠিক তেমন। ময়না কিনে দিতে বললেই এরকম একশ একটা উপদেশ শুনতে হতো মিতুলের। কিন্তু আজ সে নিজেই কুড়িয়ে পেয়েছে ময়নার ছা। কী মজা!
ময়নার ছা বাড়িতে নিয়ে আসার পর মাকে দেখাল মিতুল। দ্যাখো মা, পিচ্চিটা কী সুন্দর! ঠোঁট নাড়ছে। পাখা নাড়ছে। ওকে খাঁচায় করে পালব। মা বললেন, হ্যাঁ, ময়নার ছা-টা খুবই সুন্দর দেখতে। কিন্তু ওকে তুমি বন্দি করে রেখো না। এক্ষুণি ছেড়ে দাও। মিতুল বলল, ও তো উড়াল শেখেনি। ছেড়ে দিলে যাবে কীভাবে? তাছাড়া ওকে আমার বড্ড পছন্দ হয়েছে। কতদিন বলেছি একটি ময়নার ছা কিনে দিতে। দাওনি। এবার আমি নিজেই পেয়ে গেছি। তোমাদের তো পয়সা খরচ হয়নি। তো অমন করছ কেন?
বাবা বললেন, ময়নাটা যেখান থেকে এনেছ, সেখানে রেখে এসো। কিন্তু কিছুতেই রাজি হলো না মিতুল। বরং বাবাকে একটা খাঁচা কিনে দিতে বায়না ধরল। বলল, খাঁচা কিনে না দিলে ভাত খাব না। ইশকুলে যাব না। পড়ব না। ঘুমাব না। ভীষণ জেদ ধরল মিতুল। শেষমেশ খাঁচা কিনে দিলেন বাবা। চিকন চিকন লোহার শিক দিয়ে বানানো। রঙিন খাঁচা। যেমন সুন্দর ময়না পাখির ছা, তেমন সুন্দর খাঁচা।
মিতুল ময়নাকে খুব আদর-যতœ করতে লাগল। চার বেলা খেতে দেয়। খাঁচার ভেতর দু-পাশে দুটি টিনের কৌটা বসানো। একটার মধ্যে দেয়া হয় খাবার। অন্যটায় পানি। একটু পরপর মিতুল ময়নার খোঁজ নেয়। খাবার ফুরিয়ে গেল কি না। পানি শেষ হলো কি না। দিনের বেলায় ময়নার খাঁচাটা ঘরের খোলা বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখে সে। মাঝে মাঝে কাক এসে ময়নাকে বিরক্ত করে। মিতুল কাকগুলোকে ইচ্ছেমতো বকাঝকা করে তাড়িয়ে দেয়। সকালবেলা কমলা রঙের রোদ উঠলে ময়নাকে কিছুক্ষণের জন্য রোদে রাখে। ডানায় কাঁচা রোদের উষ্ণতা মেখে চঞ্চল হয়ে ওঠে পাখিটা। ডানা ঝাপটায় একটানা। তা দেখে মিতুল আনন্দ পায়। যখন ইশকুলে যায় কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যায়, তখন মাকে বলে যায় ময়নার প্রতি নজর রাখতে। কোনো রকম অযতœ-অবহেলা যাতে না হয়, সেজন্য মিতুলের চোখ-কান সব সময় খোলা।
দিনে দিনে ময়নার ছা বেশ বড় হলো। পরিপূর্ণ ডানা গজালো। কথা বলাও শিখল। আজব ব্যাপার হলো, ময়না যা যা বলে, সবই মিতুলের মনের কথা। মিতুলের যেদিন মন খারাপ থাকে, সেদিন খাঁচার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেই ময়না পাখিটা বলে ওঠে, কষ্টে আছ! কষ্টে আছ! যেদিন মনটা আনন্দে টইটম্বুর, সেদিন বলে, আনন্দ করো, আনন্দ করো। পড়ার সময় হলে বলতে থাকে, পড়তে বসো, পড়তে বসো। ইশকুল থেকে ফিরে মিতুল যখন ময়নার কাছে যায়, তখন বলে, খিদে পেয়েছে, খেতে বসো। খিদে পেয়েছে, খেতে বসো।
ময়নার কথা শুনে মিতুল ভীষণ অবাক। কেমন করে মানুষের মতো কথা বলে পাখি! শুধু কথা না, মিতুল যা ভাবে, তাই বলে। ময়না কখন কী বলে, মিতুল ওর মাকে জানায়। মা বলেন, ময়নার কথা আমিও শুনেছি। কী শুনেছি জানো? ও বলছে, ছেড়ে দাও, কষ্টে আছি। মায়ের কাছে যাব। আমি যতবার ওর কাছে গিয়েছি, ওই কথাগুলোই শুনেছি।
– তাহলে আমি কি মিথ্যা বলছি? মিতুলের প্রশ্ন।
– মিথ্যে বলোনি। ভুল শুনেছ।
– না মা, আমি স্পষ্ট শুনেছি।
– না মিতুল। আমি যা বলছি, তাই ঠিক। মা এবার জোর দিয়ে বললেন। এমন সময় এগিয়ে এলেন বাবা। বললেন, তোমাদের কারো কথা এক চিলতেও সত্য না। ময়নাটি কোনো কথাই বলছে না। ও শুধু কাঁদছে। আমি ময়নার কাছে গেলেই ওর কান্না শুনি। লোহার খাঁচায় পরাধীন জীবন-যন্ত্রণার কান্না। না বুঝে মানুষ ওই কান্নাকেই কথা বা গান মনে করে।
কিন্তু কাঁদবে কেন? খাচ্ছে-ঘুমোচ্ছে। আদর-যতেœর একটুও কমতি নেই। কীসের অভাব ওর? প্রশ্ন জাগে মিতুলের। এবার বাবা সহজ ভাষায় বললেন, ও চায় মুক্ত ডানা। মুক্ত আকাশ। বন্দিজীবন কার ভালো লাগে?
এত করে বলেও মিতুলকে বোঝানো গেল না। ছেড়ে দিতে রাজি হলো না ময়না পাখিটি। ভেতরে ভেতরে মা-বাবা রেগে থাকলেও মিতুলকে আর কিছুই বললেন না।
মিতুলদের একটি গাভী ছিল। গাভীর একটি বাছুর। সেটি হারিয়ে গিয়েছিল। মিতুলের বাবা গিয়েছিলেন অনেক দূরের হাটে। বাছুর হারিয়ে যাওয়ায় চিন্তায় ছিলেন মা। এমন সময় মিতুল ইশকুল থেকে ফিরল। খাওয়াদাওয়া করল। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখের পাতায় ভিড় করল ঘুম। এই ফাঁকে মা ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে বাছুর খুঁজতে গেলেন। এ বাড়ি ও বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলেন অনেক দূরে। এদিকে ঘুম ভাঙল মিতুলের। মাকে ডাকল। কোনো সাড়া না পেয়ে আবারো ডাকল জোরগলায়। তবুও সাড়া-শব্দ পেল না। এবার বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে গেল। কিন্তু দরজা বন্ধ। কয়েকবার খটখট করল দরজার খিল। খুলতে পারল না। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করা। ভেতর থেকে খোলা সম্ভব নয়। ভাবনায় পড়ে গেল মিতুল।
একটা জানালা খোলা আছে। জানালায় সারি সারি লোহার শিক। ময়না পাখির খাঁচার মতো। জানালার ফাঁক দিয়ে গাছগাছালি দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে মাঠ। ধানখেত। দূরের পথ দিয়ে লোকজন যাওয়া-আসা করছে। মিতুল ডাকাডাকি করছে দরজাটা খুলে দেয়ার জন্য। কেউ শুনছে না। এগিয়েও আসছে না। কী করবে এখন! দুচোখে জল এসে গেল ওর। ও প্রতিদিন বিকেলে মাঠে খেলাধুলা করতে যায়। আজ যেতে পারছে না। কী সুন্দর বিকেল! বন্ধুরা মাঠে এসে হয়তো ওকে খুঁজছে। খুঁজে না পেয়ে মন খারাপ করছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে যাচ্ছে। মাটি হয়ে যাচ্ছে বিকেলটা।
মাঠে যাওয়ার জন্য মিতুলের মনটা কেমন ছটফট করছে। একটু পরই ডুবে যাবে সূর্য। নেমে আসবে অন্ধকার। তবুও ফিরে আসছে না মা। বাবাও ফিরছে না হাট থেকে। রাগে-দুঃখে ফের বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল মিতুল। বারান্দায় খাঁচার ভেতর ওর মতোই ছটফট করছে ময়না পাখিটা। থেকে থেকে শুনতে পাচ্ছে ডানা ঝাপটানি। ডানা ঝাপটানির শব্দটা মিতুলের কাছে আজ আনন্দের কোনো শব্দ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, ময়না পাখি খাঁচাটা ভাঙার জন্য বারবার ডানা দিয়ে আঘাত করছে। আর কাঁদছে। এই প্রথম মিতুল ময়নার কান্না শুনতে পেল। কেঁদে কেঁদে বলছে, আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে ছেড়ে দাও।
তাহলে তো মা-বাবার কথাই ঠিক। ভাবল মিতুল। মা-বাবা ঠিকই বুঝেছেন ময়নার কষ্ট। বন্দিজীবনের বুকফাটা আর্তনাদ। শুধু আমি বুঝিনি। মাত্র একটা বিকেল ঘরের ভেতর আবদ্ধ থেকে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে না পেরে খুব কষ্ট পাচ্ছি। ময়না পাখির এরকম অনেক বিকেল নষ্ট করেছি আমি। মাত্র একটি বিকেল, এই একটু সময় মা কাছে নেই বলে মনটা কেমন খারাপ লাগছে। হাহাকার করছে বুকটা। আর ময়নাটা কতদিন ধরে মায়ের আদর পায় না। ওর মনে যে কত কষ্ট!
ভুল বুঝতে পারল মিতুল। মা-বাবার উপদেশ না শুনে যে অপরাধ করেছে, তাও বুঝতে পারল। মনে মনে বলল, কাল সকালে ময়নাকে মুক্ত করে দেবো। খুলে দেবে খাঁচার দরজা।
দীর্ঘ মনে হচ্ছে রাত। দুচোখে ঘুম নেই। কখন সকাল হবে? গুনছে প্রহর। থেকে থেকে সারারাত ময়না পাখির কান্না আর ছটফটানি শুনতে পেল মিতুল। তারপর সকাল হলো। সোনারঙের রোদ উঠল। মিতুল ময়না পাখিটা খাঁচায় করে সেই মাঠে নিয়ে গেল, যেখান থেকে ওকে ধরে এনেছিল। তারপর খাঁচার দরজা খুলে দিয়ে বলল, ক্ষমা করিস, তোকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। ময়না পাখি ফুড়ুত করে খাঁচা থেকে বেরিয়ে মুক্ত ডানায় উড়াল দিল সবুজ বনের দিকে। আপন মনে স্বাধীনতার গান গাইতে গাইতে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়